সূরা নাহল;(২৭তম পর্ব)
সূরা নাহল; আয়াত ১১২-১১৫
সূরা নাহলের ১১২ ও ১১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آَمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ (112) وَلَقَدْ جَاءَهُمْ رَسُولٌ مِنْهُمْ فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَهُمُ الْعَذَابُ وَهُمْ ظَالِمُونَ (113(
আল্লাহ (উপদেশের মাধ্যমে শিক্ষা দেয়ার জন্য) উদাহরণ দিচ্ছেন একটি জনপদের, (যার অধিবাসীরা) ছিল পুরোপুরি নিরাপদ, প্রশান্ত ও নিশ্চিন্ত। সেখানে সব দিক থেকে সহজেই তাদের জন্য আসত প্রচুর জীবিকা। এরপর তারা আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। ফলে তারা যা করত সে কারণে আল্লাহ শাস্তি হিসেবে তাদের স্বাদ আস্বাদন করালেন, ক্ষুধা ও ভীতির।” (১৬:১১২)
“এবং নিঃসন্দেহে তাদেরই মধ্য থেকে এক রাসূল তাদের কাছে এসেছিল (তাদেরকে সুপথ দেখানোর জন্য), কিন্তু তারা তাকে মিথ্য প্রতিপন্ন করল। ফলে শাস্তি তাদের আক্রান্ত করল এ অবস্থায় যে তারা অবিচার করেছিল।” (১৬:১১৩)
মহান আল্লাহ, সূরা নাহলে তাঁর নানা নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন। এ সূরার শেষে দিকের এই দু'টি আয়াতে নেয়ামত-সমৃদ্ধ একটি জনপদের কথাও উল্লেখ করেছেন। বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক- এ উভয় ধরনের নেয়ামতেরই প্রাচুর্য ছিল সেখানকার অধিবাসীদের জন্য। যেমন- শক্রদের হামলার কোনো ভয় তাদের জন্য ছিল না। প্রশান্ত ছিল তাদের জীবন। প্রচুর খাদ্য ও জীবিকা দেয়ার পাশাপাশি মহান আল্লাহ তাদেরকে সুপথ দেখানো বা হেদায়েতের জন্য একজন নবীও পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাদের দেখিয়ে দিতেন কোন পথটি সঠিক ও কোন পথটি ভুল বা মিথ্যার পথ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আল্লাহর নেয়ামতের ব্যাপারে অকৃতজ্ঞতা দেখায়। তারা সত পথে সম্পদ ও নেয়ামতগুলো ব্যবহার না করে পাপের পথে সেগুলো ব্যবহার করতে লাগল। ফলে তাদের ওপর নেমে আসে আল্লাহর শাস্তি। সেইসব নেয়ামত উঠিয়ে নেয়া হয় এবং ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের শিকার হয় তারা।
এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার :
এক. জাতিগুলোর ভাগ্য ও ইতিহাস খোদায়ী কিছু রীতি বা সূত্র মেনে চলে। এইসব সূত্র সব যুগেই একই রকম। তাই অতীতের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর দেখানো পথে জীবন পরিচালনা করা উচিত।
দুই. খোদায়ী নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতার জন্য এই দুনিয়োতেই শাস্তি দেয়া হয় এবং অকৃতজ্ঞদেরকে খোদায়ী নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করা হয়।
তিন. খোদায়ী শিক্ষাগুলোকে উপেক্ষা করার ফলেই দারিদ্র ও নিরাপত্তাহীনতার মত সংকট দেখা দেয়।
সূরা নাহলের ১১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَكُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ حَلَالًا طَيِّبًا وَاشْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
“অতএব, আল্লাহ তোমাদেরকে যেসব হালাল ও পবিত্র বস্তু দিয়েছেন, তা তোমরা খাও এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর যদি তোমরা তাঁরই এবাদাতকারী হয়ে থাক।” (১৬:১১৪)
এ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতার পরিণতি যে কত মন্দ তা তোমরা এইসব ঘটনা থেকে মনে রাখ। তোমরা খোদায়ী নেয়ামতগুলো সঠিক পথে ব্যবহার কর। প্রথমত তিনি মদ ও শুকরের মাংসের মত যেসব খাদ্য তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন সেগুলো থেকে দূরে থাক এবং অন্যদের সম্পদ দখল করা থেকে বিরত থাক। দ্বিতীয়ত নেয়ামতগুলোর জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ইবাদত-বন্দেগী কর, অন্যদের দান কর। বিশেষ করে আল্লাহ যে সম্পদ তোমাকে দান করেছেন তা থেকে দরিদ্রদের দান কর।
এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:
এক. ইসলাম মানুষের সব দিকের চাহিদা মেটায় ও সব ক্ষেত্রেই পথ দেখায়। এ ধর্ম শুধু পরকালকেন্দ্রীক ধর্ম নয়। কোন কোন জিনিস খাওয়া যাবে বা যাবে না তাও ঠিক করে দিয়েছে ইসলাম।
দুই. শুধু জিহ্বার বিলাস বা রসনা বিলাসের জন্যই খাওয়া উচিত নয়। বরং খাদ সামগ্রী দেয়া হয়েছে দায়িত্ব পালনের শক্তি অর্জনের জন্য। আল্লাহর দেয়া খাদ্যের ব্যাপারে শুকরিয়া প্রকাশের জন্যই আমাদের উচিত এমন কিছু না খাওয়া বা এমন পরিমাণে না খাওয়া যা দেহের বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়।
সূরা নাহলের ১১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের জন্যে খাওয়া হারাম করেছেন কেবল মৃত প্রাণীর (গোশত), রক্ত, শুকরের মাংস এবং সেইসব পশু-পাখী যা জবাই কালে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারণ করা হয়েছে। তবে কেউ যদি সীমালঙ্ঘনকারী না হয়ে নিরুপায় হয়ে পড়ে এসব খায় তবে, আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল ও অনন্ত করুণাময়।” (১৬:১১৫)
মানুষের মধ্যে কেউ কেউ কেবল শাক-সবজি খেয়ে থাকেন। আবার অনেকে এত বেশি আমিষপ্রিয় যে, তারা সাপ ও কুমিরের মাংসও খেয়ে থাকেন। ইসলাম এই উভয় গ্রুপকেই তিরস্কার করে। কুরআনে আল্লাহ এ ব্যাপারে যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন তাই ভারসাম্যপূর্ণ। কুরআন মানুষের প্রকৃতিগত চাহিদার আলোকে বলছে, গোশত খাও, তবে সব জন্ত্তুর গোশত ও জবাইবিহীন মৃত পশুর গোশত খাবে না, কারণ এ ধরনের পশুর রক্ত শরীরে থেকে যায়। এছাড়াও সেইসব পশু-পাখী যা জবাই কালে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারণ করা হয়েছে এবং কাফের মুশুরিকদের হাতে জবাই করা হয়েছে সেগুলোও খাবে না।
অবশ্য পবিত্র কুরআনের অন্য সূরার মধ্যেও এ ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। হালাল ও হারাম খাদ্য বা জন্তুর ব্যাপারে ইসলামের বিধান এসেছে সেইসব আয়াতে। আর এইসব বিধান মেনে চলা একজন মুসলমানের জন্য ফরয। অবশ্য এটাও বলা হয়েছে যে, কেউ যদি তীব্র অভাব ও ক্ষুধার কারণে এ ধরনের নিষিদ্ধ খাদ্য খায় তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন, তবে শর্ত হল- প্রয়োজনের বেশি খেতে পারবে না।
এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:
এক. ইসলাম কোনো কোনো খাদ্য বর্জন করতে বলেছে কেবল স্বাস্থ্যগত কারণেই নয়, শিরকের মত অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখাও এর অন্যতম প্রধান কারণ। একজন মুসলমানের খাওয়া- দাওয়াও তৌহিদ কেন্দ্রিক হওয়া উচিত।
দুই. ইসলামে কোনো অচলাবস্থা নেই। ইসলাম জরুরি অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ করাকে পাপ হিসেবে ধরে নেয় না এবং এ ধরনের আচরণকেও ক্ষমা করে।