সূরা আ'রাফ; (৫ম পর্ব)

সূরা আ'রাফ; আয়াত ২০-২৩

সূরা আরাফের ২০ ও ২১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُورِيَ عَنْهُمَا مِنْ سَوْآَتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ (20) وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِينَ (21

"অতঃপর শয়তান উভয়কে প্ররোচিত করল, যাতে তাঁদের লজ্জাস্থান, যা তাঁদের কাছে গোপন ছিল, তাঁদের সামনে প্রকাশ পড়ে। সে বললঃ তোমাদের পালনকর্তা তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করেছেন এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও-কিংবা হয়ে যাও চিরঞ্জীব বা অমর।" (৭:২০)

"সে তাঁদের কাছে কসম খেয়ে বললঃ আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী।" (৭:২১)

আগের পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি, আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত শয়তান হযরত আদম (আ.)-এর কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার কসম খেয়েছিল। কারণ, তার দৃষ্টিতে আদমের কারণেই সে আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।

এই আয়াতে শয়তানের প্রথম কুমন্ত্রণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)-কে একটি বিশেষ গাছের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু শয়তান কোনো এক বেশ ধরে তাঁদের সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁদেরকে বলল: যদিও আল্লাহ এ গাছের কাছে নিষেধ করেছেন, কিন্তু যদি খাও তাহলে তোমরা ফেরেশতাদের মত হয়ে যাবে এবং অমরত্ব লাভ করবে।

হযরত আদম ও হাওয়া (আ.) এর আগে কখনও কাউকে মিথ্যা কথা বলতে শুনেননি। তাই তাঁরা শয়তানের ধোঁকার শিকার হয়ে আল্লাহর পরামর্শ বা উপদেশ ভুলে যান। অবশ্য শয়তানের লক্ষ্য ছিল হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)-কে লজ্জাহীন এবং হিজাব ও পোশাকবিহীন করা। আর এভাবে তাঁদের নগ্নতা প্রকাশ করে দিয়ে পরবর্তীতে তাঁদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার নানা কাজে জড়িত করতে চেয়েছিল শয়তান।

এই দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. শয়তান কাউকে পাপে লিপ্ত হতে বাধ্য করে না। সে শুধু পাপের কুমন্ত্রণা দেয়। বরং আমরা নিজেরাই পাপের পথ বেছে নেই।

দুই. হিজাব বা পর্দা উঠিয়ে দেয়া ও নগ্নতা ছড়িয়ে দেয়া শয়তানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। আমাদের এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যাতে পোশাকের ব্যবস্থাই বিলুপ্ত হয় বা পোশাকহীনতা ছড়িয়ে পড়ে।

তিন. শয়তান বড় বড় আশা এবং আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার মাধ্যমে মানুষকে ধোঁকা দেয়।

চার. যে কোনো কসম ব শপথকেই বিশ্বাস করা উচিত নয়। কারণ, শয়তানও কসম খেয়েছে।

সূরা আরাফের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْآَتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ وَنَادَاهُمَا رَبُّهُمَا أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَكُمَا إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُبِينٌ (22)

"অতঃপর শয়তান ধোঁকা দিয়ে তাঁদেরকে (নিজ অবস্থান তথা আল্লাহর উপদেশ অনুযায়ী চলার অবস্থান থেকে) নামিয়ে আনে। এরপর যখন তাঁরা ওই গাছ আস্বাদন করল, তখন তাঁদের 'লজ্জাস্থান' তাঁদের সামনে খুলে গেল এবং তাঁরা নগ্নতা ঢাকার জন্য নিজেদের উপর বেহেশতের পাতা জড়াতে লাগল। তাঁদের প্রতিপালক তাঁদেরকে ডেকে বললেনঃ আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।" (৭:২২)

শেষ পর্যন্ত শয়তান ধোঁকা দিয়ে হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)-কে নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়াতে সক্ষম হয়। আর ওই ফল পুরোপুরি না খেতেই তাঁদের 'লজ্জাস্থানগুলো' পরস্পরের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। ফলে তাঁরা একে-অপরকে আবৃত করার জন্য শরীরে গাছের পাতা জড়াতে থাকেন। এমন সময় তাঁরা আল্লাহর কথা শুনলেন যে, কেন খোদার ফরমান ভুলে গেলে এবং শয়তানের ধোঁকা খেলে? তোমরা কি জান না শয়তান তোমাদের কাছ থেকে আঘাত পেয়েছে ও তোমাদের ওপর ক্ষেপে আছে? তাই সে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছে। শয়তান তোমাদের প্রকাশ শত্রু, কারণ, সে এই শত্রুতার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সূত্রে বর্ণিত ইসলামী জ্ঞানের অনুসারী নেতৃস্থানীয় মুসলিম আলেম বা চিন্তাবিদরা মনে করেন, সব নবী-রাসূলই নিষ্পাপ এবং তারা কখনও কোনো পাপ করেননি। তবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছাড়া অন্য নবী-রাসূলরা কখনও কখনও একাধিক উত্তম পন্থা বা কাজের মধ্যে সর্বোত্তম পন্থা বা কাজটিকে বেছে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। হযরত আদম ও হাওয়া(আ.) কর্তৃক নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার ঘটনাটিও সেরকম ঘটনা। এ ঘটনা চুরি করা বা মিথ্যা কথা বলার মত কোনো বড় গোনাহ বা হারাম কাজ কিংবা ছোটখাট গোনাহর সমতুল্য কোনো কাজও ছিল না। ডাক্তার যদি বলেন, অমুক খাবার খেলে আপনার অমুক রোগ হতে পারে, তাই তা খাবেন না। আর এই পরামর্শ সত্ত্বেও কেউ যদি অসতর্ক হয়ে ওই খাবারটি খায় এবং ওই খাদ্য খাওয়ার কুফল ভোগ করে তাহলে এটা বলা যাবে না যে তিনি পাপ বা অন্যায় কাজ করেছেন। হযরত আদম ও হাওয়া (আ.) কর্তৃক নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার ঘটনাটিও তদ্রুপ। অর্থাৎ এটা ছিল উপদেশমূলক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন। অনেকে মনে করেন একটি বিশেষ গাছের কাছে যাওয়া আদম-হাওয়া(আ.)'র জন্য নিষিদ্ধ ছিল, গাছটির ফল খাওয়া তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল না। আর ফলও যদি নিষিদ্ধ হয়ে থাকে, তবে তাঁরা ঠিক ওই গাছটিরই ফল বা গাছটির অন্য কিছু খাননি, বরং ওই জাতীয় অন্য গাছ থেকে খেয়েছিলেন। তা-ছাড়া তারা তখনও দুনিয়ায় আসেননি এবং শরিয়তের হালাল-হারামের বিধানও সে সময় তাঁদের ওপর প্রযোজ্য ছিল না। তবে আল্লাহর ওই উপদেশ মেনে চললে তাঁরা যে মর্যাদা পেতেন তা তাঁরা হাতছাড়া করেছেন। আর ওই কাজ নবুওতের মর্যাদা বিরুদ্ধ ছিল বলেই আল্লাহ এ জন্য আদম-হাওয়া(আ.)-কে তিরস্কার করেছেন। আর তাঁরাও অনুশোচিত হয়ে তওবা করেছিলেন। ওই ফল খাওয়ার কারণে তাঁদের 'লজ্জাস্থানগুলো' প্রকাশিত হওয়া বলতে ঘটনাটির নানা নৈতিক ফল বা শিক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল বলে কোনো কোনো তাফসিরকারক উল্লেখ করেছেন। এইসব শিক্ষার মধ্যে কয়েকটি শিক্ষা হল: মানুষ সমগ্র সৃষ্টি, এমনকি জিন ও ফেরেশতার চেয়েও শ্রেষ্ঠ। বিবেকগত ও নৈতিক পবিত্রতার চেয়ে বস্তুগত পবিত্রতার স্থান নিচে, বিদ্বেষ ও অহংকারের নিন্দা, সৃষ্টিগত গুণ, বংশ প্রভৃতিতে গর্ব করার নিন্দা, উচ্চাকাঙ্ক্ষীর ধরাশায়ী হওয়া, মন্দ সূচনার মন্দ পরিণতি, দোষীও যেন আবশ্যিক দাবি বা চাহিদা থেকে বঞ্চিত না হয়, অপরাধীর একগুঁয়েমিতে শাস্তি বৃদ্ধি, দোষীর অনুসারীরও দোষীর মত খারাপ পরিণাম, প্রকৃত বন্ধুর দুরবস্থায় সঙ্গ দেয়া, যাচাই না করেই কোন কিছুর ওপর ভরসা করার নিন্দা, সৎ উপদেষ্টার বিরুদ্ধাচারণ করার লাঞ্ছনা, শত্রুর মিথ্যা শপথে বিশ্বাস না করা, তওবা ও অনুতাপের সুফল, অনুতাপের পর আসল স্থান ফিরে পাওয়া যায়, ব্যক্তিগত শত্রুতা কখনও বংশগত হয়ে যায় ইত্যাদি।

অনেকেই মনে করেন আদম-হাওয়া (আ.) ওই ভুল না করলে বেহশত হারাতেন না এবং তাঁদের বংশধর বা মানুষকেও পৃথিবীতে আসতে হত না। আসলে মানুষের পৃথিবীতে আসার সঙ্গে ওই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, মহান আল্লাহ আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন যে, মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা করবেন।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. নারী ও পুরুষ উভয়ই শয়তানের কুমন্ত্রণার ফাঁদের সম্মুখীন। নারী বা পুরুষ হওয়ার বিষয়টি ভুল-ত্রুটি বা পাপের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখে না।

দুই. নগ্নতা এক ধরনের খোদায়ী শাস্তি। এটা সভ্যতা ও পূর্ণতার লক্ষণ নয়। খোদায়ী বিধানকে গুরুত্ব না দেয়া ও কোনো কোনো হারাম খাবার খাওয়া নগ্নতা ও অশ্লীলতার পথ খুলে দেয় এবং ছিন্ন করে লজ্জার আবরণ।

তিন. পোশাক মানুষের সহজাত বা প্রকৃতিগত বিষয়। শৈশব থেকেই সব মানুষ লজ্জার স্থানগুলো ঢাকতে সচেষ্ট। তা ঢাকার মাধ্যম যত সাদা-মাটাই হোক না কেন।

চার. প্রকৃত শত্রু কে তা অবশ্যই জানতে হবে। শত্রুর মোকাবেলায় সব সময়ই সচেতন থাকতে হবে। এ ব্যাপারে সামান্য অসচেতনতাও ধ্বংসাত্মক হতে পারে।

সূরা আরাফের ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

"তারা উভয়ে বললঃ হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি জুলম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হব।" (৭:২৩)

হযরত আদম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী হযরত হাওয়া (আ.) শয়তানের ধোঁকার শিকার হওয়ার পর খুব দ্রুত তাঁদের ভুল বুঝতে পারেন। ফলে তাঁরা অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে এ মিনতি জানান যে, "হে আল্লাহ! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি এবং এখন তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।"

শয়তানও আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিল এবং আদম-হাওয়াও আল্লাহর পরামর্শ ভুলে গিয়ে নিষিদ্ধ কাজ করেছিলেন। কিন্তু শয়তান অনুশোচনাও করেনি ও ক্ষমাও চায়নি। বরং ইচ্ছাকৃত অবাধ্যতার ব্যাপারে সাফাই দিয়ে সে আরও বেশি দম্ভ প্রকাশ করেছে। এমনকি শয়তান মহান আল্লাহর ন্যায়বিচার ও হিকমাত বা প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছে। অন্যদিকে শয়তানের ধোঁকার শিকার হয়েই আল্লাহর উপদেশের খেলাপ করেছিলেন আদম-হাওয়া (আ.)। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা নিজ নিজ ভুল স্বীকার করেছিলেন এবং ভুলের ক্ষতি পূরণের চেষ্টা করেছেন। তাই আল্লাহ শয়তানকে নিজ দরবার থেকে বিতাড়িত ও চির-অভিশপ্ত করেছেন, অন্যদিকে আদম-হাওয়াকে ক্ষমা করেছেন এবং তাঁদেরকে রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দিয়েছেন।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. আল্লাহর উপদেশ বা নির্দেশ অমান্য করা মানে নিজের ওপরই জুলুম করা। কারো পাপ কখনও আল্লাহর কোনো ক্ষতি করে না, বরং পাপীদেরই ক্ষতি করে।

দুই. আদম ও হাওয়া (আ.) উভয়ই আল্লাহর উপদেশ মনে রাখেননি, আবার উভয়ে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনায়ও শরিক হয়েছেন। পাপ করা ও অনুশোচনা আর তওবার ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। নারী ও পুরুষ উভয়েই উচ্চ গুণাবলী বা পূর্ণতার শীর্ষ স্থান অর্জন করতে সক্ষম, আবার সবচেয়ে হীনতম চরিত্রেরও অধিকারী হতে পারে।

তিন. একমাত্র আল্লাহর কাছেই গোনাহর কথা স্বীকার করা যায়। আর এই স্বীকারোক্তি ক্ষমার ক্ষেত্র তৈরি করে।

চার. গোনাহ মানুষের ক্ষতির মাধ্যম। একমাত্র তওবার মাধ্যমেই ক্ষতির ধারা বন্ধ করা সম্ভব।