ইমামত

‘ইমাম’ বা নেতা তাকেই বলা হয়, যে একদল লোককে নির্দিষ্ট কোন সামাজিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক অথবা ধর্মীয় লক্ষ্যে পৌছানোর জন্যে নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অবশ্য নেতা তার নেতৃত্বের পরিধির বিস্তৃতি ও সংকীর্ণতার ক্ষেত্রে সময় ও পরিবেশগত পরিস্থিতির অনুসারী পবিত্র ইসলাম ধর্ম (যেমনটি পূর্বে আলোচিত হয়েছে) মানব জীবনের সকল দিক পর্যবেক্ষণপূর্বক তার জন্যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।

ইসলাম মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন বিশ্লেষণপূর্বক তার জন্যে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ দান করেছে। পার্থিব জীবনের ক্ষেত্রে এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যাপন ও তার পরিচালনার ব্যাপারেও ইসলামের হস্তক্ষেপ রয়েছে । ঠিক একইভাবে মানুষের সামাজিক (পার্থিব) জীবন ও তার পরিচালনার (রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থা) ক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশ রয়েছে ।

উপরে মানব জীবনের যেসব দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে ইসলামী নেতৃত্ব তিনটি দিকে গুরুত্বের অধিকারী । সেই দিক গুলো হচ্ছে : ইসলামী শাসন ব্যবস্থা, ইসলামী জ্ঞানমালা ও আইন কানুন বর্ণনা এবং আধ্যাত্মিক জীবনে নেতৃত্ব ও পথ নির্দেশনার দিক। শীয়াদের দৃষ্টিতে ইসলামী সমাজের জন্যে উক্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দিকের নেতৃত্ব দানের জন্যে নেতার প্রয়োজন অপরিহার্য। যিনি ইসলামী সমাজের এ তিনটি দিকের উপযুক্ত নেতৃত্ব দেবেন অবশ্যই তাকে মহান আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর দ্বারা মনোনীত হতে হবে । অবশ্য মহান আল্লাহর নির্দেশে বিশ্বনবী (সা.) এই মনোনয়ন কার্য সম্পন্নও করে গেছেন ।

ইমামত এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকার

মানুষ তার খোদাপ্রদত্ত স্বভাব দিয়ে অতি সহজেই এ বিষয়টি উপলদ্ধি করে যে, কোন দেশ, শহর গ্রাম বা গোত্র এবং এমনকি গুটি কয়েক লোক সম্বলিত কোন একটি সংসারও একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া চলতে পারে না । একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের চাকা সচল রাখা সম্ভব নয় । একজন নেতার ইচ্ছাই সমাজের অসংখ্য ব্যক্তির ইচ্ছার উপর প্রভুত্ব করে । এভাবে সে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে । সুতরাং একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের গতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না । তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নেতাহীন ঐ সমাজ ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য।

যার ফলে এক ব্যাপক অরাজকতা ঐ সমাজকে ছেয়ে ফেলবে । সুতরাং, উক্ত যুক্তির উপর ভিত্তি করে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে, সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত (সে সমাজ বৃহত্তরই হোক অথবা ক্ষুদ্র তরই হোক) নেতা, সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি যদি কখনও অস্থায়ীভাবে অথবা স্থায়ীভাবে তার পদ থেকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে অবশ্যই তার ঐ অনুপস্থিতকালীন সময়ের জন্যে অন্য কাউকে দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োজিত করে যাবেন । এধরণের দায়িত্বশীল কোন নেতা কোনক্রমেই এমন কাজ করতে প্রস্তুত হবেন না, যার ফলে নিজের দায়িত্বের পদ থেকে সরে দাড়ানোর কারণে নেতার অভাবে ঐ সমাজের অস্তিত্ব ধ্বংসোন্মুখ হয়ে পড়বে । কোন পরিবারের কর্তাব্যক্তিও যদি কিছুদিনের জন্যে অথবা কয়েক মাসের জন্যে পরিবারের সদস্যদের ত্যাগ করে দূরে কোথাও ভ্রমনে যান । তখন অবশ্যই তিনি তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে সংসার পরিচালনার জন্যে পরিবারের কাউকে (অথবা তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে) দায়িত্বশীল হিসাবে নিয়োগ করে যান । কোন প্রতিষ্ঠানের পরিাচালক বা স্কুলের প্রধান শিক্ষক অথবা দোকানের মালিক, যাদের অধীনে বেশ ক’জন কর্মচারী কর্মরত, তারা যদি অল্প ক’ঘন্টার জন্যেও কোন কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করেন, তাহলে অধীনস্থ কাউকে তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে তার দায়িত্ব পালনের জন্যে নিযুক্ত করে যান । আর অন্যদেরকে ঐ নবনিযুক্ত দায়িত্বশীলের আনুগত্য করার নির্দেশ দেন । ইসলাম এমন এক ধর্ম, যা খোদাপ্রদত্ত মানব প্রকৃতি অনুযায়ী পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত । ইসলাম একটি সামাজিক আদর্শ যার প্রকৃতি এমন এক দৃষ্টান্ত মূলক যে, পরিচিত ও অপরিচিত সবাই ঐ আদেশের দর্পন থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারে । মহান আল্লাহ ও বিশ্বনবী (সা.) এই আদেশের সামাজিকতার ক্ষেত্রে যে মহান অবদান রেখেছেন, তা সবার কাছেই অনস্বীকার্য । এই ঐশী আদর্শ পৃথিবীর অন্য কিছুর সাথেই তুলনাযোগ্য নয় । মহানবী (সা.)- ও ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন সামাজিক বিষয়ই পরিত্যাগ করতেন না । যখনই কোন শহর বা গ্রাম মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হত, সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত সময়ে বিশ্বনবী (সা.) তার পক্ষ থেকে কাউকে ঐ অঞ্চলের শাসনকর্তা ও স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে পাঠাতেন । এমনকি জিহাদ পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রেরিত সেনাবাহিনীর জন্যে প্রয়োজন বোধে (অত্যাধিক গুরুত্বের কারণে) একাধিক সেনাপতিও তিনি নিযুক্ত করতেন । এমনকি ঐতিহাসিক ‘মুতার’ যুদ্ধে বিশ্বনবী (সা.) চারজন সেনাপতি নির্বাচন করেছিলেন । যাতে প্রথম সেনাপতি শাহাদত বরণ করলে দ্বিতীয় সেনাপতি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন । দ্বিতীয়জন শাহাদত বরণ করলে তৃতীয়জন দায়িত্ব গ্রহণ করবেন । আর এইভাবে এ ধারা বাস্তবায়িত হবে । রাসূল (সা.)-এর এসকল কার্যের মাধ্যমেই নেতা নিয়োগের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায় । একইভাবে বিশ্বনবী (সা.) তার স্বীয় উত্তরাধিকারের বিষয়েও সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন । তিনি স্বীয় উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে কখনোই পিছপা হননি । যখনই তিনি প্রয়োজন বোধে মদীনার বাইরে যেতেন, তখনই তিনি কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন । এমন কি যখন তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরী ত্যাগ করে ছিলেন, যখন কেউই সে সংবাদ সম্পর্কে অবহিত ছিল না তখনও মাত্র অল্প ক’দিনের জন্য স্বীয় ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন ও জনগণের গচ্ছিত আমানত দ্রব্যাদি মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে মক্কায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান । এভাবেই বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুর পূর্বে স্বীয় ঋণ পরিশোধ ও বিশ্বাসগত অসমাপ্ত কার্যাবলী সম্পাদনের জন্যে ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন । তাই শীয়ারা বলে : উপরোক্ত দলিলের ভিত্তিতে এটা আদৌও কল্পনাপ্রসূত নয় যে, বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুর পূর্বে কাউকে তার উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত´ হিসেবে নির্বাচিত করে যাননি । মুসলমানদের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা এবং ইসলামী সমাজের চালিকা শক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্যে কাউকেই মহানবী (সা.) মনোনীত করে যাননি, এটা এক কল্পনাতীত ব্যাপার বটে । এক শ্রেণীর আইন-কানুন ও কিছু সাধারণ আচার অনুষ্ঠান, যা সমাজের অধিকাংশ জনগণের দ্বারা বাস্তবে স্বীকৃত ও সমর্থিত, তার উপর ভিত্তি করেই একটি সমাজের সৃষ্টি হয় । আর ঐ সমাজের অস্তিত্ব টিকে থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপে ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও দায়িত্বশীল একটি প্রশসানের অস্তিত্বের উপরই নির্ভরশীল । এটা এমন কোন বিষয় নয় যে, মানব প্রকৃতি এর গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে । কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছেও এটা কোন অজ্ঞাত বিষয় নয় এবং এটা ভোলার বিষয়ও নয়, কারণ, ইসলামী শরীয়তের (বিধান) সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ ও বিস্তৃতি একটি সন্দেহাতীত ব্যাপার । আর এ ব্যাপারটিও অনস্বীকার্য যে, বিশ্বনবী (সা.) এ ব্যাপারে অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করতেন এবং এপথে তিনি নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন । তার ঐ আত্মত্যাগ, অসাধারণ চিন্তাশক্তি, প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠত্ব, সূক্ষ্ণ ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ক্ষমতার (ওহী ও নবুয়তের সাক্ষ্য ছাড়াও) বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিতর্কের উর্ধ্বে । শীয়া ও সুন্নী উভয় দলেরই মত নির্বিশেষে বর্ণিত ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস অনুযায়ী (‘ফিৎনা’ অধ্যায়ের হাদীস) বিশ্বনবী (সা.) তার অন্তর্ধানের পর ইসলামী সমাজ যেসব দূর্নীতিমূলক সমস্যায় আক্রান্ত হবে, তার ভবিষ্যৎবাণী করেছেন । ঐসব সমস্যার মধ্যে যেসব সমস্যাগুলো ইসলামকে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, উমাইয়া বংশ সহ আরও অন্যান্যদের খেলাফত লাভের বিষয়টি তার মধ্যে অন্যতম । কারণ : তারা ইসলামের পবিত্র আদর্শকে তাদের বিভিন্ন ধরণের অপবিত্রতা ও অরাজকতামূলক জঘণ্য কাজে ব্যাবহার করেছে । এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) তার হাদীসে বিস্তারিতভাবে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন । বিশ্বনবী (সা.) তার মৃত্যুর হাজার হাজার বছর পরের ইসলামী সমাজের খুটিনাটি বিষয়াদি ও সমস্যা সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন এবং সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ভবিষ্যৎবাণীও করে গেছেন । তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে, যিনি তার পরবর্তী সুদুর ভবিষ্যতের ব্যাপারে এত সচেতন, অথচ স্বীয় মৃত্যু পরবর্তী মূহুর্তগুলোতে সংঘটিত ঘটনাবলীর ব্যাপারে আদৌ সচেতন নন?! বিশ্বনবী (সা.)-এর পরবর্তী উত্তরাধিকারের মত এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কি তাহলে তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে অবহেলা করেছেন, অথবা এটাকে গুরুত্বহীন একটি বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন? এটা কেমন করে সম্ভব যে, খাওয়া পরা, ঘুমানো এবং যৌন বিষয়াদির মত মানব জীবনের শতশত খুটিনাটি বিষয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনি জারী করেছেন, অথচ ঐ ধরণের একটি অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণরূপে নীরবতা পালন করেছেন? নিজের উত্তরাধিকারীকে তিনি মনোনীত করে যাননি? ধরে নেয়া যাক (যদিও এটা অসম্ভব একটি ধারণা) যে, মহানবী (সা.) তার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনের দায়িত্বভার মুসলমানদের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন, তাহলে এ ব্যাপারে অবশ্যই বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকার কথা । এ ব্যাপারে অবশ্যই জনগণের প্রতি তার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকা উচিত । কারণঃ ইসলামী সমাজের অস্তিত্ব ও বিকাশ এবং ইসলামী নিদর্শনাবলীর অস্তিত্ব এ বিষয়টির উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল । তাই এ ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মতকে সদা সচেতন থাকতে হবে । অথচ, এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না । কারণ যদি এমন সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই বিশ্বনবী (সা.)-এর পরে তার স্থলাভিষিক্তের পদাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে এত মতভেদের সৃষ্টি হত না । অথচ আমরা দেখতে পাই যে, প্রথম খলিফা ওসিয়তের (উইল) মাধ্যমে দ্বিতীয় খলিফার কাছে খেলাফত হস্তান্তর করেছিলেন ।

দ্বিতীয় খলিফা তার মৃত্যু পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে একটি ‘খলিফা নির্বাচন কমিটি’ গঠন করেছিলেন । ছয় সদস্য বিশিষ্ট ঐ কমিটির প্রতিটি সদস্যই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনীত হয়েছিলেন । ঐ কমিটির খলিফা নির্বাচন সংক্রান্ত মূলনীতিও তিনি নিজেই নির্ধারণ করেছিলেন । যার ভিত্তিতেই তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন । তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর চতুর্থ খলিফা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন । ইমাম হাসান (পঞ্চম খলিফা) চতুর্থ খলিফার ওসিয়তের (উইল) মাধ্যমে নির্বাচিত হন । এরপর মুয়াবিয়া পঞ্চম খলিফা হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে বলপূর্বক সন্ধিচুক্তিতে বাধ্য করার মাধ্যমে খেলাফতের পদটি ছিনিয়ে নেন । তারপর থেকেই খেলাফত রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয় । আর তখন থেকেই জিহাদ, সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ, ইসলামী দন্ড বিধি প্রয়োগ, ইত্যাদি ইসলামী নির্দেশনাবলী একের পর এক ক্রমান্বয়ে ইসলামী সমাজ থেকে উধাও হতে থাকে । এভাবে বিশ্বনবী (সা.)- এর সারা জীবনের লালিত সাধানা ধুলিসাৎ হয়ে গেল ।[ উপরোক্ত বিষয়টি নিম্নোক্ত গ্রন্থ সমূহে বর্ণিত হয়েছে । তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ২৬- ৬১ নং পৃষ্ঠা । সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, ২২৩-২৭১ পৃষ্ঠা । তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড ১২৬ নং পৃষ্ঠা । গায়াতুল মারাম, ৬৬৪ নং পৃষ্ঠা ইত্যাদি ।] শীয়ারা আল্লাহ প্রদত্ত মানব প্রকৃতি এবং জ্ঞানী ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান চালায় । তারা ফিৎরাত বা মানব প্রকৃতি সঞ্জীবনী ইসলামী আদেশের মূল দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত, মহানবী (সা.)-এর অনুসৃত সামাজিক পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ এবং মহানবী (সা.)-এর মৃত্যু পরবর্তী দুঃখজনক ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে । মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলাম ও মুসলমানরা যেসব দূর্দশা ও জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিল তারও আদ্যোপান্ত আলোচনা করে । এছাড়াও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইসলামী প্রশাসকদের ইসলামের ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত উদাসীনতার বিষয়টিও সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করে । উক্ত গবেষণার মাধ্যমে শীয়ারা একটি সুনিশ্চিত ফলাফলে পৌছুতে সক্ষম হয় । আর তা হচ্ছে এই যে, বিশ্বনবী (সা.)-এর পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ব্যাপারে তার পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ বর্ণনার অস্তিত্ব ইসলামে বিদ্যমান । এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর বর্ণিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে, যার সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা অকাট্যরূপে প্রমাণিত ও সর্বজনস্বীকৃত । এ ব্যাপারে ‘বিলায়ত’ সংক্রান্ত আয়াত এবং গাদীরে খুমের হাদীস, ‘সাফিনাতুন নুহ’-এর হাদীস, ‘হাদীসে সাকালাইন’ ‘হাদীসে হাক্ক’ ‘হাদীসে মানযিলাত’ নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত সংক্রান্ত হাদীস সহ আরও অসংখ্য হাদীসের কথা উল্লেখযোগ্য ।

রাসূল (সা.) এর উত্তরাধিকারী হিসেবে হযরত ইমাম আলী (আ.) এর অধিকার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বেশ কিছু আয়াত উল্লেখ যোগ্য । যেমন, মহান আল্লাহ বলেন : তোমাদের অভিভাবক (পথ নির্দেশক) তো আল্লাহ ও তার রাসূল এবং মু’মিন বান্দাদের মধ্যে যে নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং রুক অবস্থায় যাকাত প্রদান করে । (সূরা মায়েদা, ৫৫ নং আয়াত ।) সুন্নী ও শীয়া উভয় তাফসীরকারকগণই এ ব্যাপারে একমত যে, পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়াতটি একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর মর্যাদায়ই অবতীর্ণ হয়েছে । উক্ত আয়াতের ব্যাখা স্বরূপ শীয়া ও সুন্নী উভয় সম্প্রদায়ের বর্ণিত অসংখ্য হাদীসও এ কথারই প্রমাণ বহন করে । এ বিষয়ে রাসূল (সা.) এর সাহাবী হযরত আবু যার গিফারী (রা.) বলেনঃ একদিন মহানবীর পিছনে যাহরের নামায পড়ছিলাম । এ সময়ে জনৈক ভিক্ষুক সেখানে উপস্থিত হয়ে সবার কাছে ভিক্ষা চাইল । কিন্তু  কেউই ঐ ভিক্ষুককে সাহায্য করল না । তখন ঐ ভিক্ষুক তার হাত দু’টা আকাশের দিকে উঠিয়ে বললোঃ ‘হে আল্লাহ্ তুমি সাক্ষী থেকো, রাসূল (সা.)-এর এই মসজিদে কেউই আমাকে সাহায্য করলনা । ঐ সময় হযরত ইমাম আলী (আ.) নামাযরত অবস্থায় ছিলেন । তিনি তখন রুকুরত অবস্থায় ছিলেন । হযরত আলী (আ.) তখন রুকু অবস্থাতেই হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঐ ভিক্ষুকের প্রতি ইশারা করলেন । ঐ ভিক্ষুকও ইমাম আলী (আ.) এর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তার হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে নিল । এ দৃশ্য দেখে মহানবী (সা.) আকাশের দিকে মাথা উচিয়ে এই প্রার্থনাটি করেছিলেন :’ হে আল্লাহ আমার ভাই হযরত মুসা (আ.) তোমাকে বলেছিল আমার হৃদয়কে প্রশস্ত করে দাও এবং আমার কাজগুলোকে করে দাও সহজ । আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও যাতে সবাই আমার বক্তব্য অনুধাবন করতে পারে । আর আমার ভাই হারূনকে আমার প্রতিনিধি ও সহযোগীতে পরিণত কর ।’ তখন তোমার ঐশীবাণী অবতীর্ণ হলঃ ‘তোমার ভাইয়ের মাধ্যমে তোমার বাহুকে আমরা শক্তিশালী করব এবং তোমাকে প্রভাব বিস্তারের শক্তি দান করব’ । সুতরাং, হে আল্লাহ ! আমিও তো তোমারই নবী । তাই আমাকেও হৃদয়ের প্রশস্ততা দান কর । আমার কাজগুলোকেও করে দাও সহজ । আর আলীকে আমার প্রতিনিধি ও সহযোগী হিসেবে নিযুক্ত কর । হযরত আবু যার (রা.) বললেনঃ রাসূল (সা.)-এর কথা শেষ না হতেই পবিত্র কুরআনের আলোচ্য আয়াতটি অবতির্ণ হল । [যাখাইরূল উকবা (তাবারী) ১৬ নং পৃষ্ঠা, ১৩৫৬ হিজরী মিশরীয় সংস্করণ ।]

একই হাদীস সামান্য কিছু শব্দিক পার্থক্য সহ নিম্নোক্ত গ্রন্থ সমূহে উল্লেখিত হয়েছে । (দুররূল মানসুর, ২য় খণ্ড, ২৯৩ নং পৃষ্ঠা । গায়াতুল মারাম-বাহরানী, এ বইয়ের ১০৩ নং পৃষ্ঠায় ।)

আলোচ্য আয়াতের অবতরণেরর ইতিহাস বর্ণনায় সুন্নী সূত্রে বর্ণিত ২৪টি হাদীস এবং শীয়া সূত্রে বর্ণিত ১৯টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে । মহান আল্লাহ বলেন : আজ কাফেররা তোমাদের ‘দ্বীন’ থেকে নিরাশ হয়ে গেছে । অতএব তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় কর । আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন’কে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম । তোমাদের প্রতি আমার অবদান (নিয়ামত) সম্পূর্ণ করে দিলাম, এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম । (সূরা মায়েদা ৩ নং আয়াত । )

বাহ্যত উক্ত আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে কাফেররা এই ভেবে আশান্বিত ছিল যে, শীঘ্রই এমন একদিন আসবে, যেদিন ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে । কিন্তু  মহান আল্লাহ উক্ত আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে চিরদিনের জন্যে কাফেরদেরকে নিরাশ করলেন । আর এটাই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব লাভ ও তার ভিত্তিকে শক্তিশালী হওয়ার কারণ ঘটিয়েছিল । এটা সাধারণ কোন ইসলামী নির্দেশজারীর মত স্বাভাবিক কোন ঘটনা ছিল না । বরং এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল, যার উপর ইসলামের অস্তিত্ব টিকে থাকা নির্ভরশীল ছিল । এই সূরার শেষের অবতীর্ণ আয়াতও আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন নয় ।

মহান আল্লাহ বলেছেন : হে রাসূল! পৌছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতির্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন তবে আপনি তার (প্রতিপালকের) রিসালাতের কিছুই পৌছালেন না । আল্লাহ আপনাকে অত্যাচারীদের (অনিষ্ট) হতে রক্ষা করবেন । (সূরা মায়েদা, ৬৭ নং আয়াত ।)

উক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, মহান আল্লাহ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন, যা সাধিত না হলে ইসলামের মূলভিত্তি ও বিশ্বনবী (সা.) এর এই মহান মিশন বা রিসালাত চরম বিপদের সম্মুখীন হবে । তাই আল্লাহ এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) কে নির্দেশ দেন । কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) ঐ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সাধিত হওয়ার ব্যাপারে জনগণের বিরোধীতা ও বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হওয়ার আশংকা করলেন । এমতাবস্থায় ঐ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি অতিদ্রুত সমাধা করার জন্যে জোর তাগিদ সম্বলিত নির্দেশ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্বনবী (সা.) এর প্রতি জারী করা হয় । মহান আল্লাহ বিশ্বনবী (সা.)-এর প্রতি উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, ঐ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সমাধানের ব্যাপারে অবশ্যই অবহেলা কর না এবং ঐ ব্যাপারে কাউকে ভয়ও কর না । এ বিষয়টি অবশ্যই ইসলামী শরীয়তের কোন বিধান ছিল না । কেননা এক বা একাধিক ইসলামী বিধান প্রচারের গুরুত্ব এত বেশী হতে পারে না যে, তার অভাবে ইসলামের মূলভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাবে । আর বিশ্বনবী (সা.) -ও কোন ঐশী বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে আদৌ ভীত ছিলেন না ।

উপরোক্ত দলিল প্রমাণাদি এটাই নির্দেশ করে যে, আলোচ্য আয়াতটি ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিবের (আ.) বিলায়াত সংক্রান্ত ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে । অসংখ্য সুন্নী ও শীয়া তাফসীরকারকগণই এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন ।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন : বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.) এর প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । এরপর বিশ্বনবী (সা.) ইমাম আলী (আ.) এর হাত দু’টা উপরদিকে উত্তোলন করেন । এমনকি বিশ্বনবী (সা.) হযরত আলী (আ.) এর হাত এমনভাবে উত্তোলন করেছেন যে, মহানবী (সা.) এর বগলের শুভ্র অংশ প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল । এমতাবস্থায় পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয় : আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন’কে পূর্ণঙ্গ করে দিলাম । তোমাদের প্রতি আমার অবদান (নেয়ামত) সম্পূর্ণ করে দিলাম, এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম । ( সূরা মায়েদা, ৩ নং আয়াত । )

উক্ত আয়াতটি অবতির্ণ হওয়ার পর মহানবী (সা.) বললেন : ‘আল্লাহ্ আকবর’ কারণ, বিশ্বনবী (সা.) এর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ‘বিলায়াত’ (কর্তৃত্ব) প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে আজ আল্লাহর নেয়ামত ও সন্তুষ্টি এবং ইসলামের পূর্ণত্ব প্রাপ্তি ঘটলো । অতঃপর উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) বললেনঃ “আমি যাদের অভিভাবক, আজ থেকে আলীও তাদের অভিভাবক । হে আল্লাহ! আলীর বন্ধুর প্রতি বন্ধু বৎসল হও ও আলীর শত্রুর সাথে শত্রুতা পোষণ কর । যে তাকে (আলীকে) সাহায্য করবে, তুমিও তাকে সাহায্য কর । আর যে আলীকে ত্যাগ করবে, তুমিও তাকে ত্যাগ কর ।”

জনাব আল্লামা বাহরানী তার ‘গায়াতুল মারাম’ নামক গ্রন্থের ৩৩৬ নং পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতের অবতরণের কারণ প্রসঙ্গে সুন্নী সূত্রে বর্ণিত ৬টি হাদীস এবং শীয়া সূত্রে বর্ণিত ১৫টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন ।

ইসলামের শত্রুরা ইসলামকে ধ্বংস করার স্বার্থে কোন প্রকার অনিষ্ট সাধনে কখনোই কুন্ঠাবোধ করেনি । কিন্তু এত কিছুর পরও তারা ইসলামের সামান্য পরিমাণ ক্ষতি করতেও সক্ষম হয়নি । ফলে ব্যর্থ হয়ে তারা সবদিক থেকেই নিরাশ হয়ে পড়ে । কিন্তু এর পরও শুধু মাত্র একটি বিষয়ে তাদের মনে আশার ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলছিল । আর সেই আশার সর্বশেষ বস্তুটি ছিল এই যে, তারা ভেবে ছিল, যেহেতু মহানবী (সা.)-ই ইসলামের রক্ষক ও প্রহরী, তাই তার মৃত্যুর পর ইসলাম অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে । তখন ইসলাম অতি সহজেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে । কিন্তু ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনা তাদের হৃদয়ে লুকানো আশার শেষ প্রদীপটাও নিভিয়ে দিল । কারণ, ‘গাদীরে খুমে’ মহানবী (সা.), হযরত ইমাম আলী (আ.) কে তাঁর পরবর্তী দায়িত্বশীল ও ইসলামের অভিভাবক হিসেবে জনসমক্ষে ঘোষণা প্রদান করেন । এমনকি বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পর ইসলামের এই দায়িত্বভার মহানবী (সা.)-এর পবিত্র বংশ তথা হযরত আলী (আ.) এর ভবিষতে বংশধরদের জন্যে নির্ধারণ করেন । (এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্যের জন্যে হযরত আল্লামা তাবাতাবাঈ রচিত ‘তাফসীর আল মিজান’ নামক কুরআনের তাফসীরের ৫ম খণ্ডের ১৭৭ থেকে ২১৪ নং পৃষ্ঠা এবং ৬ষ্ঠ খণ্ড ৫০ থেকে ৫৪ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য ।)

হাদীসে গাদীরে খুম

বিশ্বনবী (সা.) বিদায় হজ্জ শেষে মদীনার দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে ‘গাদীরে খুম’ নামক একটি স্থানে পৌছানোর পর পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতটি অবতির্ণ হয় । মহানবী (সা.) তাঁর যাত্রা থামিয়ে দিলেন । অত:পর তার আগে চলে যাওয়া এবং পেছনে আগত সকল মুসলমানদেরকে তার কাছে সমবেত হবার আহবান করেন । সবাই মহানবী (সা.)এর কাছে সমবেত হবার পর তাদের উদ্দেশ্যে তিনি এক মহা মূল্যবান ও ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন । এটাই সেই ঐতিহাসিক ‘গাদীরে খুমের’ ভাষণ হিসেবে পরিচিত । এই ভাষণের মাধ্যমেই তিনি হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন ।

হযরত বুরআ (রা.) বলেনঃ বিদায় হজ্জের সময় আমি মহানবীর পবিত্র সান্নিধ্যে উপস্থিত ছিলাম । যখন আমরা ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌছলাম, তখন মহানবী (সা.) আমাদেরকে ঐ স্থানটি পরিস্কার করার নির্দেশ দিলেন । এরপর তিনি হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে তার ডান দিকে এনে তার হাত দু‘টি জনসমক্ষে উপর দিকে উচিয়ে ধরলেন । তারপর তিনি বললেনঃ আমি কি তোমাদের অভিভাবক (কর্তা) নই? সবাই উত্তর দিল, আমরা সবাই আপনারই অধীন । অতঃপর তিনি বললেন : আমি যার অভিভাবক ও কর্তা আলীও তার অভিভাবক ও কর্তা হবে। হে আল্লাহ্! আলীর বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব কর এবং আলীর শত্রুর সাথে শত্রুতা কর । এরপর দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব হযরত আলী (আ.) কে সম্বোধন করে বললেন : ‘তোমার এই অমূল্য পদমর্যাদা আরও উন্নত হোক! কেননা তুমি আমার এবং সকল মু’মিনদের অভিভাবক হয়েছ ।’ -আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ, ৫ম খণ্ড, ২০৮ নং পৃষ্ঠা, এবং ৭ম খণ্ড, ৩৪৬ নং পৃষ্ঠা । যাখাইরূল উকবা, (তাবারী), ১৩৫৬ হিজরী মিশরীয় সংস্করণ, ৬৭ নং পৃষ্ঠা । ফুসুলুল মুহিম্মাহু , (ইবনে সাব্বাগ), ২য় খণ্ড, ২৩ নং পৃষ্ঠা । খাসাইসুন -নাসাঈ, ১৩৫৯ হিজরীর নাজাফীয় সংস্করণ, ৩১ নং পৃষ্ঠা ।

জনাব আল্লামা বাহরানী (রহঃ) তার ‘গায়াতুল মারাম’ নামক গ্রন্থে সুন্নী সূত্রে বর্ণিত ৮৯ টি হাদীস এবং শীয়া সূত্রে বর্ণিত ৪৩টি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন ।

সাফিনাতুন নুহের হাদীস

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেনঃ মহানবী (সা.) বলেছেন যে, ‘আমার আহলে বাইতের উদাহরণ হযরত নুহ (আ.) এর নৌকার মত । যারা নৌকায় আরহণ করল, তারাই রক্ষা পল । আর যারা তা করল না তারা সবাই ডুবে মরল’ । (‘যাখাইরূল উকবা’ ২০ নং পৃষ্ঠা । ‘আস সাওয়াইকুল মুহরিকাহ (ইবনে হাজার)’ মিশরীয় সংস্করণ, ৮৪ ও ১৫০ নং পৃষ্ঠা । ‘তারীখুল খুলাফাহ (জালালুদ্দীন আস সূয়ুতী)’ ৩০৭ নং পৃষ্ঠা। ‘নরুল আবসার (শাবালঞ্জি)’ মিশরীয় সংস্করণ, ১১৪ নং পৃষ্ঠা।)

জনাব আল্লামা বাহরানী, তার ‘গায়াতুল মারাম’ নামক গ্রন্থের ২৩৭ নং পৃষ্ঠায় সুন্নীদের ১১টি সূত্র থেকে এবং শীয়াদের ৭টি সূত্র থেকে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ।

হাদীসে সাকালাইন

হযরত যাইদ বিন আরকাম (রা.) বলেন : মহানবী (সা.) বলেছেনঃ মনে হচ্ছে আল্লাহ যেন আমাকে তাঁর দিকেই আহবান জানাচ্ছেন, অবশ্যই আমাকে তার প্রত্যুত্তর দিতে হবে । তবে আমি তোমাদের মাঝে অত্যন্ত ভারী (গুরুত্বপূর্ণ) দু‘টি জিনিস রেখে যাচ্ছি : তা হচ্ছে আল্লাহর এই ঐশী গ্রন্থ (কুরআন) এবং আমার পবিত্র আহলে বাইত। তাদের সাথে কেমন ব্যাবহার করবে, সে ব্যাপারে সতর্ক থেকো । এ দু’টা (পবিত্র কুরআন ও আহলে বাইত) জিনিষ ‘হাউজে কাউসারে’ (কেয়ামতের দিন) আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনোই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। (আল বিদাহয়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্ ৫ম খণ্ড, ২০৯ নং পৃষ্ঠা । যাখাইরূল উকবা, (তাবারী) ১৬ নং পৃষ্ঠা । ফুসুলুল মুহিম্মাহু , ২২নং পৃষ্ঠা । খাসইসুন্ -নাসাঈ, ৩০ নং পৃষ্ঠা । আস্ সাওয়াইকুল মুহরিকাহ , ১৪৭ নং পৃষ্ঠা ।)

গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থে ' আল্লামা বাহরানী ৩৯টি সুন্নী সূত্রে এবং ৮২টি শীয়া সূত্রে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন । ‘হাদীসে সাকালাইন’ একটি বিখ্যাত ও সর্বজনস্বীকৃত এবং অকাট্যভাবে প্রমাণিত সূত্রে বর্ণিত । উক্ত হাদীসটি অসংখ্য সূত্রে এবং বিভিন্ন ধরণের বর্ণনায় (একই অর্থে ) বর্ণিত হয়েছে । উক্ত হাদীসের সত্যতার ব্যাপারে সুন্নী ও শীয়া, উভয় সম্প্রদায়ই স্বীকৃতি প্রদান করেছে । এ ব্যাপারে তারা উভয়ই সম্পূর্ণরূপে একমত । আলোচ্য হাদীসটি এবং এ ধরণের হাদীস থেকে বেশ কিছু বিষয় আমাদের কাছে প্রমাণিত হয় । তা হল :

১. পবিত্র কুরআন যেভাবে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে টিকে থাকবে, মহানবী (সা.) এর পবিত্র আহলে বাইত ও তার পাশাপাশি মানব জাতির মাঝে কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবেন । অর্থাৎ এ বিশ্বের কোন যুগই ইমাম বা প্রকৃত নেতাবিহীন অবস্থায় থাকবে না ।

২. বিশ্বনবী (সা.) মানব জাতির কাছে এই দু’টো অমূল্য আমানত গচ্ছিত রাখার মাধ্যমে তাদের সর্ব প্রকার ধর্মীয় ও জ্ঞানমূলক প্রয়োজন মেটানো এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে গেছেন । মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণকে (আ.) সকল প্রকার জ্ঞানের অমূল্য রত্ন ভান্ডার হিসেবে মুসলমানদের মাঝে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন । মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) যে কোন কথা ও কাজকেই নির্ভরযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন ।

৩. পবিত্র কুরআন ও মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতকে অবশ্যই পরস্পর থেকে পৃথক করা যাবে না । মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের পবিত্র জ্ঞানধারা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাদের উপদেশ ও হেদায়েতের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবার অধিকার কোন মুসলমানেরই নেই ।

৪. মানুষ যদি পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) আনুগত্য করে এবং তাদের কথা মেনে চলে, তাহলে কখনোই তারা পথভ্রষ্ট হবে না । কেননা, তারা সর্বদাই সত্যের সাথে অবস্থান করছেন ।

৫. মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় সর্ব প্রকার ধর্মীয় ও অন্য সকল জ্ঞানই পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) কাছে রয়েছে। তাই যারা তাদের অনুসরণ করবে, তারা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না, এবং তারা অবশ্যই জীবনের প্রকৃত সাফল্য লাভ করবে । অর্থাৎ, পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) সর্ব প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত ও পবিত্র ।

এ থেকেই বোঝা যায় যে, পবিত্র আহলে বাইত বলতে মহানবী (সা.) এর পরিবারের সকল আত্মীয়বর্গ ও বংশধরকেই বোঝায় না । বরং পবিত্র আহলে বাইত বলতে নবী বংশের বিশেষ ব্যক্তিবর্গকেই বোঝানো হয়েছে । ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া এবং সর্বপ্রকার পাপ ও ভুল থেকে তাদের অস্তিত্ব মুক্ত ও পবিত্র হওয়াই ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বৈশিষ্ট্য । যাতে করে তারা প্রকৃত নেতৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী হতে পারেন । ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন : হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) এবং তার বংশের অন্য এগারোজন সন্তান। তাঁরা প্রত্যেকেই একের পর এক ইমাম হিসেবে মনোনীত হয়েছেন । একই ব্যাখা মহানবী (আ.) এর অন্য একটি হাদীসে পাওয়া যায় ।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেনঃ আমি মহানবী (সা.) কে জিজ্ঞাস করলাম যে, আপনার যেসব আত্মীয়কে ভালবাসা আমাদের জন্যে ওয়াজিব, তারা কারা? মহানবী (সা.) বললেনঃ ‘তারা হলেন আলী, ফাতিমা, হাসান এবং হোসাইন। (-ইয়ানাবী-উল-মুয়াদ্দাহ , ৩১১ নং পৃষ্ঠা।)

হযরত যাবির (রা.) বলেন : বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন  : মহান আল্লাহ প্রত্যেক নবীর বংশকেই স্বীয় পবিত্র সত্তার মাঝে নিহিত রেখেছেন । কিন্তু আমার বংশকে আলীর মাঝেই সুপ্ত রেখেছেন । (-ইয়ানাবী-উল-মুয়াদ্দাহ, ৩১৮ নং পৃষ্ঠা ।)

হাদীসে হাক্ক

হযরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ ‘আলী পবিত্র কুরআন ও সত্যের সাথে রয়েছে । আর পবিত্র কুরআন ও সত্যও আলীর সাথে থাকবে এবং তারা ‘হাউজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনই পরস্পর বিচ্ছিন হবে না । উক্ত হাদীসটি ‘গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থের ৫৩৯ নং পৃষ্ঠায় একই অর্থে সুন্নী সূত্রে ১৪টি এবং শীয়া সূত্রে ১০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে ।

হাদীসে মানযিলাত

হযরত সা’দ বিন ওয়াক্কাস (রা.) বলেনঃ আল্লাহর রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.) কে বলেছেনঃ ‘তুমি কি এতেই সন্তুষ্ট নও যে, তুমি (আলী) আমার কাছে মুসা (নবী) আর হারুনের মত? শুধু এই টুকুই পার্থক্য যে, আমার পর আর কোন নবী আসবে না । (বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ, ৭ম খণ্ড, ৩৩৯ নং পৃষ্ঠা । যাখাইরুল উকবা, (তাবারী ), ৫৩ নং পৃষ্ঠা । ফুসুলুল মুহিম্মাহ, ২১ নং পৃষ্ঠা । কিফায়াতুত তালিব (গাঞ্জী শাফেয়ী), ১১৪৮ - ১৫৪ পৃষ্ঠা । খাসাইসুন্ - নাসাঈ, ১৯- ২৫ নং পৃষ্ঠা । আস্ সাওয়াইকুল মুরিকাহ , ১৭৭ নং পৃষ্ঠা ।) ‘গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থের ১০৯ নং পৃষ্ঠায় জনাব আল্লামা বাহরানী উক্ত হাদীসটি ১০০টি সুন্নী সূত্রে এবং ৭০টি শীয়া সূত্রে বর্ণনা করেছেন ।

আত্মীয়দের দাওয়াতের হাদীস

মহানবী (সা.) তার নিকট আত্মীয়দেরকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন । আমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়া শেষ হওয়ার পর তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন : এমন কোন ব্যক্তির কথা আমার জানা নেই, যে আমার চেয়ে উত্তম কিছু তার জাতির জন্যে উপহার স্বরূপ এনেছে । মহান আল্লাহ তোমাদেরকে তার প্রতি আহবান জানানোর জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন । অতএব তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আমাকে এ পথে সহযোগিতা করবে? আর সে হবে আমার উত্তরাধিকারী এবং আমার খলিফা বা প্রতিনিধি । উপস্থিত সবাই নিরুত্তর রইল । অথচ আলী (আ.) যদিও উপস্থিত সবার মাঝে কনিষ্ট ছিলেন, তিনি বললেনঃ ‘আমিই হব আপনার প্রতিনিধি এবং সহযোগী’ । অতঃপর মহানবী (সা.) নিজের হাত তাঁর ঘাড়ের উপর রেখে বললেন : ‘আমার এ ভাইটি আমার উত্তরাধিকারী এবং আমার খলিফা । তোমরা সবাই অবশ্যই তাঁর আনুগত্য করবে’ । এ দৃশ্য প্রত্যক্ষের পর উপস্থিত সবাই সেখান থেকে উঠে গেল এবং এ বিষয় নিয়ে ঠাট্রা-বিদ্রূপ করতে লাগলো । তারা জনাব আবু তালিবকে বললঃ মুহাম্মদ তোমাকে তোমার ছেলের আনুগত্য করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে । (তারীখু আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১১৬ নং পৃষ্ঠা।)

এ জাতীয় হাদীসের সংখ্যা অনেক, যেমন : হযরত হুযাইফা বলেন মহানবী (সা.) বলেছেনঃ তোমরা যদি আমার পরে আলীকে খলিফা ও আমার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত কর, তাহলে তোমরা তাকে একজন দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন পথ প্রদর্শক হিসেবেই পাবে, যে তোমাদেরকে সৎপথে চলতে উদ্বুদ্ধ করবে । তবে আমার মনে হয় না যে, এমন কাজ তোমরা করবে । (খলিফাতুল আউলিয়া, আবু নাঈম, ১ম খণ্ড, ৬৪ নং পৃষ্ঠা । কিফায়াতুত তালিব, ৬৭ নং পৃষ্ঠা, ১৩৫৬ হিজরীর নাজাফিয় মুদ্রণ ।)

হযরত ইবনু মারদুইয়াহ (রা.) বলেনঃ মহানবী (সা.) বলেছেন যে, যে ব্যক্তি আমার মতই জীবন যাপন ও মৃত্যুবরণ করতে চায় এবং বহেশতবাসী হতে চায়, সে যেন আমার পরে আলীর প্রেমিক হয় ও আমার পবিত্র আহলে বাইতের অনুসারী হয় । কারণ, তারা আমারই রক্ত সম্পর্কের ঘনিষ্ট আত্মিয়বর্গ এবং আমারই কাদামাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে । আমার জ্ঞান ও বোধশক্তি তারাই লাভ করেছে । সুতরাং হতভাগ্য সেই, যে তাদের পদমর্যাদাকে অস্বীকার করবে । অবশ্যই আমার সুপারিশ (শাফায়াত) থেকে তারা বঞ্চিত হবে । (মুন্তাখাবু কানযুল উম্মাল, মুসনাদে আহমাদ, ৫ম খণ্ড, ৯৪ নং পৃষ্ঠা ।}

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস সমূহের বক্তব্যে শীয়াদের বক্তব্যেরই সমর্থন পাওয়া যায় । অবশ্য ঐসব হাদীসের যথেষ্ট অপব্যাখা করা হয়েছে । আর এই অপব্যাখার মাধ্যমে ঐগুলোর মূল অর্থকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে ।

পূ্র্বোক্ত আলোচনার পক্ষে কিছু কথা

বিশ্বনবী (সা.) জীবনের শেষ দিনগুলো যখন অসুস্থ অবস্থায় কাটাচ্ছিলেন । তখন একদল সাহাবী রাসূল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলেন । হযরত রাসূল (সা.) সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন : আমার জন্যে কাগজ ও কলম নিয়ে এসো । কারণ, আমি এমন কিছু তোমাদের জন্য লিখে রেখে যেতে চাই, যা মেনে চললে তোমারা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না । উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে কিছু লোক বললো :  ‘এ লোক তো অসুস্থতার ফলে প্রলাপ (?) বকছে । কারণ, আল্লাহর কুরআনই তো আমাদের জন্যে যথেষ্ট’!! এ নিয়ে উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল । রাসূল (সা.)-এ অবস্থা দেখে বললেন : তোমারা এখান থেকে উঠে পড় । আমার কাছ থেকে দুর হয়ে যাও । আল্লাহর রাসূলের কাছে হৈ চৈ করা উচিত নয়’ ।[আল বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্ , ৫ম খণ্ড, ২৭৭ নং পৃষ্ঠা । শারহু ইবনি আবিল হাদিদ, ১ম খণ্ড, ১৩৩ নং পৃষ্ঠা । আল কামিল ফিত তারীখ (ইবনে আসির), ২য় খণ্ড, ২১৭ নং পৃষ্ঠা । তারীখুর রাসূল ওয়াল মুলুক (তাবারী), ২য খণ্ড, ৪৩৬ নং পৃষ্ঠা ।]

পূ্র্বোক্ত অধ্যায়ের বিষয়বস্তু এবং এ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনা প্রবাহ যদি আমরা আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে, যারা রাসূল (সা.)-এর ঐ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সেদিন বাধা প্রদান করেছিল, তারাই রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর খেলাফত নির্বাচনের ঘটনা থেকে লাভবান হয়েছিল । বিশেষ করে তারা হযরত আলী (আ.) ও তার অনুসারীদের অজ্ঞাতসারেই খেলাফত নির্বাচনের’ পর্বটি সম্পন্ন করে ।

তারা হযরত আলী (আ.) ও তার অনুসারীদের বিপরীতে ঐ কাজটি সম্পন্ন করেছিল । এরপর সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে, উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত ঘটনায় মহানবী (সা.) তার পরবর্তী উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে হযরত আলী (আ.)-এর নাম ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন । মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা প্রদানপূর্বক ঐ ধরণের কথা বলার মাধ্যমে কথা কাটা-কাটি বা বিতর্ক সৃষ্টিই ছিল মূল উদ্দেশ্য, যাতে করে এর ফলে মহানবী (সা.) তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে বিরত হতে বাধ্য হন । সুতরাং অসুস্থতাজনিত প্রলাপ বকার কারণে তার নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা দেয়াই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না । কারণ,

প্রথমত : আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পবিত্র মুখ থেকে অসুস্থ কালীন সময়ে অসংলগ্ন একটি কথাও শানা যায়নি । আর এ যাবৎ এ ধরণের কোন ঘটনাও (অসংলগ্ন কথাবার্তা) কেউই বর্ণনা করেনি । ইসলাম নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী কোন মুসলমানই মহানবী (সা.)- এর প্রতি প্রলাপ বকার (?) মত অপবাদ আরোপ করতে পারে না । কারণ, আল্লাহর রাসূল (সা.) ছিলেন ঐশী ‘ইসমাত’ বা নিষ্পাপ হওয়ার গুণে গুণান্বিত।

দ্বিতীয়ত : যদি তাদের কথা (প্রলাপ বকার মিথ্যা অভিযোগ সত্যই হত, তাহলে এর পরের কথাটি (কুরআনই আমাদের জন্যে যথেষ্ট) বলার কোন প্রয়োজন হত না । কারণঃ তাদের পরবর্তী কথার অর্থ হচ্ছে, কুরআনই তাদের জন্যে যথেষ্ট, এরপর রাসূল (সা.)-এর বক্তব্যের কোন প্রয়োজন নেই । কিন্তু রাসূল (সা.) এর সাহাবীরা ভাল করেই জানতেন যে, পবিত্র কুরআনই মহানবী (সা.) এর অনুসরণকে সবার জন্যে ফরজ হিসেবে ঘোষণা করেছে । রাসূল (সা.)-এর বাণীকে আল্লাহর বাণীরই মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে । পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট দলিল অনুসারে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর নির্দেশের মোকাবিলায় মানুষের ইচ্ছার কোন স্বাধীনতা বা অধিকার নেই ।

তৃতীয়ত : প্রথম খলিফার মৃত্যুর সময় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল । তখন প্রথম খলিফা তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে দ্বিতীয় খলিফার নামে খেলাফতের ওসিয়ত (উইল) লিখে যান । তৃতীয় খলিফা ওসমান যখন প্রথম খলিফার নির্দেশে উক্ত ‘ওসিয়ত’ (উইল) লিখছিলেন, তখন প্রথম খলিফা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন । কিন্তু, তখন বার দ্বিতীয় খলিফা প্রথম খলিফার ব্যাপারে মোটেই প্রতিবাদ করেননি, যে প্রতিবাদটি তিনি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ব্যাপারে করেছিলেন।[আল কামিল ফিত তারীখ (ইবনে আসির), ২য় খণ্ড, ২৯২ নং পৃষ্ঠা । শারহু ইবনি আবিল হাদিদ, ১ম খণ্ড, ৪৫ নং পৃষ্ঠা ।]

এ ছাড়া হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে[শারহু ইবনি আবিল হাদিদ, ১ম খণ্ড, ১৩৪ নং পৃষ্ঠা ।] দ্বিতীয় খলিফার যে স্বীকারোক্তি উল্লিখিত হয়েছে, তাতে তিনি বলেছেনঃ আমি বুঝতে পরে ছিলাম যে আল্লাহর রাসূল (সা.) আলীর খেলাফতের বিষয়টি লিখে দিতে চেয়েছিলেন । কিন্তু বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে তা আমি হতে দেইনি । তিনি আরও বলেন যে ‘আলীই ছিল খেলাফতের অধিকারী ।[তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৩৭ নং পৃষ্ঠা ।] কিন্তু সে যদি খেলাফতের আসনে বসত, তাহলে জনগণকে সত্যপথে চলার জন্যে উদ্বুদ্ধ করত । কিন্তু কুরাইশরা তার আনুগত্য করত না । তাই আমি তাকে খেলাফতের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছি’ !!!

ইসলামের নীতি অনুযায়ী সত্য প্রত্যাখানকারীদের জন্যে সত্যবাদীদেরক পরিত্যাগ না করে বরং সত্য প্রত্যাখানকারীদেরকে সত্য গ্রহণে বাধ্য করা উচিত । যখন প্রথম খলিফার কাছে সংবাদ পৌছলো যে মুসলমানদের একটি গোত্র যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, তৎক্ষণাত তিনি তাদের সাথে যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন : আল্লাহ রাসূল (সা.) কে মাথার রূমাল বাধার যে দড়ি দেয়া হত, তা যদি আমাকে না দেয়া হয়, তাহলেও তাদের সাথে আমি যুদ্ধে অবতির্ণ হব ।[আল বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্ , ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩১১ নং পৃষ্ঠা ।] অবশ্য এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে কোন মূল্যের বিনিময়েই হোক না কেন, সত্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে । অথচ, সত্য ভিত্তিক খেলাফতের বিষয়টি মাথার রূমাল বাধার দড়ির চেয়ে অবশ্যই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান ছিল ।

মূল: আল্লামা মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাঈ

সম্পাদনা ও সঙ্কলন: এম এফ বারী