বিভিন্ন মতাদর্শের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানব
) هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ(
যে কোন মতাদর্শের প্রবক্তা যখনই কোন মতাদর্শ উপস্থাপন করেছেন একই সঙ্গে তার নিজের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানবের অথবা মানুষের পূর্ণত্বের বিষয়টিও উপস্থাপন করেছেন। ঐ বিষয়কে‘ আখলাক’ বলা হয়। তাদের মতে‘ আখলাখ’ বা নৈতিকতা জ্ঞান নয়; বরং শিল্প বা কৌশল। অর্থাৎ আখলাক কিরূপ হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা করে। বাস্তবে মানুষ কিরূপ অবস্থায় বিরাজ করছে তা আখলাকের বিষয়বস্তু নয়। সামগ্রিক যে বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের মধ্যে থাকা উচিত বা যে বৈশিষ্ট্যগুলো লাভ করলে সে সর্বোত্তম মানুষে পরিণত হবে ও বলা যাবে যে,সে মানবিকতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে সেটাই পূর্ণ মানবের প্রতিকৃতি।
বৃদ্ধিবৃত্তিক ( আকলগত) মতাদর্শ
বিভিন্ন মতাদর্শের প্রবক্তাদের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেল সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিকে কয়েকটি মৌলিক ভাগে ভাগ করা যায়। তার একটি বুদ্ধিবৃত্তি বা আকল ভিত্তিক মতাদর্শ। যারা খুব বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষকে দেখেন তারা এ দলের অন্তর্ভুক্ত। তারা মানুষের মূল উপাদান‘ আকল’ ব্যতীত অন্য কিছু নয় বলে মনে করেন। বুদ্ধিবৃত্তি অর্থ চিন্তাশক্তি বা চিন্তা করার ক্ষমতা। অতীতের দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই,যেমন বু আলী সিনা এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তারা চিন্তা করতেন,প্রজ্ঞাবান মানুষই পূর্ণ মানুষ এবং মানুষের পূর্ণতা তার প্রজ্ঞার মধ্যে নিহিত।
প্রজ্ঞা বলতে তারা কি বুঝাতেন? প্রজ্ঞা বলতে কি তারা যাকে আমরা বর্তমানে বিজ্ঞান বলি তা বুঝতেন? না,বরং তারা প্রজ্ঞা বলতে (ব্যবহারিক নয় তত্ত্বগত প্রজ্ঞা) অস্তিত্ব জগৎ থেকে সামগ্রিক যেরূপটি আমরা বুঝি তা-ই বুঝতেন। এটা বিজ্ঞান নয়,যেহেতু বিজ্ঞান অস্তিত্বের একটি অংশের প্রতিচ্ছবি মাত্র। যাতে করে দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার হয এজন্য একটি উদাহরণ পেশ করছি।
ধরুন,আপনি তেহরান শহর সম্পর্কে ধারণা পেতে চান। দু’ ভাবে আপনি এ ধারণা পেতে পারেন। প্রথমত আপনি তেহরান সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভ করতে পারেন,কিন্তু অস্পষ্ট। দ্বিতীয়ত আপনার ধারণা আংশিক,তবে নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট। কখনো তেহরান সম্পর্কে আপনার ধারণা পৌরসভার একজন প্রকৌশলীর মতো। তাকে বলেন তেহরান শহরের একটা মানচিত্র আঁকুন। তিনি আপনার জন্য হয়তো একটি মানচিত্র আঁকবেন যার মধ্যে শহরের মহল্লা,পথগুলো,চৌরাস্তা,পার্ক ইত্যাদি মোটামুটি অধিকভাবে কাগজের উপর এঁকে দেখাবেন। যেমন এখানে নিয়াভারন,ওখানে তাজরিস,ওপাশে শাহ আবদুল আজিম ইত্যাদি অর্থাৎ তেহরান সম্পর্কে একটা সাধারণ ও সার্বিক ধারণা আপনাকে দেবেন,কিন্তু এ ধারণা স্পষ্ট নয়। যদিও তিনি সম্পূর্ণ তেহরানের বিষয়ে আপনাকে তথ্য দিয়েছেন এবং সমগ্র তেহরানের মানচিত্র আপনার জন্য এঁকেছেন,কিন্তু তাতে আপনি আপনার বাড়ীটি যা এ শহরে রয়েছে তা খুজে পাবেন না। ঐ প্রকৌশলীও তা বলতে পারবেনঁ না।
কিন্তু কোন এক ব্যক্তি হয়তো জানেন না তেহরানের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ কত,কতটি চৌরাস্তা ও রাজপথ রয়েছে; তেহরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো কোথায়,এ শহরে কতটি পাহাড় রয়েছে,কিন্তু এ শহরের কোন এক বিশেষ এলাকা বা মহল্লার বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ঐ এলাকার বর্ণনা সে আপনাকে দান করবে। যেমন এ মহল্লায় কতটি গলি রয়েছে,গলিগুলোর মধ্যে কোন সংযোগ আছে কিনা,প্রতি গলিতে কতটি বাড়ী রয়েছে,এমনকি দালানগুলোর কোনটি হলুদ,কোনটি সাদা,কোনটি লাল রংয়ের সবই সে জানে।
যদি ঐ প্রকৌশলী যিনি এ শহর সম্পর্কে সার্বিক ধারণা রাখেন তাকে এ মহল্লার গলিগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন করেন তাহলে দেখবেন তিনি হয়তো এর কিছুই জানেন না। এ শহরের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কেও তার জানা নেই।
দার্শনিক তাকেই বলা হয় যিনি অস্তিত্ব জগতের ব্যাপারে সার্বিকভাবে গবেষণা ও পড়াশোনা করেন। তিনি অস্তিত্বের মূলকে জানতে চান,এর সমাপ্তি কোথায় তা জানতে চান- জানতে চান এ অস্তিত্ব জগতের উপর ক্রিয়াশীল সার্বিক কানুনগুলো কি। কিন্তু এই দার্শনিককে যদি আপনি বিশেষ কোনবৃক্ষ,প্রাণী বা খনিজ অথবা পৃথিবী ও সূর্যের বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রশ্ন করেন হয়তো দেখবেন তিনি কোন তথ্যই জানেন না।
দার্শনিকের নিকট প্রজ্ঞার অর্থ অস্তিত্ব জগৎ সম্পর্কে সার্বিক ধারণা। বিশ্ব জগৎ সম্পর্কে যে সার্বিক ধারণা একজন বিজ্ঞের মানসপটে প্রতিফলিত হয় অথবা সমগ্র অস্তিত্ব জগৎ যে অস্পষ্টরূপে কোন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিতে ধরা দেয় সেটাই দার্শনিকের জ্ঞান। একজন দার্শনিকের দৃষ্টিতে মানুষের পূর্ণতা এটাই যে,সে সমগ্র অস্তিত্ব জগতকে তার বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রতিফলিত করবে। তার এ জ্ঞান আংশিক নয় যে,অস্তিত্ব জগতের এক অংশ সম্পর্কে সে জ্ঞাত অন্য অংশ সম্পর্কে নয়। এ বিষয়টিকে তারা এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন,
صیروة الإنسان عالما عقلیا مضاهیا العینی
বাস্তব পৃথিবীর অনুরূপ বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বের মানুষ হওয়া অর্থাৎ মানুষ বহির্বিশ্বের বিপরীতে নিজে একবিশ্ব হবে। তবে ঐ বহির্বিশ্ব হলো বাস্তব বিশ্ব,আর মানুষের ভেতরের বিশ্ব হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্ব।
“ যে কেউ জ্ঞান করেছে আহরণ
এক বিশ্ব তারই অনুরূপ করেছে ধারণ।”
কবিতার এ ছত্র এটাই বলতে চায়।
দর্শনের ধারণায় পূর্ণ মানব তিনিই যার বুদ্ধিবৃত্তি পূর্ণতায় পৌছেছে এ অর্থে যে,অস্তিত্ব জগতের আকৃতি ও প্রকৃতি তার বুদ্ধিবৃত্তিতে পূর্ণরূপে ধরা দিয়েছে। কিন্তু কিসের মাধ্যমে? চিন্তার মাধ্যমে,দলিল-প্রমাণ ও যুক্তির মাধ্যমে সে এখানে পৌছেছে।
কিন্তু দর্শন এখানেই পরিতৃপ্ত নয়। তারা বলেন প্রজ্ঞা দু’ ধরনের : এক,তত্ত্বগত প্রজ্ঞা অর্থাৎ বিশ্বজগতের পরিচয় লাভ যেভাবে আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি; দুই,ব্যবহারিক প্রজ্ঞা। ব্যবহারিক প্রজ্ঞা কি? ব্যবহারিক প্রজ্ঞা (ব্যবহারিক প্রজ্ঞাও বুদ্ধিবৃত্তির সাথে সম্পর্কিত) হলো মানুষের সকল প্রবৃত্তি,শক্তিও ক্ষমতার উপর বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ। (আমাদের নৈতিকতা সম্পর্কিত গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন’ করলে দেখবেন,নৈতিকতার আলোচনাগুলো‘ সক্রেটিয় নৈতিকতা’ । সক্রেটিয় নৈতিকতায় সব সময়ই বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করা হয়েছে। যেমন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি তার প্রবৃত্তির উপর প্রাবল্য লাভ করেছে নাকি প্রবৃত্তি বুদ্ধিবৃত্তির উপর?) যদি আপনি তাত্ত্বিক প্রজ্ঞায় চিন্তা ও যুক্তির মাধ্যমে যেমন ভাবে বলা হয়েছে ঠিক তেমনভাবে বিশ্বকে আপনার চিন্তার জগতে প্রতিফলিত করতে পারেন সে সাথে ব্যবহারিক প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে আপনার বুদ্ধিবৃত্তিকে নাফ্স বা প্রবৃত্তির উপর বিজয় দান করতে পারেন এমনভাবে যে,আপনার প্রবৃত্তি ও কামনা বুদ্ধিবৃত্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে তখন আপনাকে পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেল বলা যাবে। এই মতবাদকে আকলের মতবাদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞার মতবাদ বলা হয়। পরবর্তী বৈঠকগুলোতে এ মতবাদগুলো সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করব। প্রথমে মতবাদগুলোকে ব্যাখ্যা করব। অতঃপর ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা রাখব।
প্রেম বা ভালবাসার মতাদর্শ
পূর্ণ মানব সম্পর্কিত অন্যতম মতবাদ হলো প্রেম বা ভালবাসার মতবাদ। প্রেমের মতবাদ যাকে এরফানও বলা হয়। এ মতবাদ মানুষের পূর্ণতাকে প্রেম বলে জানে। প্রেম বলতে এখানে স্রষ্টা বা আল্লাহ্ তায়ালার প্রতি ভালবাসা বোঝানো হয়েছে। মানুষকে জানতে হবে প্রেম কিভাবে তাকে সেই মহাসত্যের নিকট পৌছে দেয়। বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ গতির মতবাদ নয়,বরং চিন্তাগত মতবাদ (প্রজ্ঞাবান দার্শনিক গতির কথা বলেন না,বরং তার ধারণায় সকল গতিই চিন্তাগত)। এর বিপরীতে প্রেমের মতবাদ গতির মতবাদ। কিন্তু এ গতি সমান্তরাল নয়,বরং লম্বিক ও আরোহ গতি। প্রাথমিকভাবে মানুষ যখন পূর্ণতায় পৌছতে চায় তার গতি ঊর্ধ্ব বা আরোহী হওয়া উচিত অর্থাৎ আল্লাহর দিকে আরোহণ ও উড্ডয়ন।
তারা বিশ্বাস করেন এখানে চিন্তা,বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তির অবকাশ নেই। এখানে শুধু আত্মার কার্যক্রমও গতি রয়েছে এবং আত্মার এ গতি আল্লাহ্য় গিয়ে পৌছে। সমস্যা এখানেই সৃষ্টি হয়েছে যে,‘ মানুষ আল্লাহর নিকট পৌছায়’ - এর অর্থ কি? যদিও তারা তাদের এ বাণীকে বিভিন্ন স্থানে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন,কিন্তু সে সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক মতাদর্শের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
আমাদের (ফার্সী) সাহিত্যের খুবই আকর্ষণীয় একটি আলোচনা বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রেমের দ্বন্দ্ব নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। মূলত আরেফরা এ বিষয়টি নিয়ে অধিক আলোচনা রেখেছেন এবং সব সময়ই প্রেমকে বুদ্ধিবৃদ্ধির উপর বিজয়ী ঘোষণা করেছেন।
খোদাপ্রেমের মতবাদ মানুষের পূর্ণতায় পৌছার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকে যথেষ্ট বলে মনে করে না। তারা বলেন,বুদ্ধিবৃত্তি মানুষের অস্তিত্বের একটি অংশ মাত্র- পূর্ণ অস্তিত্ব নয়। চক্ষু যেমন মানুষের অন্যতম মাধ্যম,বুদ্ধিবৃত্তিও তাই। মানুষের সত্তা তার বুদ্ধিবৃত্তি নয়,বরং মানুষের সত্তা হলো তার আত্মা এবং আত্মা খোদাপ্রেমের প্রতিভূ- যেখানে তার প্রতি যাত্রা ব্যতীত অন্য কিছুই নেই। এ কারণেই এ মতবাদে বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিকে সমালোচনা করা হয়। কবি হাফেজ এ বিষয়টি সুন্দরভাবেবর্ণনা করেছেন-
“ প্রেমের শরাব পেতে চাই আমি আকলের মূল্যে
সেই তো ধন্য যে এ ব্যাবসা করলে।”
আরেফগণ সব সময়ই প্রেমাকুল হওয়াকে বুদ্ধিবৃদ্ধির উপর প্রাধান্য দেন। তাদের নিজস্ব কিছু বক্তব্য ও কথা রয়েছে। তাদের নিকট একত্ববাদের বিশেষ অর্থ রয়েছে,একত্ববাদ তাদের নিকট অস্তিত্বসমূহের একতা (ওয়াহ্দাতে উজুদ)। এ একত্ববাদ এমন যে,যদি কোন মানুষ সেখানে পৌছায় তাহলে সব কিছুরই অন্য রকম অর্থ অনুভব করে। এ মতবাদে পূর্ণ মানব অবশেষে খোদার অনুরূপ হয়ে যায়। তাদের ভাষায় প্রকৃত পূর্ণ মানব খোদ স্রষ্টা এবং যে মানুষই কামেল মানুষ হয়,নিজে বিলীন হয়ে খোদায় পৌছায়। এ মতবাদ সম্পর্কে আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব।