7%

আহলে বাইতের ভালোবাসায় ইমাম শাফেয়ী (রহ.)

মুর্তাযা জাকাঈ সাভেজী

আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইদরীস বিন আব্বাস বিন ওসমান বিন শাফে হাশেমী কারশী মোত্তালেবী-যিনি ইমাম শাফেয়ী নামে সমধিক খ্যাত- আহলে সুন্নাতের ইমাম চেয়ের অন্যতম। এ মহান ব্যক্তি 150 হিজরীতে ফিলিস্তিনের গাজায় জন্ম গ্রহণ করেন। অবশ্য কেউ কেউ তার জান্মস্থান আসকালান ,মিনা বা ইয়েমেন বলেও উল্লেখ করেছেন। শাফেয়ী অনেক দিন মাক্কা শরীফে থেকে ফিকাহশাস্ত্র শিক্ষা করে ছিলেন । এরপর তিনি মদীনায় চলে যান এবং আহলে সুন্নাতের ইমাম চতুষ্টয়ের অন্যতম মালেক বিন আনাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। 179 হিজরীতে ইমাম মালেকের ওফাতের পরে তিনি ইয়েমেনে চলে যান এবং সেখানে কিছু দিন থাকার পর বাগদাদে চলে যান। তিনি 188 হিজরীতে বাগদাদ ত্যাগ করেন এবং হারান (ইরাকে অবস্থিত) ও শাম (সিরিয়া) হয়ে মিশরে যান। কিন্তু 195 হিজরীতে তিনি পুনরায় বাগদাদে ফিরে আসেন এবং 198 হিজরী পর্যন্ত সেখানে শিক্ষা দানের কাজে নিয়োজিত থাকেন। এর পর তিনি পুনরায় মিশরে গমন করেন। 200 হিজরীতে তিনি বাইতুল্লাহ শরীফেরে উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করেন এবং হজ্ব সমাপনের পরে মিশরে ফিরে যান। 204 হিজরীতে তিনি মিশরের ফুস্তাতে ইন্তেকাল করেন।

ইমাম শাফেয়ী অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। গবেষকদের গবেষণা অনুযায়ী তার রচিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা 113 থেকে 140টি। ইবনে নাদীম তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল ফিহরিস্ত -এ-তার লিখিত 109টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। তার লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থাবলীর অন্যতম হচ্ছে কিতাবুল উম্ম যা তার অনুসারী ইউসুফ বিন ইয়াহইয়া বুয়েতী (জন্ম 270 হিজরী) কর্তৃক সংকলিত ও রাবি বিন সোলায়মান কর্তৃক বিভিন্ন অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে। কিতাবুল উম্ম -এর বিষয় বস্তু হচ্ছে ফিকাহ। গ্রন্থটি 1961-19633 খ্রিষ্টাব্দে কায়রো থেকে 8খণ্ড- এবং 1321-1326 হিজরীতে বুলা থেকে একবার চার খণ্ড- ও আরেকবার 1324-1325 হিজরীতে সাত খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।

শাফেয়ী রচিত অপরাপর বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : আল মুসনাদ (হাদীস গ্রন্থ) , আহকামুল কুরআন , আসসুনান , আর রিসালাতু ফি উসূলিল ফিকহ , ইখতিলাফুল হাদীস , আসা সাবাকু ওয়ার রামী , ফাযায়েলু কুরাইশ , আদাবুল কাজী , আল মাওয়ারিস ইত্যাদি।

প্রাচীন কালের গবেষক ইবনে আবি হাতেম রাযী (জন্ম 327 হিজরী) ,আবি বাকর মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বিন মানজার (জন্ম 318 হিজরী) ,আবি জা ’ফার বিন মুহাম্মাদ খুলদী (জন্ম 348 হিজরী) ,মুহাম্মদ বিন হোসাইন বিন ইবরাহীম ‘আছেম আবেরী (জন্ম 363 হিজরী) ,ফখরুদ্দীন আবি আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ওমর রাযী (জন্ম 606 হিজরী) প্রমুখ শাফেয়ী সম্বন্ধে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং তাতে তার সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আধুনিক কালের গবেষক ওয়াস্তেন ফেল্ড ( Wusten Feld) ইমাম শাফেয়ী এবং 300 হিজরী পর্যন্ত তার শিষ্য -অনুসারীদের সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তেমনি মুস্তাফা মুনীর আদহাম ,আবু মুহাম্মাদ যোহরাহ প্রমুখ ইমাম শাফেয়ী সম্বন্ধে গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন।

স্বাধীন চিন্তাধারা পোষণকারী এ মহান মনীষী সব রকমের অন্ধত্ব থেকে মুক্ত থেকে নিষ্পাপ ও পবিত্র আহলে বাইত সম্বন্ধে স্বীয় মনোভাবকে বারবার সুস্পষ্টভাবে বয়ান করেছেন। তিনি মীনায় অবস্থানরত হাজীদের সম্বোধন করে যে সুন্দর কবিতা রচনা করেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধান যোগ্য। তিনি লিখেছেন :

ان ﮐﺎ ن ر ﻓﻀﺎ ﺣﺐ ﺁ ل ﻣﺤﻤﺪ

ﻓﻠﻴﺸﻬﺪ ا ﻟﺜﻘﻼ ن ا ﻧﯽ را ﻓﻀﯽ

আলে মুহাম্মাদের প্রতি ভালোবাসা যদি রাফযী হয় তাহলে জিন ও ইনসান সাক্ষী থাকুক যে ,নিশ্চয়ই আমি রাফেযী।

তিনি তার আরে কবিতায় আহলে বাইত এর প্রতি তার ভালোবাসা এভাবে প্রকাশ করেছেন :

اذا ﻓﯽ ﻣﺠﻠﺲ ذ ﮐﺮ وا ﻋﻠﻴﺎ

و ﺷﺒﻠﻴﻪ و ﻓﺎﻃﻤﺔ ا ﻟﺰ کیة

ﻳﻘﺎ ل : ﺗﺠﺎ وزوا ﻳﺎ ﻗﻮ م ﻋﻦ ذا

ﻓﻬﺬ ا ﻣﻦ ﺣﺪﻳﺚ ا ﻟﺮ ا ﻓﻀﻴﻪ

هر ﺑﺖ ا ﻟﻲ ا ﻟﻤﻬﻴﻤﻦ ﻣﻦ ا ﻧﺎ س

ﻳﺮ ون ا ﻟﺮﻓﺾ ﺣﺐ ا ﻟﻔﺎﻃﻤﻴﻪ

ﻋﻠﻲ ﺁ ل ا ﻟﺮﺳﻮ ل ﺻﻠﻮ ة ر ﺑﻲ

و ﻟﻌﻨﺔ ﻟﺘﻠﻚ ا ﻟﺠﺎ هلیة

- যখন কোনো মজলিসে লোকেরা আলীকে স্মরণ করলো ,আর তার দুই সিংহ শাবককে (তার দু পুত্রকে) ও পবিত্র ফাতেমাকে ,বলা হলো : হে লোকেরা! (সাবধান!) ওরা সঙ্গীমালঙ্ঘন করেছে এ (ইসলামের সীমারেখা) থেকে ,আর এ মত দেয়া হয় হাদীসে রাফেযিয়াহর ভিত্তিতে ,(কিন্তু) আমি ঐসব লোক থেকে মুহাইমেনের (আল্লাহ তা আলার) দিকে পালিয়ে গেলাম ,ফলে (আমার মধ্যে) মুহাববাতে ফাতেমিয়াহ সুদৃঢ় হলো ,আমার রবের সালাওয়া আলে রাসূলের ওপর ,আর লা নত ঐ জাহেলীয়াতের ওপর ।

ইবনে হাজ্র মাক্কীও ইমাম শাফেয়ী থেকে নিম্নোক্ত পংক্তি উদ্ধৃত করেছেন :

ﻳﺎ اهل ﺑﻴﺖ ر ﺳﻮ ل ا ﷲ ﺣﺒﻜﻢ

ﻓﺮ ض ﻣﻦ ا ﷲ ﻓﻲ ا ﻟﻘﺮﺁ ن ا ﻧﺰﻟﻪ

کفاکم ﻣﻦ ﻋﻈﻴﻢ ا ﻟﻘﺪ ر ا ﻧﻜﻢ

ﻣﻦ ﻟﻢ ﻳﺼﻠﻲ ﻋﻠﻴﻜﻢ ﻻﺻﻠﻮ ة ﻟﻪ

হে রাসূলুল্লাহর আহলে বাইত ! তোমাদের (প্রতি) মুহাববাত ,আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয করা হয়েছে তার নাযিলকৃত কুরআনে ,এটাই যথেষ্ট যে ,(তোমাদের মধ্যে) মহান মর্যাদা পুঞ্জীভূত হয়েছে ,অতএব ,নিঃসন্দেহে তোমরা হচ্ছে সেই ব্যক্তিগণ ,যে ব্যক্তি তোমাদের ওপর সালাত (দরুদ) প্রেরণ করেনি তার জন্য কোনো সালাত (নামায ) নেই।

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শোকে ইমাম শাফেয়ীর কাসিদা (কবিতা)

মুওয়াফফাক বিন আহমদ খাওয়ারিমী তার মাকতালুল হোসাইন -এ স্বীয় ধারাবাহিক সনদসূত্রে মুহাম্মাদ বিন ইদরীস শাফেয়ী থেকে একটি কাসিদাহ উদ্ধৃত করেছেন। কাসিদাটি হচ্ছে :

ﺗﺄ وب همی و ا ﻟﻔﺆ اد کتیب

وارق ﻧﻮﻣﻲ ﻓﺎﻟﺴﺤﺎ ر ﻏﺮﻳﺐ

و ﻣﻤﺎ ﻧﻔﻲ ﻧﻮﻣﻲ و ﺷﻴﺐ ﻟﻤﺘﻲ

ﺗﺼﺎ ر ﻳﻒ ا ﻳﺎ م ﻟﻬﻦ ﺧﻄﻮ ب

ﻓﻤﻦ ﻣﺒﻠﻎ ﻋﻨﻲ ا ﻟﺤﺴﻴﻦ ر ﺳﺎﻟﺔ

و ان کرهتها انفس و قلوب

ﻗﺘﻴﻼ ﺑﻼﺟﺮ م کأن ﻗﻤﻴﺼﺔ

ﺻﺒﺢ ﺑ ـ ﻤﺎ ء ا ﻻ ر ﺟﻮ ان ﺧﻀﻴﺐ

ﻓﻠﻠﺴﻴﻒ ا ﻋﻮ ال و ﻟﻠﺮﻣﺢ ر ﻧﺔ

و ﻟﻠﺨﻴﻞ ﻣﻦ ﺑﻌﺪ ا ﻟﺼﻬﻴﻞ ﻧﺤﻴﺐ

ﺗﺰﻟﺰﻟﺖ ا ﻟﺪﻧﻴﺎ ﻵ ل ﻣﺤﻤﺪ

وکاذت ﻟﻬﻢ ﺻﻢ ا ﻟﺠﺒﺎ ل ﺗﺬ وب

و ﻏﺎ رت ﻧﺠﻮ م وا ﻗﺸﻌﺮ ت کواکب

وهتک ا ﺳﺘﺎ ر و ﺷﻖ ﺟﻴﻮ ب

ﻳﺼﻠﻲ ﻋﻠﻲ ا ﻟﻤﻬﺪ ي ﻣﻦ ال ها ﺷﻢ

و ﻳﻐﺰ ي ﻧﺒﻮﻩ ان ذا ﻟﻌﺠﻴﺐ

ﻟﺌﻦ کان ذ ﻧﺒﻲ ﺣﺐ ﺁ ل ﻣﺤﻤﺪ

ﻓﺬ ا ﻟﻚ ذ ﻧﺒﻲ ﻟﺴﺖ ﻋﻨﻪ ا ﺗﻮ ب

هم ﺷﻔﻌﺎﺋﻲ ﻳﻮ م ﺣﺸﺮ ي و ﻣﻮﻗﻔﻲ

اذا کثر ﺗﻨﻲ ﻳﻮ م ذاك ذ ﻧﻮ ب

আমার বেদনার প্রতিক্রিয়য় হৃদয় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো এবং আমার নিদ্রা হরণ করে নিলো ,এরপর নিদ্রা যে কত দূরে। আর যা আমার নিদ্রা কড়ে নিয়েছে এবং আমাকে করে দিয়েছে তা হচ্ছে কালের সেই বিবর্তন যা তাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক ছিলো। অতঃপর কে আমার বাণীকে হোসাইনের কাছে পৌছে দবে ? যদিও এ বাণী সকল ব্যক্তি ও হৃদয় অপছন্দ করবে ,তা হচ্ছে নিরপরাধ শহীদ যেন এই যে ,তার জামাকে রক্তিম রং মেশানো পানিতে ডুবিয়ে রাঙ্গানো হয়েছে। অতএব ,তলোয়ারের জন্যই বিলাপ ও আর্তনাদ এবং বর্শার জন্যই বেদনার দীর্ঘশ্বাস ,আর হ্রেষা ও দাবড়ানোর পরে অম্বের জন্য রয়েছে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন।

আলে মুহাম্মাদের জন্য দুনিয়া প্রকম্পিত হবে ,যেহেতু অচিরেই তাদের (বেদনার) কারণে পাহাড়গুলো বিগলিত হয়ে যাবে। তারকারাজি ছিটকে পড়েছে ধ্বংস হয়ে গেছে ,পোশোকসমূহ ছিন্ন হয়েছে ,জামার গলাবন্ধ ফেটে গেছে। হাশেম বংশের লোকেরা যারা স্বীয় সন্তানদেরকে মুহাববাতের শিক্ষা দান করেন তাদের পক্ষ থেকে মাহদীর প্রতি দরুদ ;আলে মুহাম্মাদের প্রতি মুহাববাত যদি গুনাহ হয়ে থাকে তাহলে এ হচ্ছে সেই গুনাহ যা থেকে আমি কখনোই তওবাহ করবো না। কিয়ামতের দিন তারাই আমার শাফায়াতকারী যেদিন আমার গুনাহ পরিমাণ হবে অনেক বেশি ;সেদিন তারাই আমার সাহায্যকারী।

অনুবাদ :নূর হোসেন মজিদী ,

সূত্র: কেইহানে ফারাঙ্গী ,সংখ্যা -1023-0289

হে মানব জাতি! আমি তোমাদের মাঝে অতি ভারী মহান দু টি জিনিস রেখে যাচ্ছি ;যদি তোমরা তা ধরে রাখো তবে তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না- একটি হলো আল্লাহর কিতাব যার মধ্যে রয়েছে হেদায়াতের নুর ,অপরটি আমার আহলে বাইত । অতঃপর হাউজে কাওসারে যাওয়া পর্যন্ত এই দুই জিনিস কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না।

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) (তিরমিযী ,মুসলিম)