7- হযরত যয়নাব (আ.) আত্মত্যাগ,ধৈর্য ও দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি :
হযরত যয়নাবের মত এক মহিয়সী নারীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমরা কথা বলতে অক্ষম । কেননা তিনি হযরত ফাতিমার (আ.) গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর হাতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন , আর আলী (আ.)-এর মত পিতা ও ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইনের মত ভাই যার ছিল । তবে আমরা এখানে আমাদের এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু সম্ভব তাই উল্লেখ করার চেষ্টা করবো ।
যে সমস্যা ও কষ্ট তার উপর এসেছিল তা যদি কোন পাহাড়ের উপর আসতো তবে পাহাড় ঐ সমস্যা ও কষ্টের ভারে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যেত । এই ধরনের এক মহিয়সী নারীর ব্যক্তিত্বকে কয়েকটি দিক থেকে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন ।
ক)- নিজের ইমাম বা নেতাকে সাহায্য করা :
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি তাকে প্রাণপণে সাহায্য করেছিলেন । ইমাম হুসাইনকে তিনি এত অধিক ভালবাসতেন যে , যখন তাঁর চাচাত ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জা ’ ফর তাইয়ার তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যে , আমি একটি শর্তে এ বিয়েতে রাজী হব তা হচ্ছে আমার ভাই হুসাইন যখনই কোন সফরে যাবে আমাকেও তাঁর সাথে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে । যেহেতু আবদুল্লাহ্ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একজন ভক্ত ছিল তাই সে এ কথা মেনে নিল । হযরত যয়নাব (আ.) ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পরে , অসুস্থ ইমাম সাজ্জাদের সেবা-শুশ্রুষা করেন । আর যতবারই শত্রুপক্ষ ইমাম সাজ্জাদকে (আ.) হত্যা করতে এসেছিল ততবারই তিনি তাঁকে আগলে রেখেছিলেন এবং শত্রুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন : যদি তোমরা তাকে হত্যা করতে চাও তবে প্রথমে আমাকে হত্যা কর ।
সাধারণত যে পুরুষ ও নারীই বেলায়াত ও ইমামতের পক্ষে কথা বলেছে তারাই কষ্ট , লাঞ্ছনা ও অপবাদের শিকার হয়েছে । যেমন : হযরত মারিয়ামকে ঈসা (আ.)-এর জন্য ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হয় , হযরত আসিয়া হযরত মূসা (আ.)-কে সাহায্য করতে গিয়ে এবং তাঁর উপর ঈমান আনাতে ফিরাউনের অত্যাচারের শিকার হয়ে শহীদ হন ।
হযরত ইব্রাহীম ও হযরত মূসা (আ.)-কে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের মাতাদের কত কষ্টই না পোহাতে হয়েছিল । রাসূল (সা.) কে সাহায্য করতে গিয়ে হযরত খাদিজাহ (আ.)কতই না কষ্ট পেয়েছিলেন । ইমাম আলী (আ.)-এর ইমামতের পক্ষে কথা বলার কারণে হযরত ফাতিমাকে (আ.) দরজা ও দেয়ালের মধ্যে পিষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হয়ে জীবন দিতে হয়েছে । তদ্রূপ ইমাম হুসাইন -কে সাহায্য করতে গিয়ে 55 বছর বয়সে হযরত যয়নাবকেও নিদারুণ কষ্টের শিকার হতে হয়েছে ।
খ)- শহীদদের সন্তানদেরকে দেখা-শুনা করা :
হযরত যয়নাব (আ.) কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার পরে , অভিভাবকহীন ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে দেখা-শুনা করতেন । তিনি নিজে না খেয়ে তাদেরকে খাওয়াতেন । যেহেতু বাচ্চারা তাদের পিতার জন্য কান্নাকাটি করতো , তাই তিনি তাদেরকে খুব বেশী মাত্রায় আদর করতেন এবং সান্ত্বনা দিতেন । আর এ দায়িত্বটি তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সুন্দরভাবে পালন করেছিলেন ।
গ)- ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর :
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পরে , তিনি যেখানেই যেতেন এবং যখনই সুযোগ পেতেন তখনই কারবালার শহীদদের বার্তা পৌঁছে দিতেন এবং জালিম ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করতেন । যদি হযরত যয়নাব না থাকতেন তবে ইসলামের শত্রুরা কারবালার ঘটনাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতো । তিনি নিজের চেষ্টায় কারবালার জালিম ও অত্যাচারীদের মুখোষ উম্মোচন করেন । আর এই পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগ চূড়ান্তে পৌঁছায় । যদি তাঁর উৎসর্গতা ও সাহসিকতা না থাকতো তাহলে শত্রুরা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) -কে হত্যা করতো এবং ইসলামের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিত । প্রকৃতপক্ষে ইমাম হুসাইন (আ.) শত্রুর বিরুদ্ধে কিয়াম করেছিলেন আর হযরত যয়নাব (আ.) ঐ কিয়ামের ধারাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন ।
ঘ)- হযরত যয়নাবের সাহসিকতা :
ফাসেক , অভিশপ্ত , মদখোর ও লম্পট ইবনে যিয়াদ তার প্রাসাদে বসে ছিল এবং ইমাম হুসাইন (আ.) -এর কাটা মাথাটি তার সামনে রাখা ছিল । সে হযরত যয়নাবকে (আ.) বলল : তোমার ভাইয়ের সাথে আল্লাহ্ যা করলেন তা কেমন দেখলে ? তিনি জবাবে বললেন
ﻣﺎﺭﺍﻳﺖ ﺍﻻ جمیلا আমি সুন্দর ছাড়া অন্য কিছু দেখি নি ।42 কেননা নবীর বংশধর এমন এক পরিবার যাদের জন্য আল্লাহ শাহাদাতকে মর্যাদা স্বরূপ করেছেন । আর তাঁরা স্বেচ্ছায়ই এ পথকে বেছে নিয়েছেন ।
হযরত যয়নাব এই কথার মাধ্যমে ইবনে যিয়াদকে এমনভাবে অপমান করলেন যে , যাতে করে সে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা নেয় ।
হযরত যয়নাব (আ.) শামে (সিরিযায়) ইয়াযিদের প্রাসাদে তাকে দারুণভাবে অপমান করলেন । তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : তুমি মনে করছো যে , আমাদেরকে বন্দী করে তোমার সম্মান বেড়েছে , তা নয় তারপর বললেন :“ আমি তোমাকে অনেক নীচ ও হীন মনে করি ।43
তিনি এই কথাটি ইয়াযিদকে এমন এক সময় বললেন যখন তাঁর এবং অন্যান্য বন্দীদের নিহত হওয়ার আশংকা ছিল । এমন কথা একজন নারীর পক্ষে ইয়াযিদের মত জালিম , অত্যাচারী , মদখোর , লম্পট লোকের সামনে কথা বলা কোন সহজ ব্যাপার নয় । হযরত যায়নাব তাকে এত বড় কথা বলার অর্থ এই যে , তিনি এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যা বুঝার ক্ষমতা আমাদের নেই ।
ঙ)- হযরত যয়নাবের ইবাদত :
কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনায় তার 6 জন ভাই যথা : ইমাম হুসাইন (আ.) , আব্বাস , জা ’ ফার , উসমান , আবদুল্লাহ্ ও মুহাম্মদ শহীদ হয়ে যাওয়া ছাড়াও তার দুই সন্তন আউন ও মুহাম্মদ এবং তার ভাইয়ের সন্তানগণ যথা : আলী আকবার , কাসিম , আবদুল্লাহ সহ চাচাত ভাইদের শহীদ হওয়ার ঘটনাকে স্বচক্ষে দেখেছিলেন । আর এদিকে ছোট ছোট শিশুরা উমর ইবনে সা ’ দ ও তার মত অপবিত্র লোকদের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছিল এবং যে কোন সময় ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর শহীদ হওয়ার আশংকা ছিল এরূপ কঠিন মুসিবতের সময়ও অর্থাৎ মুহররমের 10 তারিখের দিবাগত রাতেও তিনি তাহাজ্জুতের নামায আদায় করেন ।