সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ভীতি ও অজ্ঞতার ভূমিকা
অপর একটি ভুল ধারণা,যা কোন কোন সমাজতান্ত্রিকের পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে,তা হল এই যে,খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসসমূহ বিপদের প্রভাব বিশেষকরে,ভূমিকস্প,বজ্রপাত ইত্যাদি থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ স্বীয় মানসিক শান্তির জন্যে খোদা নামক এক কাল্পনিক অস্তিত্বকে (العیاذ بالله ) সৃষ্টি করেছে এবং তার উপাসনায় আত্মনিয়োগ করেছে। সুতরাং এ ধারণামতে প্রাকৃতিক ঘটনাসমূহের উৎপত্তির কারণ এবং ঐগুলো থেকে নিরাপদে থাকতে পারার পদ্ধতি যতবেশী আবিস্কৃত হবে খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসও ততটা দুর্বলতর হতে থাকবে ।
মার্কসবাদিরা আরও বাগাড়ম্বরপূর্ণতা সহকারে স্বীয় পুস্তকসমূহে এ বিষয়টিকে সমাজতন্ত্র— বিজ্ঞানের অর্জিত বিষয় বলে উল্লেখ করে থাকেন এবং মূর্খ ব্যক্তিদেরকে প্রতারণা করার জন্যে এটি একটি কৌশলমাত্র বলে মনে করে থাকেন ।
উত্তরে বলা উচিৎ
প্রথমতঃ এ ভুলধারণার উৎস হল কোন কোন সমাজতত্ত্ববিদের অনুমান এবং এর সপক্ষে যথোপযুক্ত কোন তাত্বিক যুক্তি নেই ।
দ্বিতীয়তঃ অধুনা অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিই,যারা প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ সম্পর্কে অন্য সকলের চেয়ে বেশী অভিজ্ঞ ছিলেন ও আছেন এবং এমতাবস্থায় খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কেও তারা সন্দেহাতীত ও দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতেন এবং করছেন।১৫ অতএব খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাস যে,ভীতি ও অজ্ঞতারই ফল,এমনটি হতে পারে না ।
তৃতীয়তঃ কোন কোন প্রাকৃতিক ঘটনা থেকে উৎসারিত ভীতি ও তাদের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে অজ্ঞতাই যদি খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসের কারণ হয়েও থাকে,তথাপি তার অর্থ এ নয় যে,খোদাভীতি ও অজ্ঞতার সৃষ্টি।
এমন অনেক মানসিক প্রবণতা আছে,যেমন : সৌন্দর্যপ্রিয়তা,খ্যাতি লাভেচ্ছা ইত্যাদি,যা তাত্ত্বিক,প্রকৌশলিক ও দার্শনিক গবেষণার কারণ হয়ে থাকে । অথচ তা ঐ গুলোর বিশ্বস্ততাকে কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না।
চতুর্থতঃ যদি কেউ খোদাকে অজ্ঞাত কারণবিশিষ্ট বিষয়সমূহের অস্তিত্বদাতা হিসেবে শনাক্ত করে থাকেন এবং ঐগুলোর প্রাকৃতিক কারণ আবিস্কৃত হওয়ার পর যদি তাদের বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়ে তবে এটাকে তাদের বিশ্বাসেরই দুর্বলতা বলে মনে করতে হবে,যা খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসের অবৈধতার প্রমাণ নয় । কারণ প্রকৃতপক্ষে জাগতিক বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে খোদার কারণত্ব,প্রাকৃতিক কারণের মত নয় ও তাদের সামন্তরিক কোন কারণও নয় । বরং এ কারণত্ব সকল কারণের উর্ধ্বে ও সমুদ্বয় বস্তুগত এবং অবস্তুগত কারণের উলম্বে অবস্থান করে । সুতরাং প্রাকৃতিক কারণের শনাক্তকরণ বা না করণ,একে গ্রহণ বা বর্জনের ক্ষেত্রে কোন প্রকার প্রভাব ফেলে না ।
কার্যকারণবিধি কি একটি সার্বিক বিধি ?
অপর একটি ভুলধারণা,যা কোন কোন পাশ্চত্য চিন্তাবিদ উল্লেখ করেছেন তা হল : যদি কার্যকারণ বিধির সার্বিকতা থেকে থাকে তবে খোদার জন্যেও কোন কারণকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। অথচ মহান আল্লাহ হলেন প্রারম্ভিক কারণ,যার অস্তিত্ব কোন কারণের উপর নির্ভরশীল নয়। অতএব কারণবিহীন খোদাকে স্বীকার করার অর্থ হল কার্যকারণ বিধির পরিপন্থি এবং এ বিধির সার্বজনীনতার ব্যতিক্রম কোন বিষয়ের স্বীকৃতি প্রদান । অপরপক্ষে যদি এ বিধির সার্বজনীনতাকে অস্বীকার করি,তবে অনিবার্য অস্তিত্বকে প্রমাণের জন্যে এ বিধিকে প্রয়োগ করতে পারব না । কারণ,হয়ত কেউ বলতে পারেন যে,বস্তুমূল অথবা শক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং কোন কারণের সাহায্য ব্যতিরেকেই অস্তিত্বে এসেছে। অতঃপর এর পরিবর্তন ও বিবর্তনের মাধ্যমেই অন্য সকল বিষয়বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে ।
এ ভুলধারণাটি (যেমনটি ৭ম পাঠে বর্ণিত হয়েছে) কার্যকারণ বিধির অপব্যাখ্যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ এরূপ চিন্তা করেছেন যে,উল্লেখিত বিধিটির প্রকৃত ভাবার্থ হল‘ সকল কিছুই কারণের উপর নির্ভরশীল’। অথচ এর সঠিক ব্যাখ্যা হল‘ প্রতিটি সম্ভাব্য অস্তিত্ব বা নির্ভরশীল অস্তিত্বই কারণের উপর নির্ভরশীল’। এ বিধিটি এমন এক বিধি,যা সার্বজনীন ও ব্যতিক্রমতা বর্জিত।
আবার যদি মনে করা হয় যে,বস্তুমূল ও শক্তি কোন কারণ ব্যতীতই অস্তিত্বে এসেছে এবং তার বিবর্তনেই অন্য সকল কিছু সৃষ্টি হয়েছে;তাহলে তার জন্যে অনেক প্রশ্ন ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। পরবর্তীতে আমরা এ সম্পর্কে আলোচনা করব বলে আশা রাখি ।
অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সংগ্রহ
অপর একটি ভুলধারণা হল এই যে,বিশ্ব ও মানুষের জন্যে কোন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস,আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন কোন বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় । যেমন : রসায়নে প্রমাণিত হয়েছে যে,বস্তু ও শক্তির মোট পরিমাণ সর্বদা ধ্রুব এবং কোন কিছুই অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আসেনা। অনুরূপ কোন অস্তিত্বই সম্পূর্ণরূপে বিনাশিত হয়ে যায় না। অথচ খোদার উপাসকগণ বিশ্বাস করেন যে,খোদা সৃষ্ট বিষয়সমূহকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন ।
অনুরূপ জীববিজ্ঞানে প্রতিপাদিত হয়েছে যে,জীবন্ত অস্তিত্ব নির্জীব অস্তিত্ব থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে বিবর্তন ও বিকাশের মাধ্যমে মানবীয় রূপ লাভ করেছে । অথচ খোদার উপাসকগণ বিশ্বাস করেন যে,খোদা তাদের প্রত্যেকটিকে স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করেছেন ।
উত্তরে বলতে হবে
প্রথমতঃ বস্তু ও শক্তির নিত্যতাসূত্র হল,একটি তাত্ত্বিক ও অভিজ্ঞতালব্ধ পদ্ধতি যা শুধুমাত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপযোগী বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সুতরাং উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় নিম্নলিখিত দার্শনিক বিষয়টির সমাধান করা সম্ভব নয়। যথা : পাদার্থ এবং শক্তি কি অনাদি ও অনন্ত হতে পারে ?
দ্বিতীয়তঃ মোট পদার্থ ও শক্তির পরিমাণ ধ্রুব ও চিরন্তন হওয়ার অর্থ,সৃষ্টিকর্তার উপর অনির্ভরশীলতা (সৃষ্টির জন্যে) নয়। বরং পৃথিবীর বয়ঃসীমা যত দীর্ঘতর হবে,সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার নির্ভরশীলতাও ততবেশী হবে। কারণ কার্যের (Effect) কারণের (Cause) উপর নির্ভরশীলতার মানদণ্ড হল তার (কার্যের) সম্ভাব্যতা ও সত্তাগত নির্ভরশীলতা -সৃষ্টি ও কালের সীমাবদ্ধতায় নয়। অন্য কথায় : পদার্থ ও শক্তি হল বিশ্বের বস্তুগত কারণ,কর্তকারণ নয় এবং তারাও স্বয়ং কর্তকারণের উপর নির্ভরশীল।
তৃতীয়ত : পদার্থ ও শক্তির পরিমাণ ধ্রুব হওয়ার অর্থ,নতুন কোন সৃষ্টির আবির্ভাব ও হ্রাস-বৃদ্ধির ব্যতিক্রম নয়। অপরপক্ষে আত্মা (روح ) ,জীবন (حیات ) চেতনা (شعور ) ও প্রত্যয় ইত্যাদি বিষয়গুলো পদার্থ ও শক্তির মত কোন বিষয় নয় যে,তাদের হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে পদার্থ ওশক্তির নিত্যতা সূত্রের পরিপন্থী কোন ঘটনা ঘটবে।
চতূর্থত : বিবর্তনের ধারণাটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো যথেষ্ট স্বীকৃতি পায়নি। বরং অধিকাংশ বিজ্ঞ -মনীষী কর্তৃক পরিত্যাজ্যও হয়েছে। এ ধারণাটির সাথে খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসের কোন বিরোধ নেই । সর্বোচ্চ হলেও তা শুধুমাত্র জীবন্ত অস্তিত্বসমূহের মধ্যে একপ্রকার সহায়ক কারণত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে -অস্তিত্বদাতা প্রভুর সাথে অস্তিত্বময়ের সস্পর্ককে নিষেধ করে না । আর এর প্রমাণ হল এই যে,এ ধারণারই অনেক সমর্থক,বিশ্ব ও মানুষের জন্যে এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব আছে বলে বিশ্বাস করতেন এবং করেন ।