সূরা আন'আম;(২৬তম পর্ব)

সূরা আন'আম; আয়াত ১১১-১১৪

সূরা আনআ'মের ১১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

  وَلَوْ أَنَّنَا نَزَّلْنَا إِلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةَ وَكَلَّمَهُمُ الْمَوْتَى وَحَشَرْنَا عَلَيْهِمْ كُلَّ شَيْءٍ قُبُلًا مَا كَانُوا لِيُؤْمِنُوا إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ يَجْهَلُونَ

"আমি যদি তাদের কাছে ফেরেশতাদের অবতারণ করাতাম এবং তাদের সঙ্গে মৃতরা কথাবার্তা বলতো এবং আমি সব বস্তুকে তাদের সমানে জীবিত করে দিতাম, তবুও তারা কখনো ঈমান আনতো না। কিন্তু যদি আল্লাহ চান (তাদেরকে ঈমান আনতে বাধ্য করতে পারেন, কিন্তু তিনি তা কখনো করবেন না।) অবশ্য তাদের বেশিরভাগই অজ্ঞ।” (৬:১১১)

গত পর্বে আমরা বলেছি, সমাজের বহু মানুষের কুফরির মূল কারণ হচ্ছে তাদের গোয়ার্তুমি ও একরোখা মনোভাব। তারা সত্য উপলব্ধি করলেও জেদের বশবর্তী হয়ে সত্যের বাণী মেনে নিতে চায় না। আজকের আয়াতেও বলা হচ্ছে : কাফেরদের অন্যতম দাবি হচ্ছে তাদের কাছে ফেরেশতা পাঠাতে হবে। অথচ ফেরেশতাদের দেখার মতো যোগ্যতা তারা অর্জন করেনি। অবশ্য পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, ফেরেশতাদের পক্ষে মানুষের আকৃতিতে জনসম্মুখে আসা সম্ভব এবং হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত লুত (আ.)- এর যুগে তাদের উম্মতের সামনে ফেরেশতারা মানুষরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু কাফেরদের দাবি মেনে তাদের সামনে ফেরেশতাদের হাজির করলেও তারা তাদেরকে ফেরেশতা হিসেবে মেনে নেয়নি।

বিশ্বনবী (সা.)-এর কাছে কাছে কাফেরদের আরেকটি দাবি ছিল, তিনি যেন হযরত ঈসা (আ.)-এর মতো মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করে দেখান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত ঈসা (আ.) যাদের সামনে মৃত ব্যক্তিদের জীবিত করে দেখিয়েছিলেন তাদের সবাই কি ঈমান এনেছিল? পবিত্র কুরআন এ সম্পর্কে বলছে : কাফেরদের দাবি মেনে ফেরেশতা নাযিল বা মৃতকে জীবিত করা হলেও তারা সত্য স্বীকার করবে না। কারণ, তখন তারা বলবে আল্লাহর রাসূল যাদুমন্ত্র দেখাচ্ছেন। অতীতের নবী-রাসূলদের সঙ্গেও কাফেররা ঠিক একই আচরণ করেছে।

এ আয়াত থেকে আমরা যেসব বিষয় শিখতে পারি তা হচ্ছে :

এক. ঈমান আনার জন্য সত্য উপলব্ধি যথেষ্ট নয়, মানসিক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন রয়েছে।

দুই. সব মানুষ কখনোই ঈমান আনবে না। আল্লাহ চান মানুষ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করুক।

সূরা আন’আমের ১১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

  وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ

"এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্য শত্রু করেছি শয়তান, মানুষ ও জ্বীনকে। তারা ধোঁকা দেয়ার জন্য একে অপরকে কারুকার্যখচিত কথাবার্তা শিক্ষা দেয়। যদি আপনার প্রতিপালক চাইতেন, তাহলে তারা এ কাজ করতো না।" (৬:১১২)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হচ্ছে : মহান আল্লাহ’র সৃষ্টিরহস্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, তিনি কোন মানুষকে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে ঈমান আনতে বাধ্য করেন না। মানুষকে ভালো ও মন্দ উপলব্ধি করার ক্ষমতা দেয়ার পাশাপাশি তাকে সত্য ও মিথ্যা গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়েছেন। কেউ ঈমান না আনলেই তাকে সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করে দেয়া তার নীতি নয়। যেমনটি হয়েছে ইবলিসের ক্ষেত্রে। ইবলিস শয়তান আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার পর তাকে ধ্বংস করা হয়নি, বরং তাকে সময় দেয়া হয়েছে। মানুষকেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সত্য গ্রহণ করার সময় দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে নিজের প্রতি অবিচার করে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার পক্ষে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা কঠিন।

কাফেররা আল্লাহর এ রীতির সমালোচনা করে এ কথা বলার চেষ্টা করে যে, আল্লাহই মানুষকে বিপথগামী করার সুযোগ শয়তানকে দিয়েছেন। এর জবাবে আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ বলছেন, কাফেররা যা বলে তার বেশিরভাগই শয়তানের শিখিয়ে দেয়া বক্তব্য। কাজেই হে পয়গম্বর, আপনি কাফেরদের বিরোধিতায় মন খারাপ করবেন না। তাদেরকে যা খুশি তাই করতে দিন। আপনার দায়িত্ব শুধু সত্যের বাণী সবার কাছে পৌঁছে দেয়া। তাদেরকে সত্য গ্রহণে বাধ্য করা নয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :

এক. ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় হক ও বাতিল বা সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব ছিল। এটি নির্দিষ্ট কোন যুগের বিষয় নয়।

দুই. দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথার ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। শয়তানের প্ররোচনার একটি উপায় হলো মিষ্টিবাক্য দিয়ে দুর্বলের মন কাবু করা।

সূরা আন’আমের ১১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلِتَصْغَى إِلَيْهِ أَفْئِدَةُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآَخِرَةِ وَلِيَرْضَوْهُ وَلِيَقْتَرِفُوا مَا هُمْ مُقْتَرِفُونَ

"সুতরাং আপনি তাদেরকে এবং তাদের মিথ্যা অপবাদকে মুক্ত ছেড়ে দিন যাতে যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তাদের মন কারুকার্যময় বাক্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় ও একে পছন্দ করে নেয়; এবং তারা যা চেয়েছিল তা অর্জন করতে পারে।"(৬:১১৩)

এ আয়াতে সত্য বিরোধীদের প্রচারণার কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে :   যার-তার কথায় কান দিও না। কারণ, শয়তানের অনুসারী ব্যক্তিরা নিজেদের বক্তব্য এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে যে, কারো যদি কিয়ামত সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে সে তাদের ধোঁকায় প্রভাবিত হয়ে সত্যকে অস্বীকার করতে শুরু করবে। কিন্তু কেউ যদি শয়তানের কথা শুনতেই রাজী না হয় তাহলে শয়তানের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।

সূরা আন’আমের ১১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

  أَفَغَيْرَ اللَّهِ أَبْتَغِي حَكَمًا وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ إِلَيْكُمُ الْكِتَابَ مُفَصَّلًا وَالَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْلَمُونَ أَنَّهُ مُنَزَّلٌ مِنْ رَبِّكَ بِالْحَقِّ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ

"তবে কি আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন বিচারক অনুসন্ধান করবো, অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি বিস্তারিত গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন? আমি যাদেরকে গ্রন্থ প্রদান করেছি, তারা নিশ্চিত জানে যে, এটি আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সত্যসহ অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং আপনি সংশয়কারীদের অন্তর্ভূক্ত হবেন না।" (৬:১১৪)

আহলে কিতাব, ইহুদি ও খিস্টানদের সম্পর্কে এ আয়াতে বলা হচ্ছে : তারা পয়গম্বরকে দেখেছে এবং তার কথা শুনেছে। তারা এ কথা ভালো করে জানে যে, হযরত মুসা ও হযরত ঈসা (আ.) –এর রেখে যাওয়া বাণী অনুযায়ী বিশ্বনবী (সা.)-এর সব কথা সত্য। তাঁর নবুওয়াত যেমন সত্য তেমনি তাওরাত ও ইঞ্জিলের মতো পবিত্র কুরআনও আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো কিতাব। কিন্তু তারপরও তারা আল্লাহ ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনেনি। তাদের পক্ষ থেকেও হযরত মুসা ও হযরত ঈসা’র মতো অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শনের যে দাবি জানানো হয়েছে, তা অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয়। এ কারণে আয়াতের পরবর্তী অংশে মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, তারা যেন কাফের, মুশরিক ও আহলে কিতাবদের বক্তব্য শুনে বিভ্রান্ত না হয়। তাদের উচিত সত্যের পক্ষে অটল থাকা।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে :

এক. ইসলাম ধর্মের সত্যতার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে অতীতে তাওরাত ও ইঞ্জিলে এ ধর্মের আগমনের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।

দুই.  অন্যদের কুফরের কারণে সত্য কখনো মিথ্যা হয়ে যায় না। অবিশ্বাসীদের ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে উতসারিত প্রশ্নের কারণে মহান আল্লাহ, তার প্রেরিত পুরুষ এবং কিতাব মিথ্যা হতে পারে না।