26. কোরআন বিকৃত হয়নি :
আমরা বিশ্বাস করি : বর্তমানে যে কোরআন বিশ্ব মুসলমানের হাতে রয়েছে , এটা সেই কোরআন যা বিশ্বনবীর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। তাতে না কোন কিছু সংযোজন হয়েছে আর না তা থেকে কোন কিছু ঘাটতি হয়েছে। ওহী নাযিলের প্রথম থেকেই একদল ওহী লেখক কোরআনের আয়াত অবতীর্ণের পরপরই লিখে রাখতেন। আর মুসলমানদের কর্তব্য ছিল , দিন- রাত তা পাঠ করা। পাঁচ ওয়াক্তের নামাযসমূহে তা পুনঃপুনঃ তিলাওয়াত করা। বিরাট একদল লোক তা স্মরণ রাখতেন ও মুখস্ত করতেন। কোরআনের হাফেজ ও কারীদের একটা বিশেষ মর্যাদা সব সময়ই ইসলামী সমাজে বিদ্যমান ছিল ও আছে। এ কারণগুলো ও অন্যান্য আরও কিছু কারণ ছিল , যে জন্যে আল-কোরআনে সামান্যতম পরিবর্তন আনাও সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও মহান আল্লাহ্ নিজেই পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ কোরআনকে সংরক্ষণ করার দায়-দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন। মহান আল্লাহর এ জিম্মাদারী গ্রহণকরার কারণে কোরআনে পরিবর্তন ও বিচ্যুতি ঘটানো একেবারেই অসম্ভব। এ মর্মে আল্লাহ্ বলেন :
) إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ(
‘ আমরাই এ কোরআনকে অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষণ করব’ (সূরা : আল- হিজর , আয়াত নং 9)।
শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সমস্ত ওলামা ও গবেষকগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষন করেছেন যে , কোন প্রকার বিকৃতির হাত আজও কোরআনের দিকে বাড়েনি। উভয় মাযহাবেরই মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক কোরআনের তাহরিফ বা বিকৃতির পক্ষে কথা বলেছেন। তারা কয়েকটি হাদীসের প্রেক্ষিতে এ কথা বলেছেন। কিন্তু উভয় মাযহাবেরই বিজ্ঞ ওলামাগণ এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণ রূপে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং উক্ত হাদীসগুলোকে জাল বা কৃত্রিম হাদীস বলে মনে করেন। অথবা , সে বিকৃতি অর্থগত বিকৃতি হতে পারে অর্থাৎ কোরআনের আয়াতের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা কেউ দিয়েছেন। কিংবা কোরআনের মূল পরিভাষার ভুল বিশ্লেষণ করেছেন।
সীমিত চিন্তাশীল এসব লোকেরা -যারা কোরআনের বিকৃতি ঘটেছে বলে বিশ্বাস করে , তাদের এ বাড়াবাড়ি শিয়া ও সুন্নী উভয় পক্ষেরই বড় বড় বিজ্ঞ ও খ্যাতনামা ওলামাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত চিন্তাধারা। প্রকৃতপক্ষে এরা শিয়াও নয় সুন্নিও নয়। এরা কোরআনের উপর আঘাত হানে। এদের এ অন্যায় গোঁড়ামীর কারণে আল-কোরআনের উপর নির্ভরতার বিষয়টি প্রশ্নের সন্মুখীন করে তোলা এবং তা শত্রুদের চাপাকলে পানি ঢালারই নামান্তর।
ইতিহাস অধ্যয়ন করে দেখা যায় , কোরআন সংগ্রহ করার বিষয়টি স্বয়ং রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর জীবদ্দশায়ই এক অসাধারণ উদ্যোগ ছিল-মুসলমানদের লিপিবদ্ধ করা , মুখস্ত বা হেফ্জ করা , পুনঃ পুনঃ পাঠ বা বিশেষতঃ একদল ওহী লেখকের প্রথম থেকে লিপিবদ্ধ করে রাখা ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা এ সত্যটি সকলের জন্যেই স্পষ্ট ও পরিস্কার করে দেয় যে , কোরআনে বিকৃতি ঘটাবার ব্যাপারে হস্ত সম্প্রসারণ করা একটি অসম্ভব ব্যাপার ছিল। এ ছাড়াও সকলের নিকট পরিচিত এ কোরআন ব্যাতীত আর কোন কোরআনের অস্তিত্বও পরিলক্ষিত হয় না। এ দলিলটি একটি স্পষ্ট প্রমাণ। তা ছাড়া অনুসন্ধান ও গবেষণার দ্বার সবার জন্যেই উন্মুক্ত। কেননা , আজকে আমাদের ঘরে ঘরে , সমস্ত মসজিদসমূহে ও সমস্ত পাঠাগারগুলোতে সব দেশের কোরআন বর্তমান রয়েছে। এমনকি , হাতে লেখা কোরআনগুলো যা বহু শতাব্দীর পূরাতন এবং আমাদের যাদুঘর ও মিউজিয়াম গুলোতে সংরক্ষিত রয়েছে। এ সব কোরআন প্রমাণ করে দেয় যে , বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে প্রচলিত কোরআনটাই সে সব কোরআনেরই অনুরূপ। অতীতে যদি এ বিষয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান করার অবকাশ না থেকে থাকে তাহলে এখন তো সে পথ রূদ্ধ নয় বরং সবার জন্যেই গবেষণার পথ খোলা। সংক্ষিপ্ত গবেষণা দ্বারাই পরিস্কার হয়ে যায় যে“ কোরআন বিকৃতির কথাটি” ভিত্তিহীন ও অবৈধ। কোরআন নিজেই বলেছে :
) فَبَشِّرْ عِبَادِ (17) الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ(
‘ আমার সেই বান্দাদেরকে সুসংবাদ দিন যারা এ কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে , অতঃপর উত্তমভাবে তার অনুস্মরণ করে’ (সূরা : যুমার , আয়াত নং 17-18)।
আজকাল আমাদের হাওযায়ে ইলমিয়াসমূহে (দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে) ব্যাপকভাবে কোরআনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষাদান চলছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল : কোরআনে তাহ্রীফ বা বিকৃতি ঘটেনি।
27. কোরআন এবং মানুষের পার্থিব ও অধ্যাত্মিক চাহিদা :
আমরা বিশ্বাস করি : মানুষের পার্থিব ও অধ্যাত্মিক জীবন-যাপনের জন্যে যা কিছু প্রয়োজন , তার মৌলনীতিসমূহ এ কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। সরকার পরিচালনা , রাজনৈতিক বিভিন্ন দিক , অন্যান্য জাতির সাথে সম্পর্ক , সহাবস্থাননীতি , যুদ্ধ ও সন্ধি , বিচার ব্যবস্থা , অর্থনীতি ইত্যাদির বিধি-বিধান ও আইন-কানূন এ কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে , যা আমাদের জীবনযাত্রাকে বাঞ্চিত লক্ষ্যের দিকে পরিচালনার বিষয়টি উরল করে দিয়েছে।আল্লাহ্ বলেন :‘ আমরা এ কিতাবকে তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি-যা সকল বিষয়ের বর্ণনাকারী এবং মুসলমানদের জন্যে হেদায়েত স্বরূপ , রহ্মত ও সুসংবাদ বাহক’ (সূরা : আন নাহল আয়াত নং 89)।
এ কারণে আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে যে , ইসলাম কখনও রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি থেকে বিছিন্ন নয় এবং মুসলমানদেরকে এ মর্মে নির্দেশ দেয় যে , নিজ নিজ যুগের রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত কর ও এ কোরআনের সাহায্যে মহান ইসলামের মহামূল্যবান ঐতিহ্যকে উজ্জিবিত রাখ। আর ইসলামী সমাজকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দান কর যে , সাধারণ মানুষ যেন ন্যায়-ইনসাফ ও সুবিচার লাভ করতে পারে। এমনকি , ন্যায় বিচারের বিষয়টি যেনো বন্ধু ও দুশমন সকলের প্রতি সমভাবে কার্যকর হয়। যেমন :
‘ হে ঈমানদার লোকেরা! ন্যায়-ইনসাফকে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা কর। আর কেবলমাত্র খোদার জন্যেই সাক্ষ্য প্রদান কর। যদিও (তোমার সাক্ষ্য) তোমার নিজের অথবা তোমার পিতা- মাতার কিংবা আত্মীয়-স্বজনের ক্ষতির কারণ হয়’ (সূরা : আন-নিসা আয়াত নং 135)।
আল্লাহ্ বলেন :‘ কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের শক্রতা যেন তোমাদেরকে এ কাজে উদ্যত না করে যে , তোমরা ন্যায়-ইনসাফের নীতি অবলম্বন করবে না , ন্যায় বিচার কর , যা খোদা ভীতি ও পরহেযগারীর নিকটবর্তী’ ( সূরাঃ আল-মায়েদাহ্ আয়াত নং 8)।
28. তিলাওয়াত , চিন্তা-গবেষণা ও অনুশীলন :
আমরা বিশ্বাস করি : কোরআন তিলাওয়াত বা অধ্যয়ন করা শ্রেষ্ঠ ইবাদত। খুব কম ইবাদতই এমন আছে যা এর সম পযার্য়ের হতে পারে। কেননা , ঐশীবাণীর এ অধ্যয়ন ও কোরআনের উপর চিন্তা ভাবনা ও গবেষণাই হচ্ছে মানুষের সৎকর্মের উৎস কেন্দ্র। কোরআন রাসূলকে (সাঃ) উদ্দেশ্য করে বলছে :
‘ রাত্রি জাগরণ কর , রাতের কিয়দংশ ব্যতীত , অর্ধ রাত্রি অথবা অর্ধেকের থেকে সামান্য কম কর , অথবা অর্ধেকের চাইতে কিছু বৃদ্ধি কর , আর কোরআনকে মনোযোগ ও সুদর্শিতার সাথে পাঠ কর’ ( সূরাঃ আল-মুযযাম্মিল 2-4)।
কোরআন সমস্ত মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলছে :‘ তোমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব কোরআন পাঠ করো’ ( সূরাঃ আল-মুযযাম্মিল 20)।
কিন্তু যেমনভাবে বলা হয়েছে কোরআন তিলাওয়াত বা অধ্যয়ন করা , কোরআনের অর্থ , বিষয়বস্তু ও তাংপর্য বুঝার জন্যে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করতে হবে তেমনিভাবে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষনা কোরআনের উপর আমল-অনুশীলনের ক্ষেত্রে ভূমিকা হিসাবে কাজ করবে। কোরআনেই বলা হয়েছে :
‘ তারা কি কোরআনকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না ? নাকি , তাদের অন্তরে তালা লেগে গেছে ?’ (সূরাঃ মুহাম্মাদ আয়াত নং 24)।
আল্লাহ্ আরো বলেন :‘ আমরা কোরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। এমন কেউ আছে কি তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে এবং এর উপর আমল করবে ?’ (সূরা : আল-কামার আয়াত নং 17)।
আল্লাহ্ আরো বলেন :‘ এটি একটি বরকতপূর্ণ ও কল্যাণময় কিতাব , যা আমি (তোমার প্রতি) অবতীর্ণ করেছি। অতএব এর অনুসরণ করো’ (সূরা : আল-আনআম , আয়াত নং 155)।
এ জন্যেই যারা শুধুমাত্র কোরআন পাঠ করে ও মুখস্ত করে , কিন্তু এর উপর চিন্তা-ভাবনা ও আমল-অনুশীলন করেনা , তারা যদি ও কোরআনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি সম্পাদন করল , অথচ গুরুত্বপূর্ণ দু’ টি আমল হাত ছাড়া করল। তাই তারা বিরাট ক্ষতির শিকার হল।
29. বিচ্যুতি বিষয়ক আলোচনা :
আমরা বিশ্বাস করি : সব সময়ই মুসলমানদেরকে কোরআনের আয়াতসমূহের উপর চিন্তা- গবেষণা ও এর উপর আমল করা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার জন্যে এক শ্রেণীর লোক লিপ্ত আছে। এক সময় বনী উমাইয়্যা ও বনী আব্বাসীদের শাসনামলে“ কোরআনের বাণীসমূহ আদি ও চিরন্তন নাকি নতূন সৃষ্টি” এ নিয়ে সমাজে একটা বিতর্কের সূচনা হয়েছে , ফলে মুসলমানরা দু’ দলে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের দুশমনে পরিণত হয়েছে এবং এ পথে ব্যাপক খুনাখুনী ও রক্তপাত ঘটেছে। বিঃ দ্রঃ (কোন কোন ইতিহাসে দেখা যায় যে ,আব্বাসী খলীফা মা’ মুন তার এক বিচারপতির সহযোগিতায় নির্দেশ পাঠাল যে ,“ যারা কোরআনকে নতূন সৃষ্ঠি বলে বিশ্বাস করবে না তাদেরকে সরকারী পদ থেকে পদচ্যুত করা হবে। আর আদালতে তার সাক্ষী গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না” )। (কোরআন সংগ্রহের ইতিহাস , পৃঃ 260)।
বস্তুতঃপক্ষে এখন আমরা জানি যে , এর সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিটি বুঝার জন্যে রক্তপাত ও মানুষ বলিদানের দরকার নেই। কেননা“ আল্লাহর বাণীর” উদ্দেশ্য যদি হয় কোরআনের অক্ষর , নকশা , লেখা ও কাগজ তাহলে নিঃশন্দেহে কোরআনের বাণীসমূহ নতুন সৃষ্টি। আর যদি এর উদ্দেশ্য হয় মহান আল্লাহর জ্ঞান-বিজ্ঞানের অর্থ ও তাৎপর্য , তাহলে নিঃসন্দেহে কোরআনের বাণীসমূহ আল্লাহর সহজাত চিরন্তন জ্ঞান (নতুন সৃষ্টি নয়)। কিন্তু ক্ষমতাধর শাসকবর্গ ও জালিম খলিফারা বছরের পর বছর ধরে মুসলমানদেরকে এ বিষয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত রেখেছে। বস্তুতঃ আজকের এ যুগেও অপশক্তিধর লোকেরা ভিন্ন পন্থায় মুসলমানদেরকে কোরআনের উপর চিন্তা-গবেষণা ও এর উপর আমল করা থেকে বিরত রাখার নানান কৌশল অবলম্বন করছে।