সূরা আন'আম;(২৮তম পর্ব)

সূরা আন'আম; আয়াত ১২০-১২২

সূরা আন’আমের ১২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَذَرُوا ظَاهِرَ الْإِثْمِ وَبَاطِنَهُ إِنَّ الَّذِينَ يَكْسِبُونَ الْإِثْمَ سَيُجْزَوْنَ بِمَا كَانُوا يَقْتَرِفُونَ

“(হে মুমিনরা!) তোমরা প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন গোনাহ ত্যাগ কর। নিশ্চয় যারা গোনাহ করেছে, তারা অতিসত্বর তাদের কৃতকর্মের শাস্তি পাবে।” (৬:১২০)

এ আয়াতে গোপনে বা প্রকাশ্যে যে কোনো ধরনের পাপে না জড়াতে মুমিনদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক গোনাহ বা পাপের রয়েছে বাহ্যিক কুফল। এ ছাড়াও প্রত্যেক পাপ মানুষের আত্মা ও মনে ধ্বংসাত্মক প্রভাবে ফেলে। বিষাক্ত খাদ্য যদি খুব সুস্বাদুও হয় তবুও তা বর্জনীয়। কারণ, এ ধরনের খাদ্য ধীরে ধীরে মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। হারাম খাবারের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। এ ধরনের খাদ্য মানুষের আত্মাকে কলুষিত করে এবং আত্মা হয়ে পড়ে পাষাণ ও অনুভূতিহীন। আয়াতে এটাও বলা হয়েছে যে, ইহকাল ও পরকালে খোদায়ী শাস্তিগুলো মানুষেরই কাজের ফসল। আল্লাহ কাউকেও বিনা কারণে শাস্তি দেন না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি দিক হল:

এক. ইসলাম বাহ্যিক ও আত্মিক পবিত্রতা – এ দুইয়ের ওপরই জোর দেয়। কাজে-কর্মে প্রকাশিত গোনাহ ছাড়াও আত্মিক ও চিন্তাগত গোনাহ ত্যাগ করতে হবে। মানুষের প্রতি খারাপ অনুমান বা ধারণাও ত্যাগ করা জরুরি।

দুই. যদিও শয়তান মানুষকে পাপ কাজের কুমন্ত্রণা দেয়। কিন্তু শয়তান মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা শক্তিকে কেড়ে নিতে পারে না। প্রত্যেকে নিজ ইচ্ছাতেই পাপের পথে নামে।

সূরা আন’আমের ১২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

“যেসব জন্তুর উপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি, সেগুলো থেকে খেয়ো না; এ ধরনের খাদ্য খাওয়া গোনাহ। নিশ্চয়ই শয়তানরা নিজ বন্ধুদের প্ররোচিত করে-যেন তারা তোমাদের সাথে তর্ক করে। (কিন্তু তোমরা তাদের কথায় কান দিও না, জেনে রাখ) যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে।” (৬:১২১)

মানুষের ইহ ও পরকালীন সৌভাগ্য নিশ্চিত করাই খোদায়ী ধর্মগুলোর লক্ষ্য। তাই খাদ্য ও পোশাকের মত ইহকালীন নানা বিষয়েও বিধান দিয়েছে ইসলাম। যেসব খাবার মানুষের শরীর ও আত্মার জন্য ক্ষতিকর সেসব খাদ্য বর্জন করতে বলেছে এ ধর্ম। শরীর ও মনের জন্য কল্যাণকর কোনো খাদ্য বর্জনে বাধা দেয় না ইসলাম।

ইসলাম মৃত পশুর খাদ্য খেতে নিষেধ করায় এ ধর্মের প্রাথমিক যুগে একদল আরব বলত, যে প্রাণী নিজেই মরে গেছে বা জবাই করার ফলে প্রাণ হারিয়েছে তার মধ্যে কী পার্থক্য রয়েছে? বরং যে জীব জবাই ছাড়াই মরে গেছে তা স্রস্টার নির্দেশে নিষ্প্রাণ হয়েছে বলে মানুষের জবাইকৃত জীবের চেয়ে উত্তম। আসলে এ ধরনের যুক্তি শয়তানের প্ররোচনা বা কুমন্ত্রণা মাত্র। কারণ যেসব জন্তু জবাই ছাড়াই নিজেই মরে যায় সেগুলো রোগাক্রান্ত হয়েই মরে। তাই এ ধরনের জন্তুর গোশত মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু জবাই করার ফলে পশু বা জন্তুর রক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে যায় বলে এ ধরনের জন্তু বা পশুর গোশত অপেক্ষাকৃত বেশি স্বাস্থ্যকর ও দূষণমুক্ত।

জবাই'র সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে কিনা তা মুমিনের জন্য আরো জরুরি বিষয়।

নামাজের জন্য যেমন কিবলামুখি হওয়া এবং আল্লাহর নাম নিয়ে নামাজ শুরু করা জরুরি তেমনি যে প্রাণীর গোশত একজন ঈমানদার ব্যক্তির শরীরের কোষ বা কোষের অংশ হতে যাচ্ছে সেই প্রাণী বা পশুকেও কিবলামুখী করে এবং আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা জরুরি।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হল:

এক. খাদ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রেও ধর্মীয় বিধান মেনে চলতে হবে। মুমিনের খাবারও হতে হবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক।

দুই. হারাম খাবার গ্রহণের ব্যাপারে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকেই বোঝা যায় এ ধরনের খাদ্য মানুষের মন ও আত্মার জন্য ক্ষতিকর।

তিন. বক্তব্য ও মতামতের ক্ষেত্রেও মুশরিকদের অনুসরণ করা শির্ক ও ঈমানহীনতার লক্ষণ।

সূরা আন’আমের ১২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 أَوَمَنْ كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُورًا يَمْشِي بِهِ فِي النَّاسِ كَمَنْ مَثَلُهُ فِي الظُّلُمَاتِ لَيْسَ بِخَارِجٍ مِنْهَا كَذَلِكَ زُيِّنَ لِلْكَافِرِينَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

“আর যে (শির্ক বা অংশীবাদিতার কারণে) মৃত ছিল অতঃপর আমি তাকে (ঈমানের আলো দান করে) জীবিত করেছি এবং তাকে এমন একটি আলো দিয়েছি, যা নিয়ে সে মানুষের মধ্যে চলাফেরা করে। সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে, যে ( শির্ক ও অজ্ঞতার) অন্ধকারে রয়েছে ও সেখান থেকে বের হতে পারছে না? হ্যাঁ, এমনিভাবে কাফেরদের কাজকর্মকে তাদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে দেয়া হয়েছে।” (৬:১২২)

ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র আপন চাচা হযরত হামজা (রা.) যখন ঈমান আনেন এবং রাসূল (সা.)’র ওপর আবু জাহলের মত ইসলামের কঠোর শত্রুর নিপীড়ন ও অত্যাচারের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়ান, তখন এই আয়াত নাজিল হয়। এখানে তাঁর অবস্থানের প্রশংসা করা হয়েছে। অবশ্য আবু লাহাব নামে রাসূল (সা.)-এর অন্য এক চাচা ছিলেন যার নিন্দায় কুরআনে একটি সূরা নাজেল হয়েছে। ওই সূরায় ইসলামের মোকাবেলায় আবু লাহাবের গোড়ামি, কুফরি ও হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোরতম ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হল:

এক. শির্ক ও কুফরি মানুষের জন্য মৃত্যুর সমতুল্য। আর ঈমান জীবন ও সৌভাগ্যের উৎস। তাই সত্যিকারের জীবন হল ঈমান ও সত্যিকারের মৃত্যু হল কুফরি।

দুই. ঈমান এনে দেয় (জ্ঞান ও কল্যাণের) আলো, কুফরি আনে (অজ্ঞতা ও অনাচারের) অন্ধকার। ঈমানদার মানুষ কখনও অচলাবস্থার শিকার হয় না, বরং সব সময়ই খোদায়ী আলো নিয়ে সাফল্যের পথে এগিয়ে যায়।

তিন. কাফেরদের বস্তুবাদী জীবনের কাজকর্মগুলো তাদের কাছে এত চাকচিক্যময় করে দেয়া হয়েছে যে তারা তাদের অধঃপতিত মানবিকতা ও বিচ্যুত অবস্থা বুঝতে পারে না।