আল হাসানাইন (আ.)

মুবাহালাহর দিবস

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

মশহুর অভিমত অনুসারে ২৪ যিলহজ্জ্ব মুবাহালার দিবস যা ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোর অন্তর্ভুক্ত। মুবাহালাহ শব্দটি বাহল (অভিশাপ দেয়া) থেকে উদ্ভূত যার অর্থ হচ্ছে একে অপরকে অভিশাপ দেয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও ধর্মীয় কেন্দ্রসমুহের প্রধানদের কাছে মহানবী (সাঃ) চিঠি-পত্র প্রেরণের পাশাপাশি নাজরানের আর্চবিশপদ আবু হারেসার কাছে একটি পত্র প্রেরণ করে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং এক –অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর নাজরানের খ্রীষ্টানবাসীদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল মহানবী (সাঃ)-এর সাথে আলোচনা করার জন্য মদীনা আগমন করে। মহানবী (সাঃ) তাদেরকে এক-অদ্বিতীয় মহান আল্লাহর ইবাদত করার এবং হযরত ঈসা (আঃ)কে আল্লাহ বা খোদাপুত্র বলে যে বিশ্বাস তাদের রয়েছে তা ত্যাগ ও বর্জন করে খাঁটি তৌহীদে বিশ্বাসী হওয়ার আহ্বান জানালে তারা (ঐ প্রতিনিধিদল) মহানবী (সাঃ)-এব় সাথে অযথা বিতর্কে লিপ্ত হয় এবং তারা অচলাবস্থা থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় হিসাবে তাঁর (সাঃ) কাছে পরস্পর মুবাহালা এবং যে পক্ষ মিথ্যাবাদী তাদের উপর লানত (অভিশাপ) দেয়া এবং মহান আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদীদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য প্রার্থনা করার প্রস্তাব দেয়। তখন ওহীর ফেরেশতা মুবাহালার আয়াত নিয়ে অবতরণ করে মহানবী (সাঃ)কে জানান, যারা তাঁর (সাঃ) সাথে অযথা বিতর্কে লিপ্ত হবে এবং সত্য মেনে নেবে না, তাদেরকে মুবাহালা করতে আহ্বান জানাবেন এবং উভয় পক্ষ যেন মহান আল্লাহর কাছে এই বলে প্রার্থনা করে যে, তিনি মিথ্যাবাদীকে স্বীয় দয়া (রহমত) থেকে দূরে সরিয়ে দেন। পবিত্র কুরআনের মুবাহালাহ সংক্রান্ত আয়াতটিঃ আপনার কাছে এতদ(হযরত ঈসা বা তৌহীদ) সংক্রান্ত জ্ঞান আসার পর যে কেউ আপনার সাথে বিতর্ক করে এবং (সত্য মেনে নিতে চায় না) তাকে বলে দিনঃ

فَمَن حَاجَّکَ فِيهِ مِن بَعدِ مَا جَائَکَ مِن العِلمِ فَقُل تَعَالَوا نَدعُ أَبنَائَنَا وَ أَبنَائَکُم وَ نِسَائَنَا وَ نِسَائَکُم وَ أَنفُسَنَا وَ أَنفُسَکُم ثُمَّ نَبتَهِل فَنَجعَل لَعنَةَ اللهِ عَلَی الکَاذِبِينَ

এসো, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্র সন্তানদেরকে এবং তোমাদের পুত্রসন্তানদেরকে, আমাদের নারীদেরকে এবং তোমাদের নারীদেরকে, আমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদেরকে নিজেদেরকে, অতঃপর আমরা (মহান আল্লাহর কাছে) বিনীতভাবে প্রার্থনা করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিশাপ (লানত) দেই (আলে ইমরানঃ ৬৩)। এরপর মুবাহালার তারিখ ও স্থান নির্দিষ্ট করা হয়। মুবাহালার দিবস ও মূহুর্ত্য ঘনিয়ে আসলে মহানবী (সাঃ) নাজরানের খ্রীষ্টানদের সাথে মুবাহালাহ করার জন্য সাধারণ মুসলিম জনতা ও নিজ আত্মীয় স্বজনদের মধ্য থেকে কেবল তাঁর আহলুল বাইতকে (আঃ)কে –যারা হচ্ছেন হয়রত আলী (আঃ),হযরত ফাতিমা (আঃ), ইমাম হাসান (আঃ)এবং ইমাম হুসাইন (আঃ)- সাথে নিয়ে মদীনা নগরীর বাইরে উন্মুক্ত মরু- প্রান্তরে নির্দিষ্ট স্থানের দিকে বের হন যা মুবাহালার জন্য পূর্ব হতে ঠিক করা হয়েছিল। কারণ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মধ্যে তখন এ চার জনের ঈমান ও পবিত্রতা অপেক্ষা পবিত্রতর ও দৃঢ়তর ঈমানের অধিকারী আর কোন মুসলমান ছিল না। মহানবী (সাঃ) শিশু ইমাম হুসাইন (আঃ)কে কোলে নিয়েছিলেন এবং ইমাম হাসান (আঃ)-এর হাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন। এ অবস্থায় হযরত আলী (আঃ) এবং হযরত ফাতিমা (আঃ) তাঁর (সাঃ) পিছে পিছে হাঁটছিলেন। মুবাহালার ময়দানে প্রবেশের আগেই তিনি (সাঃ) তাঁর সাথে মুবাহালায় অংশগ্রহণকারী সঙ্গীদেরকে বলেছিলেনঃ যখনই আমি দুআ করব, তখন তোমরাও আমার দুআর সাথে সাথে আমীন বলবে। (দ্রঃ আয়াতুল্লাহ জাফার সুবহানী প্রণীত চিরভাস্বর মহানবী (সাঃ), খঃ ২, পৃঃ ৩৬৯)

মহানবী (সাঃ) – এর মুখোমুখী হওয়ার আগেই নাজরানের প্রতিনিধি দলের নেতারা একে অপরকে বলতে লাগলঃ যখনই আপনারা প্রত্যক্ষ করবেন যে মুহাম্মাদ (আঃ) লোক-লস্কর ও সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মুবাহালার ময়দানে আসছেন এবং আমাদের সামনে তাঁর পার্থিব জৌলুস ও বাহ্যিক শক্তি প্রদর্শন করছেন, তখন তিনি ভণ্ড ও মিথ্যাবাদী হবেন এবং তাঁর নুবুওয়াতের কোন নির্ভরযোগ্যতাই থাকবে না। আর তিনি যদি নিজ সন্তান-সন্তাতি এবং আপনজনদের সাথে নিয়ে মুবাহালা করতে আসেন এবং সব ধরনের বস্তুগত ও পার্থিব জৌলুস থেকে মুক্ত হয়ে এক বিশেষ অবস্থায় মহান আল্লাহর দরগাহে প্রার্থনা করার জন্য হাত তোলেন, তাহলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, তিনি কেবল নিজেকেই সম্ভাব্য যে কোন ধ্বংসের মুখোমুখী করতে প্রস্তুত নন, বরং তাঁর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত (ও প্রিয় আপন) ব্যক্তিদেরকেও ধ্বংসের মুখোমুখী দাঁড় করাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ।

নাজরানের প্রতিনিধি দল যখন দেখতে পেল যে, মহানবী (সাঃ) তাঁর নিজের সাথে তাঁর কলিজার টুকরা নিস্পাপ আপনজনদের এবং নিজের একমাত্র কন্যাসন্তানকে মুবাহালার ময়দানে নিয়ে এসেছেন তখন তারা আশ্চর্য্যাম্বিত হয়ে নিজেদের হাতের আঙ্গুল কামড়াতে লাগল। তারা স্পষ্ট বুঝতে পারল যে, মহানবী (সাঃ) তাঁর আহ্বান ও দুআর ব্যাপারে দৃঢ় আস্থাশী। আর তা না হলে একজন দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজের আপনজনদেরকে কখনোই আসমানী বালা মুসিবত এবং মহান আল্লাহর শক্তি ও গজবের মুখোমুখী দাঁড় করাবেন না।

নাজরানের প্রধান ধর্মযাজক তখন বললেনঃ আমি এমন সব পবিত্র মুখমণ্ডল দেখতে পাচ্ছি যে, যখনই তাঁরা হাত তুলে দুআ করে মহান আল্লাহর দরবারে সবচেয়ে পাহাড়কে উপড়ে ফেলতে বলবেন, তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের দুআয় সাড়ায় দেয়া হবে। সুতরাং এ সব আলোকিত (নূরানী) মুখমণ্ডল এবং সুমহান মর্য্যাদার অধিকারী ব্যক্তির সাথে আমাদের মুবাহালা করা কখনই ঠিক হবে না। কারণ এতে করে আমাদের ধ্বংসা হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয় এবং স্রষ্টার শাস্তি ব্যাপকতা লাভ করে বিশ্বের সকল খ্রীস্টানকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে পারে। তখন পৃথিবীর বুকে একজন খ্রীষ্টানও অবশিষ্ট থাকবে না।

নাজরানের প্রতিনিধি দল পরস্পর পরামর্শ করে সম্মিলিত ভাবে মুবাহালায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর তারা জিযিয়া কর প্রদান করে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ভিত্তিতে মহানবী (সাঃ)-এর সাথে সন্ধিচুক্তি করে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর মহানবী (সাঃ) বলেনঃ মহান আল্লাহর শাস্তি নাজরানবাসীদের মাথার ওপর ছায়া বিস্তার করেছিল। আর তারা যদি মুবাহালা ও পারস্পরিক অভিশম্পাৎ (মুলাআনাহ) প্রদানের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত, তাহলে তারা তাদের মনুষ্যাকৃতি হারিয়ে ফেলত এবং মরু-প্রান্তরে যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয় . তাতে তারা দগ্ধ হতো। আর ঐশ্বরিক শাস্তিও নাজরান অঞ্চলকে গ্রাস করত। (দ্রঃ আয়াতুল্লাহ জাফার সুবহানী প্রণীত চিরভাস্বর মহানবী (সাঃ), খঃ ২, পৃ়ঃ ৩৬৮ – ৩৭০)

মুবাহালার মহাঘটনা মহানবীর (সাঃ) আহলুল বাইত (আঃ)- এর পরিচয় সুস্পষ্ট করে দেয় এবং প্রমাণ করে যে মহানবীর (সাঃ) আহলুল বাইত হচ্ছেন হাতে গোণা নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি যাঁরা হচ্ছেন সুরা-ই আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে উল্লিখিত আহলুল বাইত যাঁদেরকে মহান আল্লাহ পাক সকল পাপ-পঙ্কিলতা (রিজস) থেকে পূর্ণরূপে পবিত্র করার ইচ্ছা করেন এবং এ আয়াতের শানে নুযূলে নবীপত্নী উম্মুল মুমিনীন উম্ম-ই সালামাহ এবং আরও কতিপয় সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীস-ই কিসাহ (চাদরের হাদীস) অনুসারে উক্ত আয়াতস্থ মহানবীর (সাঃ) পবিত্র আহলুল বাইত যে কারা তা এবং কারা আহলুল বাইতের অন্তর্ভুক্ত নয় তা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ মুবাহালার দিবসে মহানবী (সাঃ) তাঁর চারজন সঙ্গীকে (হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইন) একটি কালো চাদরের নিচে প্রবেশ করিয়ে এ আয়াত তিলাওয়াত করেছিলেনঃ

হে আহলুল বাইত ! নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ চান তোমাদের থেকে সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা দূর করতে এবং পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। (সুরা-ই আহযাবঃ ৩৩){সংক্রান্ত অধ্যায়, দার সাদির, বৈরূত, লেবানন, ১ম সংস্করন, ২০০৪ হযরত আয়েশা বলেনঃ .إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذهِبَ عَنکُمُ الرِّجسَ أَهلَ البَيتِ وَ يُطَهِّرَکُم تَطهِيرَاً .

হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত অনুরূপ হাদীস সহীহ মুসলিমেও বিদ্যমান (হাদীস নং ৬২৮৮, পৃঃ ৯১৫, আহলুল বাইতের ফযিলত)}

আমের ইবনে সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস নিজ পিতা সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস থেকে বর্ণনা করে বলেনঃ মুয়াবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ান সাদকে আদেশ করে বললঃ আবু তুরাবকে (হযরত আলী (আঃ)কে) গালি দেয়া থেকে কোন্ জিনিস তোমাকে বিরত রেখেছে .... (অর্থাৎ তুমি কেন আলীকে গালি দেও না ....) তখন তিনি (সাদ) বললেনঃ তাঁর (আলীর) ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ যে তিন ফযিলত বলেছেন সেগুলো আমার স্মরণে আছে বলে আমি আবু তুরাবকে কখনোই গালি দেব না। কারণ সেগুলোর যে কোন একটিও যদি আমার হত তাহলে তা আমার কাছে লালবর্ণবিশিষ্ট গবাদি পশুর চেয়েও অধিক প্রিয় হত। ঐ ফযিলত তিনটি হচ্ছেঃ

ক. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন আলীকে কোন এক যুদ্ধে (মদীনায়) রেখে যাচ্ছিলেন তখন আলী তাঁকে (সাঃ)বলেছিলেনঃ হে রাসূলুল্লাহ, আপনি কি আমাকে নারী ও শিশুদের সাথে রেখে যাচ্ছেন .... তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ মূসার কাছে হারূন যে অবস্থান ও মাকামে ছিলেন আমার পরে কেবল নুবুওয়াত ব্যতীত আমার কাছে তুমি কি ঠিক সেই অবস্থান ও মাকামে থাকার ব্যাপারে সন্তুষ্ট নও ....

খ. আমি মহানবী (সাঃ)কে খায়বর বিজয়ের দিন বলতে শুনেছিঃ আমি অবশ্যই এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা সমর্পণ করব যে মহান আল্লাহকে এবং তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে। তখন আমরা সবাই সেটার জন্য আশা করেছিলাম। অতঃপর তিনি (সাঃ) বললেনঃ আলীকে ডাক। অতঃপর তাকে চোখ উঠা অবস্থায় আনা হলে তিনি (সাঃ) তাঁর (আলীর) চোখে থুঁথু মুখের লালা লাগিয়ে তাঁর হাতে পতাকা তুলে দিলেন। আর আল্লাহ পাক তাঁর (আলী (আঃ)) হাতে বিজয় দেন (অর্থাৎ খায়বর বিজিত হয়)।

গ. আর এ আয়াতটিঃ – অতঃপর তাকে বলে দিনঃ এসো, আমরা ডাকি আমাদের পুত্রসন্তানদেরকে এবং তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে, আমাদের নারীদেরকে এবং তোমাদের নারীদেরকে, আমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের নিজেদেরকে ........... – অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, হাসান এবং হুসাইনকে ডেকে বললেনঃ হে আল্লাহ, এরাই হচ্ছে আমার আহলুল বাইত। (দ্রঃ সহীহ মুসলিম, সাহাবাদের ফযিলত সংক্রান্ত অধ্যায়ঃ হযরতআ আলীর ফযিলত সংক্রান্ত অধ্যায়, পৃঃ ৯০৮ – ৯০৯, হাদীস নংঃ ৬৪২৬, দার সাদির, বৈরূত, লেবানন, ১ম সংস্করন, ২০০৪, আর সহীহ তিরমিযীতেও সাদ থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে,দ্রঃ আল-জামে আস-সহীহ সুনান আত-তিরমিযী, কুরআন তাফসীর সংক্রান্ত অধ্যায়, সূরা-ই আলে ইমরানের তাফসীর, হাদীস নং ২৯৯৯, পৃঃ ৭৯৮, দার ইহইয়াইত তুরাস আল-আরাবী, বৈরুত, লেবানন, ১ম সংস্করন)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)