সূরা নাহল;(৩০তম পর্ব)
সূরা নাহল; আয়াত ১২০-১২৪
সূরা নাহলের ১২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
“(হে রাসূল! মানুষকে) আপনার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান করুন প্রজ্ঞা (পূর্ণ কৌশল) ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের (বিরোধীদের) সাথে এমন পন্থায় বিতর্ক করুন যা সবচেয়ে ভাল। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং যারা সঠিক পথে আছে তাদের সম্পর্কেও তিনিই সমধিক জ্ঞাত।” (১৬:১২৫)
এই আয়াতসহ সূরা নাহলের সবচেয়ে শেষের দিকের কয়েকটি আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)সহ প্রত্যেক মুসলিম প্রশিক্ষক ও বিশেষজ্ঞকে সত্যের প্রচার বা দাওয়াতের সর্বোত্তম পন্থাগুলো ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন মহান আল্লাহ। কারণ, সব মানুষকে একইভাবে দাওয়াত দেয়া যায় না। যোগাযোগ করতে হবে প্রত্যেকের জ্ঞানগত অবস্থান, ভাষা, যোগ্যতা ও মেধার আলোকে। পণ্ডিত ও শিক্ষিতদের কাছে তুলে ধরতে হবে যুক্তি-প্রমাণ, সাধারণ মানুষকে দিতে হবে সর্বোত্তম উপদেশ বা সতর্কবাণী, গোঁড়া ও তর্কপ্রিয় মানুষের সঙ্গে বসতে হবে দ্বিপাক্ষিক সংলাপ বা বিতর্কে। আর যোগাযোগের এই সব পদ্ধতিই হতে হবে ফলপ্রসূ, দায়সারা গোছের নয়।
যোগাযোগ বা প্রচারের প্রজ্ঞাপূর্ণ পদ্ধতি সব সময়ই কল্যাণকর ও গ্রহণযোগ্য। কারণ, বুদ্ধিমান ও বিবেকবান সব মানুষই বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি-প্রমাণকে মেনে নেন। তাই যে কোনো সংলাপ ও বুদ্ধিবৃত্তিক মত-বিনিময়ের ভিত্তি হল এ ধরণের যুক্তি-প্রমাণ। কিন্তু সতর্ক করা ও বিতর্ক করা অনেক সময় ভালও হয় আবার মন্দও হতে পারে। তাই সতর্ক করার ক্ষেত্রে উত্তম উপদেশ বা সদুপদেশ এবং তর্ক করার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা ব্যবহারের কথা বলেছেন মহান আল্লাহ। অনেক সময় উপদেশ দিতে গিয়ে বা সতর্ক করতে গিয়ে আমরা অন্যকে অপমান করি বা নিজেকে বড় বলে জাহির করি। তাই এ ধরনের উপদেশ বুমেরাং হয়। অর্থাত উপদেশদাতার প্রতি ঘৃণা বা ক্ষোভ জন্ম নেয়।
মুসলমানের বিতর্কের পন্থা হওয়া উচিত প্রতিপক্ষের চেয়ে উত্তম এবং সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক। সংলাপে প্রতিপক্ষকে মিথ্যা বলা, ধোঁকা দেয়া, উপহাস করা, অবমাননা করা, হুমকি দেয়া বা চিতকার করে কথা বলা ইসলামে অনুমোদিত নয়। কারণ, কারণ ইসলাম প্রচারকের লক্ষ্য হল সত্য প্রচার করা ও প্রতিপক্ষকে আকৃষ্ট করা। দ্বন্দ্ব, বিরোধিতা বা একগুঁয়েমি প্রদর্শন প্রচারকের লক্ষ্য নয়।
এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. টার্গেটভুক্ত শ্রোতা বা দর্শকের কাছে সত্য ধর্ম প্রচারের জন্য কার্যকর নানা ভাষা ও পন্থা ব্যবহার করা উচিত যাতে তারা প্রভাবিত হন।
দুই. জনগণকে মহান আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট করার আহ্বানে বুদ্ধিবৃত্তি ও কোমল আবেগ-অনুভূতি উভয়ই ব্যবহার করা উচিত যাতে ওই আহ্বান অপেক্ষাকৃত বেশি স্থায়ী এবং ফলপ্রসূ হয়।
সূরা নাহলের ১২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ
“আর যদি তোমরা অত্যাচারীদের শাস্তি দাও, তবে ঐ পরিমাণ শাস্তি দেবে, যে পরিমাণ জুলুম সে তোমাদের ওপর করেছে। আর যদি তোমরা (তাদের মোকাবেলায়) ধৈর্য ধর, তবে তা অবশ্যই সবরকারীদের জন্যে উত্তম।” (১৬:১২৬)
আগের আয়াতে বিরোধীদের সঙ্গে সুন্দর ও শোভনীয় পন্থায় বিতর্কের পরামর্শ দেয়ার পর এই আয়াতে মহান আল্লাহ মুসলমানদের বলছেন, প্রতিপক্ষ যদি তোমাদের ওপর জুলুম করে বসে বা হামলা চালায় তাহলে সমানুপাতে বা সমান মাত্রায় তাকে শাস্তি দাও। কিন্তু যদি তাদের শাস্তি না দিয়ে ধৈর্য ধারণ কর তাহলে তা তোমাদের জন্যই কল্যাণকর।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র চাচা হযরত হামজা (রা.) ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর তাঁর হত্যাকারী ‘ওয়াহশি’ (আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার গোলাম হিন্দার নির্দেশে) এই মহান শহীদের শরীর বিদীর্ণ করেছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা হযরত হামজা (রা.)’র লাশ থেকে তাঁর কলিজা বের করে তা হিংস্র পশুর মত চিবিয়েছিল। রাসূল (সা.) বলেছিলেন, আমি যদি ওয়াহশিকে পাই তাহলে তার শরীরও বিদীর্ণ করব। কিন্তু এই আয়াত নাজেল হওয়ায় রাসূল (সা.) তাঁর ওই সিদ্ধান্ত পরিহার করেন। তিনি বলেছিলেন: আমি বরং ধৈর্য ধরব ও তাকে ক্ষমা করব।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. শত্রুর সঙ্গেও আচার-আচরণে ন্যায়-বিচার বজায় রাখা জরুরি।
দুই. প্রতিশোধ নয়, বরং ক্ষমার মধ্যেই রয়েছে আনন্দ। বিরোধীদের মোকাবেলায় কেবল আইনের প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, নৈতিকতা বজায় রাখাও জরুরি।
সূরা নাহলের ১২৭ ও ১২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَاصْبِرْ وَمَا صَبْرُكَ إِلَّا بِاللَّهِ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَلَا تَكُ فِي ضَيْقٍ مِمَّا يَمْكُرُونَ (127) إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُحْسِنُونَ (128
“(হে নবী!) আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। অবশ্য আপনার ধৈর্য ধারণ তো কেবল আল্লাহর সাহায্যেই সম্ভব হয়, আপনি তাদের জন্যে দুঃখ করবেন না এবং তাদের প্রতারণার কারণে দুঃখিত হবেন না।” (১৬:১২৭)
“নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা আত্মসংযমী বা পরহিজগার এবং যারা সৎকর্ম করেন।” (১৬:১২৮)
এটা স্পষ্ট কোনো কোনো ব্যক্তি নবী-রাসূলদের মত পবিত্রতম ও একনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মুখ থেকে সত্যের বাণী শোনার পরও কেবল গোঁড়া স্বভাবের কারণেই সত্যকে মেনে নেয় না ও দায়িত্ব এড়িয়ে চলে। তাই এ আয়াতে মহান আল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন: আপনি মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য অনেক কষ্ট করা সত্ত্বেও অনেকে আপনার সত্য বাণীকে বা সত্যের দাওয়াতকে কবুল করছে না, শুধু তাই নয়, অনেকে আপনার বিরোধিতায়ও নেমেছে। তারা আপনাকে অপবাদ দিচ্ছে, ঠাট্টা-মস্করা করছে, হুমকি দিচ্ছে, নির্যাতন করছে এবং এমনকি যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডও ঘটাচ্ছে যাতে শেষ ঐশী ধর্ম ইসলাম বিলুপ্ত হয়। কিন্তু আপনি দুঃখিত হবেন না। বরং দৃঢ়চেতা তথা ধৈর্যশীল থাকুন। কারণ, আল্লাহ খোদাভীরুদের সাহায্যকারী। তিনি খোদাভীরু বা আত্মসংযমীদের কখনও অসহায় অবস্থায় রাখবেন না।
এ দুই আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার-
এক. ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজে ও মানুষকে সুপথ দেখানোর মিশনে ধৈর্যশীল হতে হবে এবং অনেক বাধা ও প্রতিকূলতা সহ্য করতে হবে।
দুই. আল্লাহর ওপর ভরসা করা এবং আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্যের প্রতি ঈমান রাখা জরুরি যাতে শত্রুর মোকাবেলায় চিত্ত প্রশস্ত থাকে ও হতাশা বা অচলাবস্থার শিকার হতে না হয়।
(সূরা নামল সমাপ্ত)