আহলে সুন্নাতের ফকীহ্গণ
প্রথমে আমরা আহলে সুন্নাতের ফকীহ্গণ সম্পর্কে একটি ভূমিকা পেশ করছি। উমাইয়্যা খলীফাগণ অ-শিয়া আরব বংশোদ্ভূত ফকীহ্দের পৃষ্ঠপোষকতা করত। পরবর্তীতে আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসলে অ-শিয়া অনারব ফকীহ্দের পৃষ্ঠপোষকতা করা শুরু করে। জর্জি যাইদান উমাইয়্যা খলীফাদের সম্পর্কে বলেন ,
“ উমাইয়্যাগণ গোঁড়া আরব ছিল এবং অনারবদের অপাঙ্ক্তেয় মনে করত। মদীনার ফকীহ্গণ যেহেতু নবী (সা.)-এর পরিবারকে খেলাফতের প্রকৃত উত্তরাধিকারী মনে করত ও উমাইয়্যাদের ক্ষমতার অবৈধ দখলদার হিসেবে অপছন্দ করত সেহেতু উমাইয়্যা শাসকগণ মদীনার ফকীহ্দের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু তদুপরি বাধ্য হয়ে তাঁদের প্রতি বাহ্যিক সম্মান প্রদর্শন করত এবং কখনও কখনও তাঁদের বিভিন্নভাবে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করত। উমাইয়্যা শাসকদের মধ্যে সৎ শাসক হিসেবে উমর ইবনে আবদুল আজিজ মদীনার ফকীহ্দের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। উমাইয়্যাদের পরে আব্বাসীয়রা ক্ষমতা লাভ করে। আব্বাসীয় খলীফা মনসুর আরবদের হেয় ও ইরানীদের বড় করার চেষ্টায় রত হন। কারণ আব্বাসীয় খেলাফত ইরানীদের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মনসুর তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মুসলমানদের দৃষ্টিকে মক্কা ও মদীনা হতে অন্যত্র সরানোর চেষ্টায় রত হন। তিনি মদীনার লোকদের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করেন ও মক্কা হতে মুসলমানদের বিরত রাখার লক্ষ্যে‘ কোব্বাতুল খাদরা’ (সবুজ গম্বুজ) প্রতিষ্ঠা করে মক্কা যাওয়ার পরিবর্তে সেখানে গিয়ে হজ্বের বিধিবিধান পালন করার নির্দেশ দেন। সে সময় মদীনার ফকীহ্ ছিলেন আনাস ইবনে মালেক। তিনি মদীনার লোকদেরকে মনসুর হতে বাইয়াত প্রত্যাহারের ফতোয়া দেন। মদীনার লোকজন মনসুরের বাইয়াত প্রত্যাহার করে ইমাম হাসানের পৌত্র মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে হাসান ইবনে হাসানের হাতে বাইয়াত করে। মুহাম্মদের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকলে মনসুর তাঁকে দমন করার উদ্দেশ্যে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন ও বেশ প্রতিরোধের পর মুহাম্মদ পরাস্ত (বন্দী ও নিহত) হন। মদীনার লোকজন পুনরায় মনসুরের নিকট বাইয়াত করতে বাধ্য হয়। এতদসত্ত্বেও ইমাম মালিক আব্বাসীয় খলীফাদের খলীফা হিসেবে মানতেন না। মনসুরের চাচা মদীনার গভর্নর জাফর ইবনে সুলায়মান এ বিষয় সম্পর্কে অবহিত হলে মালেককে ডেকে পাঠান ও তাঁর পৃষ্ঠ উন্মুক্ত করে চাবুক দ্বারা প্রহার করেন।” 278
ইবনুন নাদিম তাঁর‘ আল ফেহেরেস্ত’ গ্রন্থে ফকীহ্দের সম্পর্কে লিখিত প্রবন্ধে মুহাম্মদ ইবনে সুজার (ইবনুস সালজী নামে প্রসিদ্ধ) জীবনী আলোচনায় একটি কাহিনী বর্ণনা করেছেন যা আব্বাসীয় খলীফাদের রাজনীতিতে ইরানীপ্রেমের সাক্ষ্য বহন করে। তিনি ইসহাক ইবনে ইবরাহীম মাসআবীর নিকট হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন ,
“ খলীফা একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন: আমার কর্মে সহযোগিতার জন্য একজন ফকীহ্ আলেমকে আন যে হাদীস বিষয়ে যেমন পণ্ডিত হবে তেমনি স্বাধীন মত প্রকাশের (কিয়াস করার) যোগ্যতাসম্পন্ন হবে। খোরাসানীদের নিকট হতে আমাদের শাসনের অধীন প্রশিক্ষিত সুন্দর চেহারার এরূপ বৈশিষ্ট্যের এক ব্যক্তিকে মনোনীত কর যাকে বিচার বিভাগের কাযী নিয়োগ করব।” ইসহাক বলেন ,“ আমি খলীফাকে বললাম: মুহাম্মদ ইবনে সুজা সালজী ব্যতীত এরূপ কাউকে দেখছি না। যদি অনুমতি দেন তাহলে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি। খলীফা বললেন: ঠিক আছে। যদি তিনি রাজী হন তাহলে আমার নিকট নিয়ে এসো। আমি মুহাম্মদ ইবনে সুজাকে প্রস্তাব দিলে তিনি তা গ্রহণ করলেন না ;বরং বললেন: এটি গ্রহণ করার কোন প্রয়োজন আমার নেই। আমার অর্থ-সম্পদ ,সম্মান ও মর্যাদা কিছুরই প্রয়োজন নেই...।” 279
আমরা জানি ,আহলে সুন্নাতের ফকীহ্দের মধ্যে চারজন স্বতন্ত্র মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রসিদ্ধ। সাধারণ সুন্নী জনগণ এই চার মাযহাবের একটিকে অনুসরণ করে থাকে। এ চার ফকীহ্ হলেন আবু হানিফা ,শাফেয়ী ,মালেক ইবনে আনাস এবং আহমদ ইবনে হাম্বল। কিন্তু চার মাযহাবের মধ্যে দীনকে সীমিত করার বিষয়টি সপ্তম হিজরী শতাব্দীতে সম্পন্ন হয়। এর পূর্বে আহলে সুন্নাতের মধ্যে দশটি মাযহাব প্রচলিত ছিল।
আমরা আহলে সুন্নাতের ফকীহ্দের সম্পর্কে আলোচনাকে তিন ভাগে ভাগ করেছি। প্রথম ভাগে চার মাযহাবের উদ্ভবের পূর্বের সময়কাল ,দ্বিতীয় ভাগে চার মাযহাবের উৎপত্তির সমকালীন সময় ,তৃতীয় ভাগে চার মাযহাবের ইমামদের পরবর্তী সময়।
চার মাযহাবের পূর্ববর্তী সময়ে তাবেয়ীদের যুগ ছিল। তাবেয়ীন হলেন যাঁরা রাসূল (সা.)-এর সাহচর্য লাভ করেননি কিন্তু তাঁর সাহাবীদের সাহচর্য পেয়েছেন। তাবেয়ীদের মধ্যে সাতজন প্রসিদ্ধ ফকীহ্ মদীনায় ছিলেন যাঁদের‘ ফোকাহায়ে সাবআ’ বলা হয়। তাঁরা হলেন :
1. আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে হারেস ইবনে মাখযুমী: তিনি কুরাইশ বংশোদ্ভূত ব্যক্তি এবং কুরাইশ নেতা আবু জাহলের ভ্রাতার বংশধর। তিনি 94 হিজরীতে মারা যান।
2. সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব মাখযুমী: তিনিও একজন কুরাইশ। তিনি ইবাদাত-বন্দেগীর জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। কথিত আছে তিনি পঞ্চাশ বছর রাত্রি জেগে ইবাদত করেছেন ও রাত্রির এশার নামাজের ওজু দিয়ে ফজরের নামাজ পড়েছেন। অবশ্য আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদর ও অনেক শিয়া আলেম তাঁকে শিয়া বলেছেন।280 সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব 91 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
3. কাসেম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বাকর: তিনি প্রথম খলীফা আবু বকরের বংশধর এবং ইমাম সাদিক (আ.)-এর নানা। আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদরও তাঁকে শিয়া বলেছেন। একটি বর্ণনা মতে কাসেম ইবনে মুহাম্মদের মাতা সাসানী শাসক ইয়ায্দ গারদের কন্যা ছিলেন। এ সূত্র মতে কাসেম পিতার দিক হতে কুরাইশ ও মাতার দিক হতে ইরানী ছিলেন। তিনি 110 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
4. খারেজা ইবনে যায়েদ ইবনে সাবিত আনসারী: তিনি প্রসিদ্ধ সাহাবী যায়েদ ইবনে সাবিতের পুত্র। তিনি 99 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
5. সুলাইমান ইবনে ইয়াসার: তিনি অনারব ,সম্ভবত ইরানী। তিনি 94 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
6. আবদুল্লাহ্ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ: তিনি বিশিষ্ট সাহাবী আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের ভ্রাতুষ্পুত্র। তিনি 98 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
7. উরওয়া ইবনে যুবাইর: তিনি প্রসিদ্ধ সাহাবী যুবাইর ইবনে আওয়ামের পুত্র। তিনিও 94 হিজরীতে মারা যান।
এ সাত ব্যক্তি হতে সম্ভবত একজন (সুলাইমান ইবনে ইয়াসার) ইরানী বংশোদ্ভূত। অন্যান্যরা মক্কা অথবা মদীনার অধিবাসী। অবশ্য এ স্তরে আরো কিছু প্রসিদ্ধ ফকীহ্ ছিলেন যাঁরা ইরানী ছিলেন। যেমন মালেকী মাযহাবের ইমাম মালেক ইবনে আনাসের শিক্ষক রাবীয়াতুর রাই। তিনিই ফিকাহ্শাস্ত্রে কিয়াসের উদ্গাতা। রাবীয়া 136 হিজরীতে মারা যান। তাউস ইবনে কাইসান এ সময়ের অপর প্রসিদ্ধ ইরানী ফকীহ্। তিনি 104 অথবা 106 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। সুলাইমান আমাশও তৎকালীন সময়ের প্রসিদ্ধ ইরানী ফকীহ্।
সে সময়ের প্রসিদ্ধ ফকীহ্দের অন্যতম হলেন ইবনে আব্বাসের মুক্ত দাস আকরামা। আকরামা উত্তর আফ্রিকার অধিবাসী ছিলেন। তিনি তাফসীর ও ফিকাহ্শাস্ত্রে দক্ষ ছিলেন। বিভিন্ন তাফসীর ও ফিকাহর গ্রন্থে তাঁর নাম উল্লিখিত হয়ে থাকে ।