ইসলামী হিজাব (পর্দা) - প্রথম প্রবন্ধ
হিজাব শব্দের অর্থ
মেয়েদের হিজাব বা শালীন পোষাক সম্পর্কে ইসলামের বিশেষ দর্শন রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি, যা ইসলামী ‘হিজাব’ এর ভিত্তি।
আলোচনা শুরুর পূর্বে ‘হিজাব’ শব্দটি যা আমাদের যুগে একজন স্ত্রীলোকের আবরণকে বোঝায় তার প্রকৃত অর্থ জানা দরকার। এ শব্দটি দ্বারা আবরণ বোঝয়, কারণ এটা আচ্ছাদন বা আবৃত করার মাধ্যমকে নির্দেশ করে। সম্ভবতঃ এটা বলা যায় যে, শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থের দিক দিয়ে সব আবরণই "হিজাব” নয়। ‘হিজাব’ বলতে যে আবরণ বোঝানো হয়েছে তা’হলো পর্দার আড়ালে অবস্থান করা। পবিত্র কোরআনে হযরত সোলায়মান (আ.) প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "...যতক্ষণ পর্যন্ত না সূর্য আচ্ছাদিত (বিল-হিজাব) হলো” (সাদ:৩২)১। মানুষের শরীরের মধ্যচ্ছতা যা হৃৎপিন্ড থেকে পাকস্থলীকে আলাদা করে রাখে তাকেও হিজাব বলা হয়।২
ইবনে খালদুন ‘হিজাব’ শব্দটি পর্দা এবং বিচ্ছিন্নতা অর্থে ব্যবহার করেছেন, আবরণ হিসেবে নয়।৩
ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞরা (ফকীহ) আবরণ বোঝাতে ‘হিজাব’ শব্দটির পরিবর্তে ‘সতর’ শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহার করেন। ধর্মীয় আইনবিদ বা ফকিহগণ নামাজ অধ্যায় বা বিবাহ অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তারা ‘হিজাব’ এর পরিবর্তে ‘সতর’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।
যদি শব্দটা পরিবর্তিত না হতো এবং আমরা আবরণ বা ‘সতর’ শব্দটিই ব্যবহার করতাম তা হলেই বরং ভাল ছিল। কারণ আমরা আগেই বলেছি ‘হিজাব’ শব্দটির প্রচলিত অর্থ হচ্ছে আচ্ছাদন। যদি এটাকে আবরণ অর্থ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়, তাহলে এটা মেয়েদের পর্দার আড়ালে থাকা বোঝায়। এ জিনিসটাই অনেকের মনে এ ধারণা দিয়েছে যে, ইসলাম চায় মেয়েরা গৃহবন্দী হয়ে পর্দার আড়ালে থাকুক। মেয়েদের পর্দা করার অর্থ এই নয় যে, তারা কখনো ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। ইসলামে মেয়েদের জন্য পর্দাপ্রথা থাকার অর্থ এই নয় যে, তারা ঘরে বন্দী হয়ে থাকবে। ইসলাম মেয়েদের আটক করে রাখতে চায় না। এ ধরণের চিন্তা প্রাক্ ইসলামী যুগের ইরান ও ভারতবর্ষ সহ কতিপয় দেশে আমরা দেখতে পাই। ইসলামে মেয়েদের জন্য হিজাব বা পর্দাপ্রথা থাকার পেছনে যে দর্শনটি কাজ করছে, তাহলো ধর্মীয় আইন অনুযায়ী যাদের সঙ্গে আত্মীয়তা সূত্রে আবদ্ধ নয় (নামাহ্রাম) এমন সব পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে একজন নারী তার শরীর ঢেকে রাখবে এবং সে তার অংগ প্রদর্শন করবে না।
পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে এবং ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞদের মত এগুলোকে সুদৃঢ় করেছে। আমরা কোরআন এবং সুন্নাহ্কে উৎস ধরে নিয়ে ঢেকে রাখার সীমা সম্পর্কে আলোচনা করবো। প্রাসংগিক আয়াতগুলোতে ‘হিজাব’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। এ বিষয় যেসব আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে, যেমন সূরা ‘নূর’ অথবা সূরা ‘আহ্যাব’ সেগুলোতে হিজাব শব্দের ব্যবহার ছাড়াই ঢেকে রাখার সীমানা ও নারী পুরুষের মেলামেশা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে আয়াতে হিজাব শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিবিগণকে বোঝানো হয়েছে।
আমরা জানি পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-এর স্ত্রীগণ সম্পর্কে বিশেষ আদেশ প্রদান করা হয়েছে। যে আয়াতে প্রথম তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে, তা এভাবে শুরু হয়েছে, "হে, নবীর স্ত্রীগণ! আপনারা অন্য নারীদের মত নন...” (আহ্যাব:৩২)।৪ ইসলাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীগণকে এতই শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে যে, তাঁরা মহানবী (সা.) জীবদ্দশাতে এবং তাঁর ওফাতের পরে মূলতঃ রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে গৃহে অবস্থান করতেন। পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-এর স্ত্রীগণকে লক্ষ্য করে সরাসরি বলা হয়েছে যে, "তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান করবে।” (আহ্যাব:৩৩)৫ ইসলাম চাচ্ছিল যে, "মোমিনদের জননীসদৃশ” রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীগণ কোনো স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির অপব্যবহারের শিকার না হন এবং তাদের সম্মান ও মর্যাদা যথার্থভাবে বজায় থাকে।
আমার মনে হয়, এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর তাঁর স্ত্রীদের আবার বিয়ে করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পর অপর কোন স্বামী হয়ত তাদের মর্যাদা ও সম্মানকে অবমাননা করতে পারে। তাই এত জোর দিয়ে ও কঠোরতার সাথে রাসূলের (সা.)-এর স্ত্রীদের ব্যাপারে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সে যাইহোক, যে আয়াতে হিজাব শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তাহলো
﴿...وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ﴾
"...এবং তাঁর স্ত্রীগণ থেকে কিছু চাইবার হলে পর্দার (হিজাব) অন্তরাল থেকে চাও।” (আহ্যাব:৫৩)৬ ইতিহাস এবং ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী যখনই ‘হিজাবের আয়াতের’ কথা উল্লেখিত হয় তখন সেই আয়াতকেই বোঝানো হয় যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীগণ সম্পর্কিত এবং সূরা নূরের আয়াতসমূহ নয়– যেখানে বলা হয়েছে,
﴿قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ...۞ وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ﴾
"মোমিন পুরুষদের বলূন তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তারা যেন লজ্জাস্থানসমূহ হেফাজত করে... এবং মোমিন নারীদেরকে বলুন যে, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে” (নূর: ৩০-৩১)৭
অথবা সূরা আহযাবের আয়াতসমূহে যেখানে বলা হয়েছে,
﴿يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا﴾
"হে নবী! আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের এবং মোমিনদের স্ত্রীদেরকে বলুন তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়, এর ফলে তাদের (সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত নারী হওয়ার) পরিচয় পাওয়া যাবে ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অত্যন্ত ক্ষমতাশীল এবং পরম দয়ালু।” (আহযাব:৫৯)
আজকের যুগে কিন্তু এটা একটা প্রশ্ন যে হিজাবের পরিবর্তে ফকিহ্দের ব্যবহৃত ‘সতর’ শব্দটির প্রচলন কেন হল না? এর কারণ আসলে সূস্পষ্ট নয়। হতে পারে তারা হয়তো ইসলামী হিজাবকে অন্যান্য দেশে প্রচলিত হিজাবের সাথে মিলিয়ে দেখেছেন। আমরা পরে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা করবো।
হিজাবের প্রকৃত রূপ
সত্য কথা হচ্ছে আবরণসহ অথবা আবরণহীন অবস্থায় মেয়েদের ঘরের বাইরে বের হওয়া ঠিক অথবা বেঠিকের সাথে আবরণ অথবা নতুন পরিভাষা ‘হিজাব’ সংশ্লিষ্ট নয়। আসল ব্যাপার হল, মেয়েদের সঙ্গে পুরুষের প্রয়োজনের সম্পর্কটা একটা অবাধ মেলামেশায় রূপ নিতে পারে কিনা? একথা ঠিক যে আপাততঃ দৃষ্টিতে একটি প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, ‘তাহলে একজন নারী কি করবে?’ ‘সে তার ঘর থেকে কি আবরণসহ বেরুবে না আবরণহীন অবস্থায়?’ প্রশ্নটি উঠেছে নারীদের সম্পর্কে এবং তা মাঝে মাঝে হৃদয়বিদারক ভাষায় করা হয়। ‘নারীদের জন্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা উত্তম, না হিজাবে অবরুদ্ধ হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া উত্তম?’ ইসলামী আবরণের দর্শন অনেকগুলো জিনিসের ওপর নির্ভর করে যার কিছু মনস্তাত্ত্বিক, কিছু পারিবারিক, কিছু সামাজিক এবং কিছু হচ্ছে মেয়েদের মর্যাদা বৃদ্ধি এবং তাদের অমর্যাদার হাত থেকে রক্ষা করা সংক্রান্ত।
ইসলামে ‘হিজাব’-এর মূল নিহিত রয়েছে অধিকতর ব্যাপক এবং মৌলিক বিষয়ে। ইসলাম পারিবারিক পরিবেশ ও বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে সবধরনের যৌন আনন্দকে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। ইসলামের দৃষ্টিতে বিভিন্নমূখী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জায়গা হচ্ছে সমাজ। বর্তমানে পাশ্চাত্য সমাজে কাজ ও যৌন আনন্দকে এক করে ফেলা হয়েছে। ইসলাম এ দুটো পরিবেশকে সম্পূর্ণ আলাদা রেখেছে।#আল বাসাইর
তথ্যসূত্র
১. মাসালিক, জিহাদ অধ্যায়।
২. লিসানুল আরাব, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৮।
৩. ইবনে খালদুন, ‘আল-মোকাদ্দিমা’ গ্রন্থের ‘ফাসলুন ফিল হিজাব কাইফা ইয়াকাআ ফিদ দোআল ওয়া ইন্নাহু ইউআযযামু ইনদাল হিরাম’ অধ্যায় দৃষ্টব্য।
৪. ওয়াসাইলুশ শিয়া ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৩৭।
৫. আয়াতটি রাসূল (সা.) এর স্ত্রীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হলেও আয়াতের বিধানটি সার্বিক ও সকল মুমিন নারীদের ওপর প্রযোজ্য।
৬. সকল ঐতিহাসিক ও ব্যাখ্যাদাতা এটা উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিকগণ মক্কা বিজয়ের ঘটনাবলী প্রসঙ্গে এবং মুফাস্সিরগণ কোরআনের আয়াত, "হে নবী, যখন মুমিন নারীরা তোমার কাছে বাইয়াত করতে আসে...” (৬০:১২) এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তা উল্লেখ করেছেন। কাফী গ্রন্থের ৫ম খণ্ড, ৫২৬ পৃষ্ঠায়ও এটা উল্লেখিত হয়েছে।
৭. ওয়াসাইলুশ শিয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৬। সহিহ মুসলিম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৭; বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৪।