পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষ-(২য় পর্ব)
- প্রকাশিত হয়েছে
-
- লেখক:
- মোহাম্মাদ জাওয়াদ রুদগার
- সূত্র:
- ঢাকা থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘প্রত্যাশা’, ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আল কুরআনে বর্ণিত প্রকৃত মানুষ পবিত্র জীবনের অধিকারী
আল কুরআনে পবিত্র জীবনের কাঠামো ও রূপ পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রবণতা বা পবিত্র বিশ্বাস নৈতিকতা ও কর্মের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। পবিত্র জীবন এমন এক জীবন যার প্রতিটি দিক ও ক্ষেত্র ঐশী বর্ণ ও গন্ধের অধিকারী এবং ঐশী সত্তার কর্তৃত্ব ও অবিভাবকত্বের ছায়ায় বিকশিত। এরূপ জীবন কল্যাণহীন জ্ঞান, অসৎ ও অনুপযুক্ত কর্ম, অপরিশুদ্ধ জীবনোপকরণ ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত। এ জীবন শুধু অজ্ঞতা, আল্লাহর প্রতি উদাসীনতা, বস্তুপ্রেম ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার বন্ধনমুক্তই নয়; বরং আল্লাহর স্মরণে জাগ্রত, তাঁর নির্দেশের অনুবর্তী ও পছন্দনীয় কর্ম পালনে তৎপর, নিষিদ্ধ কর্ম বর্জনকারী, হালাল জীবিকা অনুসন্ধানকারী, ওহী ও ঐশী প্রত্যাদেশের নিকট আত্মসমর্পণকারী, খোদা অনুরাগী, বুদ্ধিবৃত্তির যথার্থ ব্যবহারকারী ও আল্লাহর বান্দাদের সেবায় নিয়োজিত। এ বৈশিষ্ট্যগুলো পবিত্র কুরআনের সূরা মুমিনুন (আয়াত: ১-১০), সূরা ফুরকান (আয়াত: ৬৩-৭২) ও সূরা ফাত্হ (আয়াত: ২৯)-এ বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র জীবনের সার কথাটি সূরা ফাতির (আয়াত: ১০)-এ এভাবে বর্ণিত হয়েছে :
إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَ الْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ
‘পবিত্র কথা তাঁর (আল্লাহর) দিকে ঊর্ধ্বগমন করে এবং সৎকর্ম তা ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়।’ সুতরাং পবিত্র জীবনের ভিত্তি হল পবিত্র বিশ্বাস, চরিত্র ও কর্ম। অন্যত্র আল্লাহ্ বলেছেন :
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَ هُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَوٰةً طَيِّبَةً
‘পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ বিশ্বাসী অবস্থায় সৎকর্ম করবে, নিশ্চয় আমরা তাকে পবিত্র জীবন দ্বারা জীবিত করব।’ সূরা নাহল (আয়াত: ৯৭)
পবিত্র কুরআনের চিন্তাধারায় পবিত্র জীবন লাভের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই এবং সকলেই নিখাদ উদ্দীপনা, বিশুদ্ধ চিন্তা, সঠিক জ্ঞান ও সৎকর্মের মাধ্যমে এমন জীবন ও পদ্ধতি হস্তগত করতে পারে। প্রকৃত জীবন হল এরূপ জীবন ও পথ অর্জন করা যা মানুষের অস্তিত্বের সকল দিক ও অংশের ওপর ঐশী কর্তৃত্ব ও অভিভাবকত্বের নির্দেশক সত্তাকে প্রাধান্য দান করবে। অর্থাৎ মানব অস্তিত্বের সার বলে গণ্য তার অভ্যন্তরে বিদ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তাকে নিজের পরিচালকরূপে নির্ধারণ করবে। আর তাই এ অভ্যন্তরীণ সত্তাকে জাগ্রত করতে মানুষের সত্তার বাইরে বিদ্যমান ঐশী নির্দেশক বিদ্যমান যার আহবানে সাড়া দান মানুষকে পবিত্র জীবন লাভে সহায়তা করে। আর তা হল মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জীবন সঞ্চারিণী বাণী ও আহবান, যেমনটি সূরা আনফালের ২৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে :
يَأَيُّهَا الذِّيْنَ آمَنُوْا اسْتَجِيْبُوا لِلّهِ وَ لِلرَّسُوْلِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيْكُم
‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আহবানে সাড়া দাও যখন তাঁরা তোমাদের এমন কিছুর দিকে আহবান করেন যা তোমাদের জীবন দান করে।’
পবিত্র কুরআনের আলোকে আলোকিত মানুষ চিন্তা, বোধ, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, বাক্য, কর্ম, আচরণ, ভঙ্গী, নীরবতা পালন সকল কিছুর ক্ষেত্রে যথার্থ। সে পবিত্র উদ্দেশ্য ও উদ্দীপনা, পবিত্র কথা, পবিত্র কর্ম ও আচরণের অধিকারী। সে পবিত্র ভূমি ও ক্ষেত্র থেকে উপকৃত হয় যেমনটি পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘পবিত্র ভূমি তার উদ্ভিজ্জকে তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমেই বের করে।’
কুরআনী শিক্ষায় প্রশিক্ষিত মানুষ আল কুরআনের এ আয়াতের দৃষ্টান্ত-‘তুমি কি লক্ষ্য কর না আল্লাহ কীভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? পবিত্র কথা পবিত্র বৃক্ষের ন্যায়, যার মূল সুদৃঢ় ও যার শাখা-প্রশাখা ঊর্ধ্বে বিস্তৃত। যা প্রতি মৌসুমে ফলদান করে তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।’ তার সর্বোত্তম নমুনা হল ঈসা (আ.)-এর এ পবিত্র কথা-‘যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি (আল্লাহ্) আমাকে বরকতময় (কল্যাণকর সত্তা) করেছেন।’ অর্থাৎ কুরআনের কাংক্ষিত মানুষ যার শ্রেষ্ঠ নমুনা হলেন নবিগণ তাঁরা তাঁদের আলোকময় অস্তিত্ব দিয়ে সকল যুগ, স্থান ও কালকে সমৃদ্ধ ও আলোকমণ্ডিত করেছেন। অন্য ভাষায় বলা যায়, তাঁদের অস্তিত্ব সময় ও স্থানকে ছাপিয়ে সকল কিছুকে আচ্ছাদিত করেছে। এমন মানুষ চিরন্তনতা ও স্থায়িত্ব লাভ করেছেন এবং বিশ্বের সকল পত্রে তার স্বাক্ষর অঙ্কিত হয়েছে। কারণ, তার মহৎ চিন্তা, বিশ্বাস, উদ্দেশ্য, কর্ম, আচরণ ও নীতি অতি প্রাকৃতিক ঊর্ধ্ব এক জগতের সাথে সম্পর্কিত হয়েছে ও ঐশী নৈকট্য লাভের মাধ্যমে চিরন্তনতা পেয়েছে। আর কেবল এরূপ বস্তুই স্থায়ীভাবে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বলে গণ্য হয়। কুরআনের ভাষায়- ‘তোমাদের নিকট যা আছে তা নিঃশেষ হবে এবং আল্লাহর নিকট যা আছে (ও গৃহীত হয়) তা-ই স্থায়ী।’
ভারসাম্যকেন্দ্রিকতা
কুরআনে চিত্রিত আদর্শ মানুষ যেমন কখনও বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন করে না, তেমনি বাক্য, কর্ম ও আচরণে অযথার্থতার পরিচয় দেয় না; বরং সে ন্যায় চিন্তা-ভাবনার অধিকারী, ন্যায়ের পথ অবলম্বনকারী ও সকল অবস্থায় ন্যায়পন্থী। কুরআনের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত মানুষ সর্বজনীন ও সার্বিক চিন্তার অধিকারী, বুদ্ধিবৃত্তিনির্ভর, সুপ্রবৃত্তির ধারক এবং সত্য জ্ঞানের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনাকারী। কুরআনী মানুষ জীবনে কখনও ব্যক্তি, সমষ্টি অথবা পরিবারের বিপরীতে অবস্থান নেয় না। সে আধ্যাত্মিকতাকে কখনও বস্তুর জন্য কুরবানী করে না, দুনিয়াকে আখেরাতের বিপরীতে প্রাধ্যান্য দেয় না, প্রেম ও ভাবাবেগকে বুদ্ধিবৃত্তির পরিপন্থী ক্ষেত্রে ব্যবহার করে না; আবার ব্যক্তি, বস্তু, দুনিয়া, প্রেম ও ভাবাবেগকে তুচ্ছ গণ্য করে উপেক্ষাও করে না; বরং তার জীবনে এ বিষয়গুলো পূর্ণতা ও বিকাশের ক্ষেত্র বলে বিবেচিত হয়। তাই তা তার জীবনের উৎকর্ষের মাধ্যম ও উপকরণ এবং তার ঐশী যাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ক্ষেত্রে সে এতদুভয়ের মধ্যে কোন একটিকে গ্রহণে বাধ্য নয়; বরং তার কাছে দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র, বস্তু মানবিক উন্নয়ন ও বিকাশের উপাদান, পরিবার পূর্ণতার সহায়ক, সমাজ পারস্পরিক সহযোগিতা ও মত বিনিময়ের ক্ষেত্র। অর্থাৎ সমাজ ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিক সম্পদসমূহকে পুঞ্জীভূত করে তার সর্বোত্তম ব্যবহারের নিশ্চয়তা দানকারী। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হল প্রতিটি বস্তু ও উপকরণকে তার ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়ায় ব্যবহার এবং এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা।
কুরআন অনুসারী মানুষ পবিত্র কুরআনের এ আয়াতের দৃষ্টান্তস্বরূপ-‘তুমি তোমার হাত তোমার গ্রীবায় আবদ্ধ করে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কর না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’ (সূরা ইসরা: আয়াত ২৯) অর্থাৎ সে দানের ক্ষেত্রেও মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। যেমন অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছে-‘এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না; বরং তারা এতদুভয়ের মাঝে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।’(ফুরকান : আয়াত ৬৭)
একদিকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সে বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়ে থাকে না এবং কৃচ্ছ্রতা ও যোগ সাধানার ক্ষেত্রে এতটা বাড়াবাড়িতেও রত হয় না যে, দুনিয়ার সকল প্রকার সুখ ও ভোগের উপকরণ বর্জন করবে, অন্যদিকে সে ভোগবিলাসী ও অপব্যয়ী-অনাচারী নয়; বরং সে চিন্তা ও কর্মে সামগ্রিকতার ধারক ও ন্যায়সঙ্গত পন্থা অবলম্বনকারী। এ ধরনের ব্যক্তি সম্পর্কেই পবিত্র কুরআন বলছে :
وَ كَذٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطاً لِتَكُوْنُوْا شُهَدَاءَ عَلى النَّاسِ...
‘এভাবে আমরা তোমাদের মধ্যপন্থী এক জাতি করেছি যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ হও...। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৪৩)
শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী মুসলিম উম্মাহকে এভাবে চিত্রিত করেছেন :
‘মুসলিম উম্মাহ ভারসাম্যপূর্ণ এক উম্মত। তাদের ভারসাম্যপূর্ণ হওয়ার কারণ হল ইসলাম একটি সামগ্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা যা মানবজীবনের সকল দিকের প্রতি লক্ষ্য রেখেছে। এটি তার মধ্যপন্থার নিদর্শন। যদি ইসলাম মানবজীবনের ওপর কার্যকর প্রভাব বিস্তারকারী সকল উপাদানের প্রতি দৃষ্টি না দিত এবং কেবল তার জীবনের কিছু কিছু দিকে বিধান প্রণয়ন করত তবে তা কখনই ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম হত না।’ (খাতামিয়াত, তেহরান, ইনতেশারাতে সাদরা, ১৩৭৮ ফারসি সাল)
আল্লামা তাবাতাবায়ীর ভাষায় :
‘ইসলাম তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে বুদ্ধিবৃত্তির ওপর স্থাপন করেছে- আবেগ ও অনুভূতির ওপর নয়। এ কারণেই ইসলামে ধর্মীয় আহবান এমন একটি পর্যায়ক্রমিক পবিত্র বিশ্বাস, উন্নত নৈতিক আচরণবিধি এবং ব্যাবহারিকভাবে প্রয়োগযোগ্য বিধানের সমষ্টি বলে গণ্য যাকে সহজাত প্রকৃতির অধিকারী এবং অলীক কল্পনা-বিশ্বাস ও কুসংস্কারমুক্ত যে কোন মানুষ তার খোদাপ্রদত্ত বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা সত্যায়ন করবে।’ (ইসলাম ওয়া ইনসানে মুয়াসের, কোম, দাফতারে ইনতেশারাতে ইসলামি প্রকাশনা, ১৩৮২ ফারসি সাল।)
যেহেতু কুরআনের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রত্যক্ষ দর্শনমূলক ইসলাম পরিচিতির অধিকারী এবং সার্বিক ধর্মীয় বোধশক্তিসম্পন্ন সেহেতু কখনই সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যকে আধ্যাত্মিকতার নামে দূরে সরিয়ে দেয় না; আবার আধ্যাত্মিকতাকেও সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য বিসর্জন দেয় না বা সমাজসেবাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ত্যাগ করে না। তাই সে আধ্যাত্মিকতার চর্চার অজুহাতে বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ, ভালবাসার অনুভূতি ও সামাজিক জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ায় না। আবার বুদ্ধিবৃত্তির কারণে নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধি থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয় না। কিংবা স্রষ্টার দিকে যাত্রার পথিক হিসেবে রাজনীতির প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে না, তেমনি রাজনীতির সঙ্গে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকার সম্পর্কহীনতার ধুয়া তুলে স্রষ্টামুখি কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে না; বরং সে বিকাশ, ভারসাম্য ও উৎকর্ষকে তার জীবনের আবর্তনের কেন্দ্র ও সারবস্তু জ্ঞান করে। সুতরাং কুরআনের আলোয় আলোকিত মানুষ তার জীবনে পরিবেশ ও ভৌগোলিক অবস্থানের ভরকেন্দ্রকে কুরআন ও মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র বংশধরদের জীবন, কর্ম ও নীতিপদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে স্থাপিত ও সুদৃঢ় করেছে। এ কারণে সে চিন্তা, আচরণ ও কর্মে কখনও বিকৃত চিন্তা, অন্ধবিশ্বাস, পশ্চাৎমুখিতা, কুসংস্কার, প্রতিক্রিয়াশীলতা দ্বারা প্রভাবিত হয় না; বরং তার ঊর্ধ্বযাত্রা ও পূর্ণতা বুদ্ধিবৃত্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
দায়িত্বসচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা
কুরআনের আলোকে গঠিত আদর্শ মানুষ তার চাওয়া-পাওয়া, প্রয়োজন, আকাংক্ষা, ঝোঁক-প্রবণতা ও পছন্দ-অপছন্দের প্রতি গুরুত্ব দানের চেয়ে কুরআনের শিক্ষার অনুবর্তী হয়ে দায়িত্বসচেতনতা ও দায়িত্বশীলতাকে তার জীবনের ভিত্তি নির্ধারণ করে। অর্থাৎ কুরআনী বিশ্বদৃষ্টি ব্যক্তির মধ্যে দায়িত্ববোধ সৃষ্টিকারী ও তা পালনে ব্যক্তিকে অঙ্গীকারাবদ্ধ করে যা তার মধ্যে গতি, কর্মচাঞ্চল্য ও উদ্দীপনার জন্ম দেয়, সে সাথে তাকে উদ্দেশ্যে পৌঁছার জন্য প্রয়োজনীয় উপযোগিতা ও এ পথে বিদ্যমান প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে সাহস ও শক্তি যোগায়। মূলত অনুরূপ মানুষের দীনী প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত এ বাণীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় :
لِيَتَفَقَّهُوْا فِيْ الدِّيْنِ وَ لِيُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوْا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُوْنَ
‘যাতে তারা দীন সম্বন্ধে গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে পারে এবং (এর মাধ্যমে) তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে যাতে তারা সতর্ক হয়।’ (সূরা তওবা : আয়াত- ১২২)
অর্থাৎ তার মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি, ধর্মের প্রতি সংবেদনশীলতা, ধর্মজ্ঞান, ধার্মিকতা, ধর্মীয় দায়িত্ব পালন ও ধর্মীয় মিশন পরিচালনার সমন্বয় সৃষ্টি হয়। আর তার এ সমগ্র কর্মকাণ্ড ও বৈশিষ্ট্যকে নিম্নোক্ত দু’আয়াতে চিত্রায়িত করা হয়েছে :
اَلتَّائِبُوْنَ الْعَابِدُوْنَ الْحَامِدُوْنَ السَّائِحُوْنَ الرَّاكِعُوْنَ السَّاجِدُوْنَ الْآمِرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ النَّاهُوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ الْحَافِظُوْنَ لِحُدُوْدِ اللهِ...
‘তারা (আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী ও তাঁর নিকট) ক্ষমা প্রার্থনাকারী, (আল্লাহর) ইবাদতকারী, (ও তাঁর) প্রশংসাকারী, রোযা পালনকারী, রুকুকারী, সিজদাকারী, সৎকাজের নির্দেশদাতা, অসৎকাজের নিষেধকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষাকারী...।’(সূরা তওবা : আয়াত- ১২২)
إِنَّ الْمُسْلِمِيْنَ وَ الْمُسْلِمَاتِ و الْمُؤْمِنِيْنَ وَ الْمؤْمِنَاتِ وَ الْقَانِتِيْنَ وَ الْقَانِتَاتِ وَ الصَّادِقِيْنَ وَ الصَّادِقَاتِ وَ الصَّابِرِيْنَ وَ الصَّابِرَاتِ وَ الْخَاشِعِيْنَ وَ الْخَاشِعَاتِ وَ الْمُتَصَدِّقِيْنَ وَ الْمُتَصَدِّقَاتِ وَ الصَّائِمِيْنَ وَ الصَّائِمَاتِ وَ الْحَافِظِيْنَ فُرُوْجَهُمْ وَ الْحَافِظَاتِ وَ الذَّاكِرِيْنَ اللهَ كَثِيْرًا وَّ الذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَّ أَجْرًا عَظِيْمًا
‘নিশ্চয়ই আত্মসমর্পণকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পণকারী নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোযাদার পুরুষ ও রোযাদার নারী, যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী- তাদের জন্য আল্লাহ্ রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।’(সূরা আহযাব :আয়াত- ৩৫)
অর্থাৎ কুরআনের কাংক্ষিত মানুষ এ বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনের পদক্ষেপ নেবে যাতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্বের সকল দিকে আল্লাহর দাসত্বের প্রতিফলন ঘটাবে। সে শুধু আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেই নয়; বরং তার সকল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এ দাসত্বের ছাপ রাখবে। তার দায়িত্ববোধের দিকটি সময়, ক্ষেত্র, স্থান, সুযোগ, আশংকা, ভয় ও আশা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় চিন্তাধারার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। তার কর্মকাণ্ড ঐশী উদ্দেশ্য, চিন্তা, জ্ঞান ও খোদাভীতিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হবে- অন্য কিছুকে কেন্দ্র করে নয়। অবশ্য সে কর্ম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ামক ও প্রতিবন্ধকতাকে যথাযথ পর্যালোচনা করে অর্থাৎ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার সর্বোত্তম নীতি অনুসরণ করে। একদিকে মিশনের প্রচার ও এর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে সে ঐশী উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করে ও শুধু তাঁকেই ভয় করে বিধায় নিষ্ঠার সাথে তা সম্পাদন করে, অন্যদিকে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, ধৈর্য ও দূরদৃষ্টি, জ্ঞান ও উদারতার পরিচয় দেয়। তাই কুরআনের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত মানুষ কখনই চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা ও সঠিক ধারণা লাভ ব্যতীত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। তার ঐশী মিশন বাস্তবায়নের পথে পরিচালিত সংগ্রাম ও হিজরতসহ সকল কাজ বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাগত বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে এ কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন :
قُلْ هٰذِه سَبِيْلِيْ أَدُعُوْا إِلى اللهِ عَلى بَصِيْرَةٍ أَنَا وَ مَنِ اتَّبَعَنِيْ
তুমি বল, এটিই আমার পথ, আমি আল্লাহর দিকে আহবান করি নিশ্চিত জ্ঞানের ওপর (অবিচল) থেকে, আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করে তারাও। (সূরা ইউসুফ: আয়াত-১০৮)
যে ব্যক্তি কুরআনের আলোকে নিজের জীবন গড়তে চায়, পবিত্র কুরআন তার জন্য উত্তম আদর্শ ও পরিপূর্ণ নমুনা উপস্থাপন করেছে। আর সেই আদর্শ ও নমুনা হলেন আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.), যিনি তাঁর সমগ্র জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে দায়িত্ববোধ ভিন্ন কোন চিন্তা করেননি। তিনি তাঁর নবুওয়াত-পূর্ব কৈশোর ও যৌবনে যেমন এ বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখতেন, তেমনি তাঁর নবুওয়াত-পরবর্তী প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যের জীবনে মক্কা ও মদীনা উভয় স্থানে অবস্থানকালে পরিচালিত শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, শাসন পরিচালনা, জিহাদ, হিজরতসহ সকল কর্মে কেবল তাঁর মিশনের দায়িত্ব নিয়েই চিন্তা করেছেন। তাই মহান আল্লাহ্ এ সকল ক্ষেত্রেই তাঁকে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করে বলেছেন :
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُوْا اللهَ وَ الْيَوْمَ الْآخِرَ وَ ذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا
‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উৎকৃষ্ট আদর্শ রয়েছে, তার জন্য যে আল্লাহ ও পরকালে আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে।’(সূরা আহযাব: আয়াত-২১)
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের পর তাঁর পবিত্র আহলে বাইত এ মিশনের প্রচার, আল্লাহর দীনের প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় মূল্যবোধসমূহ রক্ষা, ঐশী বিধিবিধানের বাস্তবায়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় প্রশিক্ষণ দানের ক্ষেত্রে স্থান ও সময়ের দাবি অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের বিষয়েই শুধু চিন্তা করেছেন। হযরত আলী (আ.) তাঁর পবিত্র জীবনে এ পথে অনেক চড়াই-উৎড়াই পাড়ি দিয়েছেন ও অসংখ্য প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেছেন। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনসহ অন্যান্য ইমামও ইসলামি সমাজ ও ব্যক্তিবর্গের যোগ্যতা, জ্ঞান, ধারণক্ষমতা বিবেচনা করে সময়োপযোগী দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ইসলাম ও মানবতার দাবি অনুযায়ী স্বীয় কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন।
যেহেতু ইসলামের শক্তিশালী তাত্ত্বিক ভিত্তি রয়েছে, সে সাথে রয়েছে ব্যবহারিক ও কর্মগত বাস্তব নমুনা ও আদর্শ সেহেতু যে কেউ এ তত্ত্বের ওপর নির্ভর করবে এবং ঐ সকল আদর্শকে অনুসরণ করবে সে তার মিশনে সফল হবে। এ নিশ্চয়তা আল্লাহ্ এভাবে দিয়েছেন :
وَ الَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَ إِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ
‘এবং যারা আমাদের জন্য (ও পথে) চেষ্টা-সাধনা করে নিশ্চয়ই আমরা তাদের আমাদের পথসমূহ প্রদর্শন করব। এবং নিশ্চয় আল্লাহ্ উত্তম কর্ম সম্পাদনকারীদের সঙ্গে রয়েছেন।’(সূরা আনকাবুত: আয়াত-৬৯)
সুতরাং কুরআনে চিত্রিত মানুষ শুধুই তার মিশন বাস্তবায়ন করা ও তার দয়িত্ব সম্পাদনের চিন্তায় থাকে এবং ইসলামের সামগ্রিক দায়িত্ববোধের তাড়নায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও জীবন নির্বাহের দায়িত্ব পালন করে। তবে এ ক্ষেত্রে নৈতিকতা, প্রজ্ঞা, আধ্যাত্মিকতা, শরীয়তের বিধিবিধান ইত্যাদি বিষয়কে বুদ্ধিমত্তা, সচেতনতা ও দূরদৃষ্টির সাথে যথাযথভাবে কাজে লাগায় এবং দৃঢ়তার সাথে তার জীবনের সকল পর্যায়ে তার প্রতিফলন ঘটায়। এভাবে সে কুরআনের এ আয়াতের দৃষ্টান্ত হয়- ‘সুতরাং তুমি এবং ঐ সকল লোক যারা তোমার সঙ্গে (আল্লাহর দিকে) প্রত্যাবর্তন করছে, যেভাবে তোমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেভাবে (সরল-সুদৃঢ় পথে) অটল থাক’।
তাই কুরআনভিত্তিক যে বিশ্বদৃষ্টি ও মানব-পরিচিতি মানুষ লাভ করে সেটিই তার ধার্মিকতার জ্ঞান ও জ্ঞানভিত্তিক ধর্মীয় জীবনের ভিত্তি ও মানদণ্ড বিবেচিত হয় যা তাকে কোন স্থান ও সময়েই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দান করে না। এ দায়িত্বের প্রকৃতি জ্ঞানগত বা উপাসনাগত, অথবা ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক হোক, কোন অবস্থাতেই সে দায়িত্বমুক্ত নয়। যেহেতু কুরআনের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত মানুষ তার ও বিশ্বের সৃষ্টি সত্য ও সুন্দরের ভিত্তিতে হয়েছে বলে জানে, সেহেতু তার পরিশুদ্ধি ও বিকাশের বিষয়টিকে স্বীয় দায়িত্ব পালনের ওপর নির্ভরশীল জ্ঞান করে। আর তাই সে তার সঙ্গে তার সত্তা, তার স্রষ্টা, তার স্বজাতি ও তার সঙ্গে বিশ্বের যে সম্পর্ক রয়েছে তার সংস্কার ও পরিপূর্ণতা দানের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। এরূপ প্রচেষ্টা চালানোর জন্য আল্লাহ যেমন তাঁর নবীদের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন, (সূরা আহযাব: আয়াত-৭) তেমনি নবীদের উত্তরাধিকারী আলেমদের থেকেও অনুরূপ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। (নাহজুল বালাগাহ, খুতবা ৩) এ প্রতিশ্রুতির পরিধি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিকসহ সকল কর্মকাণ্ডকে বেষ্টন করে আছে। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.) তাঁর সহযোগীদের নিয়ে আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর বান্দাদের অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোয় এনেছেন ও তাদেরকে পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্তি দান করেছেন।
কুরআনে বর্ণিত আদর্শ মানুষ সকল অবস্থায় তাদের সার্বিক দায়িত্ব পালন করে ও স্বীয় অঙ্গীকার রক্ষায় সচেতনতার সামাজিক উপাদানগুলোকে ব্যবহার করে সময়োপযোগী ভূমিকা রাখেন।
যেহেতু দায়িত্বজ্ঞান ও দায়িত্ব পালনের উদ্দীপনা, যোগ্যতা, উপযোগিতা, সম্ভাবনা, কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হয় এবং অবস্থানগত কারণেও পার্থক্যের সৃষ্টি হয়, সেহেতু কুরআনকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণকারী মানুষ এ উপাদানগুলো সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। অর্থাৎ একদিকে তার ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে অবহিতি, অন্যদিকে তার সমাজ সচেতনতা, যুগ সচেতনতা এবং ক্ষেত্রগত পার্থক্য সম্পর্কে অবহিতি তার দায়িত্বের প্রকৃতি, পদ্ধতি ও প্রয়োগনীতির নির্ধারক এবং এ ক্ষেত্রে সে নিজেকে সকল সময় ঐশী সাহায্য ও সহযোগিতার মুখাপেক্ষী বলে জানে।#
অনুবাদ : এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর:
(চলবে)