সূরা আ'রাফ; (১২তম পর্ব)

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৪৯-৫২

সূরা আ'রাফের ৪৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ ((৪৯

"এই বেহেশতীরা কি তারাই; যাদের সম্পর্কে তোমরা দুনিয়ায় কসম খেয়ে বলতে যে, আল্লাহ এদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন না। (এখন দেখ যে তাদের বলা হচ্ছে:) প্রবেশ কর জান্নাতে। তোমাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তোমরা দুঃখিত হবে না।" (৪৯)

আগের অনুষ্ঠানে আমরা বেহেশত ও দোযখের অধিবাসীদের সাথে আরাফবাসীদের সংলাপের বর্ণনা শুনেছি। আরাফবাসীরা দাম্ভিক তথা দোযখবাসীদের বলেছিল, দেখলে তো তোমাদের শক্তি ও সম্পদ এখানে অর্থাৎ পরকালে কোন কাজে আসল না এবং তোমরা দোযখ থেকে রক্ষা পেলে না!

আগের আয়াতের জের ধরে এ আয়াতে দোযখীদের বলা হচ্ছে, এই বেহেশতীদের তোমরা তাচ্ছিল্য করে বলতে, “আল্লাহ আমাদেরকে ভালবাসেন বলেই আমাদেরকে পদ-মর্যাদা, সম্পদ ও ক্ষমতা দিয়েছেন এবং তোমরা দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর অনুগ্রহভাজন নও।” কিন্তু এখন দেখলে তো, ওরাই পূর্ণ প্রশান্তি, নিরাপত্তা ও কোন ভয় ছাড়াই বেহেশেতে প্রবেশ করেছে। আর তোমরা, যারা নিজেদেরকে ওদের চেয়ে বড় মনে করতে, আজ দোযখে প্রবেশ করলে।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার-

এক. আল্লাহর রহমত পাবার জন্যে ঈমান ও সৎ কাজ জরুরী, সম্পদ ও ক্ষমতা নয়। পৃথিবীতে দারিদ্র ও অখ্যাতি বেহেশত থেকে বঞ্চিত হবার লক্ষণ বা প্রমাণ নয়।

দুই. কে বেহেশতী ও কে জাহান্নামী তা তড়িঘড়ি করে বলা আমাদের কাজ নয় । এটা পরকালে বিচার দিবসেই স্পষ্ট হবে। আমাদের দৃষ্টিতে যার মূল্য নেই, সে দোযখে যাবে এমনটি ভাবা ঠিক নয়।

সূরা আরাফের ৫০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَنَادَى أَصْحَابُ النَّارِ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَنْ أَفِيضُوا عَلَيْنَا مِنَ الْمَاءِ أَوْ مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَهُمَا عَلَى الْكَافِرِينَ ((৫০

"দোযখীরা বেহেশতীদের বলবে: পানি ও অন্যান্য যেসব রিজিক আল্লাহ তোমাদের দিচ্ছেন, তা থেকে আমাদের কিছু দান কর। বেহেশতীরা বলবে: আল্লাহ কাফিরদের জন্যে এ দুই-ই নিষিদ্ধ করেছেন।" (৫০)

দোযখীদের ও বেহেশতীদের সাথে আরাফবাসীদের সংলাপ বর্ণনার পর এ আয়াতে দোযখের ও বেহেশতের অধিবাসীদের অবস্থার পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। দোযখের আগুন এত তীব্র হবে যে, দোযখীরা প্রথমেই পানির জন্যে পাগল হয়ে উঠবে। দোযখের প্রহরীদের কাছ থেকে তা পাবার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে তারা বেহেশতীদের কাছে এ আবেদন জানাবে -আমাদেরকে একটু পানি অথবা অন্যান্য যেসব শরবত বা পানীয় আল্লাহ তোমাদের দিচ্ছেন তা থেকে একটু দান কর যাতে আমাদের ভেতরের প্রচণ্ড তাপ ও তৃষ্ণা কিছুটা কমে। কিন্তু বেহেশত থেকে এক ফোটা পানিও দোযখীদের দেয়ার কোন অনুমতি নেই।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার-

এক. যারা শুধু দুনিয়ার সম্পদ সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত, পরকালে তাদেরকে শূন্য হাতে থাকতে হবে ।

দুই. যারা দুনিয়াতে আল্লাহর বিধান মেনে চলে না ও হারামকে হালাল মনে করে তারা বেহেশত থেকে বঞ্চিত হবে এবং এমনকি পানিও তাদের জন্যে অবৈধ হবে।

সূরা আরাফের ৫১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَهُمْ لَهْوًا وَلَعِبًا وَغَرَّتْهُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا فَالْيَوْمَ نَنْسَاهُمْ كَمَا نَسُوا لِقَاءَ يَوْمِهِمْ هَذَا وَمَا كَانُوا بِآَيَاتِنَا يَجْحَدُونَ ((৫১

"তারা নিজ ধর্মকে তামাশা ও খেলা বানিয়ে নিয়েছিল এবং পার্থিব বা দুনিয়ার হীন জীবন তাদেরকে অহংকারী করে রেখেছিল। অতএব, আমি আজকে তাদেরকে ভুলে যাব; যেমন তারা এ দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল এবং যেমন তারা আমাদের আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করত।" (৫১)

আগের আয়াতে আমরা শুনেছি, দোযখীরা বেহেশতীদের কাছে এক ফোঁটা পানি ভিক্ষা চাইছে, কিন্তু তাও পাওয়া তাদের জন্যে সম্ভব হচ্ছে না। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, পরকালে দোযখীদের এ অবস্থার জন্যে আল্লাহ দায়ী নন, বরং এ জন্যে তাদের অর্থাৎ দোযখীদের কর্মফলই দায়ী। ইহকালে নবী-রাসূলগণ যখন তাদেরকে সত্যের দিকে আহবান করতো, তখন তারা তা গ্রহণের পরিবর্তে বা তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তে তাঁদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতো। তারা দুনিয়ার চাকচিক্য, ক্ষমতা, সম্পদ ও পদের পিছনে ছুটে প্রতারিত হয়েও ভাবতো যে, পরকালে জবাবদিহি করতে হবে না এবং নবী-রাসূলগণের আহ্বান খেল-তামাশা মাত্র। ওরা পরকালীন কল্যাণের জন্যে কোন কাজ করেনি বলে স্বাভাবিকভাবেই আজ অর্থাৎ পরকালে তারা সব কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হয়েছে এবং বিস্মৃতি ও অবহেলার পাত্র হয়েছে।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার-

এক. কাফের বা অবিশ্বাসীরা ধর্মকে খেল-তামাশার বস্তু বলে মনে করে, অথচ তারা পার্থিব জীবনের তুচ্ছ ও ক্ষণস্থায়ী আনন্দকেই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়।

দুই. দুনিয়ার চাকচিক্য প্রতারণা মাত্র। দুনিয়ার চাকচিক্যের মোহই মানুষকে পরকাল সম্পর্কে উদাসীন করে এবং এ কারণেই কেউ কেউ পরকালকে অস্বীকার করে।

সূরা আরাফের ৫২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَقَدْ جِئْنَاهُمْ بِكِتَابٍ فَصَّلْنَاهُ عَلَى عِلْمٍ هُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ((৫২

"নিশ্চয়ই আমি মানুষের জন্যে এক গ্রন্থ দিয়েছি, এতে জ্ঞানের বিশদ বিবরণ রয়েছে যাতে তা মুমিনদের জন্যে সুপথ ও রহমত বা করুণার মাধ্যম হয়।" (৫২)

আগের আয়াত থেকে আমরা জেনেছি, কাফেররা ধর্মকে ঠাট্টা বা তামাশার বস্তু বলে মনে করে। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, ধর্ম সুপথ বা হেদায়াতের মাধ্যম। মহান আল্লাহ ধর্মীয় গ্রন্থ ও বিধানের মাধ্যমে মানুষের কাছে ধর্ম পাঠিয়েছেন। আসমানি কিতাব বা ধর্ম গ্রন্থের বাণী মানুষের বিবেক ও যুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং জ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু কাফেররা খোদায়ী পথ নির্দেশনা তথা রহমত গ্রহণে প্রস্তুত নয়। তারা কোন যুক্তি ছাড়াই ধর্মকে অবজ্ঞা করে ও প্রত্যাখ্যান করে। শুধু মুমিন বা বিশ্বাসীরা সুপথ বা খোদায়ী পথ-নির্দেশনা থেকে উপকৃত হয়।

এই আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার -

এক. আল্লাহ মানুষের কাছে শিক্ষকসহ তথা নবী-রাসূলসহ ধর্মগ্রন্থ পাঠিয়ে তাঁর দায়িত্ব শেষ করেছেন। কারণ এর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে অনুগৃহীত করেছেন এবং এরফলে 'সত্যকে জানতাম না' এমন অজুহাত তোলাও সম্ভব হবে না।

দুই. মহান আল্লাহ মানুষের প্রয়োজন পূরণ ও তাদের পূর্ণতা এবং সৌভাগ্যের জন্যে ওহী বা ধর্মগ্রন্থ পাঠিয়েছেন। খোদায়ী বিধিবিধান প্রকৃতির সঙ্গে বা সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য বা বিধি-বিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।