নবুওয়াত সম্পর্কিত একটি আলোচনা
এ মহাবিশ্বে বিরাজমান সকল কিছুই মহান আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মের অধীন। কোন অবস্থায়ই কোন কিছুই এ নিয়মের গণ্ডি থেকে মুক্ত হতে পারে না। এ নিয়মের অধীনেই সৃষ্ট বিষয়সমূহ পরিচালিত এবং বিকাশ ও পূর্ণতাপ্রাপ্তির জন্য প্রস্তুত হয়। অতএব,শষ্যবীজ এক বিশেষ নিয়মের অধীন যা উপযুক্ত শর্ত সাপেক্ষে বৃক্ষে পরিণত হয়;জীবন এককও এক বিশেষ নিয়মের অধীন যা তাকে মনুষ্যত্বের পর্যায়ে উন্নীত করে। নক্ষত্র থেকে প্রোটন পর্যন্ত এবং নক্ষত্রের চারিদিকে প্রদক্ষিণরত গ্রহসমূহ থেকে প্রোটনকে কেন্দ্র করে ভ্রমণকারী ইলেকট্রনসমূহ পর্যন্ত সবকিছুই এ নিয়মের অধীনে পরিচালিত হয় এবং নিজ নিজ বিশেষ সম্ভাবনাসমূহের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে বিকশিত ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়।
মহান প্রভু কর্তৃক প্রণীত এ কর্মসূচী সর্বজনীন। বিজ্ঞানসম্মতভাবে তা এ মহাবিশ্বের সকল পর্যায়ে এবং সকল বিষয়ে বিস্তৃত।
বিদ্যমান এ বিশ্বে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো মানুষের ঐচ্ছিক স্বাধীনতা। মানুষ এক স্বাধীন (ঐচ্ছিকভাবে) ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন অস্তিত্ব অর্থাৎ তার উদ্দেশ্য আছে এবং তার সমস্ত কর্ম ঐ উদ্দেশ্যের পথেই সম্পন্ন করে। সে মাটি খনন করে যাতে পানি পেতে পারে,খাদ্যসমূহ রান্না করে যাতে সুস্বাদ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয় এবং প্রাকৃতিক বিষয়সমূহকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাতে প্রকৃতির নিয়ম সম্পর্কে অবগত হতে পারে। ঐ সকল প্রাকৃতিক বিষয়েরও লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিদ্যমান এবং তারা সকলেই একই রেখায় নিজ নিজ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসরমান। তবে তাদের ক্রিয়াকলাপ কেবল জীবন ও জীবন ধারণ নয়,বরং এগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে শারীরবৃত্তিক (Physiological)। যেমন ফুসফুস,পাকস্থলী ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শারীরিক কাজকর্মের জন্য এক বিশেষ উদ্দেশ্যের পেছনে ধাবিত হয়। কিন্তু এ উদ্দেশ্য নিজ বিশেষ সহজাত ও শারীরিক ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে নয়,বরং তা জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান সৃষ্টিকর্তারই ইচ্ছায় হয়ে থাকে। যেহেতু মানুষ এক উদ্দেশ্যসম্পন্ন অস্তিত্ব সেহেতু তার সকল কর্মতৎপরতার পেছনে যে উদ্দেশ্য লুক্কায়িত থাকে তা ঐ কর্মসমূহের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে মানুষ তার কর্মক্ষেত্রে এমন নয় যে,সর্বদা সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সংগতি বজায় রেখে কাজ করে (যেমন এক বিন্দু পানি মহাকর্ষ নিয়মের ফলে নীচে পতিত হয়)। কারণ যদি তা-ই হতো তবে মানুষের অন্তরে এমন কোন উদ্দেশ্য বিরাজ করত না যার দিকে সে ধাবিত হতে পারে। এখন মানুষ হলো উদ্দেশ্যসম্পন্ন অস্তিত্ব যে স্বাধীন এবং সে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আধিপত্য বিস্তার করে। অতএব,মানুষের কর্মক্ষেত্র ও উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক হলো একটি নিয়ম যা তার ইচ্ছাকে প্রতীয়মান করে। কারণ উদ্দেশ্য নিজেই অবচেতনভাবে বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে না। সুতরাং প্রত্যেক মানুষই আপন উদ্দেশ্যকে তার নিজস্ব কল্যাণচিন্তা,প্রয়োজনীয়তা এবং চাহিদা অনুসারে বিধিবদ্ধ ও সীমাবদ্ধ করে। আবার স্থান-কাল ও পরিবেশ যা মানুষের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট তা তার এ চাওয়া-পাওয়া,লক্ষ্য ও অভ্যাসসমূহের সীমা নির্ধারণ করে। কিন্তু এ সকল পারিপার্শ্বিক নিয়ামক ও প্রভাবক যেগুলো মানুষকে তার লক্ষ্যপানে ধাবিত করে সেগুলো আসলে বায়ুপ্রবাহের মতো নয় যা বৃক্ষ পত্রকে আন্দোলিত করে,বরং স্বীয় লক্ষ্যপানে ধাবিত হওয়া প্রকৃত প্রস্তাবে নির্দিষ্ট সময়ে মানুষের কল্যাণচিন্তা থেকেই উৎসারিত। কারণ বায়ুপ্রবাহ এবং পত্ররাজির আন্দোলনে স্বকীয় উদ্দেশ্য নামক কোন বিষয়ের ভূমিকা নেই।
অতএব,উল্লিখিত নিয়ামকসমূহ অর্থাৎ স্থান-কাল-পরিবেশ বাধ্যগতভাবেই মানুষকে তার কল্যাণচিন্তার উপলব্ধির সাথে সম্পর্কযুক্ত কোন নির্দিষ্ট কাজে প্ররোচিত করে। তবে প্রতিটি কল্যাণচিন্তাই মানুষকে প্ররোচিত করে না,বরং তার সহজাত কল্যাণচিন্তাই এ স্থানে ভূমিকা রাখে। কল্যাণচিন্তা (مصالح) দু’প্রকারের। কোন কোন কল্যাণচিন্তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন এক উদ্দেশ্যের অধিকারী ব্যক্তিকে দ্রুত সময়ে ফল দান করে। আবার কোন কোন কল্যাণচিন্তা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে একটা সমাজকে বা জনগোষ্ঠীকে সুফল দিয়ে থাকে এবং প্রায়শঃই ব্যক্তিগত কল্যাণচিন্তার সাথে সামাজিক কল্যাণচিন্তার বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। অতএব,আমরা দেখতে পাই যে,মানুষ প্রায়ই কল্যাণচিন্তা ও ইতিবাচক মূল্যবোধের কারণে কর্মে লিপ্ত হয় না,বরং যতটুকু থেকে সে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে পারবে,ঠিক ততটুকু কার্য সম্পাদনেই উদ্যোগী হয়। অপরদিকে সমাজের কল্যাণচিন্তা অনুসারে মানব উন্নয়নের জন্য নিয়ামকসমূহের ভূমিকা মানুষের জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য শর্ত এবং তার সফলতাও দীর্ঘস্থায়ী হয়। এর ভিত্তিতে সমাজকল্যাণে মানুষের প্রাসঙ্গিক আচরণ ও প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে তার জীবন পদ্ধতি ও জীবন যাপন যা অপরিহার্য করে তা,আর তার ব্যক্তিগত প্রবণতা,সহজাত প্রবৃত্তি ও ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্য প্রচেষ্টা-এ দুয়ের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ সৃষ্টি হয়।
অতএব,একান্ত বাধ্যগতভাবেই এ বিরোধের অবসান এবং যে সকল নিয়ামক ও কারণ মানুষকে সমাজের কল্যাণার্থে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তা পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান থাকার জন্য মানুষকে একটি বিষয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। (আর তা হলো নবুওয়াত)।
নবুওয়াত মানব জীবনের জন্য একটি ঐশী বিষয় যা প্রাগুক্ত বিরোধের সমাধান দেয়। অর্থাৎ সামাজিক কল্যাণকে বৃহত্তর পরিধিতে ব্যক্ত করে যা ব্যক্তিগত স্বার্থ ও কল্যাণের সীমাকে অতিক্রম করে যায়। আর তা এ আহ্বানের মাধ্যমে রূপ লাভ করে যে,মৃত্যুর পরও মানব জীবন অব্যাহত থাকবে এবং মানুষকে প্রতিদান লাভের জন্য সত্য ও ন্যায়বিচারের ময়দানে উপস্থিত হতে হবে। মানুষই হলো সে সৃষ্টি যে আপন কর্মের ফল দেখতে পাবে। পবিত্র কোরআনের আয়াত এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য :
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْراً يَرَهُ وَ مَنْ يَعْمَلْ مِثْقاَلَ ذَرَّةٍ شَرّاً يَرَهُ
“তখন কোন ব্যক্তি এক অণু পরিমাণও পুণ্যকর্ম করিয়া থাকিলে সে উহা দেখিবে এবং কোন ব্যক্তি এক অনু পরিমাণও মন্দ কর্ম করিয়া থাকিলে সে উহা দেখিবে।” (সূরা যিলযাল : ৭ ও ৮)
সুতরাং এক দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সামাজিক কল্যাণ ব্যক্তিকল্যাণে রূপান্তরিত হয়।
অতএব,যা এ বিরোধের অবসান ঘটায় তা হলো এক নির্দিষ্ট মতবাদ এবং এর ভিত্তিতে প্রদত্ত বিশেষ শিক্ষা পদ্ধতি। আর উক্ত মতবাদ হলো পুনরুত্থান দিবস বা কিয়ামত সম্পর্কিত মতবাদ যার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সুফলদায়ক হয়। এ মতবাদের ভিত্তিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ঐশী পদ্ধতিতে হয়ে থাকে এবং ঐশ্বরিক সাহায্য ব্যতীত তা অসম্ভব। কারণ এ কার্যক্রম পরকাল বা অদৃশ্যের উপর নির্ভরশীল যা ঐশী বাণী (وحي) অর্থাৎ নবুওয়াত ব্যতীত অর্জিত হতে পারে না।
মোদ্দাকথা,নবুওয়াত ও পুনরুত্থান দিবস এ দুই পরস্পর জড়িত বিষয়ই মানব জীবনে উল্লিখিত বিরোধের সমাধান দিয়ে থাকে এবং মানুষের ঐচ্ছিক স্বাধীনতাভিত্তিক আচরণের বিকাশ সাধন ও প্রকৃত মানবকল্যাণের দিকে তাকে উন্নীতকরণের জন্য মৌলিক শর্তসমূহের আয়োজন করে।
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রমাণঃ
যেমন করে প্রজ্ঞাবান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব আরোহ যুক্তি পদ্ধতি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রমাণিত হয়েছে তেমনি মুহাম্মদ (সা)-এর নবুওয়াতও বৈজ্ঞানিক ও আরোহ যুক্তির মাধ্যমে এবং যে পদ্ধতি নিজেদের জীবনে কোন বাস্তবতাকে প্রমাণ করতে প্রয়োগ করা হয় সে পদ্ধতিতে প্রমাণিত হয়। এ উদ্দেশ্যে কয়েকটি উদাহরণ ভূমিকারূপে তুলে ধরব :
মনে করুন কোন ব্যক্তি কোন এক নিকটাত্মীয় গেঁয়ো কিশোর (যে প্রথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে) কর্তৃক প্রেরিত একটি চিঠি পেলেন। ঐ ব্যক্তি দেখতে পেল যে,উল্লিখিত চিঠিটি সর্বোচ্চ সাহিত্যমান,চূড়ান্ত ভাষাশৈলী,পূর্ণ অভিব্যক্তি ও সুন্দর চিন্তাসম্বলিত,নির্ভুল ও নূতন ভাষায় লিখিত। যখন কোন ব্যক্তি এ ধরনের একটি চিঠি পায় তখন দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে,কোন এক সুশিক্ষিত,বহুমুখী জ্ঞান ও সুন্দর লেখার অধিকারী ব্যক্তি এ চিঠিটি উক্ত কিশোরকে লিখে দিয়েছে অথবা ঐ কিশোর অন্য কোন উপায়ে কারো নিকট থেকে ভাষাগুলো শিখে নিয়েছে।
যদি আমরা উক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি তবে দেখতে পাব যে,ঐ ঘটনাটিকে পত্রপ্রাপক নিম্নরূপে বিশ্লেষণ করেছেন :
ক. পত্রলেখক হলো এক গেঁয়ো কিশোর যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে।
খ. পত্রখানি এক চূড়ান্ত বাগ্মিতা,আকর্ষণীয় ও মিষ্টি-মধুর এবং সুন্দর ও দক্ষ প্রকাশভঙ্গিতে জ্ঞানগর্ভমূলক ভাষায় লিখিত হয়েছে।
গ. অনুরূপ অবস্থাসমূহের মধ্যে অনুসন্ধানের মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে,একজন কিশোরের (ক-তে উল্লিখিত) পক্ষে এ ধরনের (খ-তে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসহকারে) একটি পত্র লিখা সম্ভব নয়।
ঘ. উপসংহারে বলা যায় পত্রটি অন্য কারো চিন্তা ও ভাষা থেকে রচিত হয়েছে। অতঃপর তা কোনভাবে উক্ত কিশোরের হাতে এসেছে এবং সে তা থেকে লাভবান হয়েছে।
অপর উদাহরণটি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পদ্ধতি থেকে নেয়া হয়েছে-যার মাধ্যমে বিজ্ঞানিগণ ইলেকট্রনের অস্তিত্ব প্রমাণ করে থাকেন। পদ্ধতিটি নিম্নরূপ :
কোন এক বিজ্ঞানী এক প্রকারের আলোক রশ্মির উপর গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়েছেন এবং অনুরূপ প্রকারের বিশেষ রশ্মিকে একটি বদ্ধ টিউবের মধ্যে উৎপাদন করেছেন। অতঃপর ঘোড়ার নাল আকৃতির একটি চুম্বক উক্ত টিউবের মাঝ বরাবর স্থাপন করলেন। এ সময় লক্ষ্য করলেন যে,উক্ত বিশেষ রশ্মি চুম্বকের ধনাত্মক মেরুর দিকে আকৃষ্ট হচ্ছিল এবং ঋণাত্মক মেরু থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এ নিরীক্ষণটিকে বিভিন্ন অবস্থা,সময় ও স্থানে পুনরাবৃত্তি করলেন এবং পরিশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে,এ বিশেষ রশ্মি চুম্বকের সাথে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ ক্রিয়া প্রদর্শন করে।
উক্ত বিজ্ঞানী তাঁর পর্যবেক্ষণকে অন্যান্য আলোক রশ্মির ক্ষেত্রেও পুনরাবৃত্তি করলেন। কিন্তু দেখতে পেলেন যে,এ আলোক রশ্মিসমূহ চুম্বক কর্তৃক প্রভাবিত হয় না অথবা তার দিকে আকৃষ্ট হয় না। অতএব,তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে,চুম্বকের চৌম্বকশক্তি আলোকরশ্মিকে আকর্ষণ করে না,বরং আলোক রশ্মির অভ্যন্তরে অবস্থিত বিশেষ সত্তাসমূহকে আকর্ষণ করে এবং উক্ত সত্তাসমূহ নির্দিষ্ট এক প্রকারের রশ্মিসমূহে বিদ্যমান যা চুম্বকের ধনাত্মক মেরুর দিকে ধাবিত হয়। এ বিষয়টিকে জ্ঞাত ধারণার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। অতএব,তিনি বুঝতে পারলেন যে,আলোক রশ্মিসমূহে অন্য কোন সত্তা বিদ্যমান। অর্থাৎ এ রশ্মিসমূহ ঋণাত্মক ধর্মবিশিষ্ট অতি ক্ষুদ্র কণিকার সমন্বয়ে গঠিত যা সকল প্রকারের পদার্থে উপস্থিত রয়েছে। এ অতি ক্ষুদ্র কনিকাসমূহকে ইলেকট্রন নামকরণ করা হলো।
উপরিউক্ত দু’টি উদাহরণে যুক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে,জ্ঞাত উপাত্তসমূহের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের পর্যালোচনা এবং অনুরূপ ক্ষেত্রসমূহে ঐ জ্ঞাত উপাত্তসমূহের অনুসন্ধানমূলক পর্যবেক্ষণ স্বয়ং ঐ নির্দিষ্ট ঘটনাসংশ্লিষ্ট নয়। আর এটা অপ্রত্যাশিত অপর এক বিষয়ের উপস্থিতি প্রমাণ করে যা উল্লিখিত ঘটনার সঠিক বিচার-বিশ্লেষণের জন্য ধরে নিতে হয়।
অন্যভাবে বলা যায়,যখন অনুরূপ অবস্থাসমূহের মধ্যে অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখা যায় যে,বিদ্যমান জ্ঞাত উপাত্তসমূহ অপেক্ষা বৃহত্তর কোন ফল পাওয়া যায়,তবে তা জ্ঞাত উপাত্তসমূহের নেপথ্যে অপর এক বিষয়ের উপাস্থিতি প্রমাণ করে যা তদোবধি আমাদের চিন্তায় ছিল না। আর এটা তা-ই যা বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াতের এবং মহান আল্লাহ্ কর্তৃক বিশ্ববাসীর জন্য ঘোষণাকৃত ঐশীবাণীর প্রমাণ বহন করে।
এ উপসংহার নিম্নলিখিত পর্যায়গুলো অতিক্রমণান্তে প্রমাণিত হয় :
ক. এ ব্যক্তি যিনি তাঁর রিসালাতকে (প্রেরিত বাণী) একক প্রভু কর্তৃক প্রেরিত বলে বিশ্ববাসীদেরকে আহবান জানাচ্ছেন তিনি ছিলেন সভ্যতা,সংস্কৃতি,চিন্তা,রাজনীতি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাৎপদ স্থান আরব উপদ্বীপের অধিবাসী। বিশেষ করে হেজায নামক এ উপদ্বীপের একটি স্থান যা এমনকি শত শত বছর পূর্বের প্রাথমিক সভ্যতার সাথেও ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত ছিল না,তিনি সে স্থানের অধিবাসী ছিলেন। হেজায পরিপূরক সামাজিক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছুই জানত না এবং সমসাময়িক সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে বিন্দুমাত্র লাভবান হয়নি। এমনকি বিশ্বের অন্যান্য স্থানের উন্নত সভ্যতা,সংস্কৃতি ও চিন্তার মতো উল্লেখযোগ্য কোন কিছুর উপস্থিতি হেজাযের অধিবাসীদের কবিতা ও সাহিত্যকর্মেও ছিল না। হেজাযের অধিবাসীরা বিশ্বাসগত দিক থেকে শিরক (অংশীদারিত্ব) এবং মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল। সমাজে সত্যিকার অর্থে বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম বিরাজ করছিল এবং একমাত্র সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতাভিত্তিক বিধানই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো। এভাবে তারা বিভিন্ন সম্প্রদায় (قبيله) ও দলে বিভক্ত ছিল। এ অবস্থার কারণে তাদের মধ্যে সর্বদা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব,সংঘাত ও লুটতরাজ লেগেই থাকত। যে শহরে নবী (সা.) বড় হয়েছেন সেখানেও শুধু গোত্রভিত্তিক শাসন-ব্যবস্থা ছাড়া প্রকৃত অর্থে কোন শাসন-ব্যবস্থা ছিল না এবং এর বাসিন্দারা গ্রোত্রপতি ছাড়া কউকে চিনত না। এমনকি পড়ালেখার মতো সভ্যতা-সংস্কৃতির এ সাধারণ কাজগুলোতেও তারা কালেভদ্রে বা কদাচিৎ হাত দিয়েছিল। অর্থাৎ এ সমাজ ছিল সামগ্রিকভাবে মূর্খ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে :
هُوَ الَّذِي بَعَثَ في الاُمِّيِّينَ رَسُولاً مِنْهُمْ يَتْلُوا عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَ يُزَكِّيهِمْ وَ يُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَ الْحِكْمَةَ وَ اِنْ كَانُو مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُبِينٍ.
“তিনিই নিরক্ষরদের মধ্যে তাহাদেরই মধ্য হইতে এক রাসূল আবির্ভূত করিয়াছেন যে তাহাদের নিকট তাঁহার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে এবং তাহাদিগকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাহাদিগকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়,যদিও পূর্বে তাহারা স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে ছিল।” (সূরা জুমু’আ : ২)
স্বয়ং রাসূল (সা.) উক্ত সমাজের ব্যক্তিসকলের নিরক্ষর অবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কোন লেখা-পড়াই করেননি। পবিত্র কোরআনের ভাষায় :
وَ ماَ كُنْتَ تَتْلُوا مِنْ قَبْلِهِ مِنْ كِتاَبٍ وَ لاَ تَخُطُّهُ بِيَمِينِكَ اِذاً لاَرْتَابَ الْمُبْطِلُونَ
“এবং তুমি ইহার পূর্বে কোন কিতাব আবৃত্তি কর নাই এবং তোমার ডান হাতে ইহা লিখও নাই,যদি এই রূপ হইত তাহা হইলে মিথ্যাবাদিগণ অবশ্যই সন্দেহ পোষণ করিত।”(সূরা আনকাবুত : ৪৮)
পবিত্র কোরআনের এ অকাট্য ভাষ্য নবুওয়াতের পূর্বে রাসূল (সা.)-এর সাংস্কৃতিক অবস্থার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। এ প্রমাণটি,এমনকি যারা কোরআনের ঐশ্বরিকতায় বিশ্বাসী নয় তাদের জন্যও অকাট্য প্রমাণ। কারণ তা এমন এক অকাট্য ভাষ্য যা নবী (সা.) তাঁর নিজ গোত্রের নিকট ঘোষণা করেছিলেন এবং যারা নবীর জীবনেতিহাস ও জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত ছিল তাদের সম্মুখে বর্ণনা করেছিলেন;তা সত্ত্বেও কেউই এ বক্তব্যের বিরোধিতা করতে পারেনি;বরং তারা জানত যে,রাসূল (সা.) এমনকি নবুওয়াতের পূর্বেও তদানিন্তন তাঁর গোত্রে প্রচলিত কবিতা বা প্রশংসাগীতির মতো কোন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করতেন না এবং চারিত্রিক বিষয়,যেমন বিশ্বস্ততা,সচ্চরিত্র,সততা ব্যতীত অন্য কোন শ্রেষ্ঠত্ব লাভের বাসনা তাঁর আচরণে পরিলক্ষিত হয়নি।
তিনি নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে চল্লিশ বছর আপন গোত্রের মাঝে অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু তাঁর প্রতিবেশীদের চেয়ে উল্লিখিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ব্যতীত অন্য কোন কিছুকে অগ্রাধিকার দেননি। অনুরূপ তিনি তাঁর জীবনে ঐ কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন,যা চল্লিশ বছর প্রকাশ লাভ করেছে তার কোন ইঙ্গিত ও চিহ্ন তাঁর প্রাকনবুওয়াত জীবনে প্রকাশিত ও প্রতিফলিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের বাণী স্মরণযোগ্য :
قُلْ لَوْ شَاءَ اللهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَ لاَ اَدْراَكُمْ بِهِ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُراً مِنْ قَبْلِهِ أفَلاَ تَعْقِلُونَ
“তুমি বল,যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করিতেন তাহা হইলে আমি ইহা তোমাদের নিকট পড়িয়া শুনাইতাম না এবং তিনিও উহা সম্বন্ধে তোমাদিগকে জ্ঞাত করিতেন না। নিশ্চয় আমি ইতোপূর্বে তোমাদের মধ্যে এক সুদীর্ঘ সময় ধরে জীবন যাপন করিয়াছি,তবুও কি তোমরা বিবেক-বুদ্ধি খাটাইবে না ও অনুধাবন করিবার চেষ্টা করিবে না?” (সূরা ইউনুস : ১৬)
মহানবী (সা.) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে দু’টি ছোট সফর ছাড়া আরব উপদ্বীপের বাইরে যাননি। এ দু’টি সফরের একটি ছিল তাঁর চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বাল্য বয়সে জীবনের দ্বিতীয় দশকের প্রথম দিকে এবং অপরটি ছিল তাঁর জীবনের তৃতীয় দশকের শুরুতে হজরত খাদিজা (সা.)-এর ব্যবসায়িক কাফেলার সাথে।
অতএব,নবী (সা.) যেহেতু পড়তে ও লিখতে অপারগ ছিলেন,সেহেতু ইহুদী ও খ্রিষ্টধর্মের কোন উৎস থেকে কিছুই পড়তে ও শিখতে পারেননি। অপরদিকে তাঁর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকেও এ ধরনের কিছু পাননি। কারণ মক্কা তখন চিন্তা ও আচরণগত দিক থেকে মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল এবং খ্রিষ্টবাদ ও ইহুদীবাদের কোন চিন্তা-চেতনা সেখানে পৌঁছেনি। আবার নীতিগতভাবে ‘হোনাফা’(الحنفاء)বলে পরিচিত যে সকল ব্যক্তি মূর্তিপূজাকে নিষেধ করতেন তাঁরাও খ্রিষ্টবাদ ও ইহুদীবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না।
এমনকি ইহুদীবাদ ও খ্রিষ্টবাদের চিন্তার কোন প্রতিফলনই কেস ইবনে সাদাত (قس ابن سعادة) এবং অন্যান্য হোনাফা অর্থাৎ দীনে হানীফের অনুসারীদের কবিতা ও সাহিত্যকর্মে খুঁজে পাওয়া যায় না।
এছাড়া রাসূল (সা.) যদি ইহুদী ও খ্রিষ্টবাদের উৎসসমূহ থেকে কিছু পাওয়ার চেষ্টাও করতেন,তবে তা ঐ রকম এক সহজ-সরল পরিবেশে এবং ইহুদীবাদ ও খ্রিষ্টবাদ সম্পর্কে অজ্ঞ সমাজে তাঁর আচার-আচরণে প্রকাশ পেত এবং এর ফলশ্রুতিতে তা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারত না।
খ. যে রিসালাত (ঐশী বাণী) ইসলামের নবী (সা.) বিশ্ব-মানুষের কাছে ঘোষণা করেছেন এবং যা কোরআন ও ইসলামী বিধি-বিধানের মাধ্যমে বাস্তব রূপ লাভ করেছে তা অনেক বিশেষত্বে পরিপূর্ণ ছিল :
ইসলামী রিসালাত মহান আল্লাহ্,তাঁর গুণাবলী,জ্ঞান ও ক্ষমতা এবং মানুষ ও স্রষ্টার মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কসমূহ সংক্রান্ত এক অভূতপূর্ব ঐশী দিকনির্দেশনা আকারে অবতীর্ণ হয়েছে। এটা মানব জাতির পথ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নবিগণের ভূমিকা এবং তাঁদের বার্তা ও বাণীর মধ্যকার ঐক্য,তাঁদের অতুলনীয় আদর্শিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টান্তসমূহকেও অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছে। এ রিসালাত নবিগণের সাথে প্রভুর আচরণ,সত্য ও মিথ্যা এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যকার অবিরাম দ্বন্দ্ব,সংঘাত ও সংগ্রাম সম্পর্কেও আলোচনা করেছে। যারা অত্যাচারিত,লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত তাদের সাথে ঐশী রিসালাতের যে গভীর সম্পর্ক আছে তা এবং সকল ঐশী রিসালাত যে,যারা অবৈধ স্বার্থ ও লেনদেনের মাধ্যমে অন্যদেরকে ঠকিয়ে সুবিধা ভোগ করে তাদের বিরোধী-এ বিষয়টিও ইসলামী রিসালাতে সুস্পষ্টরূপে বিবৃত হয়েছে।
ঐশী এ রিসালাত শুধু র্শিক ও মূর্তিপূজা কবলিত চিন্তা ও ধর্মের তুলনায়ই মহান ও শ্রেষ্ঠ নয়,বরং সকল ধর্ম-যেগুলো ঐ সময় পর্যন্ত মানুষের কাছে পরিচিত ছিল সেগুলোর চেয়েও শ্রেয়তর। এমনকি তাদের যে কোন প্রকারের তুলনা থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে যায় যে,ইসলাম এসেছে অতীতের সকল ধর্মের ক্রটি-বিচ্যুতিকে পরিশুদ্ধ করতে এবং ঐগুলোক মানবীয় ফেতরাত ও সুষ্ঠু যুক্তি ও জ্ঞানের দিকে প্রত্যাবর্তন করাতে।
আর এ বিষয়গুলোর সবই একজন নিরক্ষর ব্যক্তির মাধ্যমে এবং প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এমন এক সমাজে রূপ লাভ করেছে যে সমাজ বিকাশ ও পূর্ণতার পর্যায় তো দূরের কথা,সমসাময়িক কালের সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় পুস্তকসমূহের সাথেও যার কোন পরিচয় ছিল না।
মোট কথা,যে সকল বৈশিষ্ট্য ইসলামী বিধানে পরিদৃষ্ট হয়েছে তা ছিল মূলত নৈতিক মূল্যবোধ,জীবন যাপন জ্ঞান,মানুষ,তার কর্ম ও সামাজিক সম্পর্ক এবং ইসলামী বিধানে এ মূল্যবোধসমূহ ও ভাবার্থসমূহের যথাযথ রূপদান। এ ভাবার্থ ও মূল্যবোধসমূহ এবং বিধি-বিধানসমূহ,এমনকি যে একে ঐশী বলে বিশ্বাস করে না তার দৃষ্টিতেও মানব জাতির ইতিহাসে যত সভ্যতা ও সামাজিক মূল্যবোধ ও বিধি-বিধানের পরিচয় দেয়া হয়েছে সেগুলোর সকলের চেয়েও সুন্দরতম ও সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ।
“গোত্রীয় সমাজের সন্তান দাঁড়িয়েছে বিশ্ব ইতিহাসের চূড়ায়
বিশ্বমানবতাকে জানায় আহবান সম্প্রীতির ছায়ায়।”
যে সমাজ আত্মীয়-স্বজন ও বংশ অহমিকা আর সামাজিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞাপন করত,সে সমাজেরই সন্তান এ মিথ্যা অহমিকা আর বর্ণ বৈষম্যের সূতিকাগারকে ধ্বংস করতে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন বিশ্বের সকল মানুষ চিরুনির দাঁতের মতো পরস্পর সমান। দৃঢ় কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন :
اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقاَكُمْ.
“নিশ্চয় আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ঐ ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক খোদা-ভীরু।” (সূরা হুজুরাত : ১৩)
তিনি এ স্লোগানকে বাস্তব রূপ দান করেছিলেন যাতে করে মানুষ শোষণের কবল থেকে মুক্ত হতে পারে। নারীকে তার মর্যাদার আসনে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং মনুষ্যত্বের মর্যদার ক্ষেত্রে নারীকে পূরুষের মতোই এক আসনে বসিয়ে ছিলেন।
মরুর যে সন্তান শুধু নিজ সমস্যা ও ক্ষুধা নিবারণ ব্যতীত কোন কিছু চিন্তা করতে পারত না,অহংকার বলতে যে শুধু গোত্র ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারত না সে সন্তানই আত্মপ্রকাশ করেছিল মানব সমাজের বৃহত্তর বোঝা কাঁধে নিতে,বিশ্বের মুক্তিদাতারূপে মানব সমাজের নেতৃত্ব দিতে এবং সারা বিশ্বের অত্যাচারিত জনতাকে কাইজার আর বাদশাহী স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্তি দিতে। সুদ,ঘুষ আর মজুতদারীতে পরিপূর্ণ এক সমাজ-যার ছিল সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল দিকে বাধা-বিপত্তি,ঘাটতি ও অপ্রতুলতা সে সমাজেরই এক সন্তান উঠে দাঁড়িয়েছিল সে বাঁধা-বিপত্তিকে দূর করে ঐ ঘাটতি ও অপ্রতুলতাকে পূরণ করতে। এক দারিদ্র্য-নিপীড়িত সমাজকে মানবিক মূল্যবোধের প্রাচুর্য দিয়ে পূর্ণ করতে এবং আপন ধর্মের বিধানকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের দ্বারে প্রবেশ করাতে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। তিনি এসেছিলেন ঘুষ,মজুতদারী ও সুদ থেকে ঐ সমাজকে মুক্ত করতে,সম্পদকে ন্যায়ের ভিত্তিতে বণ্টন করতে এবং এমন এক সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে যে সমাজের শক্তি ও সরকার ধনাঢ্য আর সম্পদশালীদের হাতে না থাকে। সর্বোপরি,এক সর্বজনীন দায়িত্বশীলতা ও সামাজিক নিশ্চয়তা বিধানের মূলনীতিসমূহ ঘোষণা করতেই তাঁর উদয় হয়েছিল এ পৃথিবীতে। এগুলো সে সকল বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত যা কয়েক শতাব্দীর প্রচেষ্টা ও গবেষণা শেষে সমাজ বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে সঞ্চিত হয়েছে।
এ ব্যাপক পরিবর্তন সামাজিক বিকাশ নামে প্রকৃতপক্ষে এক ক্ষুদ্র সময়ের ব্যবধানে বাস্তব রূপ লাভ করেছিল।
মোটকথা,ইসলামের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত স্বতন্ত্র দিক হলো পবিত্র কোরআনে পূর্বের শরীয়তসমূহ,নবিগণের ইতিহাস এবং তাঁদের উম্মত ও উম্মতগণের উপর যা কিছু ঘটেছে সেগুলো সম্পর্কে বহু বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে। একটি শির্ক কবলিত ও নিরক্ষর পরিবেশ,যেখানে নবী (সা.) ঐ সময়ে বসবাস করতেন তিনিও এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই অবগত ছিলেন না। এমনকি ইহুদী ও খ্রিষ্টান আলেমগণও অনবরত রাসূল (সা.)-কে বিতর্কে আহবান করেছিলেন এবং তাঁর সাথে তাঁদের ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে কথোপকথন করতে চেয়েছিলেন। মুহম্মাদ (সা.) বীরত্বের সাথেই এ প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন এবং ঐ সকল ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে কোন কিছু জানার সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও কোরআন থেকে তিনি আহলে কিতাবের আলেমগণ যা জানতে চেয়েছিলেন তার জবাব দিয়েছিলেন।
وَ ماَ كُنْتَ بِجانِبِ الْغَرْبِّي اِذْ قَضَيْناَ اِلىَ مُوسى الْاَمْرَ وَماَ كُنْتَ مِنَ الشَّاهِدينَ
“এবং তুমি (তুর পর্বতের) পশ্চিম পার্শ্বে উপস্থিত ছিলে না,যখন আমরা মূসাকে (নবুওয়াতের) দায়িত্ব অপর্ণ করিয়াছিলাম এবং তুমি তখন সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্তও ছিলে না।”(সূরা কাসাস : ৪৪)
وَ لَكِنَّا اَنْشَأناَ قُرُوناً فَتَطاَوَلَ عَلَيْهِمُ الْعُمُرُ
“কিন্তু আমরা বহু জাতিকে সৃষ্টি করিয়াছিলাম,অতঃপর উহাদিগের বহু যুগ অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে।”(সূরা কাসাস : ৪৫)
وَمَا كُنْتَ ثَاوِياً في اَهْلِ مَدْيَنَ تَتْلُوا عَلَيْهِمْ آياَتِناَ وَ لَكِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ
“তুমি মাদ্য়ানবাসীদের মধ্যেও কোন কালে অবস্থানকারী ছিলে না যে,তুমি তাহাদের নিকট আমাদের নিদর্শনসমূহ পাঠ করিয়া শুনাইতে;কিন্তু আমরাই রাসূল প্রেরণকারী।”(সূরা কাসাস :৪৫)
وَمَا كُنْتَ بِجَانِبِ الطّورِ اِذْ نَادَيْناَ وَ لَكِنْ رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ لِتُنْذِرَ قَوْماً ماَ أتاَهُمْ مِنْ نَذِيرٍ مِنْ قَبْلِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ.
“এবং তুমি তখনও তূর পর্বতের পার্শ্বে উপস্থিত ছিলে না,যখন আমরা (মূসাকে) ডাকিয়াছিলাম। বস্তুত এ সবকিছু তোমার প্রভুর নিকট হইতে রহমতস্বরূপ,যেন তুমি সেই জাতিকে সতর্ক করিয়া দাও যাহাদের নিকট তোমার পূর্বে কোন সতর্ককারী আসে নাই,যেন তাহারা উপদেশ গ্রহণ করিতে পারে।”(সূরা কাসাস : ৪৬)
অতএব,স্পষ্টতঃই বুঝা যায় যে,কোরআনে বর্ণিত সত্য কাহিনীসমূহ বাইবেলের পুরাতন বিধান (The Old Testament) এবং নূতন বিধান (The New Testament) থেকে উদ্ধৃত ও বর্ণিত হতে পারে না,এমনকি যদি মনেও করা হয় যে,পুরাতন ও নূতন বিধানসমূহের বিষয়বস্তু ও চিন্তাসমূহ ইসলামের নবী (সা.)-এর আবির্ভাবের সময় ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। কারণ উদ্ধৃতি ও বর্ণনাকরণ নেতিবাচক ভূমিকা রাখে অর্থাৎ এক পক্ষ থেকে গ্রহণ করে এবং অন্য পক্ষকে দান করে। কিন্তু এ কাহিনীগুলো বর্ণনার মাধ্যমে কোরআন ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। আর যা নূতন ও পুরাতন বিধানসমূহে বর্ণিত হয়েছে তার পরিশুদ্ধি ও ভারসাম্য বিধান করে এবং নবী ও তাঁদের উম্মতগণের কাহিনী ও ইতিহাসসমূহকে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও জটিলতাসমূহ যা ফেতরাত,তাওহীদ ও ধর্মীয় নির্ভুল প্রমাণসমূহের সাথে কোন প্রাসঙ্গিক সম্পর্ক রাখে না তা থেকে পরিশুদ্ধ করে।
সাহিত্যমানের দিক থেকে কোরআন চূড়ান্ত বাগ্মিতা ও এক নব ভাষাশৈলী ও অভিব্যক্তিতে পরিপূর্ণ। এমনকি যারা কোরআনের ঐশ্বরিকতায় বিশ্বাস করে না তাদের কাছেও কোরআন উল্লিখিত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। বস্তুত কোরআনের বাগ্মিতা ও নব ভাষাশৈলিতা আরবী ভাষার ইতিহাসে অন্ধকার যুগ (ايام جاهلية) ও ইসলামী যুগের (ايام جاهلية-এর পরবর্তী যুগ) পার্থক্য নির্দেশক সীমারেখারূপে এবং এ ভাষার সার্বিক বিকাশ ও শাব্দিক রীতিসমূহের মূলনীতিরূপে পরিচিত।
যে সকল আরব নবী (সা.)-এর নিকট থেকে কোরআন শুনেছে তারা অনুধাবন করেছে যে,এ বাক্যসমূহ চূড়ান্ত ভাষাশৈলী ও অভিব্যক্তিতে পূর্ণ এবং তদোবধি যত ভাষা তারা শুনেছে তার যে কোনটির সাথেই অতুলনীয়। আর এ কারণেই তাদের একজন যখন কোরআন শুনেছিল তখন বলেছিল : “খোদার শপথ,এমন ভাষা শুনলাম যা না কোন মানুষের ভাষা,না কোন জ্বীনের,যে ভাষা মিষ্টি-মধুর প্রাঞ্জল। যার বাহ্যে রয়েছে ফল ও প্রাচুর্য,আর গভীরে রয়েছে সমৃদ্ধি;সবকিছুকেই যা ছাড়িয়ে যায়,কোন কিছুই যাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না,যার বাগ্মিতা আর প্রাঞ্জলতার কাছে সকল কথা-সকল ভাষাই ম্লান হয়ে যায়।(কথিত আছে যে,এ উক্তিটি ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা থেকে বর্ণিত হয়েছে। আসবাবে নুযূল : ২৯৫,সূরা মুদ্দাস্সির এবং এ’লামুল ওয়ারা,১ : ১১০-১১২ দ্রষ্টব্য। )
তৎকালীন আরবরা কোরআন তাদেরকে প্রভাবিত করবে-এ ভয়ে তা শ্রবণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখত। কোরআন শোনার ফলে তাদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে-তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করবে-এ ভয়ে তারা কোরআন শোনা থেকে দূরে থাকত। এটা কোরআনের অভিব্যক্তি ও মর্যাদার ক্ষেত্রে একটি উত্তম প্রমাণ যে,তৎকালীন সময়ে প্রকাশভঙ্গি ও সাহিত্য শৈলীর ক্ষেত্রে কোরআনের সমকক্ষ কিছুই ছিল না। যারাই নবী (সা.)-কে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কে আহবান করত তারাই সর্বদা তাঁর বক্তব্য ও যুক্তির কাছে হার মানত। কোরআন ঘোষণা করেছিল,যদি সমস্ত মুশরিক ও ইসলামের শত্রুরা একত্র হয়েও চেষ্টা করে তবু কোরআনের অনুরূপ কোন গ্রন্থ রচনা করতে পারবে না। দ্বিতীয়বার ঘোষণা করেছিল,এমনকি দশটি সূরাও আনতে পারবে না এবং তৃতীয়বার দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিল,এমনকি কোরআনের মতো একটি সূরাও তারা দেখাতে পারবে না। নবী (সা.) এ বিষয়টিকে এক বাকপটু,তার্কিক ও আপন মহিমাগীতিতে পটু সমাজের কাছে (যারা ইসলামের ধ্বংস ব্যতীত আর কিছুই ভাবতে পারত না) অনবরত ঘোষণা করেছিলেন। এতদসত্ত্বেও ঐ সমাজ (যেখানে সাহিত্যিক দিক থেকে এতটা বিতর্কের আহবান ছিল) কোরআনের মোকাবিলায় দাঁড়ানোর কোন চেষ্টাই করেনি। কারণ তারা দেখেছিল যে,কোরআনের সাহিত্যিক মান তাদের শাব্দিক,সাহিত্যিক ও কৌশলগত পারঙ্গমতার ঊর্ধ্বে অবস্থিত। এটাই সর্বাধিক আশ্চর্যের বিষয় যে,যিনি এ কোরআনের বাহক তিনি চল্লিশ বছর আপন গোত্রের মাঝে বসবাস করেছিলেন এবং কোন প্রকার বিতর্ক ও বাকযুদ্ধে কখনই অংশগ্রহণ করেননি। এছাড়া বাকপটুতায়ও তাঁর কোন প্রকার কৃতিত্ব তৎপূর্বে পরিলক্ষিত হয়নি।
এগুলো হলো নবী (সা.) কর্তৃক আনিত রিসালাতের বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে কয়েকটি।
গ. এ ধাপটি জনপদসমূহের ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের উপর গুরুত্বারোপ করে এবং তার উপর নির্ভরশীল। খ-তে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্বলিত রিসালাতের বিষয়গুলো স্পষ্টতঃই ক-তে বর্ণিত উপাদান ও বিষয়গুলো অপেক্ষা শ্রেয়। ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে আমরা এ ধরনের বহু ঘটনা দেখতে পাই যে,কোন ব্যক্তি আপন সমাজের শীর্ষে আরোহণ করেছে এবং উক্ত সমাজকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোন সমাজের ক্ষেত্রেই বর্ণিত সমাজের মতো এরকম বিপরীত অবস্থা,এরকম প্রতিকূল অবস্থা পরিলক্ষিত হয় না। এতদসত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই এক বিস্ময়কর সর্বজনীন অগ্রগতি ও বিকাশ জীবনের সর্বাবস্থায় মূল্যবোধ ও তাৎপর্যের ক্ষেত্রে এক মহাবিপ্লব জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে সঞ্চারিত হয়েছে এবং সামাজিক অগ্রগতি ছাড়াও উক্ত সমাজকে এক উজ্জ্বলতর এবং উন্নত ও শ্রেয়তর পথে পরিচালিত করেছে। গোত্রীয় সমাজ-ব্যবস্থা নবী (সা.) কর্তৃক বিশ্বাসের পথে এবং এক মানবিক ও বিশ্বজনীন সমাজ গঠনের পথে অগ্রগতি লাভ করেছিল। মূর্তিপূজারী এ সমাজও নির্মল একত্ববাদের পথে পূর্ণতা লাভ করেছিল। উপরন্তু পূর্বের সকল ঐশী ধর্মকে পরিশুদ্ধ করেছিল এবং সকল উদ্ভট গল্প ও কাহিনী ঐ সব ধর্ম থেকে দূরীভূত করেছিল। তাৎপর্য ও মূল্যবোধশূন্য এক সমাজকে তাৎপর্য ও মূল্যবোধে পরিপূর্ণ করেছিল,এমনকি ঐ সমাজকে এমন এক সমাজে রূপান্তরিত করেছিল যে,বিশ্বসভ্যতার নেতৃত্বের মশাল হস্তে ধারণ করেছিল।
অপরদিকে কোন সমাজের সার্বিক বিকাশ ও বিবর্তন যদি উল্লেখযোগ্য কোন কিছূর প্রভাব থেকে উৎসারিত হয়,তবে তা সূচনাবিহীন ও আকস্মিক হতে পারে না। কারণ একান্তভাবেই এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য সূচনালগ্নের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করতে হয় এবং নানাবিধ প্রভাব এ পরিবর্তনের পথে ক্রিয়াশীল হয়। এভাবে সর্বদা মানসিক ও চিন্তাগত পূর্ণতা ও প্রকৃষ্টতা লাভ করে এবং পথ প্রদর্শনের জন্য যথোপযুক্ত নেতৃত্ব ঐ সমাজ থেকে উদ্ভাবিত হয় যাতে করে সঠিক উন্নতির পথে ঐ সমাজ যাত্রা শুরু করতে পারে।
বিভিন্ন সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির কারণসমূহের উপর গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখা যায় যে,প্রথমে কোন সমাজে ছড়ানো-ছিটানো বীজের মতো বিভিন্ন চিন্তাগত উৎকর্ষ সূচিত হয়েছিল। অতঃপর এ বীজগুলো পরস্পরের সংস্পর্শে এসেছিল এবং চিন্তামূলক এক তরঙ্গমালার আকৃতি ধারণ করেছিল।
এভাবে পর্যায়ক্রমে এ তরঙ্গের প্রভাবসমূহ পুঞ্জীভূত হয়েছিল। ফলে ঐ সমাজে উপযুক্ত নেতৃত্ব পরিপক্বতা লাভ করেছিল। তখন সমাজের বিভিন্ন আংশিক পর্যায়ে এ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছিল এবং প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থার সাথে বৈপরীত্য প্রদর্শন করেছিল। পুরাতন ও নূতনের এ সংঘর্ষের মাধ্যমে চিন্তামূলক তরঙ্গধারা সমাজের বিভিন্ন ধাপে ছড়িয়ে পড়ে আধিপত্য বিস্তার করেছিল।
অপরদিকে মুহাম্মদ (সা.)-এর ঘটনাগুলো ছিল এর ব্যতিক্রম। এ শিকলের কোন বলয়ই মুহাম্মদ (সা.)-এর নব রিসালাতের ইতিহাসে বিরাজমান ছিল না এবং এ চিন্তামূলক তরঙ্গের সাথে এর কোন সাদৃশ্যও ছিল না। নবী (সা.) কর্তৃক ঘোষিত এ ধরনের চিন্তা,মূল্যবোধ ও ভাবার্থের কোন বীজই তাঁর সামাজিক পরিমণ্ডলে বপন করা ছিল না। যে জোয়ার নবী (সা.)-এর মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছিল এবং যা প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের বিশেষত্ব ছিল,প্রকৃতপক্ষে তা কেবল এ নব রিসালাত ও ইসলামের নেতৃত্বের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। অর্থাৎ এমনটি ছিল না যে,বিশ্বনবী উক্ত চিন্তামূলক জোয়ার-তরঙ্গে রিসালাত অর্জিত হয়েছিল এবং তখন নেতৃত্বের প্রকাশ ঘটেছিল। এদিক থেকে আমরা দেখতে পাই যে,মহানবী (সা.)-এর অর্জিত বিষয়সমূহ এবং বর্ণিত সংস্কারকগণের অর্জিত বিষয়সমূহের মধ্যে পার্থক্য নব তরঙ্গে বিদ্যমান বিন্দুসমূহের পার্থক্যের মতো ছিল না,বরং এ পার্থক্য ছিল মৌলিক এবং অবর্ণনীয়। আর এটাই প্রমাণ করে যে,মুহাম্মদ (সা.) কোন তরঙ্গের অংশ ছিলেন না,বরং উক্ত (চিন্তামূলক ) তরঙ্গ ছিল মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব ও তাঁর রিসালাতের অংশ।
ভিন্ন দৃষ্টিকোণে ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই যে,কোন নব বিপ্লবে সামাজিক,আদর্শিক এবং চিন্তামূলক নেতৃত্ব যখন কোন নির্দিষ্ট চিন্তামূলক ও সামাজিক বিকাশের মধ্যে একক কেন্দ্রবিন্দুর পরিপার্শ্বে কেন্দ্রীভূত হয় তখন ঐ কেন্দ্রবিন্দু হয় এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক এবং এতদসংক্রান্ত যাবতীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ব্যক্তিত্বেরই নেতৃত্ব। অনুরূপ তার ক্রমাগত অগ্রগতিরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যাতে তা পরিপক্বতা লাভ করে এবং তাকে ঐ অগ্রগতির ধারায় উক্ত তরঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট করা যায়।
কিন্তু উপরিউক্ত ঘটনার ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায় মুহাম্মদ (সা.)-এর ক্ষেত্রে। স্বয়ং নবী (সা.) আদর্শিক,চিন্তামূলক এবং সামাজিক নেতৃত্বকে হাতে তুলে নিয়েছেন যেখানে তিনি তাঁর জীবনেতিহাসে একজন উম্মী মানুষ (যিনি লেখা পড়া শিখেননি) হিসাবে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি না কোন সমসাময়িক সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতেন,না কোন অতীত ধর্ম সম্পর্কে। আর এ নেতৃত্ব হাতে নেয়ার পূর্বে পরিবেশে কোন ভূমিকারই উপস্থিতি ছিল না (অর্থাৎ ঐ সমাজের কোন পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না)।
ঘ. উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বিচার-বিশ্লেষণের শেষ ধাপে উপনীত হব। এখানেই আমরা এক বুদ্ধিবৃত্তিক ও গ্রহণযোগ্য বর্ণনা বিশ্লেষণের জন্য শুধু একটি সংশ্লিষ্ট নির্বাহীর (عامل) ধারণা পেতে পারি যা উক্ত ঘটনা ও বিষয়ের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবে। আর তা হলো নবুওয়াতের ধারণা যা পার্থিব বিষয়ের উপর ঐশী প্রভাবের ব্যাখ্যা প্রদান করে।
وَكَذَلِكَ اَوْحَيْناَ اِلَيْكَ رُوحاً مِنْ اَمْرِناَ مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْاِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُوراً نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِناَ وَ اِنَّكَ لَتَهْدِي اِلىَ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ .
“এবং এইরূপে আমরা তোমার প্রতি নিজ আদেশ-বাণী ওহী করিয়াছি। তুমি জানিতে না যে,কিতাব কি এবং ঈমান কি। কিন্তু আমরা ইহাকে (বাণীকে) আলোকস্বরূপ করিয়াছি যদ্বারা আমরা আমাদের বান্দাদের মধ্য হইতে যাহাকে চাহি হেদায়েত দিই এবং নিশ্চয় তুমি (লোকদিগকে) সরল সুদৃঢ় পথেপরিচালিত করিতেছ।”(সূরা শুরা : ৫২)
(এই প্রবন্ধটি শহীদ আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মূহাম্মদ বাকের আস সাদর (রহ.) লিখিত এবং মোঃ মাঈনুদ্দিন তালুকদার কর্তৃক অনুদীত দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিসমূহের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা গ্রন্থ থেকে সংকলিত)