আল হাসানাইন (আ.)

আশুরার ঘটনাবলীঃ কারবালার বীরত্বগাঁথা

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

বর্ণিত হয়েছে-হোর ইবনে ইয়াজিদ রিয়াহীর পর বারির বিন খোজাইরের মত যাহেদ ও আবেদ ব্যক্তিত্ব ময়দানে অবতীর্ণ হলেন, ইয়াজিদ বিন মা’কাল তার সাথে যুদ্ধের জন্য ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ল। তারা দু’জন মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে আল্লাহর কাছে সত্যের পথ নির্ণয়ের জেদ ধরে কামনা করল-যে বাতিল সে যেন প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর বারির তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। কিছুক্ষণ পর তিনিও শাহাদত বরণ করেন।

তারপর ওহাব বিন জেনাহ কালবী ময়দানে সমর নৈপুণ্য প্রদর্শন করে কারবালায় অবস্থানরত মা ও স্ত্রী ও পরিবারের কাছে ফিরে আসলেন। মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মা জননী আামর উপর আপনি সন্তুষ্ট আছেন?

জবাবে মা বললেন-আমি তোমার উপর রাজী ও খুশী নই যতক্ষণ না তুমি হোসাইন (আ.) এর সাহায্যার্থে প্রাণ না দেবে।

তার স্ত্রী বলল-আমাকে বিপদে ফেলো না। আমার অন্তরে কষ্ট দিও না। তার মা বললেন প্রিয় ছেলেটি আামার-তার কথায় কান দিও না। নবী নন্দিনীর সন্তানদের পথে ফিরে যাও, যুদ্ধ করো। এতেই কিয়ামত দিবসে তার নানার শাফায়াতের সৌভাগ্য লাভ করবে। ওহাব ময়দানে গিয়ে যুদ্ধ করতে করতে দু’হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তার স্ত্রী তাবুর একটি স্তম্ভ হাতে নিয়ে তার সামনে এসে বলল-আমার মাতা-পিতা তোমার জন্য উৎসর্গিত। পবিত্র আহলে বাইত ও রাসূলে খোদা (সা.) এর সম্মানিত আওলাদগণের সাহায্যার্থে যুদ্ধ করুন। ওহাব এসে তাকে নারীদের তাবুতে ফিরিয়ে নিতে চাইলেন। তার স্ত্রী স্বামীর দামান ধরে বলল-আমি মরে যেতে পারি তবুও ফিরে যাব না। ইমাম হোসাইন (আ.) বললেন-আমার আহলে বাইতের সাহায্যের জন্য আল্লাহ তোমাদের উত্তম পুরুস্কার দান করুন। (ওহাবের স্ত্রীকে বললেন) তুমি নারীদের তাবুতে ফিরে যাও, সে ফিরে যায় আর ওহাব দুশমনদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শাহদত বরণ করে।

এরপর মুসলিম বিন আওসাজা ময়দানে এসে দুশমনের মোকাবিলায় প্রচণ্ড যুদ্ধ চালিয়ে অনেক দুশমনকে ঘায়েল করে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন। মুমূর্ষ অবস্থায় দেখে ইমাম হোসাইন (আ.) বললেন-হে মুসলিম, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। এরপর কুরআনের এ আয়াত তিলাওয়াত করেন।

فمنْهُمْ منْ قضى نحْبهُ ومنْهُمُ منْ ينْتظرُ وما بدّلُوا تبْديلاً

তাদের কেউ শাহাদত বরণ করেন আর কেউ অপেক্ষায় আছেন আল্লাহ তার নেয়ামত কখনও পরিবর্তন করেন না।

হাবিব তার কাছে এসে বলল- তোমার মৃত্যু আমার কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কিন্তু তোমাকে ধন্যবাদ যে বেহেশতে চলে যাচ্ছ। মুসলিম খুব ক্ষীণ কন্ঠে বলল আল্লাহ তোমাকে সন্তুষ্ট রাখুন।  হাবিব বলল-“যদি অন্য কোন অসুবিধা না হয় তাহলে আমার বিশ্বাস তোমার পরপরই আমি নিহত হব। আমাকে কিছু অসিয়ত করলে খুশী হব।” মুসলিম ইমাম হোসাইন (আ.) এর দিকে ইঙ্গিত করে বলল আমার অসিয়ত হল এই মহান ব্যক্তির সাহায্যে এবং তারই পথে আমৃত্যু লড়াই করবে। হাবিব বলল তোমার অসিয়ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। এরপরেই মুসলিম শাহাদত বরণ করেন।

এবার আমর বনি কারতা আনসারী সামনে আসলেন । ইমাম হোসাইন (আ.) এর কাছে যুদ্ধের অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র দুশমনের উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। ইমাম হোসাইনের (আ.) সমর্থনে যুদ্ধ করে ইবনে যিয়াদের বহু সৈন্য নিধন করলেন। কথার সত্যতা আর ভীরু কাপুরুষ বাহিনীর জিহাদের অবিচলতা প্রদর্শন করলেন সমানে। ইমাম হোসাইন (আ.) এর দিকে যে তীরটি এসেছে তার হাত দ্বারা সেগুলো ফিরাতে থাকে। তরবারীর যে আঘাতই এসেছে নিজে বুক পেতে নিয়েছেন। তার শরীরে যতক্ষণ পর্যন্ত শক্তি ছিল হোসাইন (আ.) এর পবিত্র বদনে কোন আঘাত আসতে দেননি। শেষ পর্যন্ত সারা শরীর আহত হয়ে ভূমিতে লুটে পড়েন।

ইমাম হোসাইন (আ.) কে লক্ষ্য করে বললেন-হে রাসূলের আওলাদ আমি কি প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পেরেছি? ইমাম বললেন-হ্যাঁ তুমি আমাদের পূর্বেই বেহেশতে পৌছে যাবে। আমার সালাম রাসূলে খোদা (সা.)-কে পৌছাবে। আর বলবে ইমাম হোসাইন (আ.) একটু পরেই আপনার সান্নিধ্যে আসছে। আমর পুনরায় যুদ্ধ শুরু করে নিহত হন।

এরপরই কালো দাস আবুজর ইমাম হোসাইন (আ.)এর সামনে এসে দাড়ালে ইমাম বললেন- “আমি তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি তুমি এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যাও, নিজের জীবন রক্ষা করো কেননা তুমি আমাদের সাথে শান্তি ও কল্যাণের জন্যই এসেছ। নিজেকে হত্যার মুখে ঠেলে দিও না। আবুজর দৃঢ়চিত্তে বলল-হে মহানবীর আওলাদ আমি আনন্দ ও ভাল অবস্থায় আপনার সাথে থাকবো আর বিপদকালে আপনাকে ছেড়ে চলে যাব?

খোদার শপথ আমার গন্ধ অনেক খারাপ আমার বংশ নিম্নমানের আর আমার রং কালো, আপনি দয়া করে আমাকে একটু সুযোগ দিন। চিরশান্তিময় বেহেশতে পৌছে দিন যাতে আমি সুবাসিত হতে পারি, আমার বংশও উন্নত হয় এবং রঙও শুভ্র হয়। খোদার শপথ আপনাকে ছেড়ে যাব না। আমার কালো রক্তকে আপনার পবিত্র খুনের সাথে মিশিয়ে ফেলব। এপরপর যুদ্ধ করে শাহাদাতের শরবত পান করেন।

আমর বিন খালেদ সাইয়্যেদী ইমাম হোসাইন (আ.)এর সামনে এসে বলল-হে আবু আব্দুল্লাহ আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গিত। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই আপনার সাথীদের সাথে মিলিত হব, আমি বেচে থাকব আর আপনাকে আহলে বাইত (আ.)-এর সামনে নিহত অবস্থায় দেখব এটা আমি মোটেও পছন্দ করব না। ইমাম হোসাইন (আ.) বললেন-যাও (জেহাদের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়) কিছু সময় পর আমিও পৌছে যাব। আমর দুশমনের উপর প্রচণ্ড হামলা চালিয়ে শাহাদাত বরণ করেন।

হানজালা বিন সা’দ শামী ইমাম হোসাইন (আ.) এর সামনে দাড়ালেন। ইমাম (আ.) এর দিকে নিক্ষেপিত তীর, বর্শা এবং তরবারীর আঘাত তার মুখে ও বুক পেতে নিলেন, যাতে ইমাম (আ.) এর গায়ে না লাগে। এরপর ইবনে যিয়াদের সেনাবাহিনীকে আল্লাহার আযাবের ভয় দেখিয়ে, ফেরআউনের কওমকে একজন মুমিন যেভাবে ভয় দেখিয়েছেন, সে আয়াতগুলো তেলাওয়াত করলেন-

يا قوْم إنّى أخافُ عليْكُمْ مثْل يوْم الاْحْزاب مثْل د أب قوْم نُوحٍ وعادٍ وثمُود والّذين منْ بعْدهمْ، وما اللّهُ يُريدُ ظُلْما للْعباد. ويا قوْم إنّى أخافُ عليْكُمْ مثْل يوْم التّناد، يوْم تولُّون مُدْبرين ما لكُمْ من اللّه منْ عاصمٍ

মুমিন ব্যক্তিটি বলল, হে আমার সম্প্রদায়, আমি তোমাদের জন্য পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের শাস্তির দিনের অনুরূপ দুর্দিনের আশংকা করি। যেমন ঘটেছিল নূহ, আদ, সামুদ এবং তাদের পূর্ববর্তীদের ক্ষেত্রে । আল্লাহ তো বান্দাদের প্রতি কোন জুলুম করতে চান না।

হে আমার কওম, আমি তোমাদের জন্য আশংকা করি কিয়ামত দিবসের যেদিন তোমরা পশ্চাৎ ফিরে পালাতে চাইবে, আল্লাহ শাস্তি হতে তোমাদের রক্ষা করার কেউ থাকবে না।(সূরা গাফের, আয়াত নং-৩০-৩৩)

يا قوْم لا تقْتُلُ حُسيْنا فيسْحتُكُمُ اللّهُ بعذابٍ وقدْ خاب من افْترى

হে সম্প্রদায়! ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করো না। কেননা আল্লাহ তোমাদের উপর আযাব অবতীর্ণ করে তোমাদের ধ্বংস করে দেবে। যে কেউ মহান আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করবে সে অবশ্যই ধ্বংসপ্রাপ্ত ।

এরপর ইমাম হোসাইন (আ.) এর প্রতি মুখ করে বললেন-আমার পরওয়ারদিগারের কাছে কি আমি যেতে পারব না। আমার ভাইদের সাথে মিলিত হতে পারব না? ইমাম বললেন, হ্যাঁ, যাও ঐ দিকে যাও দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছু থেকে উত্তম; যাও এমন বাদশাহীর দিকে যা চিরন্তন-অক্ষয়। হানজালা শত্রুদের সাথে তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত হলেন। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করার পর শাহাদত বরণ করেছেন।

জোহরের নামাযের সময় ইমাম হোসাইন (আ.) যুহাইর বিন কাইন ও সাঈদ বিন আব্দুল্লাহর মাধ্যমে-যারা সারিবদ্ধ হয়নি তার সামনে সারিবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিলেন। ইমাম হোসাইন (আ.) তার সাথীদের নিয়ে সালাতুল খাওফ (ভয়ের নামায) পড়ছিলেন । এ সময় ইমাম হোসাইন (আ.) এর দিকে শত্রুপক্ষ একটি তীর নিক্ষেপ করল। সাঈদ বিন আব্দুল্লাহ অগ্রসর হয়ে ইমাম (আ.) এর সামনে দাঁড়ালেন। দুশমনের পক্ষ থেকে আগত সকল তীর তিনি বুক পেতে নিলেন। তীরের আঘাতে জর্জরিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। আর বলছিলেন-হে খোদা! এ সম্প্রদায়ের উপর অভিশাপ দাও যেমন আভসম্পাত করেছে আদ ও সামুদ সম্প্রদায়ের উপর। আমার সালাম মহানবীর দরবারে পৌছে দাও, আমার ক্ষতবিক্ষত বদনের যখম সম্পর্কে তাকে অবহিত করো। কেননা তোমার নবী (সা.) এর আওলাদগণের সাহায্যে আমার উদ্দেশ্যই ছিল তোমার পূর্ণ প্রতিদান লাভ করা। এসব মনের আকুতি ব্যক্ত করতে করতে তিনি শহীদ হলেন। তার শাহাদতের পর তার শরীরে তরবারী ও বর্শার অসংখ্য আঘাত ছাড়াও ত্রিশটি তীর বিদ্ধ অবস্থায় পরিলক্ষিত হয়।

তারপরই খান্দানী ও অধিক নামায আদায়কারী ব্যক্তিত্ব সুদেয় বিন আমর বিন আবি মোতা’ অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। তীব্র লড়াইয়ের চরম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখান। তিনি চতুর্মুখী আক্রমণে ধরাশায়ী হয়ে পড়েন। নড়াচড়ার ক্ষমতাও রহিত হয়। হটাৎ শুনতে পেলেন ইবনে যিয়াদের বাহিনী বলছে হোসাইন নিহত হয়েছেন। এ কথা কানে আসামাত্র অজ্ঞান অবস্থায় নিজের জুতার ভেতর থেকে একটি ছোরা বের করে তুমুল লড়াই করার পর শাহাদাত বরণ করেন।

বর্ণনাকারী বলেন-ইমাম হোসাইন (আ.) এর সঙ্গী-সাথীরা তার সাহায্যে প্রাণ দেয়ার কাজে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। যেমন কবি বলেন-

ইমাম হোসাইন (আ.) এর সাথীরা এমন বীর পুরুষ তাদেরকে যখন বিপদ উত্তরণের জন্য আহ্বান করা হয় অথচ দুশমনের দল তীর বর্শা বা তরবারী নিয়ে সম্মিলিত আক্রমণ চালায়-তখন তারা বীরত্বের বর্ম পরিধান করে নিজেদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে কুন্ঠিত হয় না।

(কারবালা ও হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ) এর শাহাদাত গ্রন্থ থেকে সংকলিত)#আল হাসানাইন

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)