আহলে বায়তের উজ্জ্বল নক্ষত্র হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)
ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসের চরমতম সঙ্কটময় যুগসন্ধিক্ষণে যে মহান দ্বীনী ব্যক্তিত্ব ইসলামের সঠিক ধারার নিভু নিভু দীপশিখাকে প্রজ্বলিত রাখেন এবং পরবর্তী বংশধরদের হাতে পৌঁছে দেন তিনি হচ্ছেন হযরত ইমাম আলী ইবনে হুসাইন (আ.)-যিনি ‘ইমাম যয়নুল আবেদীন’ (আবেদকুল শিরোমণি) ও ‘ইমাম সাজ্জাদ’ (অনেক বেশী নামায আদায়কারী) নামে সমধিক পরিচিত। তাঁর পিতা ছিলেন বেহেশতে যুবকদের নেতা সাইয়েদুশ্ শূহাদা হযরত ইমাম হোসেন (আ.) এবং তাঁর মাতা ছিলেন পারস্য সম্রাট ইয়াযদেগার্দের কন্যা শাহর বানু।
ঐতিহাসিকদের অভিন্ন মত অনুযায়ী হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) হিজরী ৩৮ সালে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর জন্মতারিখ সম্বন্ধে মতভেদ আছে; কোনো কোনো মত অনুযায়ী ৫ই শা‘বান এবং কোনো কোনো মত অনুযায়ী ১৫ই জমাদিউল আউয়াল তারিখে তিনি দুনিয়ায় আগমন করেন।
যুগশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী আধ্যাত্মিক সাধক
ইসলামের ইতিহাসে বহু বার সঙ্কটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে এবং সে সব পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মহান দ্বীনী ব্যক্তিত্ব ইসলামের পবিত্র আলোকশিখাকে নির্বাপিত হবার হাত থেকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর যুগের ন্যায় কঠিন যুগ আর কারো সামনে উপনীত হয়েছিলো বলে মনে হয় না। তাই ইসলামের হেফাযতের জন্য গৃহীত তাঁর কর্মপন্থাও ছিলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, দূরদৃষ্টির অভাবে অনেক ইতিহাস-বিশ্লেষক তাঁর এ বিশিষ্ট কর্মপন্থার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেন নি এবং এ কারণে তাঁকে সমাজ ও রাজনীতির সাথে সম্পর্করহিত স্রেফ সূফী সাধক বলে মনে করেছেন। কিন্তু তিনি রাজনীতি বর্জনকারী কোনো সাধারণ সূফী সাধক ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠতম বিপ্লবী।
মুসলিম উম্মাহর ওপরে যখন মুসলমানিত্বের ভানকারী উমাইয়াহ্ স্বৈরতন্ত্র চেপে বসেছিলো যার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সামান্যতম প্রতিবাদ ও সমালোচনা করার সুযোগ ছিলো না সে যুগে হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) আধ্যাত্মিক জীবন যাপনের মধ্য দিয়েই সঠিক ইসলামের হেফাযত ও প্রচার করেন এবং পরবর্তী বংশধরদের হাতে ইসলামের সঠিক আদর্শকে পৌঁছে দিয়ে যান। তিনি হৃদয়স্পর্শী দো‘আ ও মুনাজাতের মাধ্যমে তাঁর এ দ্বীনী দায়িত্ব পালন করে যান। তাঁর এ সব দো‘আ ও মুনাজাতের সংকলন ‘ছাহীফায়ে সাজ্জাদীয়্যাহ্’ পর্যালোচনা করলেই এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়।
ইসলামের ঘোরতর দুশমন স্বৈরাচারী শাসক ইয়াযীদের হাতে বন্দী থাকাকালে, যখন যে কোনো মুহূর্তে তাঁর শিরচ্ছেদের আশঙ্কা ছিলো, তিনি আপোসহীন সমালোচনার কঠোর কষাঘাতে ইসলামবিরোধী রাজশক্তিকে জর্জরিত করেন, অথচ মুক্তিলাভের পর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বাহ্যতঃ রাজনীতি সম্পর্কে নীরব হয়ে যান। এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি রাজনীতিবিমুখ ছিলেন না, বরং তাঁর এ নীরবতা ছিলো এক বৈপ্লবিক নীরবতা। তাঁর সময়কার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ঐ সময় ইসলামের সঠিক চিন্তাধারা ও আদর্শের হেফাযত ও প্রচার এবং পরবর্তী বংশধরদের কাছে তা পৌঁছে দেয়ার জন্য এটাই ছিলো সঠিক কর্মপন্থা।
কারবালায়
কারবালার যুদ্ধের সময় (হিজরী ৬১ সালে) হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর বয়স ছিলো প্রায় সাড়ে বাইশ বছর। সে হিসেবে তাঁর ভাই আলী আকবর (আ.)-এর ন্যায় তাঁর যুদ্ধে অংশ নেয়ার কথা, আর এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে অনিবার্যভাবেই তাঁকে শাহাদাত বরণ করতো হতো। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছা ছিলো এই যে, তিনি যুদ্ধের আগুন থেকে নিরাপদ ও জীবিত থাকবেন এবং ভবিষ্যতে সঠিক ইসলামের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নেবেন ও পরবর্তী বংশধরদের হাতে পৌঁছে দেবেন। এ কারণে ঐ সময় তিনি গুরুতর রূপে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শহীদ হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যান।
কারবালার যুদ্ধে হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-এর কাফেলায় হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ছিলেন একমাত্র পুরুষ সদস্য যিনি শহীদ হন নি। তাঁর ভাই আলী আকবর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শাহাদাত বরণ করেন এবং তাঁর দুগ্ধপোষ্য ভ্রাতা আলী আসগরকে পিতা ইমাম হোসেন (আ.) পানি পান করানোর জন্য ফোরাত নদীর তীরে নিয়ে গেলে দুশমনদের নিক্ষিপ্ত তীর বিদ্ধ হয়ে শিশু আলী আসগর শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-এর শাহাদাতের পর ইয়াযীদী সৈন্যরা তাঁর শিবিরে লুটতরাজ চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। বর্ণিত আছে যে, হোসেনী শিবির লুণ্ঠনকারী ইয়াযীদী সৈন্যদের একটি দল হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর কাছে পৌঁছলে তাদের দলপতি তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এর (ইমাম যয়নুল আবেদীনের) মৃত্যু হতে আর বেশী বাকী নেই; এরূপ মরণোন্মুখ ব্যক্তিকে হত্যা করা আরবদের রীতির বিরোধী ও লজ্জাজনক। ফলে উক্ত দলপতি তাঁকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকে।
কুফার জনগণের সামনে
শিবির লুণ্ঠনের পর ইয়াযীদী সৈন্যরা হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-এর পরিবারের নারীদের সাথে হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)কে বন্দী করে কুফায় নিয়ে যায়। কুফার প্রাদেশিক প্রশাসক ওবায়দুল্লাহ্ বিন্ যিয়াদের নির্দেশে বন্দীদেরকে কুফার রাস্তায় ঘুরিয়ে কুফাবাসীদের সামনে ইয়াযীদের বিজয়ের প্রদর্শনী করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এর ফল হয় বিপরীত। কারণ, এ সময় হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ও তাঁর ফুফু হযরত যায়নাব (সা.আ.) কুফার জনগণের সামনে জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেন। তাঁরা তাঁদের ভাষণে একদিকে হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-এর সাথে কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের এ আচরণের জন্য তাদেরকে তিরস্কার করেন, অন্যদিকে কারবালার ঘটনার স্বরূপ ও বন্দীদের সাথে ইয়াযীদী সৈন্যদের অপমানজনক আচরণের কথা তুলে ধরেন। এর ফলে কুফাবাসীদের অনেকের মধ্যেই অনুতাপের সৃষ্টি হয় যা উমাইয়াহ্ শাসনের বিরুদ্ধে মুখতারের অভ্যুত্থানকে সহজতর ও ব্যাপকতর করে।
ইবনে যিয়াদের দরবারে
বন্দীদেরকে ওবায়দুল্লাহ্ বিন্ যিয়াদের দরবারে নেয়া হলে সেখানেও হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ও তাঁর ফুফু হযরত যায়নাব (সা.আ.) অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সত্যের প্রকাশ ঘটিয়ে বক্তব্য রাখেন যার মাধ্যমে তাঁরা ওবায়দুল্লাহর দরবারে উপস্থিত লোকদের সামনে ওবায়দুল্লাহ্ ও ইয়াযীদকে চরমভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেন।
ইতিপূর্বে ইয়াযীদের সরকার ও তার সুবিধাভোগী বশংবদ লোকেরা হযরত ইমাম হোসেন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে ‘খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী’, ‘ধর্মত্যাগী (মুরতাদ)’ ইত্যাদি বলে যে জঘন্য অপপ্রচার চালিয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করেছিলো এভাবে হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ও হযরত যায়নাব (সা.আ.) তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করে দেন। ফলে মানব জাতির ইতিহাসে যথার্থ ও যথাযথভাবেই ঘৃণ্যতম ব্যক্তি হিসেবে ইয়াযীদ স্থান পেয়েছে এবং এমন একজন ইতিহাসপাঠক খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ইয়াযীদকে সমর্থন বা পছন্দ করে। অন্যদিকে হযরত ইমাম হোসেন (আ.) কারবালায় শহীদ হলেও মানব জাতির ইতিহাসে ও বিশ্বমানবতার হৃদয়কন্দরে অমর হয়ে আছেন।
বস্তুতঃ হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-এর বিজয় ও সাফল্য এখানেই যে, তিনি তাঁর বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে সকল যুগের সকল মুসলমানের জন্য বৈপ্লবিক প্রেরণার এক অফুরন্ত উৎসে পরিণত হয়েছেন। আর তাঁর এ আত্মত্যাগ ইতিহাসে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হতো না যদি না হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ও হযরত যায়নাব (সা.আ.) বন্দী অবস্থায় এহেন বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করতেন। তাছাড়া তাঁদের এ ভূমিকার আশু ফল হয়েছিলো এই যে, ইয়াযীদের জীবদ্দশায়ই উমাইয়াহ্ রাজতন্ত্র ধ্বংসের পটভূমি তৈরী হয়ে যায়।
দামেশকে
হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ও হযরত যায়নাব (সা.আ.)-এর কাছে লাঞ্ছিত হওয়ার কারণে ওবায়দুল্লাহ্ বিন্ যিয়াদ আর তাঁদেরকে কুফায় রাখা সমীচীন মনে করলো না। তাই খুব শীঘ্রই (মাত্র এক মাসের মাথায়) সে বন্দীদেরকে কুফা থেকে উমাইয়াহ্ রাজত্বের রাজধানী দামেশকে পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু দামেশকেও তাঁরা জনগণের সামনে ও ইয়াযীদের দরবারে ওবায়দুল্লাহর দরবারে রাখা তাঁদের বক্তব্যের অনুরূপ বৈপ্লবিক বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া হযরত ইমাম (আ.) দামেশকের মসজিদেও বক্তব্য রাখেন এবং তাতে তিনি আহলে বায়তের চরিত্রবৈশিষ্ট্যের কথা, বিশেষ করে তাঁদের জ্ঞান, ধৈর্য, উদারতা, বাগ্মিতা, সাহসিকতা, আত্মোৎসর্গ এবং ঈমানদারদের প্রতি বন্ধুসুলভ ও স্নেহশীল আচরণের কথা তুলে ধরেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, যারা জনগণের ওপর নেতৃত্ব করবে তাদের জন্য উত্তম গুণাবলীর ক্ষেত্রে সকলের চেয়ে অগ্রগণ্য হওয়া অপরিহার্য। এ কথার মাধ্যমে তিনি জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ইয়াযীদের খলীফাহর পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ও তা আঁকড়ে রাখার কোনো যোগ্যতা বা অধিকারই নেই।
দামেশকে হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ও হযরত যায়নাব (সা.আ.)-এর বক্তব্য সেখানকার জনগণের মধ্যে এমনই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যে, ইয়াযীদ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার লক্ষ্যে কারবালার ঘটনার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে ওবায়দুল্লাহ্ বিন যিয়াদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে এবং অচিরেই বন্দীদেরকে মুক্তি প্রদান করে। এরপর দামেশকের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে সে হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ও হযরত যায়নাব (সা.আ.) সহ কারবালার সকল বন্দীকে মদীনায় পাঠিয়ে দেয়।
দামেশক থেকে মদীনায় আসার পথে বন্দীগণ কারবালা যিয়ারত করেন এবং পথে পথে হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ও হযরত যায়নাব (সা.আ.) জনগণের সামনে কারবালার ঘটনা ও উমাইয়াহ্ রাজবংশের শাসনক্ষমতার অবৈধতার কথা তুলে ধরেন।
মদীনায় আসার পরও কিছুদিন তাঁরা তাঁদের এ প্রচারমূলক কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু শীঘ্রই ইয়াযীদ তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ইয়াযীদের নির্দেশে হযরত যায়নাব (সা.আ.)কে মিসরে নির্বাসিত করা হয়।
দ্বীনের হেফাযতে নতুন কর্মপদ্ধতি গ্রহণ
ইতিমধ্যে হিজরী ৬৪ সালে ইয়াযীদের মৃত্যু হয় এবং প্রথমে তার পুত্র দ্বিতীয় মু‘আবিয়াহ্ দামেশকের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে অতি ধুরন্ধর মারোয়ান ক্ষমতা গ্রহণ করে। ফলে এক নবতর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে এবং এ নবতর পরিস্থিতি বিবেচনায় হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ইসলামের হেফাযত ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে এক নতুন কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেন।
বস্তুতঃ ইয়াযীদ কারবালায় হযরত ইমাম হোসেন (আ.), তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাথে যে নৃশংস আচরণ করেছিলো তার পরিণাম তার নিজের ও সামগ্রিকভাবে উমাইয়াহ্ রাজতন্ত্রের জন্য শুভ হয় নি। জনগণ সম্পূর্ণরূপে তার ও উমাইয়াহ্ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে যা একটি গণবিস্ফোরণ ও বিপ্লবের রূপ নিতে পারে, এটা অনুভব করতে পেরে ইয়াযীদ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার লক্ষ্যেই হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ও হযরত যায়নাব (সা.আ.) সহ বন্দীদেরকে দ্রুত মুক্তি দিয়ে মদীনায় পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো।
বনি উমাইয়াহ্র সরকার কারবালার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিলো যে, হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) সহ আহলে বায়ত ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে কোনো নির্মূল অভিযান চালানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই তারা ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)কে নিঃসঙ্গ ও নিঃশক্তি করে ফেলার লক্ষ্যে আহলে বায়তের সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে যুলুম-নির্যাতন ও হত্যা তৎপরতা শুরু করে, কিন্তু তা করে এমনভাবে যে, জনগণ যেন সরকারকে এ কাজের মূল নায়ক বলে চিহ্নিত করতে না পারে। সরকার তার ভাড়াটে এজেন্টদের মাধ্যমে যুলুম-নির্যাতন ও গুপ্তহত্যা চালিয়ে যেতে থাকে।
এ পরিস্থিতি লক্ষ্য করে হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বাহ্যিকভাবে নীরবতা অবলম্বন করেন। তিনি যিকির-আযকার, দো‘আ-দরূদ, মুনাজাত ও নফল নামাযে মশগুল হয়ে পড়েন এবং অত্যন্ত পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য লোকজন ছাড়া অন্য সকলের সামনে স্বীয় গৃহের দরযা বন্ধ করে দেন। এভাবে দিন-রাতের বেশীর ভাগ সময়ই তিনি ইবাদতে কাটাতেন বিধায় জনগণের মাঝে তিনি ‘ইমাম যয়নুল আবেদীন’ (আবেদকুল শিরোমণি) ও ‘ইমাম সাজ্জাদ’ (অনেক বেশী সিজদাহকারী/নামায আদায়কারী) হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।
বলা বাহুল্য যে, হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর এ নীরবতা ও বাহ্যতঃ রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে দূরে অবস্থান জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে ছিলো না। কারণ, আহলে বায়তে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জন্য শাহাদাত হচ্ছে গৌরবময় ভূষণ। জীবনের মায়া করলে, যখন জীবন হারানোর আশঙ্কা ছিলো সবচেয়ে বেশী তখন অর্থাৎ বন্দী অবস্থায়, মানব জাতির ইতিহাসের ঘৃণ্যতম নরপিশাচ ইয়াযীদ ও তার এজেন্ট ওবায়দুল্লাহ্ বিন যিয়াদের সামনে তিনি তাদেরই বিরুদ্ধে কঠোরতম সমালোচনা করতে পারতেন না।
বস্তুতঃ আহলে বায়তের ধারাবাহিকতার ইমামগণের জীবন-মরণ উভয়ই ছিলো ইসলামের জন্য; জীবিত অবস্থায় যেমন তাঁরা আল্লাহর দ্বীনের হেফাযত ও প্রচার-প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম করেছেন, তেমনি শাহাদাত বরণের মাধ্যমেও তাঁরা অন্যদের জন্য আল্লাহর পথে আপোসহীন সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছেন। তাই ইয়াযীদের হাতে বন্দী অবস্থায় শহীদ হতে হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর আপত্তি ছিলো না। কারণ, তাহলে হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-এর শাহাদাতেরই ন্যায় তা ইসলামের সেবায় লাগতো। বিশেষ করে বন্দী অবস্থায় ইমামকে হত্যা করা হলে তার প্রতিক্রিয়ায় ইয়াযীদ ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে জনমনে অবর্ণনীয় ঘৃণার ও গণবিদ্রোহের সৃষ্টি হতো। আর ইয়াযীদও তা বুঝতে পেরেছিলো বিধায় তাঁকে হত্যা করতে সাহসী হয় নি।
কিন্তু মদীনার মুক্ত জীবনে তিনি গুপ্তঘাতকের হাতে শহীদ হলে তাতে ইসলামের তেমন কোনো খেদমত হতো না। কারণ, ক্ষমতাসীন সরকার তার ভাড়াটে প্রচারকদের মাধ্যমে খুব সহজেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত শত্রুতার ফল বলে প্রচার করতে পারতো। শুধু তা-ই নয়, বরং স্বৈরাচারী সরকার হয়তো এরূপ হত্যাকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব হযরত ইমামেরই নিকটতম অনুসারীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাঁদেরও মূলোৎপাটন করতো এবং ইমামের জন্য সমবেদনার কপট অশ্রু বর্ষণ করে নিজেদেরকে জনগণের কাছে প্রিয় করে তোলার চেষ্টা করতো।
এর চেয়ে বড় কথা, ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কিছু সংখ্যক লোক গড়ে তোলা এবং ইসলামের সঠিক ধারা ও রূপকে পরবর্তী বংশধরদের কাছে পৌঁছে দেয়ার যে বিরাট দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন উমাইয়াহ্ সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালনের কারণে শাহাদাত বরণ করলে সে বিরাট দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারতেন না। ফলে সত্যিকারের ইসলাম ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতো। এ কারণে তিনি দো‘আ ও মুনাজাতের মাধ্যমে এবং স্বল্প সংখ্যক অতি ঘনিষ্ঠ জনদেরকে দ্বীনী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ইসলামের সঠিক শিক্ষা রেখে যাওয়ার সুচিন্তিত কর্মপন্থা গ্রহণ করেন।
হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর বিভিন্ন দো‘আ ও মুনাজাতে ইসলামী শিক্ষার সমস্ত দিক-বিভাগ তুলে ধরেন। যেমন: ইসলামের ঈমানের মূল বিষয়গুলো, ইসলামী ‘আক্বায়েদের বিষয়াবলী, সত্যপন্থী ও জনকল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা, ন্যায়বিচার ও ঐশী নেতৃত্ব, সত্য প্রচারের জন্য হিজরত ও আত্মত্যাগ, ইসলামের হেফাযত, বাতিলের মূলোৎপাটন ও সত্যের পৃষ্ঠপোষকতা, পথভ্রষ্টদের সঠিক পথ প্রদর্শন, অক্ষমদের সহায়তা, সমাজের নিরাশ্রয় ও নিপীড়িত জনগণ, সামাজিক নিরাপত্তা, ইসলামী ‘আক্বায়েদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ধ্বংসাত্মক হামলার প্রতিরোধ, বিষাক্ত সমাজপরিবেশে সন্তান-সন্ততির সঠিক প্রশিক্ষণ, যালেমদের সহায়তা না করা, যালেমরা দ্বীনের মূলোৎপাটনকারী ইত্যাদি।
হযরত ইমাম (আ.) দো‘আ-মুনাজাত ছাড়াও যে কোনো উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে লোকদেরকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও কারবালার ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতেন।
অন্যদিকে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠতম অনুসারীদেরকে, বিশেষ করে তাঁর দুই পুত্রকে পরবর্তীকালে ইসলামের সঠিক শিক্ষা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার গুরুদায়িত্ব বহনের উপযুক্ত করে গড়ে রেখে যান।
তাঁর পুত্র হযরত ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী-যিনি ‘ইমাম বাকের’ (আ.) নামে সমধিক পরিচিত, তিনি তাঁর পিতার পরে আহলে বায়তের ধারাবাহিকতায় ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন এবং তিনি ছিলেন স্বীয় যুগের শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী যে কারণে তিনি ‘বাক্বেরুল্ ‘উলূম্’ (জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যবচ্ছেদকারী) নামে অভিহিত হতেন।
হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর অপর পুত্র হযরত ইমাম যায়েদ ইবনে আলী (আ.) ছিলেন যায়েদী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা; তিনি বনি উমাইয়াহর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে শাহাদাতের পেয়ালা পান করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
শাহাদাত
অবশেষে হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন ওরফে হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর নীরব তৎপরতারও পরিসমাপ্তি ঘটানোর লক্ষ্যে তৎকালীন উমাইয়াহ্ শাসক ওয়ালীদের ষড়যন্ত্রে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়। ফলে হিজরী ৯৫ সালের ২৫শে মহররম তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
মূল: নূর হোসেন মজিদী
তথ্যসূত্রঃ
১.مجموعه زندگانی چهارده معصوم عليهم السلام: عماد الدين حسين اصفهانی معروف به عمادزاده، نشر طلوع، تهران، چاپ هشتم، ١٣٦٤ هـ ش (١٩٨٥م).
২.زندگانی حضرت زينب سلام الله عليها: دکتر سيد عبد الحسين دسنغيب، مرکز پخش انتشارات باقر العلوم، کوچه حاج نايب، ناصر خسرو، تهران.
৩.الاعلام قاموس تراجم لخير الدين الزرکلی، المجلد الخامس، دار العلم للملايين، بيروت، لبنان، ١٩٨٩ م.
৪.المنجد فی اللغة و الاعلام: دار المشرق، بيروت، الطبعة الحادية والعشرين، ۱۹٧٣ م.
৫. Kitab Al-Irshad: Shaykh Al-Mufid, Translated by I.K.A. Howard B.A., M.A., Ph.D., Ansariyan Publication, Qom, Islamic Republic of Iran.