সূরা নাহল;(২৩তম পর্ব)
সূরা নাহল; আয়াত ৯৭-১০০
সূরা নাহলের ৯৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“পুরুষ ও নারী যে কেউ সৎ কাজ করবে এবং ঈমান আনবে,অবশ্যই তাকে আমি নতুন জীবন দান করব,যে জীবন হবে ভাল ও পবিত্র এবং তাদের কাজ অনুযায়ী তাদের আমি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।” (১৬:৯৭)
এটি কুরআনের ছোট একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। এতে দুনিয়া ও আখিরাতে মুমিনদের কি অবস্থা হবে তা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে: ঈমানের ভিত্তিতে আল্লাহর কাছে মানুষের মূল্যায়ন হয়, এখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয় না। মুমিন নারী ও পুরুষ আল্লাহর কাছে সমান মর্যাদার অধিকারি, এখানে লিঙ্গভেদে কোনো বৈষম্য করা হয় না। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, সব নবী-রাসূল কেনো পুরুষ ছিলেন এবং কোনো নারীকে কেন নবী হিসেবে পাঠানো হয়নি। এর উত্তরে বলা যায়, সর্বসাধারণের মধ্যে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেয়ার কঠিন দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ পৃথিবীতে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। কষ্টসহিষ্ণু এ কাজটি মহিলাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলে এ দায়িত্ব পুরুষদের উপর অর্পণ করা হয়েছে। অবশ্য আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছার জন্য নারীর সামনে কোন প্রতিবন্ধকতা রাখা হয়নি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হযরত মরিয়ম ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর এতবেশি কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত থেকে খাবার পাঠাতেন। এ ছাড়া, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) এতবেশি আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছেছিলেন যে, তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর সমমর্যাদা অর্জন করেছিলেন। অবশ্য ঈমানদার হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং পূর্ণতায় পৌঁছার জন্য নেক আমল ও উপযুক্ত সৎকর্ম জরুরী। সৎকর্ম কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পাদিত যে কোনো কাজ ছোট হলেও তা সৎকর্ম বলে গণ্য হবে।
এ আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, মুমিন ও সৎ ব্যক্তিরা এ পৃথিবীতে পবিত্র জীবন-যাপন করবেন। আল্লাহ তাদেরকে নোংরামি ও অশ্লীলতা হতে দূরে থাকতে সাহায্য করবেন। আখেরাতেও আল্লাহতায়ালা তার দয়া ও ভালবাসার মাধ্যমে তাদেরকে প্রাপ্য অধিকারের চেয়েও অনেক বেশি তাদেরকে দান করবেন। কারণ, আল্লাহতায়ালা শাস্তি দেয়ার সময় ইনসাফের ভিত্তিতে অর্থাত বান্দার মন্দ কাজের সমপরিমাণ শাস্তি দেবেন। কিন্তু পুরস্কার দেয়ার সময় সৎকাজের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ উপকরণ দান করবেন। এ আয়াতে এই ঐশী নিয়মের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
এক. আল্লাহর কাছে বয়স, নারী-পুরুষ, বংশমর্যাদা, জ্ঞান ও ব্যক্তির সামাজিক প্রতিপত্তির কোনো গুরুত্ব নেই। শুধুমাত্র ঈমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বান্দার মর্যাদা নির্ধারিত হয়।
দুই. কাফের ব্যক্তি দুনিয়ায় পবিত্র জীবন থেকে বঞ্চিত, পৃথিবীতে তার জীবনযাপন অনেকটা মৃত ব্যক্তির মতো হয়ে থাকে।
সূরা নাহলের ৯৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآَنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
“যখন কুরআন পাঠ করবে, অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে। (১৬:৯৮)
যদিও এ আয়াতে আল্লাহ সরাসরি বিশ্বনবী (সা.)-এর উদ্দেশ্য কথা বলছেন, কিন্তু তারপরও এটা স্পষ্ট যে সব মুমিনকে লক্ষ্য করে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনুযায়ী বিশ্বনবী (সা.)কে উদ্দেশ করে এ আয়াত নাযিল হয়েছে।
বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.) যখন কুরআন তেলাওয়াত করতেন, সেটি নামাজেই হোক বা অন্য কোনো সময়ে হোক, তার আগে ‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম’ বলতেন।
সৎকাজের মাধ্যমেও মানুষ অনেক সময় অধঃপতনের শিকার হতে পারে। যেমন কুরআন তেলাওয়াত সৎকাজ হলেও অনেক সময় লোক দেখানোর জন্য বা নিজেকে জাহির করার জন্য এ কাজ করে থাকে। আবার অনেকে পবিত্র কুরআন নিয়ে নেতিবাচক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় বা ভুল বুঝে কুরআনের মনগড়া তাফসির করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কুরআন তেলাওয়াত করার সময় সব ধরনের অশুভ কাজ হতে দূরে থাকার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে। কারণ, কুপ্রবৃত্তি ও হিংসা মানুষের কুরআন পাঠের আধ্যাত্মিক ফায়দা হাসিলের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
এক. মহাগ্রন্থ আল-কুরআন তেলাওয়াতের মতো পবিত্রতম কাজ করার সময়ও শয়তানের ধোঁকায় পড়ার ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।
দুই. শয়তানের ধোঁকা থেকে মুক্ত থাকার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
সূরা নাহলের ৯৯ ও ১০০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ (99) إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ وَالَّذِينَ هُمْ بِهِ مُشْرِكُونَ (100(
“যারা ঈমান আনে ও তাদের সৃষ্টিকর্তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে,তাদের ওপর শয়তানের কোন কর্তৃত্ব নেই।” (১৬:৯৯)
“শয়তানের কর্তৃত্ব তো শুধু তাদেরই ওপরই (কাজ করে) যারা তাকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে এবং আল্লাহর সঙ্গে (অন্য কাউকে) শরীক করে।” (১৬:১০০)
আগের আয়াতে শয়তানের ধোঁকা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়ার পর এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন: শয়তান মুমিনের অন্তরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেও যে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তার আশ্রয় কামনা করে, আল্লাহ তাকে শয়তানের ধোঁকা থেকে রক্ষা করেন।
আল্লাহ এ আয়াতে আরো বলেন: সাধারণত যারা শিরক বা কুফরি করে শয়তান তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। আর যদি কোনো মুসলমান শয়তানের কথায় কাজ করে তাহলে শয়তান তার অন্তরে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়। অন্যভাবে বলা যায়, এ ব্যক্তি শয়তানকে নিজের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেছে। কারণ, আল্লাহ কখনোই শয়তানকে মুমিনের অন্তরে প্রভাব বিস্তারের অনুমতি দেননি।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
এক.শয়তান মানুষের উপর অধিপত্য বিস্তার করতে পারে না, বরং মানুষই শয়তানের কথায় চলে নিজের অন্তরে শয়তানের প্রবেশের পথ সৃষ্টি করে।
দুই. সত্যিকারের মুমিন কখনও শয়তানের ধোঁকায় পড়ে না। কারণ, মুমিনের ঈমান, শক্ত ঢাল হিসেবে তাকে শয়তানের সব রকম অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে।