সূরা আ'রাফ;(৪র্থ পর্ব)

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৬-১৯

সূরা আরাফের ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ (16) ثُمَّ لَآَتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ (17)

"শয়তান বললঃ (যেই মানব জাতির জন্য) আপনি আমাকে যেমন উদ্ভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের ( ধোঁকা দেয়ার) জন্যে আপনার সরল পথে (ফাঁদ পেতে) বসে থাকবো।" (৭:১৬)

"এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক, পেছন দিক, ডান দিক ও বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।" (৭:১৭)

গত পর্বের আয়াতগুলোর আলোচনায় আমরা শুনেছি, শয়তান আদমকে সিজদা না করে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করায় মহান আল্লাহর দরবার থেকে বহিষ্কৃত এবং আল্লাহর ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়। কিন্তু খোদায়ী বিধান অনুযায়ী চূড়ান্ত শাস্তি ও পুরস্কার কিয়ামত বা বিচার দিবসেই দেয়া হবে। তাই পাপীদেরকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে যাতে তারা তওবার করে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করার সময়সীমা শেষ হয়। এরই ভিত্তিতে শয়তানকে আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকার সুযোগ দিয়েছেন।

এই আয়াতে বলা হচ্ছে, শয়তান মানুষের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কসম খেয়ে বলছে যে সে নিজের মতই মানুষকেও পথভ্রষ্ট করবে এবং তাদেরকেও আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত করার উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা করবে। তাই সে বলেছে, আমি মানুষকে গোমরাহ করার জন্য চার দিক বা যত দিক থেকে সম্ভব মানুষের ওপর হামলা চালাব।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র এক হাদীসে এসেছে, শয়তান যখন মানুষের ওপর চারদিক থেকে হামলা চালানোর বা ফাঁদ পাতার কসম খেল তখন ফেরেশতারা বলল, হে পরওয়ারদেগার! তাহলে মানুষ কিভাবে রক্ষা পাবে বা শয়তানের হাত থেকে কিভাবে পালাবে? আল্লাহ বললেন, উপর ও নীচ থেকে দুটি পথ খোলা রয়েছে। মানুষ যখনই আল্লাহর সাহায্যের জন্য উপরের দিকে দোয়ার হাত উঠাবে অথবা মাটিতে কপাল ঠেকাবে তখন তারা শয়তানের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পাবে।

এ দুই আয়াতের শিক্ষা হল:

এক. নিজের পাপের জন্য ও খোদাদ্রোহীতার জন্য খোদায়ী বিধান বা ভাগ্য-লিপিকে দায়ী করা শয়তানী আচরণ।

দুই. শয়তান মানুষের কসম খাওয়া শত্রু। তাই তার অনুগত না হয়ে আমাদের উচিত অসীম দয়াময় আল্লাহর অনুগত হওয়া।

তিন. শয়তানের কুমন্ত্রণা ও ফাঁদগুলো মানুষকে সব দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। তাই সদা সতর্ক থাকা উচিত মানুষের।

সূরা আরাফের ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُومًا مَدْحُورًا لَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكُمْ أَجْمَعِينَ (18)

"আল্লাহ (শয়তানকে) বললেনঃ বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। (আল্লাহ অঙ্গীকার করে বলছেন) যে কেউ তোর পথে চলবে, নিশ্চয় আমি তাদের সবাইকে দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করব।" (৭:১৮)

শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করার শপথ নেয়ায় এর জবাবে আল্লাহও এই আয়াতে বলছেন, তুই মানুষের মধ্যে যাদেরকে তোর অনুসারী করবি তারা সবাই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে এবং দোযখের মহাশাস্তির শিকার হবে। আর এই স্থান থেকে বেরিয়ে যা। কারণ, এটা পবিত্র ও সৎ বান্দা এবং খোদাভীরুদের স্থান।

শয়তান অহংকার করায় ও নিজেকে বড় মনে করায় আদমকে সিজদা করেনি। এভাবে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে সে পরওয়ারিগারের দরবার থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। তাই কোনো মানুষও যদি খোদায়ী বিধানের মোকাবেলায় অহংকার করে তা হবে শয়তানের অনুসরণ এবং তারা শয়তানের মতই লাঞ্ছনা ও অবমাননার শিকার হবে।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. শয়তান মানুষকে পাপের জন্য কুমন্ত্রণা দিলেও পাপ করতে বাধ্য করে না। বরং মানুষ নিজেই পাপে জড়িয়ে পড়ে ও শয়তানের পথে চলে।

দুই. যারা এই পৃথিবীতে শয়তানের অনুসরণ করবে তারা কিয়ামতের দিনও তার সঙ্গী হবে এবং একই সঙ্গে শাস্তি ভোগ করবে।

সূরা আরাফের ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَيَا آَدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ (19(

"হে আদম তুমি এবং তোমার স্ত্রী (বেহেশতের উদ্যানের মত) এই উদ্যানে বসবাস কর। অতঃপর সেখানকার (যে কোনো স্থান) থেকে যা ইচ্ছা খাও তবে এ বৃক্ষের কাছে যেয়ও না তাহলে তোমরা (নিজের বিরুদ্ধে) অত্যাচারী হয়ে যাবে।" (৭:১৯)

শয়তান আদমকে সিজদা না করে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করায় তাকে নিজ দরবার থেকে বহিষ্কার করেন মহান রাব্বুল আলামিন। এ ঘটনা সংক্রান্ত আয়াতগুলোর পর এই আয়াতে পরবর্তী ঘটনার বর্ণনা শুরু করা হয়েছে। পরের ঘটনাটি হলো, আল্লাহর একটি পরামর্শ বা নির্দেশ মান্য করতে ব্যর্থ হওয়ায় হযরত আদম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী হযরত হাওয়া (সা.) বেহেশত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন এবং নানা সমস্যা বা সংকটে আক্রান্ত হন।  আদম (আ.) ও হাওয়া (সা.)-কে বেহেশতী উদ্যানের সমতুল্য একটি উদ্যানে রাখা হয়েছিল। সেখানে ছিল নানা ধরনের ফলমূলে সমৃদ্ধ গাছপালা। আল্লাহ সেখানে তাদেরকে সব ধরনের ফল খাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। তবে তাদেরকে শুধু একটি বিশেষ গাছের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন তিনি।  কিন্তু তারা শয়তানের কুমন্ত্রণার শিকার হয়ে ওই বিশেষ গাছের স্বাদ আস্বাদন করে। তাদের  এ কাজ ছিল নিজেদের ওপরই জুলুম বা নিজেদেরই ক্ষতি-সাধন। এটা ছিল মানুষের মাধ্যমে খোদায়ী  উপদেশ লঙ্ঘনের প্রথম ঘটনা।

আদম (আ.) ও হাওয়া (সা.)-কে যে উদ্যান থেকে বহিষ্কার করা হয় তা প্রতিশ্রুত বেহেশত ছিল, না পৃথিবীর কোনো বেহেশতী উদ্যান ছিল তা নিয়ে তাফসিরকারকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যেহেতু প্রতিশ্রুত বেহেশতে কোনো নিষিদ্ধ গাছের অস্তিত্ব নেই এবং সেখানে বিধি-নিষেধ মান্য করার মত কোনো ব্যবস্থার অস্তিত্ব নেই, তাই কোনো কোনো মুফাসসির মনে করেন ওই উদ্যানটি ছিল পৃথিবীর বুকেই বেহেশতের মত কোনো উদ্যান। আর আল্লাহর উপদেশ লঙ্ঘনের কারণে আদম (আ.) ও হাওয়া (সা.) সেখান থেকে বহিষ্কৃত হন।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. আল্লাহ মানুষের কল্যাণ, আরাম-আয়েশ ও সুখ-সমৃদ্ধি চেয়েছিলেন, তাই তাদের বেহেশতে স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ নিজেই আল্লাহর উপদেশ অমান্য করে নিজেদের জন্য সমস্যা ও কষ্ট সৃষ্টি করেছে।

দুই. পেট ও খাবারের ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। নিষিদ্ধ খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমেই মানুষ সর্বপ্রথম খোদায়ী বিধান লঙ্ঘন করেছিল ।

তিন. হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয় বর্ণনার আগে বৈধ বা হালাল বিষয়গুলো বর্ণনা করা উচিত যাতে চাহিদাগুলো স্বাভাবিক উপায়ে মেটানো যায়।