আল হাসানাইন (আ.)

কারবালার আন্দোলন আবেগতাড়িত নাকি বিজ্ঞতাপূর্ণ

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

মানুষের মধ্যে সবসময়ই ভালো এবং মন্দের দ্বন্দ্ব লেগে আছে,সাধারণত তাকে ‘জিহাদে আকবার’ (বড় জিহাদ) বলা হয়ে থাকে। অথচ এটা জিহাদে আওসাত (মধ্যম জিহাদ)।

মানুষ যখন তার জ্ঞান,বিবেক দিয়ে মনের কু-প্রবৃত্তি ও গুনাহ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে তা হচ্ছে জিহাদে আওসাত (মধ্যম জিহাদ)। কেননা,সে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হতে চায়। এর পরের পর্যায় হচ্ছে জিহাদে আকবার- যা হচ্ছে ভালোবাসা ও বিবেক,প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিকতা এবং বুদ্ধিলব্ধ জ্ঞান ও প্রত্যক্ষ দর্শনের যুদ্ধ।
এই পর্যায়ে যদিও সে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের ভিত্তিতে কোন সত্যের তাৎপর্যকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং প্রমাণসমূহের দ্বারা তাকে প্রতিষ্ঠিত করে একটি সমাধানে পৌঁছে,কিন্তু তার অন্তর- যা প্রেম-ভালোবাসার কেন্দ্র তা কখনোই বুদ্ধিবৃত্তিক তাৎপর্যকে (অর্জিত জ্ঞানকে) যথেষ্ট মনে করে না; বরং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবতাকে অনুভব করতে প্রত্যক্ষ জ্ঞান কামনা করে। অর্থাৎ যা কিছু বুঝতে পেরেছে তা আত্মা দিয়ে অবলোকন করতে চায়।
এই কারণে এর পর থেকেই প্রেম এবং বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং জিহাদে আকবার শুরু হয়। অবশ্য এতে কোন দোষ নেই। কেননা,দু’টিই সত্যের সন্ধান পেয়েছে,কিন্তু একটি সত্যকে বুঝেছে অপরটি সত্যে পৌঁছেছে। প্রকৃত অর্থে একটি সত্য,আরেকটি চূড়ান্ত সত্য। একটি ভালো আর অপরটি খুব ভালো। একটি পূর্ণতার নিম্নতর স্তর আরেকটি পূর্ণতার উচ্চতর পর্যায়। এই কারণে আল্লাহর ওলী ও প্রেমিকদের কাজগুলো প্রেম-ভালোবাসার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : ‘সর্বোত্তম মানুষ তিনিই যিনি প্রেমের মাধ্যমে ইবাদত করেন।’(উসূলে কাফি, ২য় খণ্ড) সেই ব্যক্তিই ইবাদতের স্বাদ পায় এবং জান্নাত ও জাহান্নামের প্রকৃত রূপ দেখতে পায়।
বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান মূলত দলিল-প্রমাণ দিয়ে দোযখ এবং জাহান্নামের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। কিন্তু প্রেম ও মন বলে যে,আমি (এ পৃথিবীতেই) দোযখ ও বেহেশত্ দেখতে চাই। যে ব্যক্তি দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে কিয়ামত,বেহেশত,জান্নাত ইত্যাদিকে সত্য হিসেবে গণ্য করে সে হচ্ছে জ্ঞানী। কিন্তু যে ব্যক্তি বেহেশত ও দোজখ দেখতে চায় সে হচ্ছে প্রেমিক পুরুষ।
সাইয়্যেদুশ শুহাদার (ইমাম হোসাইন) কাজগুলো প্রেমপূর্ণ ছিল,আর সে প্রেম জ্ঞানের ঊর্ধ্বে- জ্ঞানহীনতা নয়। এক সময় বলা হয়ে থাকে,অমুক কাজ বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অর্থাৎ যে কাজ কেবল ধারণা এবং কল্পনার ভিত্তিতে হয়েছে। কিন্তু কখনো কখনো কাজ এমন হয়ে থাকে যে,শুধু বিজ্ঞতাপূর্ণই নয়; বরং তার চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের প্রেমপূর্ণ। অর্থাৎ যা কিছু বুঝেছে নিজের মধ্যে তা পেয়েছে ও অর্জন করেছে।
যখন মানুষ বাস্তবতার মর্মে পৌঁছে তখন সে প্রেমসুলভ আচরণ করে। তখন তার ক্ষেত্রে জ্ঞানের কোন ভূমিকাই নেই। এই ভূমিকা না থাকার অর্থ এই যে,জ্ঞানের আলো তার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র এক আলোক রশ্মির নিচে ঢাকা পড়েছে। এই কারণে নয় যে,জ্ঞানের আলো নিভে গেছে এবং আলো নেই। দু’টি অবস্থায় জ্ঞান অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং মানুষের কাজ-কর্ম জ্ঞান অনুযায়ী হয় না :
১. যখন মানুষ ক্রোধ এবং কুপ্রবৃত্তির বশে পাপ কাজে লিপ্ত হয় তখন তা বুদ্ধিমানের কাজ নয়; বরং বোকামিপূর্ণ। এর উদাহরণ হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণের সম্মুখীন চাঁদের মতো যখন তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই রূপ অবস্থায় জ্ঞানের আলো নেই। পাপীর জ্ঞান চন্দ্রগ্রহণ হওয়া চন্দ্রের মতো। হযরত আলী (আ.) এই বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন : ‘এমন অনেক বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেক রয়েছে যা প্রবৃত্তির কর্তৃত্বের হাতে বন্দি (অর্থাৎ তার বুদ্ধিবৃত্তি তার কুপ্রবৃত্তির নির্দেশের দাস হয়ে পড়েছে)।’
২. এক্ষেত্রে জ্ঞানের আলো আছে,কিন্তু এর কার্যকারিতা নেই। এটা ঐ সময়ে যখন জ্ঞানের আলো তার চেয়ে শক্তিশালী আলোক রশ্মির নিচে থাকে। যেমন দিনের বেলায় তারার কোন কার্যকারিতা (কোন আলো) নেই। এই কার্যকারিতা না থাকা এই কারণে যে,সূর্যের আলো আকাশকে আলোকিত করে রেখেছে,তার আলোক রশ্মির নিচে তারার আলো রঙ হারিয়ে ফেলেছে। তারার আলো না থাকা বা তা নিষ্প্রভ হওয়ার কারণে এমন হয়নি; বরং সে সূর্যের বিপরীতে ম্রীয়মাণ হয়ে পড়েছে। যে প্রেমাসক্ত হয়েছে তার জ্ঞান আছে এবং আলোও আছে,কিন্তু জ্ঞানের আলো প্রেমের আলোক রশ্মির নিচে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে।
কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি এই রকমই ছিল অর্থাৎ তাঁর কাজ শুধু বুদ্ধিমানের মতোই ছিল না; বরং তার চেয়েও উচ্চতর ছিল। কেননা,তা প্রেমপূর্ণও ছিল।

(আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)