রক্তাক্ত ফিলিস্তিন-৪র্থ পর্ব

লেবাননে ফিলিস্তিনদের উপর যায়নবাদী সৈন্যদের আগ্রাসন

১৯৮২ সালের জুন মাসে যায়নবাদী সরকার ফিলিস্তিন মুক্তিসংস্থাকে  (পি এলও) নিশ্চিহ্ন করার জন্য লেবাননের উপর স'ল, জল ও বিমান পথে ব্যাপক আগ্রাসন চালায় । যায়নবাদীরা প্রথমে ঘোষণা দেয় যে, এদের অভিযান শুধুমাত্র ফিলিস্তিনদের বিরুদ্ধে সীমিত থাকবে এবং চল্লিশ থেকে বাহাত্তর ঘন্টা স্থায়ী হবে। লেবাননে মোতায়েন সিরীয় বাহিনীর উপর কোন ধরণের হামলা কিংবা লেবাননের এক ইঞ্চি জমি দখলের ইচ্ছেও এদের নেই। এছাড়া অভিযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে এরা লেবাননের মাটি ত্যাগ করবে।
এসব দাবীর বরখেলাফ করে যায়নবাদীরা বেকা উপত্যকায় মোতায়েন সিরীয় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানে এবং এদের অভিযান আশি দিন অব্যাহত থাকে। অন্যদিকে এ অভিযান চলাকালে আরবদেশ সমূহ ও সোভিয়েত রাশিয়া ফিলিস্তিনদের সহায়তাদানে উদাসীনতা দেখায়। অথচ যায়নবাদী ইসরাইলীরা সর্বোত্তম সুযোগ গ্রহণ করে। অর্থাৎ ইরান ও ইরাক যখন সার্বিক যুদ্ধে ব্যস- এবং এ কারণে এলাকার এতোদিনকার প্রথম ও কেন্দ্রিয় ইস্যু হিসেবে ফিলিস্তিন ইস্যু যখন দ্বিতীয় স-রে স্থান পায় তখনি ফিলিস্তিনদের ধ্বংস করার কাজে হাত দেয়।
এ সময় আরব প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ইরাকের প্রতি সর্মথন দানকে প্রধান ও এক নম্বর দায়িত্ব হিসাবে নিয়ে ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার প্রতি সর্মথন দান থেকে বিরত থাকে। যায়নবাদীদের এ অভিযানের ফলে এবং পিএলও-এর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বের কারণে ফিলিস্তিনরা বৈরুত ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এবং আটটি আরব দেশ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পিএলও-এর কেন্দ্রীয় দফতর তিউনেশিয়ায় স্থানাস-র করা হয়। এ যুদ্ধ ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার সামরিক ভিত্তিকেই কেবল র্দূবল করেনি বরং এদের হাত থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর ক্ষমতাও কেড়ে নেয় । এর ফলে কতিপয় ফিলিসি-ন নেতা আপোষের পথ অবলম্বন এবং মিশর ও জর্দানের নিকটবর্তী হওয়ার পথ ধরে।
এ যুদ্ধের আরো গুরুত্বপূর্ণতম ফল হচ্ছে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) অভ্যন্তরে বিশেষ করে আল ফাতাহ গ্রুপের ভেতর মতভেদ তীব্রতর হওয়া। এই আল ফাতাহই ছিল পিএলও সংস্থা প্রতিরক্ষার অন্যতম প্রধান অংশীদার ও মেরুদন্ড। এ মতবিরোধ পিএলও-এর আনর্-জাতিক ভাবমূর্তিতে সাংঘাতিক আঘাত হানে।
পিএলও-র অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আল ফাতাহের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বেকা উপত্যকায় ১৯৭৩ সালের ৯ মে তারিখে শুরু হয়। কর্ণেল আবুমুসা ও আবু সালেহ্‌ ছিলেন পিএলও-এর কেন্দ্রীয় কমিটি এবং আল ফাতাহের বিপ্লবী কাউন্সিলের সদস্য। তারা সিরিয়ার সমর্থন পেয়ে আরাফাতের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন এবং আল্‌ ফাতাহের নীতিমালা পরিবর্তন  ও লিবিয়া, সিরিয়া ও আলজেরিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের দাবী জানান । এ অনাস্থার কারণে আরাফাতের বিরোধী ও সমর্থকদের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত আরাফাত ও তার সমর্থকদের লেবানন থেকে বহিস্কৃত হতে হয়। এরা জাতিসংঘের পতাকাবাহী পাঁচটি গ্রীক জাহাজে চড়ে এবং ফরাসী নৌ-বাহিনীর পাহাড়ায় লেবাননের ত্রিপলী বন্দর, ইয়ামেন, তিউনেশিয়া ও আলজেরিয়ার ফথে রওনা হয়। আল ফাতাহের বিদ্রোহী গ্রুপ প্রথম থেকেই লিবিয়া ও সিরিয়া সমর্থক বামপন্থী গ্রুপগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা পায়। আরাফাত বিরোধীদের প্রতি লিবিয়া ও সিরিয়ার সমর্থন থাকার ফলে এ দুই দেশ বিরোধী নীতি অবস্থানের অধিকারী জর্দান ও মিশরের দিকে আরাফাত পূর্বাপেক্ষা বেশী ঝুঁকে পড়ে। এরপর থেকে পিএলও-এর মধ্যে আবু মুসার নেতৃত্বে ফাতাহ ইন্তিফাদা নামক নয়া শাখার জন্ম হয়।
বৈরুতে আমেরিকা ও ফরাসী নৌ-সেনাদের ঘাঁটিতে বিষ্ফোরণ (১৯৮৩ সালের ২৩ শে অক্টোবর )
আল হোসাইন (আ.)১৯৮২ সালের ৬জুনে লেবাননের মাটিতে ইসরাইলী সৈন্যদের আগ্রাসন এবং বৈরুত পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার ফলে লেবাননে আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইতালীর বহুজাতিক বাহিনী আগমনের পটভূমি তৈরী হয়। যায়নবাদী আগ্রাসীরা তাদের অভিযানের প্রথম দিকে ঘোষণা দেয় যে, লেবাননের অভ্যন্তরে ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত একটি নিরাপত্তা এলাকা তৈরীই এ অভিযানের লক্ষ্য । কিন্তু পরে এরা বৈরুতে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিন মুক্তিসংস্থার সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ ও লেবানন থেকে পিএলওএর সম্পূর্ণ বহিস্কারের দাবী জানায়। এ দাবী পূরণের জন্য পশ্চিম বৈরুতের উপর বিরামহীনভাবে প্রচন্ড বোমাবর্ষণ চালাতে থাকে। এছাড়া সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবির হাজার হাজার ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে।
আল হোসাইন (আ.)শেষ অবধি লেবানন সরকার ও পিএলও ফিলিস্তিনী ইউনিটগুলোকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় এবং এ সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় যে, ফিলিস্তিনীদের অপসারণ পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করার জন্য বহুজাতিক বাহিনী বৈরুতে অবস্থান নেবে। এ বহুজাতিক বাহিনীর সৈন্যরা হচ্ছে আমেরিকা ও ফ্রান্সের আটশ এবং ইতালীর চারশ সৈন্য। ১৯৮২ সালের ২১ আগষ্ট থেকে পয়লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বহুজাতিক বাহিনী লেবানন থেকে পিএলও সৈন্যদের নির্বাসন তদারকী করে।
২৯ সেপ্টেম্বর বৈরুতে যে সব এলাকা ইসরাইল বাহিনী পরিত্যাগ করে সেখানে মার্কিনী সৈন্যদের প্রথম দলটি প্রবেশ করে বহুজাতিক নামক পশ্চিমা বাহিনী শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, বিবদমান দলগুলোর মাঝে শান্তি আলোচনা এবং বৈরুতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব অবসানের বাহানায় লেবাননে নিজেদের উপসি'তি অব্যাহত রাখতে থাকে। প্রকৃতপক্ষেএরা প্রগতিশীল ও ইসলামী দলগুলোকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পদানত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ১৯৮৩ সালের ২৩ অক্টোবর বহুজাতিক বাহিনীর ঘাঁটিগুলো ইসলামী জিহাদ সংস্থার শাহাদতকামী অভিযানের শিকার হয়। বৈরুতেস' আমেরিকান নৌ-বাহিনীর ঘাঁটিতে গাড়ী বোমা বিষ্ফোরণের ছয় মিনিট পরই ফরাসী ছত্রী সেনাদের ঘাঁটি একই কায়দায় বিষ্ফোরিত হয়। এতে ২৪১ জন মার্কিন নৌ-সেনা ৫৮জন ফরাসী ছত্রী সেনা নিহত হয়। এ বিষ্ফোরণ ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমেরিকান সৈন্যদের উপর এবং আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের পর ফরাসী সৈন্যদের উপর গুরুতর সামরিক ও রাজনৈতিক আঘাত বলে আভিহিত হয়। এতে বহুজাতিক বাহিনীর শান্তশওকত ও এদের সৃষ্ট ভয়ভীতি বরবাদ হওয়ার পাশাপাশি লেবানন ও ফিলিস্থিনে বিপ্লবী মুসলমানদের সংগ্রামী মনোবল প্রবল হয়ে ওঠে ।
শিবির যুদ্ধ
১৯৮৫ সালের ১৯মে থেকে ১৯৮৭ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত প্রায় দেড় বছর ধরে লেবাননের শিয়া সংগঠন আমাল ও বৈরুতের শরণার্থী শিবিরের ফিলিস্তিনী গেরিলাদের ভেতর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় । একপক্ষ অন্য পক্ষের এলাকাসমূহ অবরোধ করে রাখে। এ র্দীঘ যুদ্ধ ফিলিস্তিনীদের ঐক্য ও বিভেদের উপর সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে। লেবাননে ফিলিস্তিনীদের অবস্থান এবং সেখান থেকে ইসরাইলী বিরোধী অভিযান চালানার অজুহাতে ১৯৮২ সালে ইসরাইলের আগ্রাসনের পরিপেক্ষিতে আমাল সংগঠন চাচ্ছিল না যে, ফিলিস্তিনীরা লেবাননকে তাদের স্বদেশে পরিণত করে নিক। অন্যদিকে ফিলিস্তিনীরা বলতো, যদিও আমালের কথাই ঠিক তথাপি ফিলিস্তিনীদের সাহায্য করতে হবে যাতে তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে।
এসব বিতর্ক শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনী গেরিলা সংগঠন ও শিয়াদের তৎকালীন বড় সংগঠন আমালের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় যা প্রকৃতপক্ষে আল কুদস গ্রাসী ইসরাইলের স্বার্থকেই রক্ষা করে। এ যুদ্ধের ফলে আমালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফিলিস্তিনী গ্রুপের ভেতর অভিন্ন নীতি-অবস্থান গ্রহনের সুযোগ আসে। এদিকে লক্ষ্য রেখেই আল্‌ ফাতাহের নেতৃত্বের কঠোর বিরোধী ফাতাহ ইন্তিফাদা সংগঠন ঘোষণা দেয় যে, রাজনৈতিক কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই আরাফাত শিবির যুদ্ধের উস্কানি দিয়েছে। আমাল সংগঠনের ভেতরেও কার্যক্রমের বিশুদ্ধতা ও নেতৃত্বের নীতি অবস্থান প্রশ্নে সমালোচনা ও দ্বিধা দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং বিভিন্ন শাখা, বিশেষ করে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে জিহাদী সংস্থাগুলোর জন্ম হয়।
আর এভাবেই আশির দশকের প্রথম থেকে লেবাননে সংঘটিত ঘটনাবলী সামগ্রিকভাবে ইসরাইল বিরোধী সংগ্রামী ফ্রন্টকে ভেজালমুক্ত হয়ে বিশুদ্ধতার দিকে এগিয়ে নেয়। ইরানের ইসলামী বিপ্লব থেকেও এ গতিধারাটি তীব্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিশ্বাসী মূল ও খাঁটি শক্তিগুলোকে নয়া শক্তি প্রদান করে। এ নবশক্তি ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে ইসলামী ও ঈমানী দায়-দায়িত্ব বলে গ্রহণ করে নেয়। এরা আপোষ করার ঘোরতম বিরোধী হিসাবে এ পর্যন্ত আমেরিকা ও ইসরাইলের যাবতীয় লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও লালসা বাস-বায়নকে গুরুতর সংকটের সম্মুখীন করেছে।
লেবাননে ‘‘হেযবুল্লাহ’’ সংগঠনের মতো সংগঠনগুলোর জন্ম ও শক্তি অর্জনই এ গতিধারার উজ্জ্বলতম নমুনা। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে দুশমনের প্রচারণা ও চক্রানে-র বিরামহীন প্রবল ঝড় উঠে যা শক্রপক্ষের শিবিরগুলোতে ভয়ভীতি ও ত্রাস গুরুতর আকার ধারণেরই প্রমাণ। এটা স্পষ্ট যে, আপোষকামী পরিকল্পনা ও চক্রান্তগুলো ক্ষণস্থায়ী সফলতার সম্ভবনারসমূহের কথা ধরে নিলেও এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা লাভ করা যায় যে, লেবাননে ইসলামী প্রতিরোধ সংগ্রামের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গেছে এবং একইভাবে অধিকৃত ও এলাকাসমূহের যদি প্রতিরোধ সংগ্রাম অব্যাহত থাকে ও প্রয়োজনীয় শক্তি নিয়ে এগিয়ে যায় তাহলে দুশমনের পরাজয় সুনিশ্চিত।
ইনে-ফাদা তথা ফিলিস্তিনী গণঅভ্যুত্থানের উদ্ভব
এটা পরিস্কার যে, সাইয়েদ জামাললুদ্দীন আসাদাবাদীর  (আফগানী) প্রচেষ্টায় ইসলামী দেশগুলোতে এবং ইরানে তামাক আন্দোলনের মাধ্যমে যে ইসলামী জাগরণের আন্দোলন সৃষ্টি হয় তা মিশরে মুহাম্মাদ আবদুহু ও সাইয়্যেদ কুতুবের মাধ্যমে নয়া পর্যায়ে উপনীত হয়। পাক ভারতে আল্লামা ইকবালের মতো মনীষীদের মাধ্যমে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনরূপে অব্যাহত থাকে, আলজেরিয়াতে ১৯৬২ সালের বিপ্লবের জন্ম দেয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় এই ইসলামী জাগরণের আন্দোলনকে জোরদার করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। তবে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, আর তা হচ্ছে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের আগে প্রায় দু’দশক যাবত ইসলামী দেশগুলোতে ইসলামী জাগরণের এই গণআন্দোলনের গতি মন'র হয়ে পড়ে।
কারণ একদিকে ইসলামী দেশগুলোতে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর অসি-ত্ব মুসলমানদেরকে স্বৈরাচার বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে এবং ইসলামী জাগরণের তাত্ত্বিক দিকটাকে স্লান করে দেখতে বাধ্য করে আর অন্যদিকে এ গতিধারাটি ইসলামী বিপ্লবপূর্ণ যুগে দারুনভাবে আরব জাতীয়তাবাদের শিকার হয়। খোদ এই আরব জাতীয়তাবাদও কতিপয় কারণের ফল যার মাঝে খৃষ্টান চিন্তাবিদ মাইকেল আফলাকের প্রতিষ্ঠিত ইরাক ও সিরিয়ার বাথ সমাজতন্ত্রী দল অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় এ দলটি ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। এছাড়া ইসরাইল সরকারের উদ্ভব ও ইসরাইলের সাথে আরবদের যুদ্ধগুলো ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হিসাবে এ ইস্যুকে আরবীয় ইস্যুতে পরিণত করে।
১৯৭৯ সালের প্রথমদিকে ইরানে ইসলামী বিপ্লব ইসলামী জাগরণী আন্দোলনে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়ন করে। কারণ এ বিপ্লব একদিকে এতে নয়া প্রাণস্পন্দন সঞ্চার করে এবং অন্যদিকে এতে রাজনৈতিক দিক-দর্শন ও সারবত্তা দান করে। কেননা এর আগ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলন ছিল সাংস্কৃতিক ও চিন্তাগত বিষয়, আত্মপরিচয়ে ফিরে আসার আহবান, ইসলামী পরিচয়ে প্রত্যাবর্তনের ডাক এবং ইসলামী উম্মার মাঝে অভিন্ন মূল্যবোধগুলোকে উজ্জীবিত করা।
এটা স্বাভাবিক ছিল যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আহবান মুসলমানদের নাড়া দেয়, তাদের আবেগ অনুভূতিকে চাঙ্গা করে তুলে এবং ইসলামী বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেনীর নীতি-অবস্থান ফিলিস্তিনী মুজাহিদ গোষ্ঠীসহ বিশ্বের সংগ্রামী মুসলমানদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ইসলামী ঝোঁকপ্রবণতা পুনরুজ্জীবিত হলো। ফিলিস্তিনের জনগণ ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আগেও মুসলমান ছিলেন, কিন্তু তাদেরকে সংঘবদ্ধ ও সংহত করার রশিটি ছিল আরব জাতীয়তাবাদ। ইসলাম ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। এ কারণেই ফিলিস্তিনীরা ইসলামী, খৃষ্টীয় ও সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে এক এক গ্রুপ বা সংগঠনে সংঘবদ্ধ হতো। ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর একতা ও বিজয়ের জন্য ইসলামের শক্তি-সামর্থ্য ও সম্পর্কে চিন্তাদর্শন শক্তিলাভ করে এবং মুসলমান সংগ্রামীদের মনোযোগ ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হয়।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ফিলিস্তিনের মাঝে সম্পর্ক বিপ্লব বিজয়ের বহু আগেই ইসরাইল বিরোধী অভিন্ন ফ্রন্টে গড়ে ওঠে। ইরানের গেরিলা যোদ্ধারা শাহের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে ফিলিস্তিনী শিবিরগুলোতে গমন করতো ও শিক্ষা নিতো। এ সুদৃঢ় সম্পর্ক বহু বছর আগ থেকেই গড়ে ওঠে। তখনি হযরত ইমাম খোমেনী খুমস, যাকাত ও অন্যান্য ইসলামী অর্থ তহবিলের এক তৃতীয়াংশ অর্থ ফিলিস্তিনী সংগ্রাম অব্যাহত রাখার পথে ব্যয় করার অনুমতি দান করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে ইসলামী বিপ্লবের গতিধারা তুঙ্গে ওঠার সময় ‘‘আজ ইরান কাল ফিলিস্তিন’’ শ্লোগান যায়নবাদীদের ভীতসন্ত্রস- ও ফিলিস্তিনীদের আশান্বিত করে তোলে। এ ব্যাপারে ফিলিস্তিনী নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার নেতাদের বক্তব্য ও অভিমতই সবচে’ বড় প্রমাণ। ইসলামী বিপ্লব ও অভিমতই সবচেয়ে বড় প্রমান। ইসলামী বিপ্লব ও ইমাম খোমেনী সম্পর্কে বিপ্লবের প্রথম বছরগুলোতে তাদের উল্লাস ও উচ্ছাস দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উদাহরণ হিসাবে ছহিফায়ে নূর গ্রনে'র পঞ্চম খন্ডে ইমাম খোমেনীর সাথে ফিলিস্তিনী নেতাদের কথোপকথনের কথা উল্লেখ করা যায়।
ইসরাইলের সাথে সংগ্রাম একচেটিয়া ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ব্যাপার ছিল না। বিপ্লবের আগে ও অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রাচ্য ব্লক ও প্রগতিশীল দেশগুলো বাহ্যতঃ ফিলিস্তিনীদের পৃষ্ঠপোষক ছিল। তবে এসব পৃষ্ঠপোষকতার কারণ ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা কিংবা সর্বোত্তম পর্যায়ে ফিলিস্তিনী জাতির বেঁচে থাকার অধিকারে বিশ্বাস। কিন্তু এসব শক্তি  ও দেশের কোন একটিও ইসরাইলের অসি-ত্ব বিরোধী ছিল না বরং একে স্বীকার করে নিয়েছিল। শুধু একটি আগ্রাসী দেশ হিসাবেই এর সাথে সংগ্রাম করতো। অথচ ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ইমাম খোমেনী একটি দেশ হিসাবে যায়নবাদী ইয়াহুদী রাষ্ট্রটির অসি-ত্বকেই অস্বীকার করেছেন এবং একে দখলদার ও যায়নবাদী সরকারের যে কোন ধরণের টিকে থাকেই ইসলামী জাহানে সকল ফেৎনা -ফাসাদ অব্যাহত থাকার কারণ বলে অভিহিত করেন। এ চিন্তা -দর্শনই ফিলিসি'নীদের মাঝে জাতীয় ও দীনী গৌরববোধ এবং ইসলামী চেতনা ও জাগরণকে তুঙ্গে ওঠার আর ইসরাইল ও তার মুরুব্বীদের ভীতসন্ত্রস- করে তুলে।
ইসলামী জাগরণেরই আকারে অংশ ইন্তিফাদা
১৯৮৭ সালে এপ্রিলে আম্মানে আরব শীর্ষ সম্মেলন বসে এবং নজীর-বিহীনভাবে এ সম্মেলন যায়নবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর ক্ষেত্রে ন্যূনতম নীতি-অবস্থানও গ্রহণ করেনি। সম্মেলনের সকল মনোযোগই নিবদ্ধ ছিল ইরান ও ইরাকের যুদ্ধের দিকে এবং সামগ্রিকভাবে এ সম্মেলন ক্যাম্প ডেভিড লাইন ধরে এগিয়ে যায়।এদিকে ফিলিসি'নী জাতি বছরের পর বছর অপেক্ষা করছিল যে, আরব জগত তাদেরকে বাস'হারা অবস্থা থেকে নাজাত দেবে । বিশেষত অধিকৃত ফিলিস্থিনে বসবাসরত ফিলিস্তিনী জনগণ তাকিয়ে ছিল আরব সরকারগুলোর দিকে।
এই মজলুম জাতি ফিলিস্তিনী দল,গ্রুপ ও সংগঠনগুলোর আত্মবিস্মৃতি, ভোগ বিলাস, বিভেদ, অনৈক্য ও দল ভাঙ্গাভাঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে এবং ফিলিস্তিনী জনতার দুর্দশাগ্রস- অবস্থার প্রতি আরব সরকারগুলোর প্রকাশ্য উদাসীনতা ও অবহেলা প্রত্যক্ষ করে আরব জাতীয়তাবাদী চিন্তাদর্শনের কার্যকারিতা এবং সরকারগুলোর পৃষ্ঠাপোষকতা ও সর্মথন সম্পর্কে একেবারে সকল আশা-ভরসার অবসান ঘটায়। অন্যদিকে ইসলামের উপর আশা-ভরসা স্থাপন ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ওঠে, বিশেষত ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় থেকে তারা শিক্ষা গ্রহন করে।
আর এ ঠিক এসময়ই মক্কা শরীফে বায়তুল্লাহ আল হারামের মেহমান ইরানী হাজীদের পাইকারী হারে হত্যা করে সউদী শাসকগোষ্ঠী। এ রক্তাক্ত পাশবিক ঘটনায় চার শতাধিক হাজী মুশরিকদের সাথে বারায়াত ঘোষণা (সম্পর্কচ্ছেদের) এবং আমেরিকা ও ইসরাইল মুর্দাবাদ শ্লোগান দানের অপরাধে শাহাদত বরণ করেন। এদের ভেতর প্রায় দশজনের মতো হাজী ছিলেন অধিকৃত অঞ্চলের ফিলিস্তিনী। এই শহীদের  জানাযা মিছিল ও শোকানুষ্ঠান অধিকৃত ফিলিস্তিনের রামাল্লাহ ও আলখলিল শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সমস- ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৭ সালের হেমন্তকালে অধিকৃত ফিলিস্তিনের অধিবাসীরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নয়া ধারা ও গণঅভ্যুাত্থানের সূচনা ঘটায় -যার নাম দেয়া হয় ইন্তিফাদা। ইন্তিফাদার অর্থ নাড়া দেয়া, নড়ে ওঠা, ঝাঁকুনি দেয়া।  পাখীরা যেমন গোসল সেরে ভেজা শরীররটাকে হালকা করা ও আকাশে ওড়ার জন্য পাখা ঝাঁপটায় তেমনি এ ধরণের নাড়াকে বলে ইন্তিফাদা । ইন্তিফাদা ভেজালকে দূর করে খাঁটি হওয়ার গণঅভ্যুত্থান যাতে বিজয়ের আকাশপানে জনগণ পাখা মেলতে পারে। ইন্তিফাদার আগপর্যন্ত সকল আন্দোলন ও অভ্যুত্থানই ছিল বিশেষ কোন দল বা গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট । যেমন ‘ফাতাহ’ আন্দোলন’ যা ১৯৮৩ সালের মে মাসে আরাফাতের নেতৃত্বোধীন আল্‌ ফাতাহ থেকে আলাদা হয়ে যায় । কিন্তু এবার (১৯৮৭) এই ইন্তিফাদার আগে বা পরে কোন বিশেষণ যুক্ত হয়নি। এই ইন্তিফাদা আন্দোলন ছিল গণপ্রতিবাদ বা গণঅভ্যুত্থান । ফিলিস্তিন দখলদারী অব্যাহত রাখার প্রতিবাদ এই ইন্তিফাদার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও ফলাফল হচ্ছে এরূপ ঃ
১. বিস্মৃতির আঁস্তাকুড় থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুকে বের করা।
২. বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ।
৩. এলাকাব্যাপী ইসলামী আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের সাথে ইন্তিফাদাকে সমম্বিত করা যা ইন্তিফাদার চেহারাই সবিশেষ রূপ দান করে।
৪. ফিসি-ন সমস্যা সমাধানকে জরুরী পরিকল্পনা হিসাবে উপস্থান।
৫. ফিলিস্তিন ইস্যুর সাথে পশ্চিম ইউরোপকে ঘনিষ্ঠ করা।
৬. এমন কি আমেরিকা ও ইয়াহুদীদের মনেও ইসরাইলের রাজনৈতিক সঠিকতা সম্পর্কে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করা। এর ফলে অনেক ইয়াহুদী এ মতে বিশ্বাসী হয় যে, ইসরাইলের চেহারাকে আরো নিন্দনীয় (গণআন্দোলন ও যায়নবাদী সৈন্যদের গণনির্যাতন ও দমনাভিযান) হওয়া থেকে ফিরিয়ে রাখতে হলে ফিলিস্তিনীদের কিছু সুযোগ -সুবিধা দেয়া আবশ্যক।
৭. যায়নবাদীদের অসি-ত্বের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে হুমকিপূর্ণ করা।
৮. ফিলিস্তিনীগ্রুপগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও মতভেদকে ম্লান করে দেয়া এবং সরকারগুলো ও আন্তর্জাতিক সমাজকে জনমতের অনুসারী করা -যারা  এতোদিন নিজ নিজ স্বার্থে ফিলিস্তিন ইস্যুকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে আসছিল। ফিলিস্তিন জবর দখল এবং যায়নবাদী ইয়াহুদী সরকার প্রতিষ্ঠার চল্লিশ বছরেরও বেশী পর ইন্‌িফাদার ফলে এই প্রথম ফিলিস্তিনী জনগন আক্রমণাত্মক ও ইসরাইলীরা আত্মরক্ষামূলক ভূমিকায় নামে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাথে ইন্তিফাদার তুলনা
ইন্তিফাদা আন্দোলন অনেক দিক দিয়েই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, বিশেষত কোন গ্রুপ বা সংগঠনের উপরই নির্ভরশীল নয়। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের একটি বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইসলামী, অনৈসলামী, ও জাতীয়তাবাদী বহু দল ও গ্রুপ এবং া বিভিন্ন চিন্তা -দর্শনের লোকেরা আলাদা ভাবে শাহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতো এবং সবাই ভবিষ্যত বিপ্লবকে নিজ নিজ সংগঠনের বলে মনে করতো। ১৯৭৭ সালের ৭ জানুয়ারী দৈনিক ইত্তেলায়াত পত্রিকায় ইমাম খোমেনী সম্পর্কে অবমাননাকর নিবদ্ধ ছাপা হলে এর প্রতিবাদে কোম শহরের একদল লোক শাহাদতবরণ করে। শহীদের স্মরণে তেহরান, তাবরিজ ও অন্যান্য শহরে সাত দিনের ও চল্লিশার অনুষ্ঠানাদি একের পর এক অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
এসবের প্রতিটি অনুষ্ঠানেই সংঘর্ষ ও কিছু লোকের শাহাদতবরণ এবং পুনরায় তাঁদের চল্লিশা পালন একের পর এক অব্যাহত থাকে। ১৯৮৭ সালের শেষ পাঁচ মাসে ইরানের জনগণের অভ্যুত্থান সর্বব্যাপী রূপ ধারণ করে। তখন সকল রাজনৈতিক দল তথা মার্ক্সবাদী, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী গ্রুপ-সংগঠন পর পর মতাদর্শ ও পথ ছেড়ে গণ আন্দোলন ও অভ্যুত্থানকে অনুসরণ করতে থাকে। কেননা কোন সংগঠনই কখনো সাংগঠনিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ ধরণের গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা করেনি।
সকল দল ও গ্রুপ জনগণের কাতারে এসে যোগ দেয়। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের ছবি ও প্রতিকৃতি গণমিছিলে শোভা পেতে থাকে। কিন্তু সে সময় যে বিষয়টি জনগণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং যা সকল জনতাকে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ করে তা হলো একক লক্ষ্য অর্থাৎ শাহ ও তার উচ্ছেদ ঘটানো। জনগণের সকল শ্লোগানই ছিলো ইসলামমুখী ও ইসলামের জন্য আন্দোলন। কেননা ইসলামই ইরানের বেশীর ভাগ মানুষের ধর্ম। ইন্তিফাদা আন্দোলনও ঠিক একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
বর্তমানে ইন্তিফাদা সম্পর্কে নানা ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজমান। তবে যে বিষয়টি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলা যায় তা হচ্ছে এই যে, ইন্তিফাদার গণমুখিতাও স্বতঃসফ'র্ততা ।আর ইসলাম হচ্ছে এর প্রাণশক্তি। এ বিষয়টিকেই ইসরাইল ভয় পাচ্ছে।
এ ধারণার ফলশ্রুতিই হচ্ছে ইন্তিফাদার প্রথম দিকে শেখ আহম্মদ ইয়াসিনকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধকরণ । ইন্তিফাদাকে নির্মূল করার জন্যই ১৯৯২ সালে নভেম্বরে চার’শ পনেরো (৪১৫) জন ফিলিস্তিনী সংগ্রামীকে অধিকৃত এলাকা থেকে বহিষকৃত করা হয়। এরা সবাই নিষ্ঠাবান মুসলমান ও হামাস সংগঠনের সমর্থক । এত্মাই একদিকে প্রমাণ করে যে, ইন্তিফাদার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইসলামী এবং অন্যদিকে গণমুখী যা কোন বিশেষ দল বা সংগঠন, এমন কি হামাসেরও সদস্য নয়। এর প্রমাণ হলো এই যে, যায়নবাদী সরকার এদেরকে গণঅভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে বহিষকৃত করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইন্তিফাদা স'গিত থাকেনি। এর কিছুদিন পরই অধিকৃত অঞ্চলের তিন শতাধিক অধিবাসী যায়নবাদী সৈন্যদের সাথে সংর্ঘর্ষে শহীদ ও আহত হয়। এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, ইন্তিফাদা আন্দোলন বিশেষ কোন দলের বা সংগঠনের নয়, বরং এর নেতৃত্ব ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।
ইন্তিফাদা গণঅভ্যুত্থানের হঠাৎ করে উদ্ভভ এবং এ পর্যন্ত অব্যাহত থাকা প্রমাণ দিচ্ছে যে, যদিও বা ব্যক্তিবর্গ বা সংগঠন বিশেষ এই গণঅভ্যুত্থানের সূচনায় ভূমিকা পালন করেছে, তথাপি আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততায় এতে কোন ক্ষতি হয়নি। ইন্তিফাদার কোন কেন্দ্রিীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই এবং কোন বিশেষ সংগঠনই এর স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং সকল সংগঠনই এর অনুসরণকারী ও সমর্থক এবং সবারই চেষ্টা ইন্তিফাদায় সাধ্যানুসারে অংশ নেয়া ও পরিকল্পনা দেয়া।
ফিলিস্তিনী সংগঠনগুলোর প্রতি এমনভাবে কথা  বলে যেনো ইন্তিফাদার নেতৃত্ব তাদেরই হাতে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এসব সংগঠনের বেশীর ভাগই ফিলিস্তিনের বাইরে তিউনেশিয়ায়, সিরিয়ায়, জর্দানে বা অন্যত্র অবস্থান করছে। ফিলিস্তিনের বাশিন্দারা ওসব সংগঠনের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং অভিন্ন উদ্দেশ্যে তথা অধিকৃত এলাকাগুলোর মুক্তির জন্য কাজ করে যায়। কিন্তু এমন নয় যে, যদি এসব সংগঠনের সকলেও যদি হাত গুটিয়ে নেয় তাহলে ইন্তিফাদাও শেষ হয়ে যাবে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাথে ইন্তিফাদার আরেকটি সাদৃশ্য [পাশ্চাত্য বিশেষ করে আমেরিকার এই বাড়াবাড়িপূর্ণ প্রচারণা যে, ইন্তিফাদা ইরানের ইসলামী বিপ্লবকেই আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করেছে এবং উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য বিরাজমান, তা অবশ্য ওদের নোংরামী উদ্দেশ্য প্রণোদিত বৈ অন্য কিছু নয়। ওরা ইন্তিফাদার মৌলিকত্বকে বিকৃত করে দেখানো ছাড়াও ইসলামী ঝোঁকপ্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর আচারণ প্রদর্শনের বাহানা খোঁজ করছে। বিশেষতঃ এ কারনে যে, বিশ্ব ও ইউরোপীয় জনমত যায়নবাদীদের এতোসব নিষ্ঠুরতাকে মেনে নিতে তৈরী নয় বলেই এ ধরনের প্রচরণা চালিয়ে ইন্তিফাদাকে দমনের জন্যে ইসরাইলীদের হাতে সুযোগ তুলে দিচ্ছে যাতে পশ্চিমারা বলতে পারে যে, যদি ফিলিস্তিনীদের দমন না করি তাহলে সেখানে ইসলামী মৌলবাদ বিকাশের ঘাঁটি তৈরী হবে এবং আন্দালুসিয়ায় (স্পেনে) বিপর্যয়েরই (মুসলমানদের বিজয়) পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আমেরিকা ও ইসরাইল এভাবেই ফিলিস্থিনে (ইউরোপের ফটক) ইসলামপন্থীদের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে প্রতিবেশী ইউরোপীয়দের ভীতসন্ত্রস- করে তুলতে চাচ্ছে যাতে সহজে ফিলিস্তিনীগণ অভ্যুত্থানকে দমনে আত্মনিয়োগ করতে পারে।] হচ্ছে এই যে, ফিলিস্তিনী সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত বিক্ষোভ মিছিলের জন্য মসজিদ ও নামাযে জুমাকে কাজে লাগানো হয়। এর আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিনী সংগ্রাম সব সময়ই গেরিলা যুদ্ধ, অস্ত্র ও সংগঠননির্ভর ছিল। কিন্তু এবার খালি মুষ্ঠি, পাথর টুকরো ও লাঠি এসে গুলীর মুখোমুখি দাঁড়ায়। ফিলিস্তিনী নারী ও শিশুরা পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভাবে এ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। এবার সংগ্রামের নামকরণ করা হচ্ছে ইটপাটকেলের বিপ্লব কিংবা পাথর হতে তরুন ও কিশোরদের বিপ্লব। ইন্তিফাদা আন্দোলনের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো শাহাদতকামিতা ও আত্মবলিদান যে অস্ত্রের কোন বিকল্পই নেই। এতোসব নিষ্ঠুরতাকে মেনে নিতে তৈরী নয় বলেই এ ধরনের  প্রচারণা চালিয়ে ইন্তিফাদাকে দমনের জন্য ইসরাইলীদের হাতে সুযোগ তুলে দিচ্ছে যাতে পশ্চিমারা বলতে পারে যে, যদি ফিলিস্তিনীদের দমন না করি তাহলে সেখানে ইসলামী মৌলবাদ বিকাশের ঘাঁটি তৈরী হবে এবং আন্দালুসিয়ার (স্পেনে) বিপর্যয়েরই (মুসলমানদের বিজয়) পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
আরেকটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে ইন্তিফাদা হচ্ছে জাতীয়তাবাদসহ যাবতীয় সংগ্রামের ব্যর্থতায় গণপ্রতিক্রিয়া। জামাল আব্দুন নাসেরের সময় ওই জাতীয়তাবাদিতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ছিল। গত কয়েক বছরে আরব জাতীয়তাবাদ ও গোত্রবাদ চরমভাবে পরাজিত হয় এবং অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কম্যুনিষ্ট মার্কা বামপন্থী আন্দোলন ও মতগুলোবাদও চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করে।
আমেরিকা ও ইসরাইল এভাবেই ফিলিস্থিনে (ইউরোপের ফটক) ইসলামপন্থীদের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে প্রতিবেশী ইউরোপীয়দের ভীতসন্ত্রস- করে তুলেছে যাতে সহজে ফিলিস্তিনী গণঅভ্যুত্থানকে দমনে আত্মনিয়োগ করতে পারে।
ফিলিস্তিন আন্দোলন এসব নানামুখী ও বিভিন্নধর্মী মত ও পথে অচলাবস্থা ও পরাজয় প্রত্যক্ষ করে অবশেষে এ সিদ্ধানে- উপনীত হয় যে, ইসলামই একমাত্র সমাধান, যে সমাধান অন্য কোন রাজনৈতিক দর্শনে খুঁজে পেতে পারেনি, বরং পরাজয়, আত্মসমর্পণ ও আপোষকামিতার কানাগলিতে গিয়েই অপমৃত্যু বরণ করতে বাধ্য হয়েছে। আজ ফিলিস্তিন আন্দোলন ইসলামের মাঝেই তার মুক্তির খোঁজ করছে। আর এটাই হলো আত্মনিয়োগ ও আত্মচেতনায় প্রত্যাবর্তন যা শুধু ফিলিস্থিনেই নয়, বরং সকল ইসলামী দেশ ও আরব জাহানে উত্তাল তরঙ্গমালার সৃষ্টি করে চলেছে। অতীতে ইসলামের কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতাই প্রমাণ ছিল। কিন্তু একজন আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় নেতা হিসাবে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভের পর ইসলামী তৎপরতাসমূহ রাজনৈতিক ও কার্যকরী দিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনী আন্দোলন এতকাল যেখানে জাতীয়তাবাদী ধ্যান্তধারণা নিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক বৈশিষ্ট্যর অধিকারী ছিল সেখানে আজ ইসলামী চরিত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক আকিদায় পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিন জেহাদে ইসলামীর মহাসম্পাদক ডঃ ফাতহী শাকাকীর ভাষায় ইসলামী বিপ্লবের বিজয় সমগ্র বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মাঝে জীবনাদর্শ স্বরূপ দীনের প্রতি অটল বিশ্বাস এনে দেয় এবং প্রমাণ করে যে, ইসলাম এক অপরাজেয় শক্তি এবং ইসলাম ফিলিস্তিনী জনগণের মাঝে আন্দোলন ও অভুত্থানের শক্তি [ডঃ ফাতহী শাকাকী ১৯৫১ সালে গাজা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনী ও নয়া ইসলামী পরিকল্পনা নামক পুস-ক প্রনয়ণ করেন এবং ১৯৮৮ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে বহিস্কৃত হন।] ফিলিস্থিনে ইন্তিফাদা গণঅভ্যুত্থানে শুরুর ফলে যারা এখনো পর্যন্ত আরব জাতীয়তাবাদী মন্ত্রে বিশ্বাসী তারা পর্যন্ত ইসলামকে ফিলিস্তিন মুক্তির জন্যে মুক্তির এক উৎস ও আরবদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসাবে মেনে নিয়েছে এমন কি অনেককে আন্তরিক ভাবেই নিজেদের চিন্তাদর্শন পুনবিবেচনা করছেন। [প্রখ্যাত ফিলিস্তিনী ব্যক্তিত্ব আহমাদ জিব্রাইল ১৯৯২ সালে তেহরানে এক সম্মেলনে বলেনঃ আমরা কেনো বলছি যে, সকল মুসলমানের কাছে আমাদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? এজন্যেই যে, আমরা জানি, ফিলিস্তিনীরা একাকী ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে সক্ষম নয় এবং এটাও জানি যে, আরব বিশ্ব ও আরব জাতীয়তাবাদ একাকী ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে সক্ষম নয়। তিনি আরো বলেন, অতীতে আমার চিন্তাদর্শনের মূল বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশ, সমপ্রদায় ও জাতীয়তা। কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর বিপ্লবী ইসলামের দিকে আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। যখন শুনতে পেলাম যে, ইসলামী বিপ্লবের বয়োবৃদ্ধ নেতা ইমাম খোমেনী আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের নাম দিচ্ছেন শয়তানে বুযুর্গ তখন তা আমার মাঝে খুবই প্রভাব ফেলে।]
ফিলিস্থিনে ইয়াহুদীদের অভিবাসন দেয়ার লক্ষ্য কেবল জমি দখলই নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের রাজনেতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছাড়াও ফিলিস্তিন ইস্যুর ভেতর লুকিয়ে থাকা ইসলামী উম্মার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের নয়া ক্রুসেড যুদ্ধের অশুভ উদ্দেশ্য এবং ১০৯৫ থেকে ১২৪৯ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ক্রুসেড যুদ্ধে খৃস্টান জগৎ ও পাশ্চাত্যের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা। তাছাড়া ১৪৫৩ খৃস্টাব্দে উসমানী সাম্রাজ্যের হাতে কনস্ট্যান্টিনোপলের (ইস্থাম্বুল) পতনে পাশ্চাত্য ও খৃস্ট জগৎ যে, অবমাননার শিকার হয় তার গ্লানি থেকেও বের হয়ে আসা। [আহমদ জিব্রাইল বলেনঃ ভাই ও বোনেরা! আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে, বিভিন্ন পোশাক ও আকারে ক্রুসেড যুদ্ধের অবতারণা করা ছাড়া ইস্যু অন্য কিছু নয়। পশ্চিমাও ইউরোপীয় সরকারগুলো ইসলামের কাছে অতীত পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চাচ্ছে। (ফিলিস্তিন বিষয়ক প্রথম ইসলামী সম্মেলনের রচনাবলী, যামিল সাঈদী, ৪৭ পৃষ্ঠা।)
একইভাবে মুনীর শফিক বলেনঃ ফিলিস্তিন ইস্যু আসলে ইসলামের ইস্যু আর এ বিষয়টির সাথে দেশপ্রেম ও আরব জাতীয়তার কোন বিরোধ নেই। যেহেতু ফিলিস্তিন ইস্যুর মূল ভিত্তি ও সারবত্তা হচ্ছে ইসলামী, সেহেতু এ ভিত্তি অনুসারেই এ সমস্যার (ফিলিস্তিন) চিকিৎসা করা উচিত এবং এর ভিত্তিতেই সমাধান পেতে হবে। ফিলিস্তিন ইস্যু ইসলামী উম্মত ও তার দুশমনদের মাঝে লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। একই ভাবেই আমাদের দুশমন তথা যায়নবাদী গোষ্ঠী ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের যাবতীয় পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রীয় বিষয়ও হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিকৃত ফিলিস্তিন ইস্যু। আর তাই সকল ইসলামী দেশের ইসলামী স্ট্র্যাটেজী প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিলিস্তিন ইস্যুকে স্থান না দেয়া পর্যন্ত জাতীয় গণঅভ্যুত্থান, স্বাধনতা, একতা ও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু কলেমার পতাকা উত্তোলন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। (ফিলিস্তিন বিষয়ক প্রথম ইসলামী সম্মেলনের রচনাবলী, ১০৯ পৃঃ)]
ফিলিস্তিন আন্দোলনের বিভিন্ন মুখী সংগ্রামের অচলাবস্থা ও ব্যর্থতার পরই এ নয়া চিন্তা-দর্শনের জন্ম হয়। আরো সঠিক অর্থে বলা যায় এ চিন্তা-দর্শন তখনি শক্তি লাভ করে। এভাবে বলা যেতে পারে, ইন্তিফাদা ইসলামী বিপ্লবের সাথে ইসলামী ঝোঁক-প্রবণতার দিক দিয়ে বহু নৈকট্য ও সাদৃশ্যের অধিকারী এবং ইমাম খোমেনী ফিলিস্তিনী জনগণের কাছে চিহ্নিত আদর্শ হিসাবে গণ্য ও সম্মানের পাত্র। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও পথনির্দেশ ফিলিস্তিনী জনতার মনোযোগের বিষয়। আর একারণেই ইমাম খোমেনীর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-দর্শনের প্রতি ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদা আন্দোলন যথাযথ মর্যাদা দান করছে। কেননা ফিলিস্তিনী মুসলমানগণ ইমামকে ইসলামী আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনকারী বলে গ্রহন করে নিয়েছেন।
গাজা-আরিহা আপোষদফা
ইন্তিফাদা আন্দোলন জন্ম নেয়াটা একদিকে শরণার্থী ফিলিস্তিনীদের মাঝে আশা-ভরসার আলোকচ্ছটা দেখা দেয় এবং অন্যদিকে ইসরাইল গুরুতরভাবে বিপদ অনুভব করে। একারণেই দখলদার সরকার বেকায়দায় পড়ে গিয়ে আপোষের জন্য তৈরী হয়। অথচ এতোদিন যাবত ফিলিস্তিনীদের ন্যূনতম ও নামকা ওয়াসে- স্বীকৃত অধিকারসম্বলিত যাবতীয় ইশতেহার ও পরিকল্পনাকেও ইসরাইলী যায়নবাদীরা শক্ত হাতে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে এবং নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ ও ৩৩৮ নম্বর ইশতেহারকে অস্বীকার করেছে। রিগান শান্তি পরিকল্পনাসহ এ ধরনের বহু পরিকল্পনাকেই ইসরাইল পদতলে পিষ্ট করেছে। মূলত যে কোন রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখানের পেছনে যে কারণটি নিহিত ছিল তা হচ্ছে যায়নবাদী ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিন নামক কোন জাতির ঐতিহাসিক পরিচয়কেই ভিত্তিহীন বলে মনে করতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইন্তিফাদার আতঙ্কে আমেরিকা ও ইসরাইল ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা পিএলও’র সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন এবং একমুখী বিশ্ব ব্লক সৃষ্টি হওয়ার কারণেও আমেরিকা চাচ্ছিল যত দ্রুত সম্ভব সঙ্কটের কেন্দ্রগুলো বিশেষ করে বৈশ্বিক বিপদাপদের উৎস মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি ও সংকটের আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে ও নিভিয়ে ফেলতে। কেননা এতে করে ইউরোপ ও জাপানের প্রভাব, এমন কি ইসলামপন্থী আন্দোলনকে ঠেকাতে ও নিশিহ্ন করতে পারবে।
এদিকে ফিলিস্তিনী আপোষকামী মহলও ইন্তিফাদাকে নিজেদের হাতে আলোচনায় দরকষাকষি ও সুবিধা আদায়ের ধারালো অস্ত্র মনে করে ফল ভোগের জন্যে আপোষের আলোচনায় অবতীর্ণ  হয়।
১৯৯৩ খৃস্টাব্দের নয়ই সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার চেয়ারম্যান হিসাবে ইয়াসের আরাফাত আইজাক রাবিনের কাছে লিখিত এক পত্রে ইসরাইলের অসি-ত্ব স্বীকার করে নেয় এবং ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানমূলক সকল আন্তর্জাতিক ইশতেহার ও বিধি মেনে নেয়বার ঘোষণা দান করে। এছাড়া পিএলও সনদের যে অংশে ইসরাইলের অসি-ত্ব অস্বীকার করা হয়েছিল তা বাতিল বলে ঘোষণা দেয়া হয়। আইজাক রবিনও একই দিনে জবাবী পত্রে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থাকে ফিলিস্তিনী জনতার প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং এর সাথে আলোচনার বিষয়টি ইসরাইলী ক্যাবিনেটে অনুমোদন করিয়ে নেয়। ইয়াসির আরাফাত ও আইজাক রাবিন কতিপয় আলোচনার পর সতেরো দফাবিশিষ্ট এক খসড়া সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করে। এ সমঝোতায় জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের কিছু এলাকা (আরিহা) ও গাজা অঞ্চলের উপর ফিলিস্তিনীদের স্বায়ওশাসনকে মেনে নেয়া হয়।
আমেরিকা ও ইসরাইল কর্তৃক এ চুক্তি মেনে নেয়ার আসল মতলব ছিল ফিলিস্তিনীদের ভেতর ফাটল ধরানো এবং ইন্তিফাদার বিপ্লবী আগুনকে ফিলিস্তিনীদের দিয়েই নিভিয়ে দেয়া। এ আপোষ সমঝোতার আরেকটি ফল এই হয়েছে যে, প্রতিক্রিয়াশীল আরব সরকারগুলো কর্তৃক ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার পথে বিদ্যমান সকল বাধা-বিঘ্ন সরিয়ে রাস্তা মসৃন করা। এরা ইসরাইলকে এলাকায় একটি আইনানুগ ঘাঁটি হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েিছল। ইসরাইলের পক্ষ থেকে এ চুক্তি মেনে নেয়াটা এক ধরনের পশ্চাদপসারণই ছিল। এর আসল কারণ ইন্তিফাদার বিপদ সম্পর্কে ইসরাইলীদের ভীষণ ভয় ও উদ্বেগ। তবে নিশ্চিত করেই বলা যায়, এ সমঝোতা ফিলিস্তিনী জাতির সংগ্রামের সুমহান লক্ষ্য-আদর্শ থেকে অনেক ব্যবধান রয়েছে।
ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান ভবিষ্যত মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল ও মুসলিম উম্মার জন্যে দারুন বিপর্যয় ডেকে আনবে। এ অপরাধের দায়-দায়িত্ব কেবল আরাফাত ও পিএলও’র ঘাড়েই বর্তাবে না। যখন এ সমঝোতার প্রতি ব্যাপক ও গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে তাকাবো এবং ইমাম খোমেনীর চিন্তা-দর্শনের আলোকে বিচার করবো তখন দেখতে পাবো যে, এ গুনাহ ও অপরাধের দায়-দায়িত্ব সকল ইসলামী সরকারের ঘাড়েই বর্তিয়েছে। কেননা এরা সবাই এ ধরনের যিল্লতিপূর্ণ পরিসি'তি সৃষ্টির জন্যে দায়ী।
যা হোক এই আপোষকামী নয়া তৎপরতার ফলাফল ও ভাগ্য সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যদিও অনেক সময়ের দরকার এবং আগামী বছরগুলোই বাস-বতাকে তুলে ধরবে, তথাপি একথা বলা যায় যে, ফিলিস্থিনে প্রতিরোধের লীজ তার ইসলামী আকিদা বিশ্বাসগত উর্বর ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে এবং ফিলিস্তিনী সাধারণ মুসলমান জনতার ঈমান ও আদর্শ এমনি এক ফল ধারায় পরিণত হয়েছে যে, তা প্রতিরোধের বীজ ও অঙ্কুরকে অবারিত পানি দিয়ে বড় করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করা যায় যে, প্রতিরোধ ও আন্দোলনের এক বিশালদেহী চিরসবুজ বৃক্ষ তার জটাজাল বিস্তার করে মাথা তুলে চিরন্তন হয়ে দাঁড়াবে। এর সুস্পষ্ট লক্ষন ও নমুনা অত্যন্ত পরিস্কার। আর এটাই সেই ভবিষ্যত ইমাম খোমেনী যার প্রতীক্ষা করে গেছেন এবং তাঁর সমগ্র জীবন ও সংগ্রামব্যাপী এর বাস-বায়ন দেখার জন্যে দুঃখ-কষ্ট সয়ে গেছেন এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন।