সূরা আন'আম;(৩৬তম পর্ব)

সূরা আন'আম; আয়াত ১৫৩-১৫৭

সূরা আন’আমের ১৫৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

 “নিশ্চিতভাবে এটি আমার সরল পথ। অতএব এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তাহলে সেসব পথ তোমাদেরকে তার পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। (মহান আল্লাহ) তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।” (৬:১৫৩)

আগের অনুষ্ঠানগুলোতে মহান আল্লাহ মক্কার মুশরিকদের আচার-আচরণ ও ভ্রান্ত চিন্তাধারার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এসব আচরণকে খোরাফাত বা কুসংস্কার হিসেবে উল্লেখ করে মানুষের জন্য হালাল ও হারামের সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সে আলোচনার শেষ পর্যায়ে এ আয়াতে বলা হচ্ছে: মানবরচিত ভিন্ন ভিন্ন পন্থা বাদ দিয়ে মহান আল্লাহ প্রদর্শিত সরল-সঠিক পথ অবলম্বন করতে হবে। কারণ এ পথ সুস্পষ্ট এবং সবাই তা অনুসরণ করলে সমাজে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু মানুষের প্রদর্শিত পথগুলো সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং তা সুস্পষ্টও নয়।

বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সমাজে প্রচলিত বহু কুসংস্কার ও ভ্রান্ত আচরণ তাদের মাধ্যমে প্রচলিত হয়েছে যারা নিজেদেরকে ধার্মিক ও ঈমানদার বলে দাবি করে। তারা নিজস্ব ধ্যান-ধারণাকে ধর্মীয় রীতি বলে চালিয়ে দিয়েছে। অথচ ধর্মের নির্দেশিত পথ হচ্ছে মধ্যপন্থা ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন। পবিত্র কুরআন এ পথকে সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরলপথ বলে অভিহিত করেছে। এ পথ অনুসরণের ওপর মানুষের মুত্তাকি হওয়া এবং চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠার সর্বোতকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে ধর্মীয় নির্দেশাবলী পালন করা।

দুই. যে কোন পরিস্থিতিতে অসংখ্য ভ্রান্তপথের মধ্যে যেমন সত্যপথ থাকে শুধুমাত্র একটি- তেমনি আল্লাহর নির্দেশিত পথও একটি- দুই বা তার চেয়ে বেশি নয়।

সূরা আন’আমের ১৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

ثُمَّ آَتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ تَمَامًا عَلَى الَّذِي أَحْسَنَ وَتَفْصِيلًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لَعَلَّهُمْ بِلِقَاءِ رَبِّهِمْ يُؤْمِنُونَ

“অতঃপর আমি মুসাকে গ্রন্থ দিয়েছি সতকর্মশীলদের প্রতি নেয়ামত পূর্ণ করার জন্য, প্রত্যেক বস্তুর বিশদ বিবরণের জন্য, হেদায়াতের জন্য এবং করুণার জন্য- যাতে তারা স্বীয় প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতে বিশ্বাসী হয়।” (৬:১৫৪)

অনেকে মনে করেন, আসমানি ধর্মগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য ও পরস্পরবিরোধিতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। সব আসমানি গ্রন্থ পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সব নবী-রাসূল তাদের পূর্ববর্তী প্রেরিত পুরুষের ধারাবাহিকতায় এক আল্লাহর বাণী প্রচার করার জন্য পৃথিবীতে এসেছেন। মানুষের কাছে সতপথে চলার দিকনির্দেশনা দিয়ে তাদেরকে হেদায়েত করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এ আয়াতে পবিত্র কুরআন  তাওরাতকে অনেকটা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, হযরত মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়কে সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য মহান আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে তাওরাত নাজিল করা হয়েছিল। ওই গ্রন্থে হযরত মুসার কওমের কাছে আল্লাহর বাণী পূর্ণাঙ্গভাবে এসেছিল এবং তাদেরকে কিয়ামতা বা মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :

এক. আসমানি কিতাবগুলো মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন পুরণের পাশাপাশি তাদেরকে পূর্ণতায় পৌঁছানোর পথ বাতলে দিয়েছে।

দুই. শুধুমাত্র সতকর্মশীল ব্যক্তিরা আসমানি কিতাবের দিকনির্দেশনা মেনে চলে, অসত ব্যক্তিরা এ ঐশি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।

সূরা আন’আমের ১৫৫ ও ১৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَهَذَا كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ فَاتَّبِعُوهُ وَاتَّقُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (155) أَنْ تَقُولُوا إِنَّمَا أُنْزِلَ الْكِتَابُ عَلَى طَائِفَتَيْنِ مِنْ قَبْلِنَا وَإِنْ كُنَّا عَنْ دِرَاسَتِهِمْ لَغَافِلِينَ

"এটি এমন একটি গ্রন্থ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি অত্যন্ত মঙ্গলময় (হিসেবে), কাজেই এর অনুসরণ করো এবং ভয় করো- যাতে তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও।" (৬:১৫৫)

"এজন্য যে, কখনো তোমরা বলতে শুরু করো (বা বলতে না পারো যে) : গ্রন্থ তো কেবল আমাদের পূর্ববর্তী দু'সম্প্রদায়ের প্রতিই অবতীর্ণ হয়েছে এবং আমরা সেগুলোর পাঠ ও পঠন সম্পর্কে কিছুই জানতান না।" (৬:১৫)

হযরত মুসা (আ.)-এর কওমের প্রতি আসমানি গ্রন্থ নাজিলের কথা উল্লেখের পর এ দুই আয়াতে বলা হয়েছে : তোমাদের প্রতিও তাওরাতের মতো পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এ কিতাবের দিক-নির্দেশনা মেনে চললে তোমরা সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভূক্ত হবে এবং পূর্ণতায় পৌঁছাতে পারবে। এ ছাড়া, তোমরা যাতে এ অজুহাত দাঁড় করাতে না পারো যে, তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছায়নি- সেটিও কুরআন নাজিলের অন্যতম উদ্দেশ্য। কাজেই এ গ্রন্থের অনুসরণ করে একমাত্র আল্লাহকে ভয় করো। একমাত্র তাকে ভয় করার মাধ্যমে তোমরা তার বিশেষ অনুগ্রহ পাওয়ার আশা করতে পারো।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :

এক. পবিত্র কুরআন কোন মতাদর্শভিত্তিক গ্রন্থ নয়। এটি একটি ব্যবহারিক গ্রন্থ যার প্রতিটি কথা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে।

দুই. মানুষের সৌভাগ্য দুটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল- হক বা সত্যকে অনুসরণ এবং বাতিল বা মিথ্যা থেকে দূরে থাকা।

সূরা আনআমের ১৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أَوْ تَقُولُوا لَوْ أَنَّا أُنْزِلَ عَلَيْنَا الْكِتَابُ لَكُنَّا أَهْدَى مِنْهُمْ فَقَدْ جَاءَكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَّبَ بِآَيَاتِ اللَّهِ وَصَدَفَ عَنْهَا سَنَجْزِي الَّذِينَ يَصْدِفُونَ عَنْ آَيَاتِنَا سُوءَ الْعَذَابِ بِمَا كَانُوا يَصْدِفُونَ

“কিংবা বলতে শুরু করো : যদি আমাদের প্রতি কোন গ্রন্থ অবতীর্ণ হতো, আমরা এদের চেয়ে বেশি পথপ্রাপ্ত হতাম। কাজেই, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ, হেদায়াত ও রহমত এসে গেছে। এরপর সে ব্যক্তির চেয়ে বেশি  অবিচারকারী কে হবে, যে আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে এবং গা বাঁচিয়ে চলে। খুব শিগগিরিই আমি তাদেরকে শাস্তি দেবো, যারা আমার আয়াতসমূহ থেকে গা বাঁচিয়ে চলে- জঘন্য শাস্তি তাদের গা বাঁচানোর কারণে।” (৬:১৫৭)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় মহান আল্লাহ এ আয়াতে বলছেন: আমরা আমাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ করার জন্য তোমাদের কাছে এ গ্রন্থ পাঠিয়েছি। তোমরা যাতে মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতার পক্ষে কোন অজুহাত দাঁড় করাতে না পারো সে লক্ষ্যে আমাদের এ আয়োজন। এখন তোমরা আর একথা বলতে পারবে না যে, আমাদের কাছে আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হলে অন্যান্য জাতির তুলনায় আমরা বেশি ঈমানদার হতাম। এখন যখন তোমরা কুরআন পেয়েছো তখন তা অস্বীকার করলে তা হবে চরম ধৃষ্ঠতা এবং তার পরিণতিতে তোমাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের নির্দেশ থেকে দূরে সরে থাকার কোন সুযোগ এখন আর তোমাদের সামনে নেই।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. ঈমানদার হওয়ার দাবিদারদের সংখ্যা সমাজে কম নয়। বালা-মুসিবত ও পরীক্ষার সময় প্রমাণ হয় কে সত্য কথা বলছে।

দুই. আসমানি কিতাব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আল্লাহর নির্দেশ অস্বীকার করার মতো আর কোন অবিচার মানব জাতির প্রতি হতে পারে না।