অভাবীদের প্রাপ্য অংশ

বর্তমান জগতে অনেক মানুষের দারিদ্র ও অভাব-অনটন এবং তীব্র শ্রেণী-বৈষম্য জ্ঞানী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আর তাঁরা এ সমস্যার সমাধান ও বিপজ্জনক শ্রেণী-বৈষম্য কমিয়ে আনার ব্যাপারে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

পবিত্র ইসলাম ধর্ম ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত করাকে প্রতিরোধ ও দারিদ্র্য বিমোচন করার জন্য দান-সদকা এবং যাকাতের বিধান প্রবর্তন করেছে। আর এ বিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে,নিজেদের ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্র ও অভাবীদের মধ্যে দান করার ব্যাপারে ধনবান ব্যক্তিবর্গ যেন বাধ্য থাকে।

পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে এ বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে। আর এ ব্যাপারে এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে,সাধারণভাবে ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় ফরয বিধান নামায আঞ্জাম দেয়ার পাশাপাশি এর উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন,

أَقامُوا الصَّلاةَ وَآتَوُا الزَّكاةَ وَأَمَروا بِالمَعروفِ وَنَهَوا عَنِ المُنكَرِ وَلِلَّهِ عاقِبَةُ الأُمورِ

“তোমরা নামায কায়েম কর ও যাকাত প্রদান কর;আর তোমরা যে সৎকাজ আঞ্জাম দেবে তা মহান আল্লাহর কাছে পাবে।”

যাকাত ফরয হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ

ইসলাম ধর্মের মহান ইমামগণ নিজেদের হাদীস ও বাণীসমূহে যাকাত ফরয হওয়ার মূল রহস্য বর্ণনা করেছেন। এভাবে তাঁরা মুসলমানদেরকে তা আদায় করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন,

“নিশ্চয়ই ধনীদের পরীক্ষা করা এবং দরিদ্রদের সাহায্য করার জন্য যাকাত ফরয করা হয়েছে। আর যদি সবাই তাদের ধন-সম্পদের যাকাত প্রদান করত তাহলে কোন মুসলমানই দরিদ্র ও অভাবী থাকত না এবং মহান আল্লাহ তার (দরিদ্র-অভাবীর) জন্য যা ধার্য করেছেন তা (যাকাত)    দ্বারা অভাবমুক্ত হয়ে যেত আর একমাত্র ধনীদের পাপের কারণে (যাকাত আদায় না করার কারণেই) মানুষ অভাবগ্রস্ত,দরিদ্র,ক্ষুধার্ত ও বস্ত্রহীন হয়েছে। তাই যারা তাদের নিজেদের সম্পদে মহান আল্লাহর অধিকার আদায় করা থেকে বিরত থেকেছে তাদেরকে স্বীয় রহমত ও করুণা থেকে বঞ্চিত রাখা মহান আল্লাহর জন্য শোভনীয় ও যথার্থ।”

ইমাম সাদেক (আ.) আরো বলেছেন,

“নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ ধনীদের ধন-সম্পদে দরিদ্রদের জন্য একটি অংশ ফরয করে দিয়েছেন;তাই ধনীরা তা আদায় না করা পর্যন্ত (মহান আল্লাহর কাছে) প্রশংসিত হবে না। আর ঐ ফরয অংশটি হচ্ছে যাকাত যার দ্বারা মুসলমানগণ রক্তপাত বন্ধ রাখতে পারবে (অর্থাৎ জীবনে নিরাপত্তা আনয়ন করতে পারবে)। আর এ যাকাত আদায় করার মাধ্যমেই মুসলমানগণ মুসলমান বলে গণ্য হয়।”

ইমাম সাদেক (আ.)-এর এ বাণীটিও দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য :

“নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ প্রতি এক হাজার দিরহামে ২৫ দিরহাম যাকাত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। কারণ তিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন (এবং তিনি তাদের প্রয়োজনীয় পরিমাণ সম্পর্কে জ্ঞাত)। তিনি জানেন যে তাদের মধ্য থেকে কারা ধনী ও কারা দরিদ্র,কারা শক্তিশালী এবং কারা দুর্বল। তিনি জানেন যে,প্রতি হাজার ব্যক্তির মধ্যে ২৫ জন দরিদ্র আছে (অর্থাৎ দুর্বল এবং এ ধরনের ব্যক্তিবর্গ যারা কাজ করতে অক্ষম এবং তাৎক্ষণিক ত্রাণ ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী তারাই এদের অন্তর্ভুক্ত)। আর যদি এমন না হতো (অর্থাৎ তাদের সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতো) তাহলে তাদের অংশও বৃদ্ধি পেত। কারণ মহান আল্লাহ তাদের স্রষ্টা এবং তিনি তাদের অবস্থা সম্পর্কে উত্তমরূপে জ্ঞাত।”

পবিত্র ইসলাম ধর্ম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বেচ্ছাচারী ধনীদের জন্য বিপদের ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছিল এবং তাদেরকে ঐ সব বিপদাপদ সম্পর্কে সচেতন করেছে যা শ্রেণী-বৈষম্যের জন্ম দেয়। মহানবী (সা.) বলেছেন,.

“তোমাদের ধন-সম্পদকে যাকাতের মাধ্যমে সংরক্ষণ কর...।”

কেননা এ বিষয়টি স্পষ্ট যে,অত্যধিক অন্যায়,চৌর্যবৃত্তি এবং কমিউনিজমের প্রতি অশুভ অনুরোগ ও ঝোঁক তীব্র অভাবের ফলশ্রুতিতেই সৃষ্ট হয়েছে।

যা কিছু ওপরে বর্ণিত হয়েছে তা যাকাতের অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করেই বর্ণিত হয়েছে। তবে এ কথা বিস্মৃত হওয়া অনুচিত যে,যাকাতের আধ্যাত্মিক দিক যাকাতের অর্থনৈতিক দিক অপেক্ষা আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আলী (আ.) বলেছেন,

“নামাযের পাশাপাশি যাকাতকেও মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম করা হয়েছে। অতঃপর যে ব্যক্তি প্রসন্ন চিত্তে যাকাত প্রদান করবে তা তার পাপসমূহের কাফ্ফারাহ্ হয়ে যাবে এবং তা দোযখের আগুন থেকে তাকে রক্ষা করবে। এজন্য ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাকাত আদায় করা এবং যাকাত আদায় করে বিমর্ষ হওয়া অনুচিত।”

অপর একটি স্থানে তিনি বলেছেন,

“সাবধান! সাবধান! তোমরা যাকাত আদায় করতে যেন ভুলো না;কেননা যাকাত মহান আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে।”

যারা যাকাত দেয় না

এ সব কারণে পবিত্র ইসলাম ধর্ম যাকাত না দেয়ার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আর যে সব ধনবান-বিত্তশালী ব্যক্তি যাকাত আদায় করা থেকে বিরত থাকে তাদেরকে ইসলাম কঠোর ভাষায় তিরস্কার ও নিন্দা করেছে।

ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন,“আমরা হযরত আলী (আ.)-এর গ্রন্থে পেয়েছি যে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন :

“যখন যাকাত আদায় করা হবে না তখন এ পার্থিবজগৎ মহান আল্লাহর নেয়ামতসমূহ থেকে বঞ্চিত হবে।”

ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন,

“যে ব্যক্তি যাকাতের সর্বনিম্ন পরিমাণ অর্থাৎ এক কীরাৎ আদায় করা থেকে বিরত থাকবে সে মুমিনও নয়,মুসলমানও নয়।”

ইসলাম এ সামাজিক বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব দেয় যে,মহানবী (সা.) এমন কতিপয় মুসলমান যারা অতি গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়কে সাধারণ বিষয় বলে মনে করত এবং দরিদ্রদের অধিকারসমূহ আদায় করত না তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে মসজিদ থেকে বের করে দিয়েছিলেন। ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন,

“একদা মহানবী (সা.) মসজিদে উপস্থিত হয়ে পাঁচ ব্যক্তিকে মসজিদ থেকে বহিষ্কার করা পর্যন্ত বলতে লাগলেন,“হে অমুক! উঠে দাঁড়াও। হে অমুক! উঠে দাঁড়াও। হে অমুক! উঠে দাঁড়াও। অতঃপর তিনি (তাদেরকে) আদেশ দিয়ে বললেন : আমাদের মসজিদ থেকে বের হয়ে যাও। যাকাত আদায় না করে এ মসজিদে তোমরা নামায পড়তে পারবে না।”

ইসলামে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তি মালিকানা সম্মানিত বলে গণ্য করা হয় এবং বলা হয়েছে যে,মহান আল্লাহ স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রাকে (ধন-সম্পদ) তাঁর বান্দাদের জন্য কল্যাণকর ও উপকারী মাধ্যম করেছেন। এর ফলে বান্দাগণ এ সব মুদ্রার সদ্ব্যবহার করে নিজেদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে এবং এগুলোর মাধ্যমে তারা তাদের বস্তুগত চাহিদা ও প্রয়োজনাদি মেটাতে সক্ষম হবে। এ কারণেই যে ব্যক্তি প্রচুর ধন-সম্পদ অর্জন করে মহান আল্লাহর আদেশ পালন করে এবং যাকাত অর্থাৎ অভাবীদের অধিকারসমূহ আদায় করে তার সমুদয় সম্পদ,অর্থ ও বিত্ত তার জন্য পবিত্র ও বৈধ হয়ে যাবে।

এর পাশাপাশি দরিদ্রদের অধিকারসমূহ আদায় না করাটাও ইসলাম ধর্মে এক অমার্জনীয় পাপ বলে গণ্য করা হয়েছে। ইমাম বাকেরকে দীনার,দিরহাম এবং এগুলোর ব্যবহার প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন,

“এগুলো হচ্ছে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর আংটিসমূহ যা তিনি তাঁর বান্দাদের কল্যাণার্থে সৃষ্টি করেছেন। এগুলোর মাধ্যমে তাদের সমুদয় বিষয় এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত হয়। অতএব,যে ব্যক্তি বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী হয়ে এগুলোর ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর অধিকার সংরক্ষণ করবে এবং তার অর্জিত এ ধন-সম্পদের যাকাত আদায় করবে সেগুলো তার জন্য পুতঃপবিত্র হবে। আর যে ব্যক্তি বিপুল বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়েও কার্পণ্য করে এবং মহান আল্লাহর হক আদায় করে না এবং এ সব স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা থেকে স্বর্ণ ও রৌপ্যের প্লেট ও পাত্র তৈরি করে (এবং বিলাসবহুল জীবন-যাপনের উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করে) তাহলে তার ওপর মহান আল্লাহর গ্রন্থে শাস্তি অবধারিত হয়ে রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন : সে দিন সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে গলিয়ে সেগুলো দিয়ে তাদের কপালে,পার্শ্বদেশসমূহে এবং পিঠে ছ্যাঁকা দেয়া হবে। তাদেরকে বলা হবে,তোমরা নিজেদের জন্য যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা হচ্ছে এটাই। তাই তোমরা যা নিজেদের জন্য গচ্ছিত করেছিলে তার স্বাদ আস্বাদন কর।”১০

তথ্যসূত্র:

১. সূরা বাকারাহ্ : ১০৪

২. মান লা ইয়াহদুরুহুল ফাকীহ্,পৃ. ১৫১।

৩. ফুরু’ আল কাফী,১ম খণ্ড,পৃ. ১৪০।

৪. মান লা ইয়াহ্দুরুহুল ফাকীহ্,পৃ. ১৫১।

৫. ওয়াসায়েলুশ্ শীয়া,২য় খণ্ড,পৃ. ৪।

৬. নাহজুল বালাগাহ্,৬৩৫।

৭. সালীম বিন কাইসের গ্রন্থ,নাজাফ থেকে মুদ্রিত,পৃ,১৫।

৮. ফুরু’ আল কাফী,১ম খণ্ড,পৃ. ১৪২।

৯. ওয়াসায়েলুশ্ শীয়া,২য় খণ্ড,পৃ. ৫।

১০. ওয়াসায়েলুশ্ শীয়া,২য় খণ্ড,পৃ. ৪।

(জ্যোতি বর্ষ ২, সংখ্যা ২)