শয়তানের হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গ
অনেক মানুষই মনে করে যে , মানুষের গোমরাহীর জন্য কেবল শয়তানই দায়ী। তাদের ধারণা , শয়তানকে সৃষ্টি করা না হলে হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ) বেহেশত থেকে বহিষ্কৃত হতেন না এবং আমরা (মানব প্রজাতি) বেহেশতেই থাকতাম। কেউ কেউ অজ্ঞতাবশতঃ এতদূর পর্যন্ত বলে যে , আল্লাহ্ তা‘ আলা মানুষকে গোমরাহ্ করার উদ্দেশ্যেই আগেই শয়তানকে (অর্থাৎ আযাযীল বা ইবলীসকে) সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। বলা বাহুল্য যে , এটা মহান আল্লাহ্ তা‘ আলা সম্পর্কে অত্যন্ত হীন ধারণা।
যেহেতু বিষয়টি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত ধারণারই অংশবিশেষ এবং বিশেষ করে এ ধারণায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত হওয়া ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘ আলাকেই দায়ী করা হয় সেহেতু এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা জরুরী বলে মনে হয়।
প্রথম কথা হচ্ছে এই যে , শয়তানের গোমরাহ্ করার ক্ষমতা অদৃষ্টবাদ প্রমাণ করে না , বরং অদৃষ্টবাদকে খণ্ডন করে। কারণ , এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , আল্লাহ্ তা‘ আলা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে মানুষ সহ প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টির ভবিষ্যতের ছোটবড় সবকিছু নির্ধারণ করে রাখেন নি। কেননা , আল্লাহ্ তা‘ আলা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে সব কিছু নির্ধারণ করে রেখে থাকলে শয়তানের কোনো ক্ষমতা থাকার প্রশ্ন ওঠে না। তেমনি শয়তানের ক্ষমতা এ-ও প্রমাণ করে যে , প্রতি মুহূর্তে মানুষ সহ সকল সৃষ্টির প্রতিটি কাজ স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘ আলা করেন বা করিয়ে নেন-এ ধারণাও পুরোপুরি ভ্রান্ত।
এ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি আনুষঙ্গিক ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করা যরূরী বলে মনে হয়। এসব ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে , আযাযীল (শয়তান) ফেরেশতা ছিলো এবং ফেরেশতাদের শিক্ষক ছিলো। অবশ্য যারা জানে যে , কোরআন মজীদে আযাযীলের জিন্ প্রজাতির সদস্য হওয়ার কথা উল্লেখ আছে , তাদের অনেকে মনে করে যে , সে জিন্ হলেও ফেরেশতাদের শিক্ষক ছিলো। আর এদের সকলেই মনে করে যে , সে অত্যন্ত উঁচু স্তরের‘ আাবেদ (আল্লাহ্ তা‘ আলার‘ ইবাদতকারী) ছিলো ; অতঃপর আল্লাহ্ তা‘ আলার একটিমাত্র হুকুম অমান্য করে [হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে] আল্লাহর অভিসম্পাতের শিকার হয়। এজন্য অনেকে বিস্ময়করভাবে দাবী করে যে , আযাযীল ছিলো সবচেয়ে বড় তাওহীদবাদী , এ কারণে সে আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে সিজদাহ্ করতে রাযী হয় নি। (!!!)
এসব দাবী অকাট্য দলীল বিহীন ভিত্তিহীন কাল্পনিক দাবী মাত্র। কারণ , আযাযীল বা ইবলীস ফেরেশতা ছিলো না। ফেরেশতারা আল্লাহ্ তা‘ আলার নাফরমানী করতে পারে না ; নাফরমানীর মূল চালিকাশক্তি স্বাধীনতা ভোগের প্রবণতা , বিশেষতঃ কুপ্রবৃত্তি থেকে তারা মুক্ত। বরং আযাযীল জিন্ প্রজাতির সদস্য ছিলো (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্: ৫০) ।
আর যারা স্বীকার করেন যে , আযাযীল জিন্ প্রজাতির সদস্য ছিলো , কিন্তু অত্যন্ত উঁচু দরের আলেম ও‘ আাবেদ ছিলো বিধায় আল্লাহ্ তা‘ আলা তাকে ফেরেশতাদের শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। এ দাবীরও কোনো ভিত্তি নেই। বিশেষ করে ফেরেশেতাদের সম্পর্কে ইসলামের অকাট্য সূত্রসমূহ থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হচ্ছে তাদের মধ্যে অজ্ঞতা , সুপ্ত প্রতিভা ও প্রতিভার বিকাশ ও জ্ঞানার্জন বলতে কোনো কিছু নেই। বরং সৃষ্টিগতভাবেই তারা আল্লাহ্ তা‘ আলা সম্পর্কিত , স্বীয় নিয়মিত দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত ও আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে সৃষ্টি সম্পর্কে প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী এবং সেই সাথে আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে যখনই যে হুকুম দেয়া হয় তা পালনের প্রবণতার অধিকারী। এমতাবস্থায় তাদের জন্য শিক্ষক নিয়োগের ধারণা একটি একান্তই অবান্তর ধারণা।
অন্যদিকে জিন্ প্রজাতির সদস্য আযাযীল আদৌ কোনো‘ আাবেদ ছিলো না। বরং হযরত আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির পূর্ব থেকেই সে নাফরমান ছিলো। হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করতে আযাযীল ইবলীসের অস্বীকৃতি প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘ আলা এরশাদ করেন:
( أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ)
“ সে (আল্লাহর হুকুম পালনে) অস্বীকৃতি জানালো ও বড়ত্ব দাবী করলো (অহঙ্কার করলো) ; আর সে ছিলো কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩৪)
অনেকে এ আয়াতের শেষ বাক্যের অর্থ করেন:“ আর সে কাফের হয়ে গেলো।” বা“ আর সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো।” কিন্তু এরূপ অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয়। সে মুসলমান (আল্লাহর অনুগত) ছিলো , কিন্তু কাফের হয়ে গেলো-এটা বুঝাতে চাওয়া হলে বলা হতো:فاصبح کافراً (ফলে সে কাফের হয়ে গেলো)। কিন্তু আয়াতে যা বলা হয়েছে তা থেকে সুস্পষ্ট যে , সে পূর্ব থেকেই কাফের ছিলো। শুধু তা-ই নয় , আয়াত থেকে এ-ও বুঝা যায় যে , হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করার জন্য আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে যখন হুকুম দেয়া হয় তখন সে একাই কাফের ছিলো না , বরং পূর্ব থেকেই একটি গোষ্ঠী (একদল জিন্) কাফের ছিলো ; ইবলীস ছিলো তাদের নেতা।
এমনকি আল্লাহ্ তা‘ আলা হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করার জন্য ইবলীসকে হুকুম না দিলে সে হযরত আদম (আঃ) ও মানব প্রজাতির ক্ষতি করার (তাদেরকে গোমরাহ্ করার) চেষ্টা করতো না-এরূপ মনে করাও ঠিক নয়। কারণ , কুফর্ বা খোদাদ্রোহিতার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মু’ মিনদেরকে কুফরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা।
অন্যদিকে ঐ সময় ইবলীসের অস্তিত্ব না থাকলেও তথা ইবলীসকে আদৌ সৃষ্টি করা না হলেও মানব প্রজাতিকে বেহেশতে রাখা হতো না। কারণ , মানুষকে সৃষ্টি করাই হয়েছিলো ধরণীর বুকে আল্লাহ্ তা‘ আলার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০)।
অবশ্য বেহেশতে থাকাকালে ইবলীসের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ঘটনা না ঘটলে কোনোরূপ তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়াই হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ)কে বেহেশত ছেড়ে যমীনে আসতে হতো।
ইবলীসের অস্তিত্ব না থাকলে কোনো মানুষই নাফরমান হতো না তা নয়। কারণ , স্বাধীনতার মানেই হচ্ছে নাফরমানী ও ফরমানবরদারী উভয়েরই সম্ভাবনা। আল্লাহ্ তা‘ আলা যখন ধরণীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি (খলীফাহ্) পাঠাবার কথা ঘোষণা করেন (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০) তখনই ফেরেশতারা ধারণা করে নেয় যে , আল্লাহর প্রতিনিধিগণ (অন্ততঃ তাদের একাংশ) নাফরমানী করবে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০)। কারণ ,“ খলীফাহ্” (স্থলাভিষিক্ত) শব্দ থেকেই তারা বুঝতে পেরেছিলো যে , আল্লাহ্ তা‘ আলার ক্ষমতা , এখতিয়ার ও গুণাবলীর অনুরূপ ক্ষমতা , এখতিয়ার ও গুণাবলী এ নতুন সৃষ্টিকে (সীমিত পরিমাণে হলেও) দেয়া হবে , কিন্তু সৃষ্টি হওয়া জনিত সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কারণে তাদের দ্বারা স্বীয় ক্ষমতা ও এখতিয়ারের অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। অসম্ভব নয় যে , ইতিপূর্বে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টি জিন্ প্রজাতির সদস্যদের একাংশের নাফরমানী দেখেই তাদের এ ধারণা হয়ে থাকবে। বিশেষ করে জিন্ প্রজাতি আল্লাহ্ তা‘ আলার খলীফাহ্ ছিলো না বিধায় তাদের ক্ষমতা , এখতিয়ার ও স্বাধীনতা ছিলো অপেক্ষাকৃত সীমিত , কিন্তু আল্লাহ্ তা‘ আলার খলীফাহ্ হওয়ার কারণে মানুষের ক্ষমতা , এখতিয়ার ও স্বাধীনতা হবে তাদের চেয়ে অনেক বেশী। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যকার অন্ততঃ একাংশের পক্ষ থেকে নাফরমানী হওয়াই স্বাভাবিক।
মোদ্দা কথা , নাফরমান ইবলীস না থাকলেও কতক মানুষ নাফরমান হতো।
বস্তুতঃ“ শয়তান” কোনো ব্যক্তিবাচক নাম নয় , বরং গুণবাচক নাম। তাই আল্লাহ্ তা‘ আলার এ সৃষ্টিলোকে ইবলীস বা আযাযীল একাই শয়তান নয়। কোরআন মজীদে‘ শাইত্বান’ শব্দের বহু বচন‘ শায়াত্বীন্’ শব্দটি ১৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে। জিন্ ও মানুষ উভয় প্রজাতির মধ্যেই শয়তান রয়েছে (সূরাহ্ আল্-আন্‘ আম্: ১১২)। শুধু মানুষ শয়তানদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ১৪)। প্রায় অভিন্ন অর্থে“ খান্নাস্” শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে , যে মানুষের অন্তরে ওয়াস্ওয়াসাহ্ (কুমন্ত্রণা ও সন্দেহ-সংশয়) সৃষ্টি করে এবং এ ধরনের খান্নাস্ মানুষ ও জিন্ উভয় প্রজাতির মধ্যেই রয়েছে (সূরাহ্ আন্-নাস্: ৫-৬)।
প্রকৃত পক্ষে মানুষকে গোমরাহ্ করার ক্ষেত্রে মানুষের নিজের ভূমিকা ইবলীসের চেয়ে বেশী। তাই যে ব্যক্তি গোমরাহ্ হতে চায় না তাকে গোমরাহ্ করার কোনো ক্ষমতাই ইবলীসের নেই (সূরাহ্ ইবরাহীম: ২২ ; আল্-হিজর্: ৪২ ; আন্-নাহল্: ৯৯ ; ইসরা’ / বানী ইসরাঈল: ৬৫)। অন্যদিকে কতক লোক স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে প্রবৃত্তিপূজায় লিপ্ত হয় , কোরআন মজীদের ভাষায় , স্বীয় প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ্ রূপে গ্রহণ করে (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ৪৩ ; আল্-জাছিয়াহ্: ২৩)। এ ধরনের লোককে হেদায়াত করা স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জন্যও সম্ভব ছিলো না (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ৪৩)।
অতএব , সুস্পষ্ট যে , মানুষের গোমরাহীর জন্য সে নিজেই মুখ্য কারণ ; ইবলীস সহ অন্যান্য শয়তান গৌণ কারণ মাত্র।