7%

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্

সর্বজনীনভাবে মানবপ্রজাতির অনুভূতি মৃত ব্যক্তিদের আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার সচেতন উপস্থিতির সপক্ষে রায় দেয় , অচেতন বা ঘুমন্ত অবস্থার সপক্ষে রায় দেয় না। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকলেই সদ্যমৃত ব্যক্তি সম্পর্কে অনুভব করে যে , যেন সে আশেপাশেই আছে , যেন সব কিছু দেখছে ও শুনছে , কিন্তু কথা বলতে পারছে না অর্থাৎ জীবিতদের শোনার মতো করে কথা বলতে পারছে না।

এমনকি নাস্তিক লোকেরা পর্যন্ত তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মৃতদেহের প্রতি সম্মান দেখায় এবং তাদের স্মৃতির প্রতি ঠিক সেভাবেই ভক্তি , শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে যেভাবে ভক্তি , শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতো তাদের জীবদ্দশায় ; তাদের চেতনার অসম্মান হোক এটা তারা কিছুতেই মানতে পারে না। এ ব্যাপারে তাদের প্রায় সকলেই আন্তরিক। বিশেষ করে মৃত ব্যক্তিদের জীবিত থাকাকালে যাদের সাথে তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো তার মৃত্যুর পরেও তারা তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা অনুভব করে। কিন্তু যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তথা অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা পোষণের তো কোনোই অর্থ হয় না। আসলে তারা অবচেতনভাবে হলেও মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার অমরত্ব ও কাছাকাছি উপস্থিতির প্রত্যয় পোষণ করে। অন্যদিকে যারা আস্তিক , ধর্ম নির্বিশেষে তাদের সকলেই সচেতনভাবেই এ প্রত্যয় পোষণ করে থাকে।

মানুষ সাধারণতঃ এমন কিছু করতে চায় না তার মৃত স্বজন বেঁচে থাকলে যা অপসন্দ করতো। তারা মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তাকে পর্যবেক্ষণক্ষমতাসহ উপস্থিত অনুভব করে বলেই এরূপ আচরণ করে থাকে। মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তাকে বিলুপ্ত বা ঘুমন্ত মনে করলে তারা কখনোই এরূপ আচরণ করতো না , কারণ , সে ক্ষেত্রে এরূপ আচরণ হতো অযৌক্তিক ও অর্থহীন। মৃত ব্যক্তিদের দেহভস্ম সসম্মানে সংরক্ষণ অথবা তাদের ক্ববরে বা তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের কাছে বা তাদের মমিকৃত মৃতদেহের সামনে গিয়ে ভক্তি-শ্রদ্ধা , ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের পিছনেও তাদের একই অনুভূতি কাজ করে থাকে।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে প্রিয় স্বজনদের কাছাকাছি থাকতে চায় , প্রয়োজনে দূরে কোথাও গেলেও যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কাছে ফিরে আসতে চায় এবং নিয়মিত পরস্পরের খোঁজখবর জানতে চায়। তাই মৃত্যুর পরেও প্রিয় স্বজনদের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকার চিন্তা তাদের মধ্যে হতাশা ও বিমর্ষতার সৃষ্টি করে। তাই সকলেই সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে এ আশাই পোষণ করে যে , মৃত্যুর পরেও সে প্রিয় স্বজনদের কাছাকাছি থাকবে। নিজ বাড়ীতে বা বাড়ীর যথাসম্ভব কাছাকাছি প্রিয় স্বজনদের ক্ববরের পাশে ক্ববর দেয়ার জন্য ওয়াছ্বীয়াত্ করে যাবার পিছনেও একই অনুভূতির প্রভাব বিদ্যমান। নয়তো মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা অনন্ত নিদ্রায় নিদ্রিত থাকে বলে ধারণা পোষণ করলে মৃত ব্যক্তির বা তার জীবিত প্রিয় স্বজনদের কারো কাছেই এ ধরনের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনোই মূল্য হতে পারে না।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে দীর্ঘ ঘুম পসন্দ করে না - না তার নিজের জন্য , না তার প্রিয় স্বজনদের জন্য। তাই ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা হাজার হাজার বা কোটি কোটি বছর ঘুমিয়ে থাকবে এটা নিজের বা প্রিয়জনদের জন্য চিন্তা করতেই মানুষ বিষণ্ন ও বিমর্ষ হতে বাধ্য। তাই তারা মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তার জাগ্রত অবস্থাই কামনা করে।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে তার নিজের ভালো কাজের পুরষ্কার ও তার শত্রুর বা তাকে কষ্টদানকারীর জোর-যুলুম ও মন্দ কাজের শাস্তির ব্যাপারে অতি বিলম্ব পসন্দ করে না। অবশ্য সে নিজের পুরষ্কার ও প্রতিপক্ষের শাস্তির ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা অপরিহার্য লক্ষ্য করলে সে ক্ষেত্রেও যথাসময়ের পূর্বে ভালো ও মন্দ কাজের কিছু না কিছু প্রভাব আশা করে। উদাহরণস্বরূপ , যাকে পুরষ্কার দেয়া হবে তাকে নির্ধারিত অনুষ্ঠানের আগেই অনুষ্ঠানস্থলে এলে সেখানেই বা তার কাছাকাছি কোনো ভালো ও আরামদায়ক অবস্থানস্থলে সাদরে বিশ্রাম নিতে দেয়া হয় এবং হাল্কাভাবে হলেও আদর-আপ্যায়ন করা হয়। তেমনি বিবাহ বা অন্যবিধ আনন্দ-অনুষ্ঠানেও মেহমানদেরকে মূল ভোজনপর্বের আগেই অনুষ্ঠানস্থলে বা কাছাকাছি অন্য কোনো উত্তম পরিবেশে বিশ্রাম ও আরাম করতে দেয়া হয় এবং হাল্কাভাবে হলেও , আন্তরিক আদর-আপ্যায়ন করা হয়। বস্তুতঃ সকলে এটাই আশা করে। অন্যদিকে একজন সন্দেহাতীত ফৌজদারী অপরাধীকে গ্রেফতারের পর থেকে বিচার শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত এমন অবস্থায় রাখা ও আনা-নেয়া করা হয় যাকে শাস্তি বলা না গেলেও তা মোটেই আরামদায়ক বা সম্মানজনক নয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় - যা এক ধরনের মানসিক শাস্তি বটে। আর সাধারণভাবে লোকেরা এটাই পসন্দ ও আশা করে।

তাছাড়া শাস্তি ও পুরষ্কার উভয়ই যদি হাজার হাজার বছর , এমনকি কোটি কোটি বছর দূরবর্তী হয় ; তার ছিটেফোঁটাও যদি আশুপ্রাপ্তি না ঘটে , বরং হাজার হাজার বছর , এমনকি কোটি কোটি বছর যদি ভালো ও মন্দ উভয় ব্যক্তিকে পাশাপাশি অভিন্ন অবস্থায় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় তাহলে মানবমনে তা অন্যায় বলে প্রতিভাত হয় এবং তা মানুষের মনে ও আচরণে হতাশা সহ বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে বাধ্য। কারণ , অতি বিলম্বিত পুরষ্কারের প্রতি আকর্ষণ হ্রাস পায় এবং অতি বিলম্বিত শাস্তির প্রতি ভীতিও হ্রাস পায়।

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , মানবপ্রকৃতিতে যতো প্রয়োজন ও কামনা-বাসনা নিহিত রাখা হয়েছে তার সবই পূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাই সর্বজনীনভাবে যেহেতু মানবপ্রকৃতি তার ব্যক্তিসত্তার অমরত্ব এবং সচেতন জাগ্রত অবস্থা , স্বীয় সৎকর্মের পুরো পুরষ্কার প্রাপ্তিতে বিলম্ব হলেও অবিলম্বে অন্ততঃ কিছুটা সম্মান-আপ্যায়ন এবং অপরাধীর বিচার ও পুরো শাস্তিতে বিলম্ব হলেও তার জন্য অবিলম্বে অন্ততঃ অপসন্দনীয় অবস্থা দাবী করে , তখন এমনটি হওয়াই অপরিহার্য। অন্যথায় সৃষ্টিকর্তা মানবপ্রকৃতিতে এ ধরনের কামনা-বাসনা প্রদান করতেন না।