2%

রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে যারথুষ্ট্র ধর্ম

সাসানীরা যেহেতু ধর্মের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিল সেহেতু যারথুষ্ট্র ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে এবং যারথুষ্ট্র পুরোহিতদের পর্যাপ্ত ক্ষমতা দান করে। তারা অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সদাচারণ করত না ;বরং কখনও কখনও তারা ধর্মযাজকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম ত্যাগে বাধ্য করত এবং যারথুষ্ট্র ধর্মকে শক্তি প্রয়োগে তাদের ওপর চাপিয়ে দিত।

ক্রিস্টেন সেন বলেছেন ,

যারথুষ্ট ধর্মযাজকগণ অত্যন্ত গোঁড়া ছিলেন এবং দেশের অভ্যন্তরে অন্য কোন ধর্মকেই অনুমতি দিতেন না। তবে এই নীতি বিশেষভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে গৃহীত হয়েছিল। যারথুষ্ট্র ধর্ম প্রচার উপযোগী ধর্ম ছিল না। কারণ এর পুরোধাগণ সমগ্র মানব জাতির মুক্তির কথা বলতেন না। তাঁরা দেশের অভ্যন্তরে সমগ্র কর্তৃত্বের দাবিদার ছিলেন। অন্যান্য ধর্মের অনুসারিগণের প্রজা হিসেবে কোন নিরাপত্তা ছিল না। বিশেষত যদি ঐ ধর্মের কেউ অন্য রাষ্ট্রে বিশিষ্ট কোন পদ অর্জন করে থাকে তবে তাদের অবস্থা আরো শোচনীয় হতো।

সাঈদ নাফিসী উল্লেখ করেছেন ,

সাসানী আমলের বিশৃঙ্খলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল এই বংশের শাসন কর্তৃত্বের পূর্বে ইরানের সকল মানুষ যারথুষ্ট্র ধর্মাবলম্বী ছিল না। আরদ্শির বাবেকান যেহেতু পূর্বে ধর্মযাজক ছিলেন ও যারথুষ্ট্র পুরোহিতদের সহযোগিতায় শাসন ক্ষমতা লাভ করেছিলেন সেহেতু চেয়েছিলেন যে কোনভাবেই হোক পূর্বপুরুষদের ধর্মকে ইরানে ছড়িয়ে দেবেন। তাই যখন পুরোহিতদের পৃষ্ঠপোষকতায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন তখন হতেই যারথুষ্ট্র পুরোহিতগণকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দান করলেন। ফলে তাঁরা সমাজের সবচেয়ে শক্তিধর শ্রেণী বলে পরিগণিত হতেন ,এমনকি কোন সম্রাটের মৃত্যুর পর তাঁরাই নতুন সম্রাট মনোনীত করতেন ও স্বহস্তে রাজমুকুট পরিধান করাতেন। এ কারণেই একমাত্র আরদ্শির বাবেকান তাঁর পুত্র শাপুরকে স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করে গিয়েছিলেন। অন্য কেউ এরূপ স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করে যান নি। কারণ তাঁর মৃত্যুর পর শীর্ষস্থানীয় পুরোহিতগণ যদি তাঁকে মেনে না নিতেন তবে তিনি সম্রাট বলে পরিগণিত হতেন না। এ সময়ের সকল সম্রাট শীর্ষস্থানীয় পুরোহিতদের ক্রীড়নক ছিলেন এবং যদি তাঁদের কেউ এই ধর্মযাজকদের কথা না শুনতেন তবে তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার মাধ্যমে পদত্যাগে বাধ্য করা হতো। যেমন দ্বিতীয় ইয়ায্দ গারদ খ্রিষ্টানদের হত্যা না করায় তাঁকে গুনাহগার ও অপরাধী ঘোষণা করা হয়। এরই আরবী প্রতিশব্দ হলো আসিম যা আরব ঐতিহাসিকগণ ব্যবহার করেছেন। তিনি আট বছর পর বাধ্য হয়ে তাঁর পূর্বপুরুষদের মত খ্রিষ্টানদের সঙ্গে অসদাচারণ করেন।

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন ,

হাখামানেশী ,আশকানী ও সাসানী সকল রাজত্বকালেই আর্মেনিয়া ইরানের প্রদেশ ছিল এবং মাদ বংশ সেখানে শাসনকার্য চালাত। আশকানী যুবরাজগণও দীর্ঘ সময় সেখানে শাসনকার্য চালিয়েছেন। সাসানী আমলে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের ওপর কঠোরতা আরোপ করা হয় ও জোরপূর্বক যারথুষ্ট্র ধর্ম চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। আর্মেনিয়ার অধিবাসীরা শতাব্দীকাল ধরে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালায় ও মূর্তিপূজা অব্যাহত রাখে। পরবর্তীতে 302 খ্রিষ্টাব্দ হতে ধীরে ধীরে সকলে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। তাদের গৃহীত খ্রিষ্ট মতবাদ আর্মেনিয়ান খ্রিষ্টবাদ বলে প্রসিদ্ধ। ধর্মীয় বিশৃঙ্খলার কারণেই পুরো সাসানী আমল জুড়ে আর্মেনিয়া নিয়ে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত ছিল। এরূপ ধর্মীয় বাড়াবাড়িই রোম বাইজান্টাইন শাসকদের মোকাবিলায় ইরানকে দুর্বল করে তুলেছিল। পরবর্তীতে অন্যান্য বিশেষত আরবদের জন্যও ইরান বিজয়কে সহজতর করেছিল।

তিনি আরো বলেছেন ,

প্রথম শাপুরের শাসনামলে আযকিরিতার প্রধান ধর্মযাজক ছিলেন এবং শাপুরের পরবর্তীতেও তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। নাকশে রাজাব ,সার মাশহাদ ও যারথুষ্ট্রদের তীর্থস্থানে বিদ্যমান তিনটি শিলালিপিতে শক্তি প্রয়োগে যারথুষ্ট্র ধর্ম প্রচারে তাঁর ব্যবহৃত পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।

তিনি তামাদ্দুনে ইরানী (ইরানী সভ্যতা)48 গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে পুরোহিতগণের শিলালিপি সম্পর্কে আলোচনায় বলেছেন ,

1939 সালে তাখতে জামশিদের নিকটবর্তী নাকশে রুস্তমে শিকাগো ইস্টার্ন এজেন্সী যে খনন কার্য চালায় তাতে যারথুষ্ট্রদের তীর্থস্থানের পূর্বদিকে একটি দীর্ঘ শিলালিপির সন্ধান পাওয়া যায়। এ শিলালিপিতে শীর্ষ ধর্মযাজক কিরিতার বর্ণনা করেছেন যে ,তিনি কিভাবে 242-293 খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রধান ধর্মযাজকের পদ দখল করেছিলেন। অপর একটি শিলালিপিতে অন্য ধর্মের পুরোহিতদের (এ দেশে যাঁদের অবস্থান কল্যাণকর বলে পরিগণিত হতো না) কিভাবে ইরান হতে বহিষ্কার করেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। যে সকল পুরোহিতকে বহিষ্কার করা হয় তাঁরা হলেন ইহুদী ,সামনা (বৌদ্ধ পুরোহিত) ,ব্রাহমা ,খ্রিষ্টান ,নাসেরী ,মুকতাকা ,মুক্তিপ্রাপ্ত (সম্ভবত ভারতীয়) এবং মনিগণ।49

অবশ্য সাসানী শাসনামলের সকল পর্যায়ে ধর্মীয় কঠোরতা একরূপ ছিল না তেমনি বিভিন্ন পর্যায়ে যারথুষ্ট্র পুরোহিতদের ক্ষমতারও হ্রাসবৃদ্ধি ঘটত। সকল শাসকই তাঁদের সম্পূর্ণ অনুগত ছিলেন না। যেমন প্রথম শাপুর ,প্রথম ইয়ায্দ গারদ ও খসরু আনুশিরওয়ানগণ অন্তত তাদের শাসনামলের একাংশ তুলনামূলকভাবে স্বাধীন ছিলেন এবং অন্য ধর্মসমূহের প্রতি কিছুটা উদার আচরণ প্রদর্শন করতেন।

তামাদ্দুনে ইরানী গ্রন্থে ধর্মযাজক কিরিতার-এর শিলালিপি ও তাঁর দ্বারা আরোপিত কঠোরতার আলোচনার পর সাসানী আমলে পশ্চিম ইরানের ধর্মীয় অবস্থা শীর্ষক আলোচনায় বলা হয়েছে :

অন্যদিকে আর্মেনীয় লেখক এলিজা ওয়ারদাপেটের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে তিনি সম্রাট শাপুরের হস্তলিপির উল্লেখ করে বলেছেন সেখানে নির্দেশ দেয়া হয়েছে মুগ ,ইহুদী ,মনী ও অন্যান্য সকল ধর্মাবলম্বী যারা ইরানের বিভিন্ন স্থানে বাস করে তাদের যেন স্বাধীনতা দেয়া হয় যাতে করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতে পারে। প্রথম শ্রেণীর শিলালিপিতে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অত্যাচারের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা দ্বিতীয় বাহরামের (277-293 খ্রি.) সময়কালীন ঘটনা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের শিলালিপি যাতে অন্য ধর্মাবলম্বীদের স্বাধীনতা দানের কথা বলা হয়েছে তা প্রথম শাপুরের (242-273 খ্রি.) সময়কালের এবং এ কৃতিত্ব তাঁরই প্রাপ্য। 50

ক্রিস্টেন সেন তাঁর গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ের যেখানে ইরানের খ্রিষ্টানদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন:

সেখানে তৎকালীন ইরানী খ্রিষ্টানদের সার্বিক অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেছেন , চতুর্থ ও পঞ্চম খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর ইরানী খ্রিষ্টানদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ধর্মের সম্পর্কের বিষয়ে যাখু হতে বর্ণিত হয়েছে ,সাসানী আমলের সবচেয়ে কঠিন সময়েও খ্রিষ্টধর্ম ইরানে স্বাধীন ছিল ;যদিও কখনও কখনও তারা বিভিন্ন শহর ও গ্রামে রাজকীয় কর্মচারীদের অত্যাচারের শিকার হতো। খ্রিষ্টানরা 410 ও 420 খ্রিষ্টাব্দে ইরানের তৎকালীন রাজধানীতে ধর্ম সমিতি গঠন করে যাতে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পক্ষ হতে দু জন পাদ্রী প্রতিনিধি ছিলেন যাঁদের একজন হলেন মিয়াফারেকিনের বিশপ মারুসা এবং আমিদার বিশপ অকাস । দ্বিতীয় শাপুরের আমলে যখন খ্রিষ্টানদের ওপর চরম নিপীড়ন চালানো হয় তখন খ্রিষ্টান পাদ্রী ইফাউত তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য ও উপদেশ বাণী লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু তাতে এরূপ কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না যে ,খ্রিষ্টানরা তাদের স্বাভাবিক ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠানাদি বন্ধ করেছিল। খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের ওপর সব সময় চাপ থাকলেও কখনো সাধারণ খ্রিষ্টানদের ধর্মান্তরিত করার কোন প্রচেষ্টা নেয়া হয় নি। ইরান ও রোমের খ্রিষ্টানরা পারস্পরিক অধিকারের ক্ষেত্রে রোম ও সিরিয় আইনের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করত। বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড খুব কম ঘটত এবং তারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ধর্মযাজকদের নৈতিক দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন যাপন করত। 51

সার্বিকভাবে খ্রিষ্টধর্ম ইরানে সংখ্যালঘু হিসেবে স্বাধীনতা ভোগ করত। যদিও ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে খ্রিষ্টানদের ওপর নির্যাতনের কথা শোনা যায় তদুপরি বলা যায় তা রাজনৈতিক কারণে করা হতো। কারণ ইরানের খ্রিষ্টানগণ পারস্য ও রোম সম্রাজ্যের মধ্যকার দ্বন্দ্বে তাদের স্বধর্মের রোমীয়দের পক্ষাবলম্বন করত। তাদের এ ভূমিকা পারস্য সম্রাটদের ক্রোধের উদ্রেক করত।

ক্রিস্টেন সেন প্রথম ইয়ায্দ গারদ সম্পর্কে বলেন ,

প্রথম ইয়ায্দ গারদ রাজনৈতিক কারণেই খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন তা স্পষ্ট। কারণ তিনি ইরান ও রোমের মধ্যকার সম্পর্কোন্নয়নের যে ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করে তাতে তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত মজবুত হয়। খ্রিষ্টানদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হলেও প্রকৃতগতভাবে তিনি সকল ধর্মের বিষয়ে সমঝোতার নীতিতে বিশ্বাস করতেন।

তিনি খসরু আনুশিরওয়ান সম্পর্কে বলেছেন ,

খসরু যদিও মাযদাকীদের শায়েস্তা করার জন্য যারথুষ্ট্র পুরোহিতদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শাসনামলে পুরোহিত ও সম্ভ্রান্তগণের কেউই পূর্বের ন্যায় ক্ষমতা পান নি। প্রথম খসরু নিঃসন্দেহে যারথুষ্ট্র মতাবলম্বী ছিলেন ,কিন্তু অন্যান্য সাসানী শাসকদের হতে তাঁর স্বাতন্ত্র্য হলো তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামী ও স্থবিরতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাই বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও দর্শনের প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল। তিনি খ্রিষ্টানদের দাতব্য ও সামাজিক কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহে সহযোগিতায় কুণ্ঠিত হতেন না।