আল হাসানাইন (আ.)

আশুরার ঘটনাবলীঃ আশুরার দিন ভোরে ইমাম হোসাইন (আ.) এর ভাষণ

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

আশুরার রাতটি ইমাম (আ.) ও তার সঙ্গীদের মুনাজাত ও আহাজারীতে কাটে। একদল রুকু অপর দল সিজদা বা অন্যান্য ইবাদতে গোটা রাত কাটিয়ে দেয়। ঐ রাতে ওমর বিন সাদের বাহিনীর বত্রিশ জন ইমাম হোসাইন (আ.) এর সৈন্যদলে যোগ দেয়। অধিক নামায আদায় ও পূর্ণতার বিভিন্ন গুণে হযরত হোসাইন (আ.) এর চরিত্রই ছিল অনন্য । ইবনে আবদুল বার রচিত ইকদুল ফরিদ গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডের বর্ণনামতে, আলী বিন হোসাইন (আ.) কে জিজ্ঞেস করা হয় “আপনার পিতার সন্তান এত কম কেন? তিনি বলেন-একটি সন্তানও বিস্ময়কর ব্যাপার। কেননা রাত দিনে তিনি হাজার রাকাআত নামায আদায় করতেন। এতে করে তার স্ত্রীর সাথে সময় কাটানোর ফুরসত ছিল না।

আশুরার দিন ভোরে ইমাম হোসাইন (আ.) তাবুর ভিতরের অংশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করার নির্দেশ দিলেন। আতর গোলাব ছিটালেন ।

আশুরার দিন ভোরে ওমর বিন সাদের অশ্বারোহী বাহিনী অগ্রসর হল। ইমাম হোসাইন (আ.) বারির বিন খুজাইরকে তাদের কাছে পাঠালেন। বারির তাদেরকে উপদেশ দিলেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু তারা বিন্দু মাত্র কর্ণপাত করেনি। এসব নছিহত তাদের মনে কোন প্রভাব ফেলেনি। এরপর ইমাম হোসাইন (আ.) তার উটে মতান্তরে অশ্বে আরোহণ করে ওমর বিন সাদের বাহিনীর সামনে দাঁড়ালেন। তাদেরকে গভীর মনযোগ দিয়ে তার কথা শোনার আহবান জানালেন। তারা নিরবে শুনতে লাগলো। ইমাম হোসাইন (আ.) অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের শব্দ ও বাক্য প্রয়োগ করে মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং মুহাম্মদ (সা.) ফেরেশতাকুল ও সকল নবীদের উপর দরুদ পড়ার পর বললেন-

تبّا لكُمُ أيّتُها الْجماعةُ وترْحا حين إسْتصْرخْتُمُونا والهين ف أصْرخْناكُمْ مُوجفين سللْتُمْ عليْنا سيْفا لنا فى ايمانكُمْ وحششْتُمْ عليْنا نارا إقْتدحْناها على عدُوّنا وعدُوّكُمْ ف أصْبحْتُمْ أُلبّاً لاعْدائكُمْ على أوْليائكُمْ

হে জনগোষ্ঠী! তোমাদের এজন্য ধ্বংস হোক যে, তোমরা জটিল পরিস্থিতিতে আমার সাহায্য চেয়েছো। আমি তোমাদের সাহায্যের জন্য ছুটে এসেছি। কিন্তু যে তরবারী আমার সাহায্যে পরিচালনার শপথ তোমরা নিয়েছিলে আজ আমাকে হত্যার জন্য সে তরবারী হাতে নিয়েছো। তোমরা যে আগুন আমাকে জ্বালানোর জন্য প্রজ্বলিত করছো আমি চেয়েছিলাম এ আগুন দিয়ে আমার ও তোমাদের দুশমনদেরকে জ্বালিয়ে দেবো। আজ তোমরা সবাই নিজের বন্ধুকে হত্যা আর দুশমনদের সাহায্যে ছুটে এসেছ। অথচ তারা তোমাদের মাঝে ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেনি। তাদের সহযোগীতার ফলে তোমাদের আনন্দ বা অনুগ্রহ পাওয়ার কোন আশা নেই। তোমাদের জন্য আফসোস। কেন তোমরা ফেতনার আগুন জ্বালানোর জন্য পঙ্গপালের মত ঝাপিয়ে পড়েছ। পতঙ্গের মত পাগল হয়ে নিজেদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করছে।

হে সত্য বিরোধীরা, হে অমুসলিমের দল, হে কুরআনকে প্রত্যাখ্যানকারীরা, হে কথা বিকৃতিকারী, হে অপরাধীর দল, ওহে শয়তানের কুমন্ত্রণায় পতিত গোষ্ঠী, হে মহানবী (সা.) এর শরীয়ত ও সুন্নতকে স্তব্ধকারী আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত দল, এ অপবিত্র জনগোষ্ঠীকে সহযোগীতা করে আমাদের সহযোগীতা থেকে হাত গুটিয়েছো? হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ তোমাদের চরিত্রে প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র পূর্ব থেকেই ছিল। তোমাদের মূল ও শাখা-প্রশাখা এ প্রতারণায় সমানভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। এ কুচিন্তা তোমাদের মাঝে বলিষ্ঠভাবে স্থান পেয়েছে। তোমরা সবচেয়ে নাপাক ফল যা নিজের দর্শককে কষ্ট দেয়। স্বল্প আহার যা ডাকাতরাই গিলে খেতে পারে।

ألا وإنّ الدّعيّ ابْن الّدعي قدْ ركز بيْن اثْنتيْن: بيْن السّلّة والذّلة وهيْهات منّا الذّلّةُ ي أبى اللّهُ لنا ذلك ورسُولُهُ والْمُؤْمنُون

জেনে রাখ,জারজের ছেরে জারজ (ইবনে যিয়াদ) আমাকে দু’বস্তুর এখতিয়ার দিয়েছে। নাঙ্গা তরবারী হাতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবো না হয় অপমানের পোষাক-পরিধান করে ইয়াজিদের বাইয়াত মেনে নেবো। তবে অপমান আমাদের থেকে বহু দূরে। আল্লাহ তার রাসূল, মুমিনগণ এবং পবিত্র ঘরে লালিত সন্তানরা ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও বীরত্বের প্রতীকগণ কখনও অপমানকে মেনে নেবে না। তারা ইজ্জতের উপর আঘাত হেনে এ ধরনের লোকদের আনুগত্য করার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করে। জেনে রাখ যদিও আমার সঙ্গী কম তবুও আমি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করব। ভাষণশেষে ফরওয়া বিন মুসাইক মুরাদীর কবিতার কয়েকটি লাইন উদ্বৃত করলেন যার সারমর্ম হচ্ছে নিম্নরূপঃ-

আমরা যদি বিজয়ী হই আর দুশমন বিজিত হয় তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। কেননা আমরা সবসময় বিজয়ী ছিলাম। যদি পরাভূত বা নিহত হই আমাদের নিজেদের কারণে হব না এবং ভয়ভীতির পথে নিহত হব ন। বরং আমাদের মৃত্যুর সময় এসে গেছে এবং যুগের আবর্তনে বিজয়ের পালা অন্যের ভাগে পড়েছে। যদি মৃত্যুদূত এই জনগোষ্ঠীর দরজা থেকে সরে যায় তবে অন্য গোষ্ঠীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।

আমাদের সম্প্রদায়ের বুজর্গগণ তোমাদের হাতে ঐরুপ মৃত্যুবরণ করেছে যেরূপ যুগ যুগ ধরে মানুষ মৃত্যুর হাতে বলি হয়েছে। রাজা-বাদশাহরা যদি এ জগতে চিরস্থায়ী হতো আমরাও চিরস্থায়ী হতাম। যদি মহান ব্যক্তিগণ এ দুনিয়ায় বেচে থাকতেন আমরাও বেচে থাকতাম।

যারা আমাদের ভৎসনা করছে তাদেরকে বলে দাও নিজেকে নিয়ে চিন্তা করো, অযথা ভৎসনা করো না। কেননা আমরা যে মৃত্যুর সম্মুখিন হয়েছি ভৎসনাকারীরাও একই মৃত্যুর সম্মুখিন হবে।

এ কবিতার চরণগুলো আবৃত্তির পর বললেন-আল্লাহর কসম আমার মৃত্যুর পর তোমরা বেশীদিন বাচতে পারবে না। তোমাদের জীবন কোন সওয়ারীতে আরোহণ এবং নেমে পড়ার অধিক সময় স্থায়ী হবে না। সময় যাতাকলের মত তোমার মাথার উপর চক্কর দিচ্ছে। আর তোমরা যাতাকলের মধ্যেপড়া গমের মত পিষে যাচ্ছ। আমার পিতা আলী (আ.) রাসূলে খোদা (সা.) থেকে যা শুনেছেন তাই তোমাদের সামনে ব্যক্ত করেছি।

এখন তোমরা তোমাদের মতামত ঠিক করো, বন্ধুদের সাথে মিলিত হও, পরামর্শ করো যাতে তোমাদের কাছে বিষয়টি অস্পষ্ট না থাকে। এরপর আমাকে হত্যার জন্য পদক্ষেপ নিও আমাকে সময় দিও না, আমি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছি যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা । সৃষ্টির সকল কাজের ক্ষমতা তারই হাতে। আর আমার পরওয়ারদিগার সর্বদা সঠিকভাবে অনড় অটল রয়েছেন।

এ ভাষণের পর ইমাম শত্রুপক্ষকে ভৎসনা করে বললেন-হে খোদা, তোমার রহমতের বারি এদের জন্য বন্ধ করে দাও। বছরের পর বছর এমন দুর্ভিক্ষ দাও, হযরত ইউসুফ (আ.) এর সময়কার মত দুর্ভিক্ষ দাও। সাকাফী গোলামকে তাদের উপর আধিপত্য দাও যাতে মৃত্যুর তিক্ত স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করাতে পারে। কেননা এরা আমার সাথে মিথ্যা বলেছে, প্রতারণা করেছে।

গোলাম সাকাফী বলতে সম্ভবতঃ হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে বুঝিয়েছেন। তিনি ছিলেন সাকাফী গোত্রের লোক। আল্লামা মাজলিসী ও মুহাদ্দেস কোমীর মতে সাকাফী গোলাম বলতে মোখতার বিন আবি উবাইদা সাকাফীকে বুঝানো হয়েছে।

তুমিই আমার পরওয়ারদিগার আমি তোমারই উপর তাওয়াক্কুল করেছি তোমারই দিকে মনোনিবেশ করেছি সবাই তোমারই দিকে ফিরে যাবে।

এরপর ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন এবং রাসূলে খোদার মোরতাজা নামক ঘোড়াটি চাইলেন এবং নিজের সাথীদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করলেন।

হযরত ইমাম বাকের (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে, হোসাইন (আ.)এর সাথীদের মধ্যে ৪৫জন ছিলেন অশ্বারোহী আর একশো জন ছিলেন পদাতিক। অন্যান্য বর্ণনাতেও এ সংখ্যার সমর্থন পাওয়া যায়।

(কারবালা ও হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ) এর শাহাদাত গ্রন্থ থেকে সংকলিত)#আল হাসানাইন

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)