ইসলামের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভিতর বহুবিধ পার্থক্য রয়েছে। শিক্ষার অর্থ অন্যকে শিক্ষা দান করা এবং প্রশিক্ষণের অর্থ একজনের চরিত্র গড়ে তোলা। দায়িত্বশীল নারী-পুরুষ গড়ে ওঠার জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ দরকার। সমাজে বড় বড় পরিবর্তন এই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই সংঘটিত হচ্ছে।

প্রত্যাশিত ফল লাভ হলে প্রশিক্ষণের বিভিন্ন পর্যায় অবশ্যই সুষ্ঠু পরিকল্পনাভিত্তিক হতে হবে। প্রশিক্ষণের বেলায় একক উপদেশ দান যথেষ্ট হয় না। এক্ষেত্রে বিষয়গত ও লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে  সযত্ন চিন্তা-ভাবনা করতে হবে এবং যথাযথভাবে তা প্রয়োগ করতে হবে। প্রশিক্ষণের সাথে বেশকিছু দিক জড়িত :

-প্রশিক্ষক যাকে প্রশিক্ষণ দিতে চান তার সাথে তাঁর ভালো পরিচয় থাকা আবশ্যক এবং বিশেষ করে শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও চেতনাগত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত থাকা।

-শিশুদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে তাদের চাহিদা অনুপাতে।

-যে কোন কর্মসূচি বাস্তবায়নের আগে একটি সযত্ন পরিকল্পনা নিতে হবে। যেমন : কারো চরিত্র গঠনের জন্য অবশ্যই প্রয়োজনীয় শর্তাবলি নির্ধারণ করতে হবে এবং ঐ সকল শর্ত পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দিকগুলো পূরণ সাপেক্ষে আমরা ভালো ফল আশা করতে পারি।

প্রশিক্ষণ শুরুর সবচেয়ে কার্যকর সময় হচ্ছে জীবনের প্রথম বছরগুলো অর্থাৎ শিশুর বেড়ে ওঠার সময়টাতে। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব মূলত শিশুর পিতা-মাতার। শিশুদের প্রশিক্ষণ দান কোন সহজ কাজ নয়। এ কাজ পিতা-মাতার অনুভূতি ও দায়িত্ব সচেতনতার ওপর নির্ভর করে, বিশেষত যাঁরা প্রশিক্ষণের পদ্ধতি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, ধৈর্যশীল, অবিচল মনের অধিকারী ও দক্ষ তাঁরাই এ কাজ ভালোভাবে আঞ্জাম দিতে পারেন। দুর্ভাগ্যজনক হলো অনেক পিতা-মাতাই প্রশিক্ষণের সর্বোত্তম পন্থা সম্পর্কে অবহিত নন এবং যার ফলে অধিকাংশ শিশু যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ পায় না বা ধর্মনিষ্ঠ ও সুশিক্ষার অধিকারী মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে না।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতে শিশুদের প্রশিক্ষণ ও গঠনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বহু গবেষণা পরিচালনা করা হয়, প্রয়োজনীয় বহু বই-পুস্তক ছাপা হয়েছে এবং শিশু প্রতিভার বিকাশ বা গঠনের ওপর অনেক বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর গণমাধ্যম বা সরকারি খাত এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খুব সামান্যই গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। এসব দেশে শিশু প্রশিক্ষণের ব্যাপারে যেসব সংস্থ বা কর্তৃপক্ষ আছে এবং এ ব্যাপারে যে পরিমাণ বই-পুস্তক লেখা হয়েছে তা একেবারেই অপ্রতুল। তাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অধিকাংশ বই আজ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু এসব বইয়ের ক্ষেত্রে দুটি প্রধান সমস্যা রয়েছে :

ঐসব বইয়ের প্রধান ত্রুটি হচ্ছে যে, সেগুলোতে মানুষকে কেবল দৈহিক ও পার্থিব দিক থেকে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং পরকালীন জীবন, আধ্যাত্মিকতা ও পরপারের জীবনে শাস্তি ও পুরস্কারের কথা অস্বীকার করা হয়েছে।

পাশ্চাত্যে শিশুদেরকে কেবল এই লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয় যে, তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্যই যেন বৈষয়িক ও দৈহিক চাহিদা পূরণ করা। নৈতিকতার বিষয়টি কখনও কখনও আলোচিত হলেও তা হয় এই পার্থিব জীবন বা বৈষয়িক স্বার্থের সাথে ঐ নৈতিকতার সংশ্লিষ্টতার আলোকে। শুধু তাই নয়, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে শিক্ষাদানে খুব সামান্য সময় ও সুযোগ দেয়া হয়। দ্বিতীয় ত্রুটি হচেছ, পাশ্চাত্য দেশীয় প্রশিক্ষণের ভিত্তি হচ্ছে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও পরিসংখ্যান- যার সাথে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার কোন যোগ নেই।

এসব ব্যাপকতার অভাবে পাশ্চাত্য দেশীয় বই-পুস্তক মুসলমানদের দিক-নির্দেশনার বাহন হতে পারে না। কেননা, তারা মানুষকে দৈহিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিক এবং চিরস্থায়ী পরকালীন জীবনে বিশ্বাসের আলোকে দেখে না।

পিতা-মাতার মর্যাদা : কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর ইবাদত ও পিতা-মাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করার আদেশ দিয়েছেন।

ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন : ‘একজন মুসলমান তিনটি সেরা কাজ করতে পারে : সময়মতো নামায আদায় করা, পিতা-মাতার সাথে দয়ার্দ্র ও ভালো আচরণ করা এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’

এখন যে প্রশ্নটি আসে তা হলো, কিভাবে এবং কোন পন্থায় পিতা-মাতা উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হন? পিতা-মাতা কোন পন্থায় কাজ করলে শিশুদের তরফ থেকে এত শ্রদ্ধা লাভ করবেন? পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের ভ্রূণ অবস্থা থেকে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত গড়ে তোলা ও লালন-পালনের কাজ করেন। মা শিশুকে খাদ্য দান করেন এবং খেয়াল করেন। আর পিতা পরিবারকে আর্থিক সরবরাহ দান করেন।

উল্লিখিত করণীয় ছাড়া পিতা-মাতার কি আর কোন দায়-দায়িত্ব আছে? পিতামাতা হিসাবে তাঁরা যে দায়িত্ব পালন করেন সেটাই তাঁদের এই মর্যাদাপ্রাপ্তির কারণ, নাকি এটা পারস্পরিক ব্যাপার? শিশুদের অধিকার সম্পর্কে বেশ কিছু হাদিস রয়েছে, পিতা-মাতাদের উচিত তা মেনে চলা। যেমন, মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘তুমি যদি তোমার পিতার কাছে ঋণী হও, তাহলে তোমার পিতাও তোমার কাছে ঋণী।’ ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : ‘তোমাদের সন্তানদের প্রতি কতিপয় দায়িত্ব রয়েছে, যা তোমাদের জন্য অবশ্যই পালনীয়। তোমরা তাদেরকে জ্ঞান ও আল্লাহর আনুগত্যের পথে পরিচালিত করবে। সন্তানদের প্রতি তোমাদের আচরণ হতে হবে ঐ ব্যক্তির মতো যে তার সঠিক আচরণের জন্য পুরস্কৃত হয় এবং নিশ্চিত জেনে রাখ, ত্রুটিপূর্ণ আচরণের জন্য শাস্তি পেতে হবে।’

ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : ‘এমনটি হওয়া উচিত নয় যে, তোমার ও তোমার ব্যবহারের কারণে তোমার পরিবার ভাগ্য বিড়ম্বনার সম্মুখীন হবে।’

মহানবী (সা.)-এর ভাষায় : ‘কারো যদি একটি কন্যা থাকে এবং সে যদি তাকে ভালোভাবে শিক্ষাদান করে এবং তাকে তার কল্যাণের উপযোগী করে গড়ে তোলে, তাহলে ঐ কন্যা তাকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করবে।’

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা নিজেদেরকে আগুন থেকে রক্ষা কর যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।’

একটি ছোট শিশুকে সহজেই গড়ে তোলা যায়। সে হতে পারে একজন বিশিষ্ট ধার্মিক ও মানবদরদি ব্যক্তি। আবার হীনমনা ও অসৎলোক হিসাবেও গড়ে উঠতে পারে। কোন ব্যক্তির জীবনের ভবিষ্যৎ সুখ বা অসুবিধা নির্ভর করে তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মানের ওপর। আর এই ভালো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় পিতা-মাতার ওপর। পিতা-মাতাই হচ্ছেন তাঁদের শিশুসন্তানদের চরিত্র সংগঠক এবং সন্তানদেরকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার সামর্থ্য তাঁদেরই আছে। সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার প্রধান প্রধান কর্তব্য হচ্ছে তাদেরকে সদাচারী, দয়াবান, উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী, সাহসী, ন্যায়পরায়ণ, ঈমানদার, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, শিক্ষিত এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে সাফল্য লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা। এধরনের ব্যক্তিগণই প্রকৃতপক্ষে পিতা-মাতার সঠিক মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকেন। যাঁরা কেবল যৌন আনন্দ চরিতার্থ করার ফলশ্রুতি হিসাবে সন্তানের জন্মদান করে তাদেরকে নিজে নিজেই গড়ে ওঠা ও প্রশিক্ষিত হবার জন্য ছেড়ে দেন তাঁরা এই মর্যাদার অধিকারী হতে পারেন না। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘শিশুদেরকে পিতা-মাতা কর্তৃক সদাচরণ শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণ প্রদানই সর্বোত্তম।’ তিনি আরো বলেছেন : ‘সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি সে, যে তার মায়ের গর্ভে থাকাকালে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং সবচেয়ে হতভাগ্য ব্যক্তি সে যার দুর্ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে মায়ের গর্ভ থেকে।’ মহানবী (সা.) আরো বলেছেন : ‘মায়ের পায়ের নিচেই বেহেশত।’

যেসব পিতা-মাতা তাঁদের সন্তানদেরকে যথাযথভাবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দানের চেষ্টা না করে খারাপ ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের ভাগ্য বিড়ম্বনার দিকে ঠেলে দেন, তাঁরা এক বড় ধরনের অপরাধ করেন। ঐসব অুবঝ শিশু কি কাউকে বলেছিল জন্মদান করতে এবং গরুর বাছুরের মতো ছেড়ে দিতে? জন্মদানের ক্ষেত্রে যার ভুমিকা থাকবে সন্তানকে সর্বোত্তম পন্থায় শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করার ক্ষেত্রেও তার দায়িত্ব পালন বাধ্যতামূলক। বিবেক ও ধর্ম উভয় বিবেচনায়ই তা বাধ্যতামূলক । তাই সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং তাদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দান পিতা-মাতা উভয়ের জন্যই এক বিরাট দায়িত্ব। এছাড়া সমাজের প্রতিও পিতা-মাতার একটি দায়িত্ব রয়েছে। আজকের সন্তানই আগামী দিনের নারী ও পুরুষ। তারাই এই সমাজে নেতৃত্ব দেবে। তারা আজকে যা শিখবে, আগামীকাল তাই তাদের মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। তারা যদি ভালোভাবে শিক্ষালাভ করে তাহলে আগামী দিনের সমাজ আরো ধার্মিকতা ও অগ্রগতি অর্জন করতে পারবে। আর নতুন বংশধর যদি অল্প শিক্ষিত হয় তাহলে সমাজও অধিক দুর্নীতিপরায়ণ হবে।

এককালের শিশুসন্তানদের মধ্য থেকেই রাজনীতি, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের আজকের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বেড়ে উঠেছেন। আগামী দিনেও তাই হবে। অতএব, পিতা-মাতা ইচ্ছা করলে আগামী দিনের সমাজকেও তাঁরা সংশোধন করতে পারেন। আবার সেটাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বা ধ্বংসও করতে পারেন। এই কারণেই সমাজের প্রতি তাঁদের এক বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। তাঁরা যদি তাঁদের সন্তানদেরকে যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দান করেন তাহলে তা হবে সমাজের এক বিরাট খেদমত এবং এক্ষেত্রে নিষ্ঠা ও উদ্দেশ্যের সততার জন্য তাঁরা পুরস্কৃত হবেন। আর তাঁরা যদি এ ব্যাপারে অবহেলা ও অশ্রদ্ধা করেন, তাহলে তা কেবল একটি অপরাধ বলেই গণ্য হবে না- এর মাধ্যমে আগামী বংশধরদেরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবেন। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর কাছে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

সন্তানদেরকে শিক্ষিত করা ও তাদের প্রশিক্ষণ দানের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টা শতশত অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীর কর্মের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পিতা-মাতা যদি তাঁদের সন্তানদেরকে সর্বোত্তম উপায়ে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করার চেষ্টা চালান তাহলে এই জগতে তার সুফলও দেখতে পাবেন আর যদি অবহেলা বা অবজ্ঞা করেন তার ক্ষতিকর দিকও দেখতে পাবেন এই জগতেই। ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : ‘একটি খারাপ সন্তান একটি বিরাট অসুবিধার কারণ হতে পারে (পিতা-মাতাও যার সম্মুখীন হতে পারেন)।’ তিনি আরো বলেছেন : ‘একটি মাত্র সন্তানই পিতা-মাতার মান-মর্যাদা নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।’