14%

কুফাতে সাইয়েদা যায়নাব বিনতে আলী (আ.)-এর খোতবা

উমর ইবনে সা ’ আদ কারবালা থেকে মহানবী (সা.)-এর পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদের বন্দী করে কুফার নিকটবর্তী স্থানে আসলে সেখানকার লোকেরা দৃশ্য দেখার জন্য জমায়েত হলো। কুফার লোকেরা বন্দীদের পরিচয় জেনে কাঁদতে শুরু করে। এ সময় সাইয়েদা যায়নাব বিনতে আলী (আ.) একটি ভাষণ দেন।

আবু মানসূর তাবারসি তার ইহতিজাজ ’ -এ বর্ণনা করেছেন যে , কুফাবাসীদের মধ্যে ইমাম আলী বিন আবি তালিব (আ.)-এর কন্যা যায়নাব (আ.)-এর খোতবা ছিলো তাদের প্রতি তিরস্কার ও দমনমূলক। হিযাম বিন সাতীর আসাদি বর্ণনা করেছে যে , যখন ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.)-কে অসুস্থ অবস্থায় কারবালা থেকে কুফা আনা হলো , কুফার নারীরা নিজেদের জামার কলার ছেঁড়া শুরু করলো এবং উচ্চ স্বরে কাঁদতে লাগলো এবং পুরুষরাও তাদের আহাজারির সাথে যোগ দিলো। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) , যিনি অসুস্থ ছিলেন , তাদেরকে ক্ষীণ কণ্ঠে ডেকে বললেন , হে যারা কাঁদছো , তোমরা ছাড়া আর কারা আমাদের হত্যা করেছে ? সাইয়েদা যায়নাব (আ.) বিনতে আলী (আ.) লোকদেরকে ইশারা করলেন চুপ থাকার জন্য। হিযাম আসাদি আরো বলে যে , আল্লাহর শপথ আমি কখনো কোন নম্র নারীকে তার চাইতে বাগ্মী দেখি নি যিনি বিশ্বাসীদের আমির আলী (আ.)-এর কণ্ঠে বলছিলেন , তিনি লোকদেরকে ইশারা করলেন কথা শোনার জন্য। তাদের নিশ্বাস বুকের ভেতরে বন্ধ হয়ে গেলো এবং তাদের সম্মিলিত কন্ঠের সুর মিলিয়ে গেলো। এরপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর সালাম পেশ করলেন এবং বললেন ,

আম্মা বা দ , হে কুফাবাসীরা , হে অহংকারী ব্যক্তিরা , হে প্রতারক ব্যক্তিরা , হে পেছনে পলায়নকারীরা , শুনে রাখো , তোমাদের কান্না যেন কখনো না থামে এবং তোমাদের বিলাপ যেন কখনো শেষ না হয়। নিশ্চয়ই তোমাদের উদাহরণ হচ্ছে সেই নারীর মতো যে নিজেই তার সুতার প্যাঁচ খুলে ফেলে তা প্যাঁচানোর পর। তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছো প্রতারণার মাধ্যমে এবং তোমাদের মাঝে লোক দেখানো আত্ম-গরিমা , সীমা অতিক্রম এবং অসততা ছাড়া কিছু বাকী নেই। তোমরা দাসীদের প্রতি প্রেমবাক্য এবং শত্রুদের প্রতি মিষ্টি কথাকে তোমাদের ঐতিহ্য হিসাবে নিয়েছো। তোমাদের উদাহরণ হলো বিস্তীর্ণ বনের মতো অথবা কবরস্থানের মূল্যবান গহনার মতো। জেনে রাখো , কী খারাপই না তোমরা নিজেদের জন্য এনেছো যা আল্লাহর ক্রোধ ডেকে এনেছে তোমাদের ওপরে এবং তোমরা আখেরাতে ক্রদ্ধ আগুনের ভেতরে জায়গা অর্জন করেছো। তোমরা আমার ভাইয়ের জন্য কাঁদছো ? হ্যাঁ , নিশ্চয়ই , আল্লাহর শপথ , তোমাদের কাঁদা উচিত , তোমরা এর যোগ্য। প্রচুর কাঁদো , কম হাসো , এভাবেই তোমরা অপমানে আক্রান্ত হয়েছো এবং ঘৃণার ভেতরে বন্দী হয়েছো যা তোমরা কখনোই ধুয়ে ফেলতে পারবে না। কীভাবে তোমরা শেষ নবী ’ (সা.)-এর সন্তান এবং তোমাদের মাঝে রিসালাতের খনি ’ -র রক্ত নিজেদের হাত থেকে ধুয়ে ফেলবে ― যিনি ছিলেন বেহেশতের যুবকদের সর্দার , যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাপতি এবং তোমাদের দলের আশ্রয়। তিনি ছিলেন তোমাদের বিশ্রামের এবং তোমাদের কল্যাণের বাসস্থান। তিনি ক্ষত নিরাময় করতেন এবং তোমাদেরকে রক্ষা করতেন , যেসব খারাপ তোমাদের দিকে আসতো। তোমরা তার কাছে যেতে যখন তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করতে। তিনি ছিলেন তোমাদের শ্রেষ্ঠ পরামর্শদাতা , তোমরা তার ওপর নির্ভর করতে এবং তিনি ছিলেন তোমাদের পথ চলার বাতি। জেনে রাখো , কী খারাপই না তোমরা নিজেদের জন্য এনেছো এবং ক্বিয়ামতের দিনের জন্য কী বোঝাই না তোমরা তোমাদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছো। আত্মার ধ্বংস! আত্মার ধ্বংস! ধ্বংস! তোমাদের সন্ধান ব্যর্থ হোক এবং তোমাদের হাত অবশ হয়ে যাক , কারণ তোমরা তোমাদের রিযক্ব-এর বিষয়টি প্রবহমান বাতাসের কাছে হস্তান্তর করেছো। তোমরা আল্লাহর ক্রোধের ভেতরে জায়গা করে নিয়েছো এবং ঘৃণা ও দুর্ভাগ্যের মোহর তোমাদের কপালে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

দুর্ভোগ হোক তোমাদের! তোমরা কি জানো তোমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় সন্তানের মাথা কেটে বিচ্ছিন্ন করেছো ? এবং কী অঙ্গীকার তোমরা তার সাথে ভঙ্গ করেছো ? এবং তার প্রিয় পরিবারকে তোমরা রাস্তায় বের করে এনেছো ? এবং তাদের মর্যাদার কোন্ আবরণ [বোরখা] তোমরা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছো ? এবং কোন্ রক্ত তোমরা তার কাছ থেকে ঝরিয়েছো ? কী কুটিল জিনিসই না তোমরা জন্ম দিয়েছো যে , আকাশগুলো যেন ভেঙ্গে পড়বে এবং জমিন ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে , আর পাহাড়গুলো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়বে পৃথিবী ও আকাশের মাঝের জায়গা পূর্ণ করে।

তোমাদের বিষয়গুলোর বধূ হলো চুলবিহীন , অপরিচিত , নোংরা , অন্ধ , কুৎসিত ও গম্ভীর। তোমরা আশ্চর্য হচ্ছো কেন আকাশ থেকে রক্ত বৃষ্টি হয়েছে ? আখেরাতের শাস্তি আরো অপমানকর এবং তখন কোন সাহায্যকারী থাকবে না। তোমাদের এ অবসর যেন তোমাদেরকে হালকা মনের না করে দেয় , কারণ সর্বশক্তিমান ও পবিত্র আল্লাহ সম্পর্কে কেউ পূর্ব-ধারণা করতে পারে না এবং প্রতিশোধ নেওয়ার বিষয়ে তিনি ভুলে যান না ; না , কখনোই না , তোমাদের রব তোমাদের জন্য ওঁত পেতে আছেন।

এরপর তিনি নিচের শোকগাঁথাটি আবৃত্তি করলেন , কী উত্তর দিবে যখন নবী জিজ্ঞেস করবেন , তোমরা ছিলে শেষ উম্মত ; কেমন আচরণ করেছো তোমরা আমার বংশ ও আমার সন্তানদের সাথে ― যারা ছিলো সম্মানিত ; যাদের কিছুকে বন্দী করেছিলে এবং তাদের কিছুকে তাদের রক্তে ভিজিয়েছো ? এটি তো সেই প্রতিদান নয় যে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিয়েছিলাম যার মাধ্যমে তোমরা আমার ক্বুরবা ’ [রক্তজ]-এর প্রতি আচরণ করেছো ; আমি আশঙ্কা করি , যে গযব ইরাম ’ -এর লোকজনের ওপর পড়েছিল ঐ রকম একটি গযব তোমাদের ওপর অবতরণ করবে। এ কথা বলে তিনি তার মুখ তাদের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিলেন।

হিযাম বলে যে , আমি দেখলাম সব পুরুষ এদিক সেদিক চলে গেলো এবং তারা গভীর অনুতপ্ত ছিলো। আমার পাশে দাঁড়ানো একজন বৃদ্ধ মানুষ ভীষণ কাঁদলো এবং তার দাড়ি তার চোখের পানিতে ভিজে গেলো। সে তার হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে ধরলো এবং বললো , আমার বাবা-মা কোরবান হোক তাদের জন্য যাদের বৃদ্ধ , যুবক ও নারীরা সব বৃদ্ধ , যুবক ও নারীদের ওপরে বাছাইকৃত। তাদের পরিবার সম্মানিত এবং তাদের মর্যাদা সুউচ্চ। এরপর সে বললো , তাদের পুর্বপুরুষরা এবং তাদের বংশধরগণ শ্রেষ্ঠ। যখন আগামীকাল তাদের বংশধরদের গণনা করা হবে , তখন ধ্বংসপ্রাপ্ত ও অভিশপ্তদের মাঝে তাদের [বংশধর] থাকবে না।

ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.) বলেছেন , হে প্রিয় ফুফু , দয়া করে চুপ থাকুন , যা ঘটে গেছে তা ভবিষ্যতের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। আলহামদুলিল্লাহ , আপনি কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিচক্ষণ ব্যক্তি এবং জ্ঞানী , যাকে আর বুঝানোর প্রয়োজন নেই। নিশ্চয়ই কান্না ও আহাজারি তাদেরকে ফেরত আনতে পারবে না যারা চলে গেছে।