সূরা আ'রাফ; (১৮তম পর্ব)

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৮৩-৮৬

সূরা আ'রাফের ৮৩ ও ৮৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

فَأَنْجَيْنَاهُ وَأَهْلَهُ إِلَّا امْرَأَتَهُ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ (83) وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ مَطَرًا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُجْرِمِينَ (84(

"কিন্তু আমি তার স্ত্রীকে ছাড়া তাকে (অর্থাত লুত (আ.) কে) এবং তার পরিবারকে রক্ষা করেছিলাম। [তার স্ত্রী] ছিল পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভূক্ত।" (৭:৮৩)

"আমি তাদের উপর প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। অতএব, দেখ পাপীদের পরিণতি কেমন হয়েছে।" (৭:৮৪)

আগের পর্বে আমরা বলেছি, লুত (আ.) এর সম্প্রদায় তার উপদেশ মেনে চলার পরিবর্তে তাকে এবং তার অনুসারীদেরকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করেছিল এবং তারা নবী ও তার অনুসারীদের পবিত্রতা ও সৎ জীবনযাপনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছিল।

এই আয়াতে বলা হয়েছে, ওই সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষই যেহেতু লুত (আ.)এর উপদেশ প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তাকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করেছিল, সে কারণে আল্লাহর শাস্তি তাদের উপর নেমে আসে এবং শুধুমাত্র হযরত লুত (আ.) ও তার অনুসারীরা ওই শাস্তির বাইরে ছিল। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, হযরত লুত (আ.)এর স্ত্রী সমাজের পুরুষদের মতো অত্যন্ত ঘৃণ্য অপরাধে লিপ্ত না হলেও স্বামী লুত (আ.)এর পাশে ছিল না বরং পাপীদের সহযোগিতা করেছে ও তাদের অন্যায় কাজে সমর্থন দিয়েছে। এর মাধ্যমে লুত (আ.) এর স্ত্রী পাপীদের সহযোগীতে পরিণত হয় এবং অবশেষে অন্য পাপীদের সঙ্গে ধ্বংস হয়।

লুত (আ.) এর সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসা ঐশী শাস্তির  সঙ্গে আবরাহা ও তার সৈন্য বাহিনীর উপর নেমে আসা শাস্তির অনেকটা মিল রয়েছে। কোরানে এসেছে,আব্রাহা বাহিনী পবিত্র ক্বাবা ঘর ধ্বংস করার জন্য মক্কায় হামলা চালিয়েছিল। সূরা হুদের ৮২ আয়াতে  এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাদের ওপর বৃষ্টির মতো করে ছোট ছোট পাথর নিক্ষেপ করলাম। এ ছাড়া, সূরা ফিলে আব্রাহার হস্তি বাহিনীকে শাস্তি দেয়া প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,তাদের ওপর টুকরো টুকরো পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে আক্রমণ করা হলো।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো;

এক. কে, কার আত্মীয়,তা আল্লাহর শাস্তি ও পুরস্কার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়। এ কারণে হযরত লুত (আ.) এর স্ত্রীর উপরও আল্লাহর শাস্তি নেমে এসেছিল আর অন্যদিকে,সৎকর্মশীল হওয়ার কারণে নবীর অনুসারীরা শাস্তির বাইরে ছিলেন।

দুই. পুরুষের মতো নারীও ধর্ম নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং এ ক্ষেত্রে কোন জোর জবরদস্তি নেই। এ আয়াতেও সে বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে। যেমন লুত (আ.) এর স্ত্রী তার নিজের ইচ্ছায় কাফেরদের পথ বেছে নিয়েছিল। আবার অন্য সূরায় আমরা দেখতে পাই, ফেরাউনের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও বিবি আসিয়া, হযরত মুসা (আ.)এর পথ অনুসরণ করেছিলেন।

তিন. শুধু পরকালেই যে মানুষকে শাস্তি দেয়া হবে তা নয় বরং এ দুনিয়াতেও কখনো কখনো মানুষের উপর শাস্তি নেমে আসতে পারে।

সূরা আরাফের ৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءَتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ فَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (85(

"আমি মাদইয়ানবাসীদের প্রতি (নিজ সম্প্রদায় থেকে) তাদের ভাই শোয়েবকে পাঠিয়েছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর এবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রমাণ এসে গেছে। তোমরা সঠিক মাপ ও ওজন দেবে ও লোকদের তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দেবে না এবং দুনিয়ায় সংস্কার সাধনের পর অশান্তি সৃষ্টি করো না। তোমাদের যদি ঈমান থাকে, তবে তা হবে তোমাদের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ।" (৭:৮৫)

হযরত লুত (আ.) এর সম্প্রদায়ের ঘটনা তুলে ধরার পর এই আয়াতে হযরত শোয়েব (আ.) ও তার সম্প্রদায়ের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা মাদইয়ান সম্প্রদায়ের কাছে তাদের মধ্য থেকেই হযরত শোয়েব (আ.) কে নবী হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। ওই সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ জিনিসপত্র বিক্রির সময় ওজনে কম দিতো। অর্থাত একে অপরকে ঠকাতো। শোয়েব (আ.)তাদেরক ওই অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে এবং জিনিসপত্র সঠিকভাবে ওজন করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। নবী শোয়েব (আ.)তার সম্প্রদায়ের লোকজনকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ওজনে কম দেয়া, পৃথিবীতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সমতুল্য, যা কোন ঈমানদার ব্যক্তি করতে পারে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. যাদের ঈমান নেই, তারা সব সময় বিভ্রান্তির মধ্যে থাকে। তাদের অর্থনৈতিক ও নৈতিক-উভয় ক্ষেত্রেই দুর্নীতিগ্রস্ত ও বিপথগামী হওয়ার আশংকা থাকে।

দুই. আল্লাহর নবী-রাসূলগণ শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন না বরং তারা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নানা সমস্যার বিষয়েও সজাগ দৃষ্টি রাখতেন । তারা সমাজকে বিভ্রান্তির পথ থেকে রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতেন।

তিন. সঠিক উপায়ে আয়-উপার্জন করতে হবে এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে নীতিবান হতে হবে। এটা ঈমানেরই অংশ।

সূরা আ'রাফের ৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَا تَقْعُدُوا بِكُلِّ صِرَاطٍ تُوعِدُونَ وَتَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ مَنْ آَمَنَ بِهِ وَتَبْغُونَهَا عِوَجًا وَاذْكُرُوا إِذْ كُنْتُمْ قَلِيلًا فَكَثَّرَكُمْ وَانْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ (86(

"যারা তাঁর [আল্লাহ্‌র] প্রতি ঈমান এনেছে, তাদের ভয় দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় তাদের বাঁধা দেয়ার জন্য পথে-ঘাটে বসে থাকবে না। এবং তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করবে না। স্মরণ কর, তোমরা [সংখ্যায়] কত কম ছিলে এবং তিনি তোমাদের [সংখ্যা] বৃদ্ধি করেছেন। লক্ষ্য কর অশান্তি সৃষ্টিকারীদের শেষ পরিণাম কী রকম হয়।" (৭:৮৬)

শোয়েব (আ.)এর সম্প্রদায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে মুমিন ব্যক্তিদের হুমকি ও কষ্ট দিত। হযরত শোয়েব (আ.) মাদইয়ান সম্প্রদায়ের লোকজনকে সমাজের জন্য কল্যাণকর রীতি-নীতি মেনে চলতে আহ্বান জানাতেন। তিনি ঈমানদার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও খুন-রাহাজানিতে লিপ্ত না হওয়ার পরামর্শ দিতেন এবং আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। তিনি বলতেন, আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাক। তোমরা তো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ছিলে, কিন্তু আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তোমরা শক্তি অর্জন করতে পেরেছো। সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, খারাপ কাজ থেকে বিরত থাক এবং অতীতের লোকজনের পরিণতি থেকে শিক্ষা নাও। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পরিণতি ভালো হয় না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. ঐশি ধর্মের শত্রুরা সব সময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে এবং মুমিন ব্যক্তিদের বিভ্রান্ত করার জন্যে সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করে।

দুই. মানুষকে সঠিক পথে আসতে উৎসাহিত করার একটি পন্থা হলো, আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং পূর্ববর্তীদের পরিণতির কথা বর্ণনা করা।