প্রেম ও ভালবাসার মতাদর্শ (আত্মপরিচিতির মতবাদ)
পূর্ণ মানব সম্পর্কিত অন্য আরেকটি মতবাদ যাকে প্রেম ও ভালবাসার মতবাদও বলা যায়। কয়েক হাজার বছর পূর্বে পূর্ব-এশিয়ায় চিন্তা ও জ্ঞানের উচ্চ পর্যায়ের চর্চা ছিল। অনেক পুরাতন ভারতীয় গ্রন্থ (ফার্সী ভাষায়ও অনুবাদ হয়েছে) যেমন‘ উপনিষদ’ এ ধরনের উচ্চ মার্গের গ্রন্থ।’
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আল্লামা তাবাতাবায়ী কয়েক বছর পূর্বে যখন প্রথম‘ উপনিষদ’ পড়েছিলেন তখন মন্তব্য করতেন,প্রচুর মূল্যবান কথা এ গ্রন্থে আছে,কিন্তু কমই এ গ্রন্থের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।
এ মতাদর্শে মানুষের পূর্ণতার কেন্দ্রবিন্দু হলো আত্মপরিচয়। এ মতাদর্শ বলে,‘ নিজেকে জান’ । অবশ্যই নিজেকে জান- এটা সক্রেটিসও বলেছেন,সকল নবীও বলেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন,“ যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে তার প্রতিপালককে চিনতে পেরেছে।” কিন্তু এ মতাদর্শে যে বিষয়ের প্রতিই কেবল দৃষ্টি দেয়া হয়েছে তা হলো আত্মপরিচয়।
মহাত্মা গান্ধীর লেখা কিছু প্রবন্ধ ও পত্র‘ এটাই আমার ধর্ম’ শিরোনামে ফার্সীতে গ্রন্থাকারে ছাপানো হয়েছে। এ অনুবাদ গ্রন্থটি আমার মতে বেশ ভালো। গান্ধী এ গ্রন্থে বলেছেন,“ আমি উপনিষদগুলো পড়ে তিনটি মৌলিক বিষয় পেয়েছি যা আমার সারা জীবনের দিক-নির্দেশনা হিসেবে রয়েছে।” প্রথম মৌল বিষয় যা গান্ধী উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে পৃথিবীতে শুধু একটি সত্য রয়েছে,তা হলো নিজেকে চেনা ও জানা।‘ নিজেকে জান’ এ বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই গান্ধী সুন্দরভাবে পাশ্চাত্যের উপর হামলা করেছেন। তিনি বলেছেন,“ পাশ্চাত্য বিশ্বকে জেনেছে,কিন্তু নিজেকে চিনেনি। যেহেতু নিজেকে চিনেনি তাই নিজেও যেমন দুর্ভাগা হয়েছে বিশ্বকেও দুর্ভাগ্যে নিপতিত করেছে।” তার এ কথা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ও খুবই সুন্দর।
দ্বিতীয় মৌল বিষয় : যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে স্রষ্টাকেও চিনতে পেরেছে। সে সুবাদে সব কিছুকেই চিনতে পেরেছে।
তৃতীয় মৌল বিষয় : শুধু একটি শক্তিরই অস্তিত্ব রয়েছে আর তা হলো নিজের উপর পূর্ণ আধিপত্যও নিয়ন্ত্রণ। যে কেউ নিজের অধিপতি হবে অন্য সকল কিছুর উপরও আধিপত্য লাভ করবে। বিশ্বে একটি পুণ্য কাজ রয়েছে। আর তা হলো ভালোবাসা,অন্যদেরকে ভালোবাসা যেমনভাবে মানুষ নিজেকে ভালোবাসে। অন্যভাবে বললে অন্যদেরকেও নিজের মত করে দেখতে হবে।
তাদের ভাষায় পরিচিতি অর্থ আত্মপরিচয়। নিশ্চয়ই জানেন,হিন্দু দর্শনে মোরাকাবা বা আত্মনিয়ন্ত্রণ,নিজের মধ্যে নিমজ্জিত হওয়ার বিষয়টির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে (যদিও এখন এই আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্যে যোগীদের কঠিন অনুশীলন ও অন্যান্য বিষয় যোগ হয়েছে সেগুলো আমার উদ্দেশ্য নয়)। হিন্দু দর্শনের মূলে আত্মপরিচয়,আত্মনিয়ন্ত্রণ,নিজেকে উদ্ঘাটনের মাধ্যমে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।
সুতরাং এ মতবাদের মতে পূর্ণ মানব হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেকে চিনেছে। যখন সে নিজেকে চিনবে তখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে। আর যখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে তখন অন্যদেরকে ভালোবাসতে শুরু করবে। এখন এ মতবাদকে আমরা আত্মপরিচিতির মতবাদও বলতে পারি,আবার প্রেম ও ভালবাসার মতবাদও বলতে পারি।