আল মুরাজায়াতঃ অষ্টম পত্র

১। আমরা মহানবী (সা.)-এর বাণীর মাধ্যমেই শুধু যুক্তি প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে অবহেলা প্রদর্শন করি নি,বরং আমাদের পত্রের শুরুতে এরূপ একটি হাদীসের প্রতি ইশারা করেছি যা পরিষ্কাররূপে আহলে বাইতের ইমামগণের অনুসরণকে ফরয ঘোষণা করেছে,অন্যদের নয়।

কেননা বলেছি রাসূল (সা.) তাঁদেরকে কোরআনের সমকক্ষ,জ্ঞানবানদের নেতা,মুক্তির তরণী,উম্মতের রক্ষাকেন্দ্র ও ক্ষমার দ্বার বলে ঘোষণা করেছেন। এগুলো রাসূল হতে বর্ণিত সহীহ ও স্পষ্ট হাদীসসমূহের সারসংক্ষেপ। বলেছিলাম,আপনি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ইশারা ও ইঙ্গিতই যাঁদের বোঝার জন্য যথেষ্ট (কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই)।

২। সুতরাং আমরা যা বলেছি,এ হাদীসের ভিত্তিতে তাঁদের কথা আহলে বাইতের বিরোধীদের ওপর প্রমাণ হিসেবে অগ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে তাঁদের উপস্থাপিত বাণী চক্র বলে গণ্য হবে না।

৩। এখন রাসূলের বাণীতে যে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছিল তার প্রতি লক্ষ্য করুন। তিনি অজ্ঞ ও অসচেতন ব্যক্তিবর্গকে উচ্চৈঃস্বরে আহবান করে বলেছেন,

يَا أيّهَا النّاسُ إنّي تَرَكتُ فِيكُم مَا إِن أَخَذتُم بِهِ لَن تَضِلّوا,كِتَابَ الله وَ عِترَتِي أهلَ بَيتِي

“হে লোকসকল! আমি তোমাদের মাঝে এমন বস্তু রেখে যাচ্ছি যদি তা ধারণ কর তবে কখনোই বিপথগামী হবে না। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং আমার রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় (আহলে বাইত)।”(এই হাদীসটি তিরমিযী ও নাসায়ী হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী হতে এবং মুত্তাকী হিন্দী তাঁর কানজুল উম্মাল গ্রন্থে এ দুই গ্রন্থ হতে (প্রথম খণ্ড,৪৪ পৃঃ) বর্ণনা করেছেন।)

তিনি আরও বলেছেন,

إنّي ترَكتُ فِيكُم مَا إِنْ تَمَسّكتُم بِهِ لَن تَضِلّوا بَعدِي كِتَابَ اللهِ حَبلٌ مَمدُوْدٌ منَ السّمَاءِ إِلَى الأرضِ وَ عِترَتِي أَهلَ بَيتِي وَ لَن يَفتَرِقَا حَتّى يَرِدَا عَلَيّ الحَوضَ فَانظُرُوا كَيفَ تُخَلِّفُونِي فِيهِمَا

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি জিনিস আমানত রেখে যাচ্ছি,যদি এ দু’টিকে আঁকড়ে ধর তাহলে কখনোই গোমরাহ হবে না। তার একটি হলো আল্লাহর কিতাব কোরআন যা আসমান হতে যমীন পর্যন্ত প্রসারিত রজ্জু ও অন্যটি আমার আহলে বাইত। এ দু’টি কখনোই পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হবে না এবং এ অবস্থায়ই হাউজে কউসারে আমার সাথে মিলিত হবে। তাই লক্ষ্য রেখো তাদের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ করবে।”(এই হাদীসটি তিরমিযী হযরত যাইদ ইবনে আরকাম হতে নকল করেছেন এবং কানজুল উম্মালেও প্রথম খণ্ডের ৪৪ পৃষ্ঠায় এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে)

অন্য এক স্থানে রাসূল (সা.) বলেছেন,

“আমি তোমাদের মাঝে দু’টি খলীফা বা প্রতিনিধি রেখে যাচ্ছি। আল্লাহর কিতাব যা আসমান হতে যমীন পর্যন্ত প্রসারিত এবং আমার নিকটাত্মীয় ও পরিবার। তারা হাউজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত একে অপর হতে বিচ্ছিন্ন হবে না।”(এই হাদীসটি মুসনাদে আহমাদ যাইদ ইবনে সাবিত হতে দুইভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রথমটি ৫ম খণ্ডের ১৮২ নং পৃষ্ঠায় এবং দ্বিতীয়টি ৫ম খণ্ডের ১৮৯ নং পৃষ্ঠায়। কানজুল উম্মাল,হাদীস নং ৮৭৩)

তিনি আরও বলেছেন,

“তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী বস্তু (মূল্যবান বস্তু) রেখে যাচ্ছি। আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত। তারা হাউজে কাওসারে আমার সঙ্গে মিলিত হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।”(হাকিম নিশাবুরী তাঁর ‘মুসতাদরাক’গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৪৮ নং পৃষ্ঠায় এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন,“বুখারী ও মুসলিম হাদীস সহীহ হওয়ার যে শর্ত বলেছেন সে শর্তানুসারে এই হাদীস সহীহ বলে গণ্য।”যাহাবীও তাঁর ‘তালখিসে মুসতাদরাক’গ্রন্থে তা স্বীকার করেছেন)

রাসূল (সা.) অন্যত্র বলেছেন,

“খুব শীঘ্রই আল্লাহ্পাকের পক্ষ থেকে আমাকে আহবান করা হবে এবং আমি তা গ্রহণ করবো। আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি : আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত। আল্লাহর কিতাব রজ্জুর মত আসমান হতে যমীন পর্যন্ত প্রসারিত।” তিনি আরো বলেছেন,“আমার ইতরাত অর্থাৎ নিকটাত্মীয় রক্তজ বংশধরগণই আমার আহলে বাইত। সর্বজ্ঞাত ও সূক্ষ্মদর্শী আল্লাহ্ আমাকে জানিয়েছেন,এরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না ও এ অবস্থায়ই আমার সাথে হাউজে কাওসারে মিলিত হবে। আমি লক্ষ্য করব আমার পর তাদের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ কর।”(ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল এই হাদীসটি তাঁর মুসনাদের ৩য় খণ্ডের ১৭ ও ২৬ পৃষ্ঠায় হযরত আবু সাঈদ খুদরী হতে এবং ইবনে আবি শাইবাহ্,আবু ইয়ালী ও ইবনে সা’দ আবু সাঈদ থেকে তা বর্ণনা করেছেন। আর এটিই কানযুল উম্মাল ১ম খণ্ডের ৪৭ পৃষ্ঠার ৯৪৫ নং হাদীস)

যখন রাসূল বিদায় হজ্ব হতে প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখন ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে অবতরণ করে নির্দেশ দিলেন বৃহৎ বৃক্ষসমূহের নীচে পরিষ্কার করে সেখানে সকলকে অবস্থান নিতে। অতঃপর তিনি বললেন,

“আমাকে আহবান করা হয়েছে ও আমি তা গ্রহণ করেছি। আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি যার একটি অপরটি হতে বৃহৎ। কোরআন ও আমার নিকটাত্মীয় ও রক্তজ বংশধর (আহলে বাইত)। তাদের প্রতি লক্ষ্য রেখো এবং মনে রেখো তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।” অতঃপর তিনি বললেন,

إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ مَولاي وَ أنا مَولى كُلِّ مُؤْمِنٍ

“নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ আমার অভিভাবক এবং আমি সকল মুমিনের অভিভাবক।”

তারপর আলী (আ.)-এর হাত উঁচু করে ধরে বললেন,

مَن كُنتُ مَولاهُ فَهذَا وَلِيُّهُ,اَللّهُمَّ وَالِ مَن وَالاهُ وَعَادِ مَنْ عَادَاه.

“আমি যার মাওলা বা অভিভাবক আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ্,তুমি তাকে ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে এবং তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে।”(হাকিম নিশাবুরী তাঁর মুসতাদরাকের ৩য় খণ্ডের ১০৯ পৃষ্ঠায় হাদীসটি সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী ও মুসলিম তা রেওয়ায়েত না করলেও তাঁদের প্রস্তাবিত শর্তানুসারে হাদীসটিকে তিনি সহীহ বলেছেন। হাদীসটি তিনি যাইদ ইবনে আরকাম থেকে বর্ণনা করেছেন।)

আবদুল্লাহ ইবনে হানতাব বলেছেন,“রাসূল (সা.) জুহফাতে আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবা দান করেন ও প্রশ্ন করেন : আমি কি তোমাদের ওপর তোমাদের অপেক্ষা অধিক অধিকার রাখি না? সবাই বলল : হ্যাঁ।

অতঃপর বললেন,

إنّي سَائِلُكُمْ عَنْ اِثنَيْن : اَلْقُرْآن وَ عِتْرَتِيْ

“আমি তোমাদেরকে অবশ্যই দু’টি বিষয়ে প্রশ্ন করবো। আর তা হলো কোরআন ও আমার আহলে বাইত।”(এ হাদীসটি তাবরানী তাঁর ‘আরবাইনাল আরবাইন’গ্রন্থে এবং আল্লামাহ্ সুয়ূতী তাঁর ‘ইহ্ইয়াউল মাইয়্যেত’গ্রন্থে এনেছেন)

৪। নির্ভরযোগ্য সুন্নাহ্ দু’টি মূল্যবান বস্তুকে আঁকড়ে ধরাকে ফরয বলেছে যা মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত। হাদীসটির বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা বিশ-এর অধিক এবং এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে যে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে একথাগুলো বিভিন্নভাবে বলেছেন।

যেমনটি লক্ষ্য করেছেন বিদায় হজ্ব থেকে ফিরার পথে গাদীরে খুমে,তদ্রুপ আরাফাতের ময়দানে,তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর,আবার কখনো মদীনার মিম্বারে,এমন কি তাঁর শেষ অসুস্থতার সময়ও (যখন তাঁর কক্ষ সাহাবীদের দ্বারা পূর্ণ ছিল) তিনি এ কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করেছেন।

“হে লোকসকল! অতি শীঘ্রই আমার আত্মা স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করবে এবং (আমি) এ পৃথিবী থেকে চলে যাব। আমি তোমাদের এরূপ একটি কথা বলব যার পর তোমাদের ওজর পেশ করার কোন সুযোগ থাকবে না। জেনে রাখ,আমি কোরআন ও আমার আহলে বাইতকে তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি।”

অতঃপর আলী (আ.)-এর হাত উঁচু করে ধরে বললেন,

هذَا عَلِيّ مَعَ الْقُرْآنِ وَ الْقرآنُ مَعَ عَلِيٍّ لا يَفْتَرِقَانِ حَتَّى يَرِدَا عَلَيَّ الْحَوْض

“এই আলী কোরআনের সঙ্গে এবং কোরআনও আলীর সঙ্গে। তারা হাউজে কাওসারে মিলিত হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।”(ইবনে হাজার হাইতামী তাঁর ‘আসসাওয়েকুল মুহরাকাহ্’গ্রন্থের ৯ম অধ্যায়ের ৭৫ পৃষ্ঠায় চল্লিশটি বিভিন্ন হাদীসের পর এ হাদীসটি এনেছেন)

এ বিষয়টিকে আহলে সুন্নাহর অনেক বড় বড় আলেম স্বীকার করেছেন,এমন কি ইবনে হাজার ‘হাদীসে সাকালাইন’ বর্ণনা করার পর বলেছেন,“জেনে রাখুন,কোরআন ও আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরার হাদীসটি কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে এবং বিশের অধিক সাহাবী তা বর্ণনা করেছেন।”

অতঃপর এর সঙ্গে এ কথাগুলো যোগ করেছেন,“১১ নম্বর সন্দেহের জবাবে এ হাদীসগুলোর কয়েকটি সনদের কথা আমরা বলেছি যার কোনটি রাসূল (সা.) বিদায় হজ্বে আরাফাতের ময়দানে,কোনটি মদীনাতে অসুস্থতার সময় তাঁর গৃহে যখন প্রচুর সাহাবী সমবেত হয়েছিলেন তখন বর্ণনা করেছেন,কোনটি গাদীরে খুমে এবং কোনটি তায়েফ হতে প্রত্যাবর্তনের সময় বর্ণনা করেছেন বলে বলা হয়েছে। এ হাদীসগুলো পরস্পর বিরোধী নয়। কারণ হতেই পারে সকল স্থানেই রাসূল (সা.) এ সত্যকে পুনরাবৃত্তি করেছেন কোরআন ও আহলে বাইতের মহান গুরুত্বের কথা চিন্তা করে।(সাওয়ায়েকুল মুহরাকাহ্ গ্রন্থের ১১ অধ্যায়ের ৮৯ নং পৃষ্ঠার শেষে সূরা সাফফাতের ২৪ নং আয়াতের তাফসীরে তিনি এ কথা বলেছেন)

আহলে বাইতের ইমামগণের মর্যাদার জন্য এটিই যথেষ্ট যে,আল্লাহ্ ও রাসূল (সা.) তাঁদেরকে কোরআনের পাশাপাশি ও এর সমপর্যায়ে স্থান দিয়েছেন যার মধ্যে অসত্য ও বাতিল কোনরূপেই প্রবেশ করতে পারে না।

لا يأتَيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَ لا مِنْ خَلْفِهِ

অর্থাৎ এতে মিথ্যার প্রবেশাধিকার নেই,না সামনের দিক হতে,না পেছন দিক হতে।(সূরা হা মীম সিজদা : ৪২)

এগুলোই আহলে বাইতের ইমামগণের অনুসরণের পক্ষে কোরআন ও সুন্নাতের স্পষ্ট দলিল হিসেবে আমাদের এ পথে পরিচালিত করেছে। কারণ মুসলমানরা কোরআনের স্থলে অন্য কিছুকেই গ্রহণ করতে পারে না। তাই কিরূপে সম্ভব তদস্থলে এমন কিছু গ্রহণ করবে যা কোরআনের সমমানের ও সমমর্যাদার হবে না?

৫। তদুপরি হাদীসে এসেছে-

إنّي تارِكٌ فِيكُمْ ما إن تَمسّكْتُمْ بِهِ لَنْ تَضِلّوا : كِتابَ اللهِ وَ عِتْرَتِيْ

অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে এমন কিছু রেখে যাচ্ছি যাকে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনও বিপথগামী হবে না। (ভাবার্থ হলো যে কেউ এ দু'টিকে একসঙ্গে আঁকড়ে না ধরবে সে গোমরাহ হয়ে যাবে।) এ হাদীসের (হাদীসে সাকালাইন) সঙ্গে তাবরানীর বর্ণনানুসারে রাসূলুল্লাহ্ এ কথাটিও সংযোগ করেছেন,

فَلا تُقَدِّموهُمَا فَتُهْلِكُوا وَ لا تُقَصِّرُوا عَنهُما فَتُهْلِكُوا وَلا تُعَلِّمُوهُمْ  فَإِنَّهُمْ أعْلَمُ مِنْكُمْ

তাদের চেয়ে অগ্রবর্তী হয়ো না তাহলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এবং তাদের ব্যাপারে উপেক্ষার দৃষ্টি নিক্ষেপ করো না,তবে ধ্বংসগহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে। তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষাদান করতে যেও না কারণ তারা তোমাদের চেয়ে জ্ঞানী।

ইবনে হাজার বলেন,“তাদের চেয়ে অগ্রবর্তী হয়ো না বা তাদেরকে উপেক্ষা করো না,তাদেরকে কিছু শেখানোর চেষ্টা করো না- নবীর এ কথাটির অর্থ হলো যে কেউ জ্ঞানের যে পর্যায়েই পৌঁছে থাকুক না কেন আহলে বাইত দীনি দায়িত্ব ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের ওপর প্রধান্য রাখেন।”(আস-সাওয়ায়েক,রাসূলের ওসিয়ত অধ্যায়,১৩৫ পৃষ্ঠা। সুতরাং এখন তাঁকে প্রশ্ন করুন তবে কেন আবুল হাসান আশা’আরীকে দীনের মৌলিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এবং চার মাজহাবের ইমামগণকে ফিকাহর ক্ষেত্রে নবীর আহলে বাইত হতে প্রাধান্য দান করেন?

কিরূপে নবী (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আলী ইবনে আবি তালিবকে (যিনি ব্যতীত সূরা তওবা প্রচারের অধিকার অন্য কাউকে আল্লাহ্ দান করেন নি) অন্যদের পরে স্থান দেন? কিরূপে মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের মত মুর্জিয়া যে আল্লাহর দৈহিক অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল এমন ব্যক্তির তাফসীরকে আহলে বাইতের ইমামগণের চেয়ে অগ্রগামী মনে করেন?) 

৬। যে সকল প্রামাণ্য দলিল মুসলমানদের আহলে বাইতের প্রতি পরিচালিত করে ও এ পথে চলতে বাধ্য করে তার একটি হলো নবী করিম (সা.)-এর এ বাণীটি-

أَلا إِنَّ مَثَلَ أَهْل بَيْتِيْ فِيْكُم مَثَلُ سَفِيْنَةِ نُوح مَنْ رَكِبَهَا نَجا وَ مَنْ تَخَلَّفَ عَنْهَا غَرَقَ

জেনে রাখো,নিশ্চয়ই আমার আহলে বাইত তোমাদের জন্য নূহের তরণির মত। যে ব্যক্তি তাতে আরোহণ করবে সে মুক্তি পাবে আর যে তা থেকে বিরত থাকবে সে নিমজ্জিত হবে।(হাকিম নিশাবুরী তাঁর মুসতাদরাকের ৩য় খণ্ডের ১৫১ পৃষ্ঠায় হযরত আবু যার থেকে এটি বর্ণনা করেছেন)

এছাড়াও রাসূল বলেছেন,

“শুধু আমার আহলে বাইতই নূহের কিস্তির মত যে তাতে আরোহণ করবে সে নাজাত পাবে,যে আরোহণ না করবে সে নিমজ্জিত হবে। আমার আহলে বাইত তোমাদের মাঝে বনি ইসরাঈলের ক্ষমার দ্বারের অনুরূপ,যে তাতে প্রবেশ করবে সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে।”(তাবরানী তাঁর ‘আরবাইন’গ্রন্থের ২১৬ পৃষ্ঠায় আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণনা করেছেন)

অন্যত্র বলেছেন,

النُّجُومُ  أمَانٌ لِأهْلِ الأرْضِ مِنَ الْغَرَقِ وَ أَهْلُ بَيْتِي أمانٌ لِأمّتِي مِنَ ا لْلاِخْتِلافِ ( فِي الدّينِ) فَإِذَا خَالَفَتْهَا قَبِيلَةٌ مِنَ الْعَرَبِ ( يَعْني في اَحْكامِ اللهِ )  اِخْتلفوا فَصَارُوا حِزْبَ

“তারকারাজি পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্য নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষাকবচ। আর আমার আহলে বাইত উম্মতের দীনের ক্ষেত্রে বিভক্তি হতে রক্ষার আশ্রয়স্থল। যদি আরবদের মধ্যে কোন গোত্র তাদের বিরোধিতা করে (আল্লাহর হুকুম ও বিধানের ক্ষেত্রে) তবে সে গোত্র শয়তানের দলে পরিণত হবে।”(হাকিম নিশাবুরী তাঁর ‘মুসতাদরাক’গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে ইবনে আব্বাস থেকে এ হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন)

এগুলোই উম্মতের জন্য আহলে বাইতের অনুসরণকে অপরিহার্য করে তোলে এবং তাঁদের বিরোধিতা থেকে দূরে রাখে। আমার মনে হয় না এর থেকে সুষ্ঠু কোন ভাষা ও শব্দের মাধ্যমে এটি মানুষকে বোঝানো সম্ভব।

৭। কিন্তু আহলে বাইত বলতে এখানে যা বোঝানো হয়েছে তা রাসূল (সা.)-এর বংশধারার মধ্যকার ইমামগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ,অন্য কোন ব্যক্তি এর অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ এই সম্মান ও মর্যাদা যাঁরা আল্লাহর নির্দেশকে বাস্তবায়ন করেন ও তাঁরই ঐশী নিদর্শন তাঁরা ব্যতীত অন্য কারো জন্য প্রযোজ্য নয়। একথাটি যেরূপ হাদীস ও রেওয়ায়েত হতে সেরূপ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও প্রমাণিত। আহলে সুন্নাতের অনেক প্রসিদ্ধ আলেমও তা স্বীকার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ : ইবনে হাজার তাঁর ‘আসসাওয়ায়েকুল মুহরাকাহ্’ গ্রন্থে বলেছেন,

“অনেকে বলেছেন : যে আহলে বাইতের কথা বলা হয়েছে তাঁরা রক্ষিত,তাঁরা আহলে বাইতের আলেমগণ হতে পারেন কারণ মানুষ তাঁদের মাধ্যমেই হেদায়েতপ্রাপ্ত হন;তাঁরা মানুষের মাঝে তারকাস্বরূপ এবং যদি তাঁরা পৃথিবীতে না থাকেন তবে মানুষের ওপর আল্লাহর আজাব পতিত হয়।”

অতঃপর বলেন,“এবং এটি মাহ্দী (আ.)-এর সময় ঘটবে। কারণ ইমাম মাহ্দী (আ.) সম্পর্কিত হাদীসসমূহ থেকে জানা যায় হযরত ঈসা (আ.) তাঁর পেছনে নামায পড়বেন এবং দাজ্জাল তাঁর সময়েই নিহত হবে। এর পরই একের পর এক আল্লাহর নিদর্শনসমূহ প্রকাশিত হতে শুরু করবে।”(আস-সাওয়ায়েক,১১ পৃষ্ঠা,৭ম আয়াতের তাফসীর)

অন্যত্র তিনি বলেছেন,“মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো : আপনার আহলে বাইতের পরবর্তীতে মানুষ কিরূপে জীবন যাপন করবে? জবাব দিলেন : কোমর ভাঙ্গা গাধার ন্যায়।”(উপরোক্ত গ্রন্থের ১৪৩ পৃষ্ঠায় রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর আহলে বাইতের ওপর আপতিত বিপদাপদের বর্ণনা দানের পর এ কথাটি বলেছেন)

৮। আপনি ষ্পষ্টত বুঝতে পেরেছেন যে,নবী (সা.)-এর আহলে বাইতকে নূহ (আ.)-এর তরণীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে কারণ যে কেউ দীনের মৌলিক ও বিধানগত বিষয়ে (ফিকাহ্গত) আহলে বাইতের ইমামগণ হতে নির্দেশনা গ্রহণ করবে তারা জাহান্নামের শাস্তি হতে মুক্তি লাভ করবে। আর কেউ যদি তার বিরোধিতা করে সে ঐ ব্যক্তির মত যে নূহ (আ.)-এর সময়ের প্লাবন হতে পাহাড়ের ওপর আশ্রয় গ্রহণ করেও মুক্তি পায় নি। এখানে নিমজ্জিত হবার অর্থ জাহান্নামে পতিত হওয়া। তাই এমন কর্ম হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

তাঁদেরকে ক্ষমার দ্বারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে কারণ আল্লাহ্ ঐ দ্বারকে তাঁর শক্তিমত্তার বরাবরে তাঁর নির্দেশানুযায়ী মস্তক অবনত করা ও বিনয়ী হবার পথ হিসেবে বলেছেন এবং এ কারণেই এ দ্বার বনী ইসরাঈলের জন্য ক্ষমার পথ হয়েছিল। তদ্রুপ এই উম্মতের জন্য এ দ্বারকে আহলে বাইতের মোকাবিলায় আল্লাহর নির্দেশের অনুকূলে আত্মসমর্পণ করা এবং ক্ষমা ও মাগফিরাত লাভের উপায় করা হয়েছে। ইবনে হাজার এই হাদীসগুলো উদ্ধৃত করার পর আহলে বাইতকে নূহ (আ.)-এর তরণী ও ক্ষমার দ্বারের সঙ্গে তুলনা করার কারণ এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন,

“তাঁদেরকে নূহ (আ.)-এর তরণীর সঙ্গে তুলনা করার কারণ এটিই,যে কেউ তাঁদের ভালবাসবে ও সম্মান করবে সে আল্লাহর নিয়ামতের শোকর আদায় করেছে এবং সে অবশ্যই আহলে বাইতের ইমামগণের মাধ্যমে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে ও তাঁদের বিরোধিতার অন্ধকার হতে মুক্তি লাভ করবে। আর যে কেউ তাঁদের বিরোধিতা করবে আল্লাহর নিয়ামতের অস্বীকৃতির সাগরে নিমজ্জিত ও ধ্বংসের গহ্বরে পতিত হবে।”(আস-সাওয়ায়েক,১১ অধ্যায়,৯১ পৃষ্ঠা)

অতঃপর বলেছেন,“তাঁদেরকে ক্ষমার দ্বারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এজন্য যে,এ দ্বারে প্রবেশ করা বায়তুল মুকাদ্দাস বা রাইহার দ্বারে প্রবেশের মত (যদি তা আল্লাহর সামনে মস্তক অবনত করার উদ্দেশ্যে হয়) ক্ষমা লাভের কারণ। আল্লাহ্পাক আহলে বাইতের ভালবাসাকে উম্মতের ক্ষমা লাভের উপায় করে দিয়েছেন।”(এখন আমার প্রশ্ন এসব জানার পরও তিনি কেন দীনের মৌলিক ও শাখাগত বিষয়ে আহলে বাইতের অনুসরণ করেন নি?)

সুতরাং আহলে বাইতের অনুসরণের বিষয়টি অপরিহার্য হওয়া সম্পর্কিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির ও বহুল প্রচারিত। বিশেষত আহলে বাইত হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ সহীহ বলে পরিগণিত। আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন এ ভয় যদি না করতাম তবে আমার লেখনীকে স্বাধীন করে ছেড়ে দিতাম যাতে তা পূর্ণতায় পৌঁছায়। যা হোক যতটুকু লিখলাম আশা করি তা এ উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম হবে।

(আবুল কাসেম অনূদীত আল মুরাজায়াত গ্রন্থ থেকে সংকলিত)#আল হাসানাইন