23
ঈদের নামায
মামুন একজন চালাক-চতুর , সচেতন ও পরিণামদর্শী আব্বাসীয় খলিফা। সে স্বীয় ভাই মুহাম্মদ আমীনকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে তাকে হত্যা করে। সময়কার বিস্তৃত সাম্রাজ্যের সমস্ত অঞ্চলই সে নিজের করতলগত করে। তার এ ব্যস্ততার সময় সে মারভ নামক স্থানে অবস্থান করছিল। মারভ খোরাসানের একটা এলাকা ছিল। মারভে থেকে মামুন একটি পত্র হযরত ইমাম রেজা (আঃ)-এর নামে মদীনায় পাঠায়। পত্রে সে ইমামকে মারভে আসার আমন্ত্রণ জানায় । জবাবে হযরত ইমাম রেজা (আঃ) বিভিন্ন কারণে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন , এ মুহূর্তে মদীনা ত্যাগ করার মতো অবস্থা আমার নেই। মামুন তার ইচ্ছা থেকে নিবৃত্ত হলো না। তাই সে পরপর কয়েকটি চিঠি ইমামের খেদমতে পাঠালো। প্রতিটি চিঠিতেই ইমামকে মারভে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এভাবে ইমাম বুঝতে পারলেন যে , খলিফা মামুন তার ইচ্ছা থেকে পিছু হটবার পাত্র নয়।
অবশেষে ইমাম রেজা (আঃ) মদীনা থেকে রওনা হলেন এবং মারভে এসে উপস্থিত হলেন। মামুন প্রস্তাব দিল , আসুন! খেলাফতের দায়িত্ব্ভার গ্রহণ করুন। ইমাম (আঃ) মামুনের মনের ভেদ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। সুতরাং তাঁর বুঝতে দেরী হলো না যে , এ প্রস্তাবের একশ ভাগই রাজনৈতিক চালাকির অংশ বিশেষ। তাই তিনি খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণে অস্বীকার করলেন।
প্রায় দুই মাস এভাবে অতিবাহিত হয়ে গেল। একপক্ষ থেকে প্রবল চাপ আর অপর পক্ষ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অটল।
অবশেষে যখন মামুন বুঝতে পারলো যে , ইমাম রেজা (আঃ) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণে মোটেও রাজী নন , তখন সে তার পরবর্তী যুবরাজ পদে প্রস্তাব রাখলো। ইমাম এ প্রস্তাবটি এ শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করলেন যে , তার ওপর কোন দায়-দায়িত্ব অর্পণ করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় কোন ব্যাপারে ইমাম কোন হস্তক্ষেপ করবেন না। মামুন ইমামের সমস্ত শর্ত মেনে নিল।
অতঃপর মামুন লোকদের কাছ থেকে ইমামের যুবরাজ পদে বাইয়াত (শপথ) আদায় করলো। রাজ্যব্যাপী ফরমানও জারি করে পাঠালো। মামুন আরো হুকুম জারি করলো যে , ইমাম রেজা (আঃ) এর নামে মুদ্রা চালু করা হবে এবং সারা দেশের সমস্ত মসজিদগুলোর মিম্বার থেকে ইমামের নামে খোৎবা পাঠ করা হবে। সুতরাং সমগ্র দেশ জুড়েই মামুনের নির্দেশ পালিত হলো।
কোরবানীর ঈদ এসেছে। মামুন এক ব্যক্তিকে ইমামের খেদমতে পাঠালো এবং নিবেদন করলো : এ বছর ঈদের নামায আপনি পড়াবেন যাতে করে লোকদের দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে যায় যে , পরবর্তীতে খেলাফতের স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি আপনিই।
ইমাম (আঃ) বার্তা পাঠালেন , আমাদের মধ্যে এ অঙ্গীকার হয়েছিল যে , আমি সরকারী কোন কাজেই হস্তক্ষেপ করবো না। সুতরাং এ কাজটি আঞ্জাম দিতে আমি অপারগ।
মামুন উত্তর পাঠালো : সময়ের দাবি হচ্ছে আপনি লোকদের ঈদের নামায পড়াবার জন্য ঈদগাহে যাবেন। তাতে করে যুবরাজের বিষয়টি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। মোদ্দাকথা মামুন এতো বেশী জিদ ধরলো যে , অবশেষে ইমাম (আঃ) জবাব দিলেন , যদি তুমি আমার অপারগতা মেনে নাও তাহলে সেটাই উত্তম। আর যদি ঈদের নামায পড়াবার জন্য আমাকে অবশ্যই যেতে হয় তাহলে আমি খোদার এ বিধানটিকে এমনভাবে পালন করবো , যে ভাবে মহানবী (সাঃ) ও হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ) পালন করতেন।
মামুন বললো , আপনার পূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা রয়েছে। যেভাবে চান সেভাবেই পড়াবেন। ঈদের দিন সকালে সেনাবাহিনীর বড় বড় কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন নেতাবর্গ , অভিজাত মহল ও সাধারণ লোকজন খলিফাদের সময়কার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মূল্যবান নতুন নতুন পোশাক পরিধান করে সুসজ্জিত ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে ঈদের নামাযে শরীক হবার জন্য ইমামের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল। অন্যান্য লোকজনও অলিতে-গলিতে দাঁড়িয়ে যুবরাজের রাজসিক আগমন প্রত্যক্ষ করার জন্য তার বাহনের অপেক্ষায় অপেক্ষা করতে থাকে। যাতে করে তারাও ঈদগাহ পর্যন্ত যুবরাজের বাহনের পেছনে পেছনে ঈদগাহে যেতে পারে। এমনকি অগণিত নারী-পুরুষ নিজেদের ঘর-বাড়ির ছাদের উপর দাঁড়িয়ে ইমামের শান-শওকত , পূর্ণ যাত্রার অপেক্ষায় রইলো। সকলের দৃষ্টি ইমামের বাড়ির আঙ্গিনার দিকে নিবদ্ধ ছিল এবং অধীর আগ্রহে সকলেই ইমামের অপেক্ষা করছিল।
অপরদিকে হযরত ইমাম রেজা (আঃ) পূর্ব থেকেই খলিফা মামুনের কাছ থেকে এ অঙ্গীকার নিয়ে রেখেছিলেন এবং এ শর্তসাপেক্ষে তিনি ঈদের নামাযে অংশগ্রহণে রাজী হয়েছিলেন যে , খোদায়ী এ বিধান পালন করার ক্ষেত্রে খলিফাদের নয় , বরং মহানবী (সাঃ) ও হযরত আলী (আঃ)-এর নিয়ম অনুসরণ করবেন। সে মতে তিনি ঈদের দিন সকালে সর্বপ্রথম গোসল করলেন। মাথায় পরিধান করলেন সাদা পাগড়ি। পাগড়ির এক মাথা বুকের উপর ঝুলিয়ে দিলেন এবং অপর মাথাটি দুই কাঁধের মাঝামাঝি রেখে দিলেন। অতঃপর জামার আঁচলকে উপরে ওঠালেন ও খালি পা হয়ে গেলেন। তারপর তার সাথীগণকে বললেন , তোমরাও আমার মতো হয়ে যাও। এরপর তিনি লাঠিটি হাতে নিলেন যার অগ্রভাগ ছিল লোহার। এবার তিনি তাঁর সাথীদেরকে সাথে নিয়ে ঘর থেকে বাইরে আসলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই ইমাম (আঃ) এদিনে ইসলামী সুন্নত মাতাবেক তাকবীর ধ্বনি উচ্চরণ করলেন : (আলাহু আকবার , আল্লাহু আকবার)।
লোকেরা ইমামের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চস্বরে তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করলো। এ সময় মনে হচ্ছিল যে , আসমান-যমীন ও প্রতিটি দেয়াল থেকে তাকবীর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ইমাম (আঃ) কিছুক্ষণ বাড়ির সম্মুখে দাঁড়ালেন এবং অতি উচ্চ স্বরে এ কথাগুলো বললেন : (আলাহু আকবার , আলাহু আকবার , আলাহু আকবার , আলা-মা-হাদানা , আল্লাহু আকবার আলা- রাজাকানা মিন বাহীমাতিল আনআমি , আল হামদুলিলাহি আলা-মা-আবালানা।
সমস্তলোকেরা উচ্চ স্বরে সম্মিলিতভাবেও পরস্পর সমস্বর এ বাক্যটি পুনরাবৃত্তি করলো।
অবস্থা তখন এমন ছিল যে , সকলে অঝোরে কাঁদছিল। লোকদের চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসা অশ্রু“ এ কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে , সমবেত প্রত্যেকটি লোকের মধ্যেই জোশানুভূতি জেগে উঠেছিল। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা , যারা মূল্যবান সরকারী পোশাক পরিধান করে উত্তম ঘোড়ায় আরোহণ করে এসেছিল , যারা নিজেদের মনে এ ধারণা পোষণ করে রেখেছিল যে , খলিফার যুবরাজ অত্যন্তশান-শওকতপূর্ণ খুব দামী পোশাক পরিধান করে ঈদগাহে গমন করবেন। কিন্তু তারা যখন দেখতে পেলো যে , ইমাম (আঃ) একেবারে সাধারণ পোশাক পরে এবং খালি পদে ঘর থেকে বের হলেন আর পরিপূর্ণরূপে মহান আল্লাহর প্রতি অন্তর নিবদ্ধ আছেন , তখন তারা এমন আবেগময় হয়ে উঠলো যে , তাদের অজান্তেই চোখ দিয়ে অশ্রুপ্রবাহিত হতে লাগলো। তারাও সব জোরেশোরে তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে নিজেদের বাহনের পিঠ থেকে নেমে পড়লো এবং নিজেদের জুতার ফিতা চাকু দিয়ে কেটে ফেললো। যাতে করে খালি পা হতে দেরী না হয়। প্রত্যেকের চেষ্টা ছিল যে , সে তার অপরাপর সাথীদের আগেই শূন্য পদ হবার সৌভাগ্যের অধিকারী হবে।
মারভ্ শহরের সর্বত্র আবেগ , উত্তেজনা আর কান্নার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছিল। ইমাম (আঃ) প্রতি দশ কদমে একবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন এবং উচ্চ ¯স্বরে চারবার তাকবীর বলছিলেন। বিরাট সংখ্যক একদল লোক অত্যন্ত জোশানুভূতির সাথে ইমামের সাথে সাথে এগিয়ে চলছিল। জনগণ যারা বস্তুগত ও জাগতিক জাকজমক প্রত্যক্ষ করার অপেক্ষায় ছিল , মুহূর্তেই যেন তাদের সে প্রত্যাশা উঠে গেল।
এ সংবাদ খলিফা মামুনের নিকট পৌঁছে গেল। মামুনের সাথী-বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দিয়ে বললো যদি এ অবস্থা আরো কিছুক্ষণ স্থায়ী থাকে এবং ইমাম আলী ইবনে মূসা আর রেজা (আঃ) ঈদগাহে পৌঁছে যান তাহলে বিপ্লব ঘটে যাবার বিপদ রয়েছে। মুহূর্তেই মামুন কেঁপে উঠলো। তৎক্ষণাৎ সংবাদ পাঠালো : (হে ইমাম) আপনি ফিরে আসুন। তা না হলে আপনার সাথে কোন দুঃখজনক ঘটনার অবতারণা হয়ে যেতে পারে। ইমাম (আঃ) নিজের জুতা ও জামা কাপড় চেয়ে পাঠালেন এবং সেগুলো পরিধান করে বাড়ী ফিরে গেলেন। আর বললেন , আমি তো আগেই বলেছিলাম যে , এ কাজ করতে আমি অপারগ।34