সূরা আ'রাফ; (১৫তম পর্ব)

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৬৭-৭১

সূরা আল আ'রাফের ৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قَالَ يَا قَوْمِ لَيْسَ بِي سَفَاهَةٌ وَلَكِنِّي رَسُولٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ ((৬৭

"(হুদ (আ.) তার জাতির দাম্ভিকতার জবাবে) বললেন: হে আমার সম্প্রদায়, আমি মোটেই নির্বোধ নই, বরং আমি বিশ্বজগতের পরওয়ারদেগার বা প্রতিপালকের প্রেরিত পয়গম্বর।" (৭:৬৭)

আদ জাতির লোকেরা হযরত হুদ (আ.)'র দাওয়াত মেনে নেয়নি। তারা কোনো যুক্তি না দেখিয়ে নবীর তৌহিদি আহ্বানকে বিদ্রুপ ও পরিহাসের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করে এবং হুদ (আ.)-কে বোকা ও জ্ঞানহীন বলে অভিযুক্ত করে। জবাবে মহান আল্লাহর নবী হযরত হুদ (আ.) কোনো ধরনের উত্তেজনাপূর্ণ বাক্য ও অশোভনীয় কথা বলেননি। বরং তিনি সম্পূর্ণ শান্ত চিত্তে তাদের ওই অপবাদকে খণ্ডন করেছেন।

এ আয়াতের ক'টি শিক্ষা হল:

এক. নবী-রাসূলরা সবচেয়ে কঠিনতম প্রচারণা ও ধুম্রজালের শিকার হওয়া সত্ত্বেও কখনও ময়দান ছেড়ে দেননি।

দুই. আমাদের ওপর কেউ যদি কোনো অপবাদ দেয় তাহলে তা খণ্ডনের অধিকার রয়েছে, কিন্তু অপবাদদানকারীদের বিরুদ্ধে একই ধরনের অপবাদ দেয়ার অধিকার কারোরই নেই।

তিন. মানুষকে সত্যের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য সত্যের প্রচারককে উদারতা ও মহানুভবতার অধিকারী হতে হবে।

সূরা আল আরাফের ৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছ-

أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ ((৬৮

"(হে আমার জাতি!) আমি তো তোমাদের প্রতিপালকের পয়গাম তোমাদের কাছে পৌঁছে দেই এবং আমি তোমাদের বিশ্বস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী।" (৭:৬৮)

এই আয়াতে এটা তুলে ধরা হয়েছে যে হযরত হুদ (আ.) তাঁর দাওয়াতের প্রতি স্বজাতির লোকদের বিদ্রুপ ও পরিহাস সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেননি, বরং তিনি বলেছেন, আমি তোমাদের বিশ্বস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী এবং আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত; আর আমি তো নিজ থেকে কিছু বলছি না। আর আমি তোমাদের কাছ থেকে আমার জন্য কিছু দাবিও করছি না। প্রত্যেক জাতিই নবী-রাসূলদের সততা ও পবিত্রতা সম্পর্কে সচেতন ছিল। কারণ, নবী ও রাসূল হওয়ার আগেই জনগণের সঙ্গে তাঁদের নানা আচরণে ও লেনদেনের মধ্যে তাদের সততা বা বিশ্বস্ততার খ্যাতি প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা যখনই সত্যের দাওয়াত শুরু করেন তখনই জাতিগুলোর অনেকেই তা প্রত্যাখ্যান করত। কারণ, এইসব দাওয়াত মেনে নিলে তাদেরকে অনেক বিধি-নিষেধের বিধান মেনে চলতে হত এবং পরিহার করতে হত অনেক অবৈধ স্বার্থ, যা মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তারা যে কোনো অজুহাতে এইসব দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করত ও নবী-রাসূলদেরকে বিদ্রুপ আর অবমাননার বাণে জর্জরিত করত।

এই আয়াতের দুটি শিক্ষা হল:

এক. নবী-রাসূলরা ধর্ম প্রচারের জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের প্রচেষ্টা বা পন্থা তারা বাদ রাখেননি।

দুই. আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা ধর্ম প্রচারকদের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট হওয়া উচিত। এ দুই বৈশিষ্ট অর্জন করতে না পারলে জনগণ প্রচারকদের ডাকে সাড়া দেবেন না।

সূরা আল আরাফের ৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أَوَعَجِبْتُمْ أَنْ جَاءَكُمْ ذِكْرٌ مِنْ رَبِّكُمْ عَلَى رَجُلٍ مِنْكُمْ لِيُنْذِرَكُمْ وَاذْكُرُوا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِنْ بَعْدِ قَوْمِ نُوحٍ وَزَادَكُمْ فِي الْخَلْقِ بَسْطَةً فَاذْكُرُوا آَلَاءَ اللَّهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ((৬৯

"তোমরা কি বিস্মিত হচ্ছো যে, তোমাদের মধ্য থেকেই একজন পুরুষের মাধ্যমে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে আল্লাহর নির্দেশ ও উপদেশ এসেছে যাতে সে তোমাদেরকে (অশালীন ও পাপ কাজের পরিণতি সম্পর্কে) সতর্ক করতে পারে? তোমরা স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে কওমে নূহের পর সেই জাতির স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের দেহের শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই তোমরা আল্লাহর নেয়ামতগুলোকে স্মরণ কর (কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে)-যাতে তোমরা সফল হতে পার।" (৭:৬৯)

এই আয়াতে ও কুরআনের অন্য আয়াতের বর্ণনায় এসেছে, আদ জাতির পুরুষরা ছিল খুবই শক্তিশালী। তারা এতটা দীর্ঘদেহী ছিল যে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর জমিনে পড়ে থাকা তাদের দেহগুলোকে খেজুর গাছের সঙ্গে তুলনা করেছে কুরআন।

এই আয়াতে আল্লাহ আদ জাতিকে বলছেন, হুদ (আ.) তো তোমাদেরই জাতির লোক। কেন তাঁর কঠোর বিরোধিতা করছ? সে তো শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই তোমাদের সতর্ক করছে। তাঁর কাছে আমি যে ওহী বা প্রত্যাদেশ নাজেল করেছি তা তোমাদের অসচেতনতা দূর করারই মাধ্যম যাতে তোমরা আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর নেয়ামতগুলো সম্পর্কে উদাসীন না হও। পৃথিবীতে তোমাদের সাফল্য নির্ভর করছে তোমাদের উতসমূল বা স্রস্টা ও পরকালের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার ওপর। সেই খোদার কথা তোমাদের মনে রাখা উচিত যিনি তোমাদেরকে এমন শক্তিশালী করেছেন এবং করেছেন নুহের জাতির স্থলাভিষিক্ত। নুহের জাতি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমরাও যদি তাদের পথ ধর তাহলে সেই একই পরিণতির শিকার হবে।

এ আয়াতের দু.টি শিক্ষা হল:

এক. নবী-রাসূলরা জনগণের সারি থেকেই এসেছেন এবং তাঁরা জনগণের কল্যাণের জন্যই কাজ করতেন। তাঁরা নিজেদের জনগণের চেয়ে বড় বলে দাবি করতেন না।

দুই. দৈহিক শক্তি আল্লাহর দেয়া অন্যতম নেয়ামত। এই শক্তি সঠিক পথে ব্যবহার না করলে ক্ষতি ও ধ্বংস অনিবার্য।

সূরা আল আরাফের ৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالُوا أَجِئْتَنَا لِنَعْبُدَ اللَّهَ وَحْدَهُ وَنَذَرَ مَا كَانَ يَعْبُدُ آَبَاؤُنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ ((৭০

"তারা বললঃ তুমি কি আমাদের কাছে এজন্যে এসেছ যে আমরা কেবল এক আল্লাহর উপাসনা করব এবং আমাদের বাপ-দাদা যাদের পূজা করত, তাদেরকে ছেড়ে দেব? অতএব নিয়ে আস সেই শাস্তি আমাদের কাছে যার ভয় আমাদেরকে দেখাচ্ছ, যদি তুমি সত্যবাদী হও।" (৭:৭০)

এই আয়াতে খোদাদ্রোহী আদ জাতির অযৌক্তিক আচরণ ও গোঁড়ামির চূড়ান্ত অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। তারা হুদ (আ.)'র দাওয়াত অস্বীকারের অজুহাত হিসেবে কেবল এটাই বলছে, আমাদের পূর্বপুরুষরা আল্লাহর উপাসনা করত না বলে আমরাও তার উপাসনা করব না এবং এমনকি তারা খোদায়ী শাস্তির ভয় প্রদর্শনকেও অসত্য বা ভয় পায় না বলে উপহাস করেছে।

এই আয়াতের ক'টি শিক্ষা হল:

এক. পূর্বপুরুষদের প্রথা ও বিশ্বাসের অন্ধ অনুসরণ অগ্রহণযোগ্য এবং অযৌক্তিক । যুক্তিই হওয়া উচিত জীবনের সব আচার-আচরণের মানদণ্ড।

দুই. অন্ধ বিদ্বেষ ও অন্ধ অনুকরণ মানুষকে সত্য থেকে দূরে রাখে এবং এর ফলে তারা গোঁড়া হয়ে পড়ে।

তিন. প্রচলিত হওয়ার অজুহাত থাকা সত্ত্বেও নবী-রাসূলরা কুসংস্কার ও বিচ্যুত প্রথাগুলোকে নির্মূল করতে দ্বিধান্বিত হননি কখনও।

সূরা আল আরাফের ৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَ قَدْ وَقَعَ عَلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ رِجْسٌ وَغَضَبٌ أَتُجَادِلُونَنِي فِي أَسْمَاءٍ سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآَبَاؤُكُمْ مَا نَزَّلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ فَانْتَظِرُوا إِنِّي مَعَكُمْ مِنَ الْمُنْتَظِرِينَ ((৭১

"সে বললঃ অবধারিত হয়ে গেছে তোমাদের উপর তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে শাস্তি ও ক্রোধ। আমার সাথে (মূর্তিগুলোর) ঐসব নাম সম্পর্কে কেন তর্ক করছ, যেগুলো তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা রেখেছে। অথচ আল্লাহ এদের সম্পর্কে কোন প্রমাণ পাঠাননি। অতএব (খোদায়ী শাস্তির জন্য) অপেক্ষা কর। আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি।" (৭:৭১)

হযরত হুদ (আ.) অনেক ধৈর্য ধরে আন্তরিক চিত্তে ও বিনম্রভাবে আদ জাতিকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তারা সত্যকে মেনে নেয়নি। বরং বলেছে যে, তোমার কথিত পরকালীন খোদায়ী শাস্তি যদি সত্যই হয়ে থাকে তাহলে এ পৃথিবীতেই ওই শাস্তির একটা অংশ আমাদের দেখাও এবং আমাদের ওপর ওই শাস্তি নাজেল কর!

এই আয়াতে হযরত হুদ (আ.) তার জাতির নাফরমান লোকদের বলছেন, তোমরা অহংকার ও গোড়ামির বশে যে শাস্তি দেখার জিদ করেছ তা এই দুনিয়াতেই উপভোগ করবে। তোমরা এই শাস্তির জন্যই অপেক্ষা করছ, আর আমিও তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। কারণ, তোমরা আসল খোদার ইবাদত না করে যে কাঠ ও পাথরগুলোকে খোদা বলে উপাসনা করছ তা খেয়ালিপনা মাত্র। তোমরাই এগুলোর মধ্যে খোদায়ী নাম আরোপ করেছ, কিন্তু এসবের কোনো খোদায়ী মহত্ত্ব নেই। এদের না আছে খোদায়ী শক্তি, খোদায়ী জ্ঞান, খোদায়ী দয়া ও প্রজ্ঞা।

এ আয়াতের ক'টি শিক্ষা হল:

এক. অর্থহীন ও গুরুত্বহীন নামগুলো শুনতে সুন্দর লাগলেও সেগুলো পরিহার করা উচিত। বরং আমাদের উচিত সত্য সন্ধানী হওয়া।

দুই. মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসের ভিত্তি যুক্তি-প্রমাণ হওয়া উচিত, অন্ধ অনুকরণ ও বিদ্বেষ নয়।