বিচারবুদ্ধির মানদণ্ড কেন
আমরা আমাদের আলোচনায় প্রধানতঃ তিনটি অকাট্য জ্ঞানসূত্রের আশ্রয় নিয়েছি , তা হচ্ছে : বিচারবুদ্ধি (‘ আক্বল্) , কোরআন মজীদ ও প্রথম যুগ থেকে চলে আসা মুসলমানদের সর্বসম্মত মত ও আমল - যাকে আমরা ইজমা ‘ এ উম্মাহ্ নামকরণ করেছি - যা অকাট্যভাবে সুন্নাতে রাসূল (ছ্বাঃ)-এর উদ্ঘাটনকারী। অবশ্য আমরা বস্তুবিজ্ঞানের ও অভিজ্ঞতার অকাট্য দলীলও বিবেচনায় নিয়েছি , তবে তা বিচারবুদ্ধির দলীলেরই সম্প্রসারণ হিসেবে মাত্র।
তিনটি কারণে আলোচ্য বিষয়ে বিচারবুদ্ধি (‘ আক্বল্)কে অন্যতম মানদণ্ড বা অকাট্য জ্ঞানসূত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথমতঃ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সর্বজনীনকরণ অর্থাৎ বিষয়টিকে শুধু মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা , দ্বিতীয়তঃ সাম্প্রতিককালে মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী চিন্তাধারার প্রভাব বৃদ্ধির কারণে যে সব ক্ষেত্রে কোরআন মজীদে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে এমন অনেক বিষয়েও বিচারবুদ্ধির দলীল ছাড়া অনেক লোকের পক্ষেই মানসিক নিশ্চিন্ততার অধিকারী হওয়া সম্ভবপর হয় না। তৃতীয়তঃ স্বয়ং কোরআন মজীদ বিচারবুদ্ধি (‘ আক্বল্) কাজে লাগানোর ওপর বার বার তাকিদ করেছে।
বস্তুবাদীরা বস্তুর বাইরে কোনো অবস্তুগত অস্তিত্ব আছে বলে স্বীকার করে না। এ কারণে তারা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণশীল অস্তিত্বকে বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল বলে দাবী করে অর্থাৎ তারা বস্তু-উর্ধ আত্মার (নাফ্স্-এর) এবং সৃষ্টিকর্তা ও পরকালের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ফলে স্বভাবতঃই তারা‘ আালামে বারযাখ্ বা ক্ববরের জীবনের অস্তিত্বও স্বীকার করে না। কিন্তু সুস্থ বিচারবুদ্ধি মানুষের বস্তুগত শরীর জুড়ে অবস্থানরত বস্তু-উর্ধ সত্তা (নাফ্স্/ আত্মা) ও সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব এবং পরকালের দৃঢ় সম্ভাবনার পক্ষে রায় প্রদান করে ; কেবল অন্ধ প্রবৃত্তিপূজারীদের পক্ষেই সে রায় প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব। [এ বিষয়ে আমি আমার জীবন জিজ্ঞাসা গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।]
দ্বিতীয়তঃ বিচারবুদ্ধির দলীল পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত মুসলমানদের ঈমানী দুর্বলতা দূরীকরণে সহায়ক হয়। বিশেষ করে যারা বস্তুবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে কোরআন মজীদের আয়াতের সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যকেও রূপকভাবে ব্যাখ্যা করতে অভ্যস্ত বিচারবুদ্ধির দলীল তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূরীকরণে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
বিচারবুদ্ধির মানদণ্ডের গ্রহণযোগ্যতা
[এ সম্পর্কে আমার জীবন জিজ্ঞাসা গ্রন্থের‘ বিচারবুদ্ধি ও ইসলাম ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ; এখানে সংক্ষিপ্ত আভাস দেয়া হলো।]
ইসলামের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে সুস্থ বিচারবুদ্ধির প্রয়োগে উৎসাহিত করা এবং ইসলাম তার মৌলিক দাও ‘ আত্-কে সুস্থ বিচারবুদ্ধির কাছেই উপস্থাপন করেছে। কিন্তু এ বিষয়টি সম্বন্ধে সচেতন না থাকার কারণে অনেকেই দ্বীনের মৌলিক উপস্থপনাসমূহের ব্যাপারে বিচারবুদ্ধির দ্বারস্থ হওয়ার বিরোধিতা করেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে : বিচারবুদ্ধি ভুল করতে পারে।
তাঁদের এ যুক্তির জবাব হচ্ছে এই যে , জীবন ও জগতের পিছনে নিহিত মহাসত্য সম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্নাবলীর জবাবে সুস্থ বিচারবুদ্ধি (‘ আক্বলে সালীম্)-এর ভুল করার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। আর বিচারবুদ্ধি যদি ভুল করেও , তো তা বিচারবুদ্ধিভিত্তিক পর্যালোচনার সাহায্যে চিহ্নিত করতে সক্ষম। অর্থাৎ কেউ যদি বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভুল করে থাকে তো পরবর্তীতে তার নিজের বিচারবুদ্ধিই , অথবা অন্যদের কারো না কারো বিচারবুদ্ধি তা ধরতে সক্ষম হবে।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে , ইসলাম অন্যান্য ধর্মের ন্যায় কোনো ধর্ম নয়। অন্য সমস্ত ধর্ম অন্ধ বিশ্বাসের নিকট আবেদন করে , কিন্তু ইসলাম তার বিপরীতে মানুষের বিচারবুদ্ধির নিকট আবেদন করে। যারা একাধিক খোদার বা দেবদেবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস পোষণ করে তাদের সে বিশ্বাসের পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। আসলে একই বিষয়ে অন্ধ বিশ্বাস ও যুক্তি একত্রে চলতে পারে না। অন্যদিকে ইসলাম জীবন ও জগতের পিছনে নিহিত মহাসত্য সম্বন্ধে বিচারবুদ্ধির দলীল অর্থাৎ যুক্তি উপস্থাপন করেছে। স্বয়ং কোরআন মজীদ আল্লাহ্ তা‘ আলার অস্তিত্ব ও একত্ব প্রমাণ করার জন্য যুক্তি উপস্থাপন করেছে , যেমন , আল্লাহ্ তা‘ আলার একত্ব প্রমাণের লক্ষ্যে বলেছে :
) لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلا اللَّهُ لَفَسَدَتَا(
“ এতদুভয়ে (আসমান ও যমীনে) যদি আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোনো ইলাহ্ থাকতো তাহলে এতদুভয় ধ্বংস হয়ে যেতো। ” (সূরাহ্ আল্-আম্বিয়া ’ : ২২)
এভাবে তাওহীদ , আখেরাত ও নবুওয়াত্ প্রশ্নে কোরআন মজীদ বহু বিচারবুদ্ধিগ্রাহ্য দলীল বা যুক্তি উপস্থাপন করেছে। এভাবে বিচারবুদ্ধির দলীল উপস্থাপনের কারণ এই যে , আল্লাহ্ তা‘ আলা সকল মানুষকে জীবন ও জগতের পিছনে নিহিত মহাসত্য খুঁজে পাবার ক্ষমতা স্বরূপই বিচারবুদ্ধি দান করেছেন। তাই সকল মানুষের নিকট অভিন্নভাবে গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড হচ্ছে বিচারবুদ্ধি (‘ আক্বল্) । অন্যান্য ধর্ম যেভাবে তাদের মৌলিক উপস্থাপনাগুলোকে অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তিশীল করেছে ইসলামও যদি সেভাবেই মানুষের কাছে অন্ধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে আবেদন পেশ করতো তাহলে ইসলামের আবেদন সত্য হওয়া সত্ত্বেও কেউ তা গ্রহণ করতো না। কারণ , অন্ধ বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই যে , প্রতিটি ব্যক্তিই নিজ নিজ বিশ্বাসের অনুসরণ করবে। তাই কোরআন মজীদ বার বার বিচারবুদ্ধির কাছে আবেদন জানিয়েছে। কোরআন মজীদে কম পক্ষে তেরো বার এরশাদ হয়েছে :افلا تعقلون؟ -“ অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাবে না ?”
বিচারবুদ্ধি অবশ্য খুঁটিনাটি ও বিশেষজ্ঞত্ব পর্যায়ের বিষয়াদিতে স্বাধীনভাবে ফয়ছ্বালা দিতে সক্ষম নয় , কিন্তু জীবন ও জগতের পিছনে নিহিত মৌলিকতম সত্যসমূহ উদ্ঘাটনে সক্ষম। সুতরাং যে কেউ এ বিষয়ে বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাবে সে-ই তাওহীদ , আখেরাত্ ও নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (ছ্বাঃ)-এর সত্যতায় উপনীত হবে। অন্যদিকে কোরআন মজীদের তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও , বিশেষ করে মতপার্থক্যের ক্ষেত্রগুলোতে বিচারবুদ্ধি সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
সুতরাং মত্যুপরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগত - যা আখেরাত সংক্রান্ত ধারণারই একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা , সে সম্পর্কে প্রথমেই আমরা বিচারবুদ্ধির দ্বারস্থ হবো। কারণ , যদিও বিচারবুদ্ধি এতদসংক্রান্ত খুঁটিনাটি উদ্ঘাটনে সক্ষম নয় , তবে মত্যুপরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগতের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদেরকে পথনির্দেশ দানে সক্ষম। এরপর আমরা দেখবো যে , এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে কী আছে।