কোরআন মজীদ: একমাত্র অবিকৃত ঐশী কিতাব
আসমানী কিতাবকে কেন্দ্র করে যে সব ধর্ম প্রবর্তিত হয়েছে সে সব ধর্মের অনুসারীরা নবুওয়াত্ ও আসমানী কিতাবের ধারণায় বিশ্বাসী। ইয়াহূদী ধর্ম , খৃস্ট ধর্ম ও যরথুস্ত্রী ধর্ম এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত - ইসলাম যাদেরকে আহলে কিতাব অর্থাৎ আসমানী কিতাবধারী বলে উল্লেখ করেছে। এমনকি হিন্দু ধর্মের মতো পৌত্তলিক ধর্মও অবতারবাদে বিশ্বাস করে - যা সম্ভবতঃ নবুওয়াতের ধারণারই বিকৃত রূপ। হিন্দুরা তাদের ধর্মগ্রন্থ গীতা-কে শ্রীকৃষ্ণের - তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী যিনি তিন শীর্ষদেবতার অন্যতম বিষ্ণুর মানবীয় রূপ - বাণী বলে বিশ্বাস করে। অন্য কথায় , গীতা হিন্দুদের নিকট ঐশী গ্রন্থ স্বরূপ।
[এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , গীতা যার বাণী সেই শ্রীকৃষ্ণ ও গোপ জাতির উপাখ্যানের শ্রীকৃষ্ণ যে অভিন্ন ব্যক্তি নয় এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই ; দীর্ঘ কালের প্রবাহে উভয়কে অভিন্ন গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু গীতা-র শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব ও জীবনেতিহাস অকাট্য ঐতিহাসিক সূত্রে ও প্রত্যয় সৃষ্টিকারীরূপে প্রমাণ করা সম্ভব না হলেও গীতা যার বাণী তিনি যে অত্যন্ত উঁচু স্তরের বাগ্মী ও ধর্মজ্ঞানী ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। তবে গীতায় বিকৃতি প্রবেশ ও গীতা-র বক্তা শ্রীকৃষ্ণের জীবনেতিহাস হারিয়ে যাওয়ার কারণে তিনি নবী ছিলেন কিনা তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না হলেও উপাখ্যানের শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাঁকে অভিন্ন গণ্য করে তাঁর প্রতি কটাক্ষ করা কোনো মুসলমানের জন্য ঠিক হবে না। বরং সতর্কতার নীতি অনুযায়ী তাঁর সম্পর্কে নীরব থাকা বাঞ্ছনীয়।]
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও তাদের ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক-কে গৌতম বুদ্ধের উপদেশবাণী বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু ঐশী কিতাব হবার দাবীদার গ্রন্থাবলীর মধ্যে একমাত্র কোরআন মজীদ ছাড়া অন্য কোনো গ্রন্থকেই আজ ঐশী কিতাব হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ:
(1) যে সব ব্যক্তির নামের সাথে এ সব গ্রন্থকে সম্পৃক্ত করা হয় ঐ সব নামে আদৌ কেউ ছিলেন কিনা তা ঐতিহাসিক সূত্র থেকে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ , কোনো ঐতিহাসিক পরম্পরাই প্রত্যয় (يقين ) সৃষ্টিকারীরূপে কথিত সময় ও ব্যক্তিদের পর্যন্ত পৌঁছে না।
(2) যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নেয়া হয় যে , এ নামের ব্যক্তিগণের অস্তিত্ব ছিলো তথাপি তাঁরা যে নবী বা তথাকথিত অবতার বা ঐশী প্রেরণার অধিকারী মহাপুরুষ ছিলেন তা প্রত্যয় সৃষ্টিকারীরূপে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ , তাঁদের জীবনকাহিনী , আচার-আচরণ ও অলৌকিক কাজকর্ম (মু‘ জিযাহ্) ঐতিহাসিক সূত্রে ও প্রত্যয়সৃষ্টিকারী পরম্পরায় আমাদের কাছে পৌঁছে নি।
বিশেষ করে মু‘ জিযাহ্ বা অলৌকিক কর্মের বৈশিষ্ট্যই এমন যা কেবল প্রত্যক্ষকারীদের জন্যই পূর্ণ মাত্রায় প্রত্যয়সৃষ্টিকারী হয়ে থাকে। এমনকি কথিত কোনো মু‘ জিযাহ্ বা অলৌকিক কাজ প্রত্যক্ষকারী নয় এমন সমকালীন লোকদের জন্যও তা প্রত্যক্ষকারীদের কাছ থেকে শোনার পরেও প্রত্যক্ষকারীদের প্রত্যয়ের অনুরূপ প্রত্যয় সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ , এরূপ বর্ণনার ওপর প্রত্যয়ের বিষয়টি তা প্রত্যক্ষ করার দাবীদারদের নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে শ্রোতাদের প্রত্যয়ের ওপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় মুতাওয়াতির্ বা প্রতি স্তরে ব্যাপকভিত্তিক অবিচ্ছিন্ন পরম্পরায় বর্ণনার অকাট্য দলীল-প্রমাণ ছাড়া এরূপ দাবী পরবর্তীকালীন লোকদের জন্য প্রত্যয় সৃষ্টি করতে পারে না। এমনকি মুতাওয়াতির্ বর্ণনা থেকে তা পাঠকারী বা শ্রবণকারীদের মধ্যে প্রত্যয় সৃষ্টি হলেও তা প্রত্যক্ষকারীদের প্রত্যয়ের সমমাত্রায় হয় না এবং অনেকের মধ্যে আদৌ প্রত্যয় সৃষ্টি না-ও হতে পারে।
(3) যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নেয়া হয় যে , কথিত ব্যক্তিবর্গের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ছিলো এবং তাঁরা নবী , ঐশী প্রেরণার অধিকারী মহাপুরুষ বা তথাকথিত অবতার ছিলেন তথাপি এটা প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে , ঐ সব গ্রন্থ আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছিলো। কারণ , ঐ সব গ্রন্থে এমন সব বক্তব্য রয়েছে যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , ঐ সব গ্রন্থ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয় নি ; অন্ততঃ যেভাবে ঐ সব গ্রন্থ বিদ্যমান সেভাবে নাযিল হয় নি। এ সব গ্রন্থ পাঠ করলেই সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে , এগুলো সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আগত নয় , বরং মানুষের রচিত গ্রন্থ। শুধু তা-ই নয় , এ সব গ্রন্থ যাদের ওপর নাযিল হয়েছিলো বলে অনেকে মনে করেন , এগুলো তাঁদের নিজেদের রচিতও নয়। বরং এ সব গ্রন্থের বাচনভঙ্গি প্রমাণ করে যে , এগুলো ইতিহাস ও জীবনী গ্রন্থ রূপে পরবর্তীকালে রচিত।
বাইবেলের‘ পুরাতন নিয়ম’ অংশের প্রথম পাঁচ পুস্তককে‘ তাওরাত্” বলে দাবী করা হয়। কিন্তু এর প্রথম দুই পুস্তক -‘ আদি পুস্তক/ সৃষ্টি পুস্তক’ ও‘ যাত্রা পুস্তক’ - পুরোপুরি ইতিহাসগ্রন্থ ; বিশেষতঃ‘ যাত্রা পুস্তক’ হযরত মূসা (‘ আঃ)-এর জীবনী বিষয়ক পুস্তক।
বাইবেলের‘ নতুন নিয়ম’ অংশের প্রথম চার পুস্তককে‘ ইনজীল্’ বলে দাবী করা হয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা চারজন ভিন্ন ভিন্ন লেখকের লেখা হযরত‘ ঈসা (‘ আঃ)-এর জীবনকাহিনী মাত্র।‘ মথি’ পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ে হযরত‘ ঈসা (‘ আঃ)-এর বংশের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ বংশবর্ণনাটি আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে হযরত‘ ঈসা (‘ আঃ)-এর নিকট ওয়াহীরূপে নাযিল হয়েছিলো বলে কি কোনো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ? নাকি স্বয়ং খৃস্টানরা এরূপ বিশ্বাস করে ? তেমনি গীতায় শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ শুরু হবার পূর্বে যুদ্ধক্ষেত্রে দুই পক্ষের সৈন্যসমাবেশের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাকে কি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের বাণী বলে মেনে নেয়া চলে ? নাকি স্বয়ং হিন্দুরাও এরূপ বিশ্বাস করে ?
(4) ঐ সব গ্রন্থের কোনোটিই মূল ভাষায় বর্তমান নেই এবং ক্ষেত্রবিশেষে , মূল ভাষার গ্রন্থ পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার কারণে অন্য ভাষার অনুবাদ থেকে মূল ভাষায় পুনরায় অনূদিত হয়েছে।
এ সব গ্রন্থে সংঘটিত বিকৃতি (অর্থাৎ সংশোধন , সংযোজন , পরিবর্তন ও অংশবিশেষ হারিয়ে যাওয়া) একটি অকাট্য সত্য - যা সংশ্লিষ্ট ধর্মের অনুসারী পণ্ডিতগণও স্বীকার করেন। এ কারণে এ ধরনের প্রতিটি গ্রন্থেরই বিভিন্ন সংস্করণ আছে এবং এ সব সংস্করণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পার্থক্য ও পরস্পরবিরোধিতা বিদ্যমান। ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের‘ পুরাতন নিয়ম’ আলাদা এবং খৃস্টানদের‘ বাইবেল্’ (পুরাতন নিয়ম ও নতুন নিয়ম)-এর বিভিন্ন সংস্করণ রয়েছে , যেমন: রোম্যান ক্যাথলিক বাইবেল্ , এ্যাপোক্রাইফা বাইবেল্ , অর্থোডক্স্ বাইবেল্ ইত্যাদি।
‘ নতুন নিয়ম্’ -এর শুরুতে যে চারটি পুস্তক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে - যেগুলোকে‘ ইনজীল্’ (সুসমাচার) নামে অভিহিত করা হয় খৃস্টান্ পণ্ডিত ও ধর্মনেতাগণ বলছেন না যে , এগুলোর মধ্য থেকে কোনটি প্রকৃত ইনজীল্ ? নাকি এগুলোর মধ্য থেকে একটিও সঠিক নয় ? কারণ , একাধিক তো সঠিক হতে পারে না। যদি একটি পুস্তক সঠিক হয়ে থাকে তো বাকী তিনটিকে‘ নতুন নিয়ম্’ ভুক্ত করার কারণ কী ?
কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো , ইনজীলের সংস্করণ মাত্র চারটিতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর সংস্করণসংখ্যা (মুদ্রণসংখ্যা নয়) অনেক বেশী। ইনজীলের 77টি সংস্করণের কথা লন্ডন্ থেকে 1813 খৃস্টাব্দে মুদ্রিত ‘ এক্সিহোমো ’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ‘ এন্সাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা ’ র ত্রয়োদশ মুদ্রণের 2য় খণ্ডের 179-180 পৃষ্ঠায় 25টি ইনজীলের (ইনজীলের 25টি সংস্করণের) নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ তালিকার 6নং নামটি হচ্ছে ‘ বারনাবার ইনজীল্ ’ ( Gospel of Barnabas) । হযরত ‘ ঈসা ( ‘ আঃ)-এর নির্দেশে তাঁর প্রত্যক্ষ শিষ্য বারনাবা কর্তৃক সংকলিত এ ইনজীলকে মোটামুটি ছ্বহীহ্ বলা চলে। কিন্তু এতে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ‘ মুহাম্মাদ্ ’ ও ‘ আহমাদ্ ” নাম , আল্লাহ্ তা ‘ আলা কর্তৃক কেবল তাঁকে সৃষ্টির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্র হিসেবে এ বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করা এবং তাঁর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী , তাঁর পরিচয় ও মর্যাদা উল্লেখ থাকায় খৃস্ট জগতে এ ইনজীল্ নিষিদ্ধ রয়েছে। (অবশ্য খৃস্টান ধর্মগুরুদের আরোপিত এ নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে খৃস্টীয় বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এটি ইংরেজী ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয় এবং তার ভিত্তিতে বিশ্বের আরো বহু ভাষায় এটি অনূদিত হয়।)
কোরআন মজীদ ব্যতীত ঐশী গ্রন্থ হিসেবে পরিচয়কৃত অন্যান্য গ্রন্থের প্রতটিরই যে কেবল বিভিন্ন সংস্করণ রয়েছে তা নয় , বরং ঐ সব গ্রন্থে এমন সব বক্তব্য রয়েছে যে কারণে ঐ সব গ্রন্থকে আদৌ ঐশী কিতাব বলা চলে না। বিশেষ করে বাইবেলের বিভিন্ন পুস্তকে আল্লাহ্ তা ‘ আলা ও নবী-রাসূলগণ ( ‘ আঃ) সম্পর্কে এমন সব জঘন্য অপবাদ দেয়া হয়েছে যা মুখে উচ্চারণ করা যায় না। এ গ্রন্থের বিভিন্ন পুস্তকে নবী-রাসূলগণের ( ‘ আঃ) প্রতি মদপান , ব্যাভিচার , গণহত্যার নির্দেশ দান ইত্যাদি অপবাদ আরোপ করা হয়েছে। এ সব কথাকে যদি সত্য ও আল্লাহ্ তা ‘ আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বলে মানতে হয় তাহলে যাদের নামে ঐ সব পুস্তককে পরিচিত করা হয়েছে তাঁদেরকে নবী-রাসূল্ ( ‘ আঃ) বলে গণ্য করা আদৌ সম্ভব নয়। অন্যদিকে তাঁদেরকে নবী-রাসূল্ ( ‘ আঃ) বলে গণ্য করলে ঐ সব তথ্য যে মিথ্যা ও ঐশী গ্রন্থে অনুপ্রবিষ্ট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
বাইবেল্ নামে পরিচিত সকল গ্রন্থেই এ ধরনের বিকৃতি কম-বেশী ঘটেছে। হিন্দু ধর্মের সর্বপ্রধান গ্রন্থ‘ গীতা’ য়ও প্রক্ষিপ্ত বা অনুপ্রবিষ্ট বক্তব্য রয়েছে বলে নিষ্ঠাবান হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন। অবশ্য তিনি না বললেও যে কেউ এ গ্রন্থটি পাঠ করলেই বুঝতে পারবেন যে , এটি আদিতে যদি ঐশী বাণী থেকেও থাকে তথাপি এতে মানবরচিত বহু কথা অনুপ্রবেশ করেছে।
পূর্ববর্তী নবীদের (‘ আঃ) পক্ষে কোরআনের সাক্ষ্যের যুক্তি গ্রহণযোগ্য কি ?
বিশেষতঃ ইয়াহূদী ও খৃস্টান্ পণ্ডিতগণ হযরত মুহাম্মাদ্ (ছ্বাঃ)-এর পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের (‘ আঃ)- যাদেরকে তাঁরা নবী বলে মানেন - নবুওয়াত্ , তাঁদের মু‘ জিযাহ্ ও তাঁদের নামে প্রচলিত গ্রন্থাবলীর ঐশী গ্রন্থ হবার সত্যতার সপক্ষে কোরআন মজীদের সাক্ষ্য ও মুসলমানদের ঈমানের যুক্তি উপস্থাপন করে থাকেন।
এ পণ্ডিতগণ বলেন:“ তোমরাই তো তাঁদেরকে নবী বলে স্বীকার করছো এবং এ-ও স্বীকার করছো যে , তাঁদের ওপর তাওরাত্ , ইনজীল্ , যাবূর্ ইত্যাদি ঐশী কিতাব নাযিল্ হয়েছিলো ; আমরা-ও তা-ই স্বীকার করি। অতএব , তাঁদের নবী হওয়া ও তাওরাত্-ইনজীলের ঐশী কিতাব হওয়ার ব্যাপারে বিতর্ক নেই। কিন্তু আমরা মুহাম্মাদকে নবী ও কোরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে মনে করি না। অতএব , আমরা যাদেরকে নবী মানি তাঁদের নবী হওয়ার বিষয়টি এবং আমরা যে সব কিতাবকে ঐশী কিতাব হিসেবে মানি সে সব কিতাবের ঐশী কিতাব হওয়ার বিষয়টি সর্বসম্মত ও সন্দেহাতীত , কিন্তু মুহাম্মাদের নবী হওয়া ও কোরআনের ঐশী কিতাব হওয়ার বিষয়টি সর্বসম্মত ও সন্দেহাতীত নয়।”
তাঁদের এ বিভ্রান্তিকর ( fallacious)কূট যুক্তিতে অনেক সরলমনা ও দ্বীনী জ্ঞানে দক্ষতাহীন মুসলমান বিভ্রান্ত হয়।
ঐ সব ইয়াহূদী ও খৃস্টান্ পণ্ডিত আরো বলেন:“ কোরআনে হযরত মূসা (‘ আঃ)কে“ কালীমুল্লাহ্” (আল্লাহর সাথে কথোপকথনকারী) এবং হযরত‘ ঈসা (‘ আঃ)কে“ কালিমাতুল্লাহ্” (কালিমাতুম্ মিনহু - আল্লাহ্ তা‘ আলার বাণী বা তাঁর বাণীর জীবন্ত মূর্ত প্রতীক) বলে উল্লেখ করা হয়েছে , কিন্তু মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে এরূপ মর্যাদা দেয়া হয় নি। অতএব , তিনি যদি নবী হয়েও থাকেন তো হযরত মূসা (‘ আঃ) ও হযরত‘ ঈসা (‘ আঃ)-এর মর্যাদা তাঁর ওপরে। তাই হযরত মূসা (‘ আঃ) ও হযরত‘ ঈসা (‘ আঃ)-এর ধর্মেরই অনুসরণ করা উচিত , হযরত মুহাম্মাদের (ছ্বাঃ) ধর্মের নয়।”
তাঁদের এ ধরনের যুক্তি হচ্ছে এক ধরনের অপযুক্তি - যুক্তিবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে ভ্রমাত্মক অপযুক্তি (مغالطة - fallacy) বলা হয়। কারণ , মুসলমানরা যে অতীতের নবী-রাসূলগণকে (‘ আঃ) নবী-রাসূল বলে গণ্য করে এবং তাঁদের ওপর তাওরাত্ , যাবূর্ , ইনজীল্ প্রভৃতি ঐশী গ্রন্থ নাযিল্ হয়েছিলো বলে স্বীকার করে , আর তাঁদের মু‘ জিযাহ্ সমূহকে স্বীকার করে থাকে - তা ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের দাবী , ঐ সব নামে প্রচলিত গ্রন্থাবলীর বক্তব্য অথবা ঐ সব নামের ব্যক্তি ও গ্রন্থের ঐতিহাসিকভাবে প্রত্যয়সৃষ্টিকারী প্রামাণ্যতার কারণে নয়। বরং হযরত মুহাম্মাদ্ (ছ্বাঃ)কে নবী ও কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব বলে মানে বিধায় এবং কোরআন মজীদে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের (‘ আঃ) ও তাঁদের ওপর নাযিলকৃত ঐশী কিতাব সমূহের কথা উল্লেখ থাকার কারণেই মুসলমানরা তাঁদেরকে নবী-রাসূল্ (‘ আঃ) বলে মনে করে এবং তাঁরা মু‘ জিযাহ্ ও উল্লিখিত নামের বিভিন্ন ঐশী কিতাবের অধিকারী ছিলেন বলে প্রত্যয় পোষণ করে থাকে।
এখন হযরত মুহাম্মাদ্ (ছ্বাঃ) যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত নবী না হয়ে থাকেন এবং কোরআন মজীদ যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব না হয়ে হযরত মুহাম্মাদ্ (ছ্বাঃ)-এর নিজের রচিত গ্রন্থ হয়ে থাকে তাহলে কোরআন মজীদের উক্তির ভিত্তিতে ঐ সব নবী-রাসূলের (‘ আঃ) ঐতিহাসিক অস্তিত্ব , নবুওয়াত্ , মু‘ জিযাহ্ ও তাঁদের নামে প্রচলিত কিতাব সমূহ ঐশী কিতাব বলে প্রমাণিত হয় না ; এ সব ব্যাপারে কোরআন মজীদের সাক্ষ্য প্রত্যয় সৃষ্টি করতে পারে না। কারণ , হযরত মুহাম্মাদ্ (ছ্বাঃ) যদি নবী না হয়েও নবী হবার মিথ্যা দাবী করে থাকেন এবং নিজের রচিত কিতাবকে আল্লাহর কিতাব বলে দাবী করে থাকেন (না‘ উযু বিল্লাহি মিন্ ক্বাওলি যালিক্) , তাহলে তাঁর ও তাঁর উপস্থাপিত গ্রন্থের দেয়া সাক্ষ্য ও তথ্যের কোনোই গ্রহণযোগ্যতা থাকতে পারে না।
সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে , কেবল হযরত মুহাম্মাদ্ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতের ও কোরআন মজীদের ঐশী গ্রন্থ হবার ওপরে ঈমানই এতে উল্লিখিত নবী-রাসূলগণের (‘ আঃ) , তাঁদের প্রদর্শিত মু‘ জিযাহ্ ও ঐ সব আসমানী কিতাবের আসমানী কিতাব হওয়া সংক্রান্ত তথ্যের ওপর ঈমান সৃষ্টি করে থাকে। অতএব , কারো অন্তরে যদি কোরআন মজীদের আল্লাহর কিতাব হওয়ার ব্যাপারে প্রত্যয় সৃষ্টি হয় তাহলে তার জন্য কোরআন মজীদের সকল কথাকেই সত্য ও ঐশী প্রত্যাদেশ বলে জানা অপরিহার্য। সুতরাং কোরআন মজীদ আরো যা কিছু বলেছে তার জন্য তার সব কিছুর ওপর ঈমান পোষণ করা অপরিহার্য।
আর কোরআন মজীদ সাক্ষ্য দিয়েছে যে , ঐ সব নবী-রাসূলের (‘ আঃ) কাছে যে সব আসমানী গ্রন্থ নাযিল হয়েছিলো তাঁদের পরে তাঁদের অনুসারী হবার দাবীদার লোকেরা সে সব গ্রন্থকে বিকৃত করেছে এবং সেগুলোর অংশষবিশেষকে লুকিয়ে ফেলেছে। এছাড়া কোরআন মজীদ হযরত মুহাম্মাদ্ (ছ্বাঃ)কে“ রাহমাতাল্লিল্‘ আালামীন্ - সমগ্র জগতবাসীর জন্য দয়া ও অনুগ্রহের মূর্ত রূপ” (সূরাহ্ আল্-আম্বিয়া’ : 107) এবং“ সমগ্র মানবমণ্ডলীর জন্য রাসূল্” (সূরাহ্ আল্-আ‘ রাফ্: 158) হিসেবে ঘোষণা করে তাঁকে সকল নবী-রাসূলের (‘ আঃ) ওপর মর্যাদা দিয়েছে। কোরআনের সাক্ষ্যকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করতে হলে এ সব বিষয়েও কোরআনের সাক্ষ্যকে মেনে নিতে হবে।