মুসলিম সমাজে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত (২য় পর্ব)
অন্যের ভুল-ভ্রান্তিকে উপেক্ষা করা ও ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা মানুষের একটা বিশেষ গুন যা জন্তুদের নেই। কেউ যদি অন্যের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেয়াই হলো মহত্বের লক্ষণ। ক্ষমার আনন্দানুভূতি উপভোগ করার মধ্যে যে আত্মিক প্রশান্তি থাকে, তা এক কথায় অলৌকিক। কিন্তু তারপরও মানুষ হিংসুক হয়, পরশ্রীকাতর হয়, প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়। এই পাশবিক গুনটি যেন আমাদের ভেতরে বাসা না বাঁধে, সে ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া উচিত। হিংসা এবং পরশ্রীকাতরতা থেকে মানুষ নিন্দুক হয়ে ওঠে। গীবত চর্চা করে তারা অন্যের ক্ষতি করতে উদ্যত হয়। কোন পরিবারে যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মধুর সম্পর্ক থাকে, নিন্দুকেরা তাদের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে তৎপর হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে নিন্দুকেরা এমন সব গুজব ছড়ায়, যা থেকে রেহাই পেতে হলে প্রয়োজন ঠাণ্ডা মাথায় সংবেদনশীল মন নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মাঝে বিষয়টি আলোচনা করা। জিজ্ঞাসাবাদ নয় বরং সত্য আবিস্কারের ব্যাপারে উভয়কে আন্তরিক হওয়া উচিত । কোন রকম রূঢ় মনোভঙ্গী এ ক্ষেত্রে বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে ।
আমি আমার স্বামী, শ্বাশুড়ী ও ননদসহ একত্রে থাকি। প্রথম প্রথম স্বামীর সাথে ভালোই কেটেছে আমার। একটা মধুর দাম্পত্য জীবন আমরা কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের এই সুখ কারো কারো অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যে আমার স্বামীর কাছে আমাকে অপ্রিয় করে তোলার জন্য আমার সম্পর্কে নানা রকম গুজব স্বামীর কানে দেয়া হয়। সেসব গুজব এমন লোকদের কাছ থেকে শোনানো হয় যে স্বামীর পক্ষে তা অবিশ্বাস করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্নকারী জানতে চাইলো-কী ধরণের গুজব একটু বলবেন ? ভদ্র মহিলা বললেন, আমার শ্বাশুড়ী চব্বিশটা ঘন্টাই আমার খুঁত ধরতে ওঁৎ পেতে থাকে। নানা ছলছুতায় আমার সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতে চায়। স্বভাবে এমনিতেই তিনি ভীষণ বদমেজাজী। আমার সাথে ঝগড়া করতে না পারলে আমার ব্যাপারে উল্টো-পাল্টা কথা বলে স্বামীর সাথে আমার ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতে চেষ্টা করে। সেদিন আমি কেনাকাটা করে বাসায় ফিরছিলাম। রাস্তায় ভীষণ জ্যাম ছিল। বাসায় ফেরার পর শ্বাশুড়ী আমাকে জেরা শুরু করে দিলেন। কেন দেরী হলো, কোথায় গেছো, কার সাথে পিরিতি করে বেড়াও? ইত্যাদি সব বাজে কথা।
আমাদের সমাজে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা মানবতাকে স্তব্ধ করে দেয়। ধরা যাক এরকম একটি চিত্র: দেখা গেল-একটা ঘরে হঠাৎ আগুন, সাথে চীৎকার চেঁচামেচি। পাড়া-প্রতিবেশীরা ঐ চীৎকার শুনে এগিয়ে এলো। যেই রুমের ভেতরে আগুন, সেরুমের দরজা খুলে ভেতরে দেখলো ঐ বাসার সুন্দরী বধূটির গায়ে আগুন জ্বলছে। তাড়াহুড়া করে আগুন নিভিয়ে বধূটিকে নিয়ে গেল মেডিকেলে। সৌভাগ্যবশত: বধূটি প্রাণে বেঁচে গেল। সুস্থ হবার পর গৃহবধূটিকে বাসায় যেতে বললে সে বললো, বাসায় যাবো না। প্রশ্ন করা হলো কেন যাবেন না? ভদ্র মহিলা বললো, ঐ বাসায় যাতে থাকতে না হয় সেজন্যেই তো মরতে চেয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করা হলো কেন থাকতে চান না ঐ বাসায়? জবাবে বধূটি বললো, সে অনেক কথা। প্রশ্নকারী আবার বললো, বলুন! আমরা শুনবো। তারপর ভদ্রমহিলা বলতে শুরু করলেন। অবশেষে আমার স্বামী যখন বাসায় ফিরলেন, শ্বাশুড়ী কান্নাকাটি করে তার ছেলেকে সব ঘটনা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলার পর বললো, কোন মাংস বিক্রেতার সাথে নাকি আমার বাজে সম্পর্ক আছে। একথা শুনে আমার স্বামী স্বাভাবিকভাবেই রেগে গেলেন। আমিও রাগে-দুঃখে ভেঙ্গে পড়লাম। আমি নিজেকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করলাম। এই বলে বধূটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
যে ঘটনাটি এতোক্ষণ আমরা শুনলাম, এধরনের ঘটনা কারোরই কাম্য নয়। এধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে পারিবারিক কাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বে। পরিবারের ভাঙ্গন রোধ করার জন্য তাই সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করতে হবে। এই ঘটনাটিতে একদিকে রয়েছে মা-বোন, অন্যদিকে স্ত্রী। উভয়ের প্রতিই স্বামী পুরুষটির দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বামী পুরুষটিকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে অগ্রসর হতে হবে। কোন রকম বোকামীর পরিচয় দিলেই সমূহ বিপদের আশঙ্কা দেখা দেবে। যে ঘটনাটি আমরা একটু আগে জানলাম, এধরনের ঘটনা অনেক পরিবারেই অহরহ ঘটছে। এর যে কী সমাধান তা অনেকেই ভেবে কুল পান না। অথচ ইসলাম এসব ব্যাপারে চমৎকার সমাধান দিয়েছে। এবারে সে সম্পর্কেই আলোচনা করা যাক।
প্রতিটি ছেলেই বিয়ের আগে বাবা মায়ের আশ্রয়ে বড় হয়ে ওঠে। ছোট বেলা থেকেই সন্তানেরা বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকে। বাবা-মা যেহেতু ছেলেকে লালন-পালন করে বড়ো করে তোলেন, সেহেতু তারা স্বাভাবিকভাবেই আশা করেন যে, বড়ো হয়ে ছেলে তাদের দেখাশোনা করবে। কিন্তু বিয়ে করার পর বাবা-মা যখন দেখেন যে, ছেলে তার নতুন সংসার তথা স্ত্রীর প্রতিই বেশী যত্নশীল হয়ে পড়ছে, তখন বাবা-মা কষ্ট পান। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে তারা আপাতত দৃষ্টিতে স্বাধীন করে দিলেও মনে মনে ঠিকই প্রত্যাশা করেন যে, ছেলে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাবে। কিন্তু বাস্তবে তা না দেখতে পেয়ে ভাবেন পুত্রবধূটিই এই পরিস্থিতির কারণ। সেজন্যেই তারা পুত্রবধূর ওপর থেকে ছেলের মনোযোগ কমাতে নববধূটির পেছনে লেগে পড়েন। আর বাবা-মায়ের এই দুঃখজনক আচরণ ছেলের নতুন জীবনের জন্যে মোটেই কল্যাণকর নয়। তাই ছেলেকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে যার যার অধিকার বুঝিয়ে দেয়াই হবে যুক্তিযুক্ত। বাবা-মা ছেলের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে যে, ছেলে উপার্জনক্ষম হলে তাদের প্রতি ছেলে লক্ষ্য রাখবে। বাবা-মায়ের এই প্রত্যাশা তাদের অনিবার্য অধিকার। এই অধিকার বিয়ের পরও যথাযথভাবেই অটুট থাকে। ফলে স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী হবার পাশাপাশি বাবা-মায়ের প্রতি আন্তরিক দায়িত্ব পালনেও সক্রিয় হতে হবে। বাবা-মায়ের আর্থিক সংকট মেটানো উপার্জনক্ষম সন্তানের অন্যতম কর্তব্য। তাই আগের মতোই বাবা-মায়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা ছেলের কর্তব্য। এই কর্তব্য যদি ছেলে পালন করে, তাহলে বাবা-মা ছেলের বৌ এবং সংসারের মঙ্গল কামনা করবে। সে ক্ষেত্রে ছেলের বৌ-এর পেছনে লাগার কোন কারণ আর ঘটবে না। কিন্তু তারপরও ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা ঘটে থাকে, সেসব ঘটনার ক্ষেত্রে ছেলেকে গভীরভাবে ভাবতে হবে-বাবা-মায়ের কথা কতোটা ন্যায্য। অন্যায় বা অধর্মীয় কোন আদেশ মানতে ছেলে বাধ্য নয়-একথা বাবা-মা এবং ছেলে সবারই জানা থাকা উচিত। বাবা-মায়ের প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের কারণেই যদি তারা বৌকে অন্তরায় ভেবে থাকেন, সেক্ষেত্রে, ছেলের উচিত হবে-বাবা-মায়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। বাবা-মাকে তার ঘরে ডেকে আনা, বাচ্চাদের বলা তারা যেন দাদা-দাদীকে সম্মান করে চলে। স্ত্রীকেও বলতে হবে সে যদি শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে সম্মান করে চলে, শ্বশুর-শ্বাশুড়ীও ছেলের বৌ-এর বিরুদ্ধে লেগে পড়ার পরিবর্তে বরং বৌকে নিয়ে গর্ববোধ করবে, পুত্র বধূকে তারা সকল ক্ষেত্রেই সহায়তা করবে।
এখানে যে কথাটি উল্লেখ করা দরকার তাহলো, বাবা-মাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে স্বামী স্ত্রীমুখী হয়ে পড়ুক-স্ত্রীদের এ ধরনের চিন্তা একেবারেই অন্যায্য। এ ধরনের দাবী না ন্যায়সঙ্গত না বাস্তবসম্মত। বরং স্ত্রীরা কৌশলে বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সাথে এমন আচরণ করতে পারে, যাতে তারা ভাবে যে বৌ তাদের সংসারের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য। তাতে উভয়কূল রক্ষা পাবে। মনে রাখতে হবে, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা যত্নের মধ্যে সন্তানের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। বাবা-মায়ের বাইরেও পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকে ঈর্ষুক থাকতে পারে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, তাহলো বাবা-মা সাধারণত ছেলের অমঙ্গল কামনা করে না। তারা যদি ছেলের সংসারে ঝামেলা ঘটানোর কোন কারণও হয়, তা কেবল তাদের নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য। ছেলে যদি তাদের অধিকার ঠিকমতো আদয় করে, তাহলে বাবা-মা ছেলের কল্যাণকামী হয়ে ওঠে। কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীরা হিংসা করে যদি কোন গীবত চর্চা করে, তাহলে তা খুবই ভয়ঙ্কর। তাদের কথায় হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই বোকামীপূর্ণ কাজ হবে। মনে রাখতে হবে বৌ আপনার জীবন সঙ্গী। সেও রক্ত-মাংশের মানুষ। পৃথিবীর কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। বৌ-এর ব্যাপারে কেউ যদি আপনার কানে কথা লাগায়, তাহলে ধীরে-সুস্থে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে ঠান্ডা মাথায় তা প্রতিহত করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কোনভাবেই বাইরের লোকের কুৎসা রটনাকে পাত্তা দেয়া যাবে না। বৌ-এর সাথে ভালোবাসাপূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে আলোচনা করার পর যদি মনে হয় যে, সত্যিই বৌ কোন অন্যায় করে ফেলেছে, তাহলে বৌ-এর ঐ অন্যায়কে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখাই হবে বড় মনের পরিচয়। যুক্তি দিয়ে বৌকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করুন-এর ফলে তাদের কী ক্ষতি হতে পারে, স্ত্রীকে হুট করেই কোন শাস্তি দেয়া একেবারেই ঠিক নয়। তাকে বুঝিয়ে বলার পর নিশ্চয় তার ভেতরে অনুশোচনাবোধ কাজ করবে। এর ফলে ভুলের পুনরাবৃত্তি আর নাও হতে পারে। অন্যদিকে আপনার স্ত্রী কৃতজ্ঞতায় আপনার প্রতি সব সময় সশ্রদ্ধ থাকবে। পরিণতিতে পারিবারিক শান্তি ও শৃঙ্খলা থাকবে অক্ষুন্ন। ক্রোধ খুবই মারাত্মক জিনিস। ক্রোধের আগুনে পুড়ে বহু সুন্দর সংসার ছারখার হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে যাবার পর ক্রুদ্ধরা কিন্তু অনুতপ্ত হয়। ফলে ক্রোধ নয়, ধৈর্য্যরে পরিচয় দিন। আল্লাহ ধৈর্য্য ধারনকারীদের সাথে রয়েছেন।
সোনালী নীড়ের গত পর্বে আমরা পুত্রবধূর ওপর ছেলের বাবা-মায়ের অসন্তোষজনিত জটিলতার ক্ষেত্রে স্বামীর কর্তব্য নিয়ে বথা বলেছি। এবারের পর্বে আমরা মেয়ের সংসারে ছেলের শ্বাশুড়ীর নাক গলানো সংক্রান্ত জটিলতায় স্বামীর করণীয় সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে To Err Is Human অর্থাৎ মানুষ মাত্রই ভুল আছে। সত্যিই তাই, আল্লাহ নিজেই যাদেরকে পাপ থেকে মুক্ত রাখবার ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা ব্যতীত অন্য কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। ফলে বাপের বাড়ীতে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা যে মেয়েটি হঠৎ বধূ হয়ে অচেনা একটা পরিবেশে এলো, সে যে ছোট-খাটো ভুল-ত্রুটি করে বসতেই পারে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। নববধূটি সাধারণত: যে ভুলগুলো করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-(১) স্বামীর সাথে রূঢ় আচরণ করা। (২) স্বামীর ইচ্ছার বিরূদ্ধে কিছু করে বসা এবং (৩) বেখেয়ালীপনাবশত স্বামীর আর্থিক ক্ষতি ঘটাবার মতো কোন আচরণ করা ইত্যাদি।
কোন স্ত্রীই সাধারণত প্রথম প্রথম স্বামীর সাথে রূঢ় আচরণ করে না। অবশ্য দু একটি ঘটনা ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। ধীরে ধীরে স্ত্রীদের অনেকেই রূঢ় আচরণ করতে প্রলুদ্ধ হয়। এর কারণ অনেক সময় স্ত্রীদের মা অর্থাৎ ছেলের শ্বাশুড়ী। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা না করলে ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে পারে। আমরা বলছি না যে, ছেলেদের শ্বাশুড়ীরা সবাই একইরকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তবে মেয়ের বিয়ে দেবার পরপর মেয়ের মা স্বাভাবিকভাবেই কামনা করে যে, তার জামাই হবে তারই মন মতো একটা আদর্শ ছেলে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিটি মানুষই মূলত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ফলে আপন-আপন স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই শ্রদ্ধা-সম্মানের ভিত্তিতে জামাই-শ্বাশুড়ী সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু শ্বাশুড়ী যখন দেখে যে জামাইর চালচলন একটু অন্য রকম, তখন শ্বাশুড়ী জামাইকে নিজের আদর্শে গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। এ ধরণের চেষ্টা প্রথম দিকে মেয়ের কল্যাণেই মূলত হয়ে থাকে। কিন্তু পরক্ষণে জামাই যখন তার ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যে অটল থাকে, তখন শ্বাশুড়ী মেয়েকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে জামাই সংশোধন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। এভাবে ছেলের শ্বাশুড়ী, মেয়ের সংসারে এবং জীবনে আস্তে আস্তে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। শ্বাশুড়ীর পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে জামাতার ওপর মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আর এই ক্ষিপ্ততার প্রয়োগ ঘটানো হয় মেয়েকে দিয়ে। মেয়ে তাই ধীরে ধীরে তার স্বামীর সাথে একটু অন্যরকম আচরণ শুরু করে দেয়। স্বামী যে ধরনের আচরণ তার স্ত্রীর কাছ থেকে প্রত্যাশা করে, স্ত্রী সেরকম আচরণ না করে কেমন যেন বিগড়ে যেতে থাকে। এমনকি স্বামীর কোন কোন কর্মকান্ডের সমালোচনায় মুখরও হয়ে ওঠে। মেয়েকে রীতিমতো শ্বাশুড়ী বিভিন্ন রকম নির্দেশ দিতে শুরু করে, আর মেয়েও আগ-পর চিন্তা না করে মায়ের আদেশ-নির্দেশকে অনুসরণ করতে শুরু করে। এমনকি স্বামীকে তার আচার-আচরণ পরিবর্তন করার জন্য বলতে শুরু করে। মা-মেয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। এই সম্পর্ক স্বভাবগত, প্রকৃতিগত । বছরের পর বছর ধরে যে মেয়ে তার মায়ের একান্ত আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বড়ো হয়েছে, স্বামীর তুলনায় মা-ই মেয়ের কাছে বেশী আপন বলে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। সেজন্যে মায়ের আদেশ শিরোধার্য করে মেয়ে তার স্বামীর সাথে দুর্ব্যবহার করতেও দ্বিধা করে না। অন্যদিকে জামাই যখন শ্বাশুড়ীর মনোপুত: হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, তখন শ্বাশুড়ী মেয়ের জামাতার ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে। ফলে দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে মহা-অসন্তোষ, দ্বন্দ্ব-কলহ। যার পরিণতি হয় বিবাহ বিচ্ছেদ, অথবা চির অশান্তি। স্বামীর সাথে এভাবেই স্ত্রী রূঢ় আচরণ করতে শুরু করে। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাহলো, শ্বাশুড়ীর সাথে জামাতার সম্পর্ক মানেই যে বৈরী সম্পর্ক এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বরং সম্পর্কটা সাধারণত এর বিপরীত অর্থাৎ শ্বাশুড়ীর সাথে জামাইর সম্পর্ক খুবই আন্তরিক ও শ্রদ্ধা-স্নেহের। মেয়ের মঙ্গল কামনা থেকেই মূলত: শ্বাশুড়ীরা মেয়ের সংসারে প্রভাব বা হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে। কিন্তু অজ্ঞতাবশত: অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যে শ্বাশুড়ীদের ব্যাপারে পুরুষদের অতিরিক্ত সমালোচনার মনোভাব পরিহার করে চলাই শ্রেয়। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে শ্বাশুড়ীরা খুবই ভালো প্রকৃতিরও হয়ে থাকেন। এক ভদ্রলোক বলেছেন, তাঁর ভাষায় “আমার শ্বাশুড়ী যেন সাক্ষাৎ দেবী। তিনি যেমন দয়াবতী, তেমনি সবকিছু ভালোমত বুঝতেও পারেন। তাই আমি তাকে মায়ের মতোই ভালোবাসি। আমাদের সমস্যায় তিনি সবসময় আমাদের পাশে থাকেন। তার অস্তিত্ব যেন আমার পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য এক নিশ্চয়তা স্বরূপ।”
তাই বলা যায়, শ্বাশুড়ী মাত্রই খারাপ নয় এবং শ্বাশুড়ীই মেয়ের সংসারে জটিলতা সৃষ্টির একমাত্র কারণ নয়। আরো অনেক কারণেও সংসারে সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেজন্যে শ্বাশুড়ীর সাথে বা শ্বশুর বাড়ীর সাথে সমস্যা এড়িয়ে চলার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হলো শ্বশুর পক্ষীয় আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। আসলে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই পরস্পরের বাবা-মা, ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। এতে উভয়েরই কল্যাণ নিহিত রয়েছে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সামনে কখনোই তাদের মেয়ের সমালোচনা করা উচিত নয়। বরং তাদের কন্যার প্রতি জামাতার ভীষণ ভালোবাসার দিকটিই ফুটিয়ে তোলা উচিত। মেয়ের বাবা-মাও কিন্তু অভিভাবক। ফলে নিজের বাবা-মায়ের মতো স্ত্রীর বাবা-মায়ের কাছেও অভিভাবকসুলভ পরামর্শ গ্রহণ করে সংসার জীবনে তা কাজে লাগানো যেতে পারে। স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই উচিত আপন-আপন শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সাথেই কেবল নয় বরং শ্বশুর বাড়ীর সবার সাথেই সহৃদয় আচরণ করা। এর ফলে দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি ও সাফল্য নেমে আসবে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যসমূহ যা আমার উম্মতকে বেহেশতে প্রবেশ করাবে তা হচ্ছে আল্লাহর ভয় ও উত্তম আচরণ।” ইমাম আলী (আঃ) বলেছেন, সদাচরণ প্রচুর পরিমাণে জীবনোপকরণ দান করে এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাকে বাড়িয়ে দেয়। তিনি আরো বলেছেন, বন্ধুত্ব গড়ে তোলা হলো জ্ঞানীর মতো কাজ। ফলে প্রতিটি মানুষের উচিত সর্বাবস্থায় উত্তম আচরণ করা।
সুখ-শান্তির মূল ভিত্তি হলো উত্তম আচরণ। তাই সদাচরণের অভ্যাস গড়ে তোলা শান্তিকামী প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সদাচরণের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রাসূল (সাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনি যদি কঠোর ও নির্মম হতেন তাহলে তারা নিশ্চিতরূপে আপনার চারপাশ থেকে সরে যেত। অন্যত্র বলেছেন, রাসূল (সাঃ)এর মধ্যেই রয়েছে, সর্বোত্তম চরিত্রের আদর্শ। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে রাসূলের আদর্শকে অনুসরণ করা । পারিবারিক সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও তার অনুসরণের কোন বিকল্প নেই।
আসলাম সাহেব বাসায় ফিরে দেখলেন তার স্ত্রী ঘরে নেই। ক্লান্তিকর কাজ শেষে ঘরে ফিরে স্ত্রীকে না দেখা আসলাম সাহেব কেন, সকল স্বামীর পক্ষেই কষ্টকর একটা ব্যাপার। কিন্তু তারচেয়েও কষ্টকর হলো স্ত্রী কোথায় গেল-এটা জানা না থাকা। আসলাম সাহেব সোফায় বসে ভাবছেন, এমন সময় একটা ফোন এলো- আসলাম সাহেব হ্যালো বলতেই ফোনটা কেটে গেল। স্বাভাবিকভাবেই মাথায় আরেকটা দুশ্চিন্তা ঢোকার কথা। আসলাম সাহেব পায়চারী করতে করতে স্ত্রীর ড্রেসিং টেবিলের ওপর চিঠির প্যাড খোলা দেখতে পেলেন। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা সন্দেহজনক বৈ কি। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে যদি তার স্ত্রী ঘরে এসেই পড়তো তাহলে আসলাম সাহেবের কী করণীয় ছিল? কোথায় গেছ? কেন গেছ? কেন আমাকে আগে জানাওনি? চিঠির প্যাড এখানে কেন? কার কাছে গোপনে গোপনে চিঠি লেখ ?-এসব করা কি সঙ্গত ? না, মোটেই না। কারণ এটা সন্দেহপ্রবণ মনের অভিব্যক্তি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রবিত্র কোরআনে বলেছেন, হে ঈমানদারগণ, অধিকাংশ অমূলক ধারণা করা পরিহার কর, কেন না আন্দাজ অনুমান কোন কোন ক্ষেত্রে নিশ্চিতরূপে গুনাহের কাজ হিসেবে পরিগণিত। তাছাড়া ইসলাম সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য না পাওয়া পর্যন্ত সন্দেহ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, সন্দেহ করার ব্যাপারে সতর্ক হও, কেননা সন্দেহ ইবাদত ধ্বংস করে এবং গুনাহ বৃদ্ধি করে।
ফলে সন্দেহ করা যাবে না। সন্দেহ পোষণ করলে স্ত্রীর বিশ্বস্ততাকে অবিশ্বাস করা হয়। এ ধরণের সন্দেহপরায়নতা পারিবারিক জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। এ রকম মানসিকতায় যারা ভোগেন তারা সারাক্ষণ স্ত্রীকে গোয়েন্দার মতো অনুসরণ করতে থাকেন। কিছু একটা হলেই সন্দেহের স্বপক্ষে প্রমাণ দেখতে পান। তার কাজই হয়ে পড়ে কেবল স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করা। অথচ ধৈর্যের সাথে সন্দেহ মুক্ত মন নিয়ে স্ত্রীকে দেখলে এক সময় স্ত্রী নিজেই হয়তো আপনাকে জানাবে কোথায় গেছে, কি করেছে, কার কাছে চিঠি লিখেছে। ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে স্বামী নিজেই এক সময় তার স্ত্রীকে বলেছিল-বাড়ীতে একটা চিঠি লিখতে। সেই চিঠিটাই লিখেছিল তার স্ত্রী। আর পোস্ট করার জন্যে গিয়েছিল পোস্ট অফিসে। কিন্তু পোস্ট অফিসে যথারীতি ভীড় থাকায় বাসায় ফিরতে তার দেরী হয়ে যাচ্ছিল। সেজন্যে টেলিফোন করে স্বামীকে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বাসার টেলিফোন সেটে সমস্যা থাকায় রিং হওয়ার পর কেটে যাচ্ছিল। যার ফলে আর কথা বলা সম্ভব হয়নি। এই সত্যটি যতোক্ষণ না অপনি জানছেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত আপনার মন থেকে সন্দেহের কালিমা দূর হচ্ছে না। কিন্তু কথা হলো স্ত্রীকে সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিলে স্ত্রী কি আপনাকে এই তথ্যটি মজা করে জানাতে যাবে ? অতএব সন্দেহ পরায়ন হওয়াটা মোটেই কল্যাণের নয় বরং হাসিখুশী থাকুন, স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত হন।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “যদি কেউ স্ত্রীর নামে দুঃশ্চরিত্রের মিথ্যা অপবাদ দেয়, তাহলে তার সমস্ত ভালকাজের সুফল বাতিল হয়ে যাবে। যেমন সাপের গা থেকে তার খোলস ঝড়ে পড়ে।” নবীজী আরো বলেছেন, যে কেউ ঈমানদার নারী বা পুরুষের নামে মিথ্যা অভিযোগ করে, শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ তাকে জ্বলন্ত অগ্নিকান্ডের ওপর বসিয়ে দেবেন, যেন সে এই অপরাধের যোগ্য শাস্তি পায়।”
ফলে অমূলক সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকুন। তারমানে এই নয় যে, আপনি স্ত্রীর আচরণের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসিন থাকবেন। বরং আপনার দেখা আলামতটাকে আপনি নিজেই যাচাই করুন-স্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্যে নয় বরং সত্যটাকে জানার জন্যে। সত্য না জেনেই কোন রকম সিদ্ধান্ত নেয়া, বাড়াবাড়ি করা মারাত্মক ভুল। যে ঘটনাটি আমরা আলোচনার শুরুতে জানলাম, সেখানে সন্দেহবশত স্ত্রীকে পরকীয়ার অভিযোগে যদি অভিযুক্ত করতেন, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হতো? না, সেটি মোটেই ভালো হতো না। স্ত্রী অপমানিত বোধ করতো। নিজস্ব সম্মান ও ব্যক্তিত্ব হারানোর যন্ত্রণায় স্ত্রী অবশ্যই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতেন। অথচ স্ত্রী মোটেই কোন অন্যায় করেননি। শুধুমাত্র ছোট্ট একটি অবিশ্বাস একটি সুন্দর সংসারকে ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দেয়ার আশঙ্কা থেকে যেত। স্বামীর অমূলক সন্দেহের ব্যাপারটা যদি বাইরে জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে আরো বড়ো বিপদ হতে পারে। মানুষ মাত্রই শত্রুমিত্র পরিবেষ্টিত থাকে। আপনার শত্রুরা এই সন্দেহের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আপনার সংসারের ব্যাপারে নাক গলাবার সুযোগ পাবে। তারা আপনার সন্দেহকে যথার্থ বলে প্রমাণ করার কুমতলবে বিভিন্ন গালগল্প ও বানোয়াট ঘটনার জন্ম দেবে। যা আপনার কাছে সত্য বলে মনে হবে। আপনি যখন সে সবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা মহা বিপদে পড়বেন-তখন তারা দেখে দেখে উপহাসের হাসি হাসবে।
মনে রাখবেন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালবাসার সম্পর্ক। এখানে তাই গভীর আবেগ ও আন্তরিকতা কাজ করে। কোন রকম সন্দেহ-অবিশ্বাস ভালবাসা বা আন্তরিকতাকে নষ্ট করে দেয়। সহজ-সরল পবিত্র মনে যদি একবার সন্দেহের কালো দাগ পড়ে, ঐ দাগ চিরজীবন থেকে যাবে। তাই যেকোন কাজ চিন্তা-ভাবনা করে করুন। হুট করে কোন কাজ করে বসা মারাত্মক ভুল, যেমনটি কবিও বলেছেন-
একটু খানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে
ভুল করেছে যারা সবাই ভুক্তভোগী বটে।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, তাহলো স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সন্দেহপরায়নতার যদি কোন কারণই না থাকে, অর্থাৎ স্ত্রী যদি সত্যিই সন্দেহজনক কোন কাজ না করে থাকে, তাহলে স্বামীর সন্দেহপ্রবণতা একটা মানসিক রোগ বৈ কি! এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর কিছু করণীয় থেকে যায়। প্রথমতঃ আপনাকে গভীর মনোযোগ ও আন্তরিকতা দিয়ে দেখতে হবে, আপনার স্বামী আপনার ঠিক কোন আচরণটিকে সন্দেহজনক ভাবছে। যদি আবিস্কার করছে সক্ষম হন, তাহলে ঐ ধরণের কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। আপনি এমনটি ভাববেন না যে আপনি আপনার স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাস হয়ে পড়েছেন। বরং একজন স্ত্রী হিসেবে আপনার মানসিকভাবে অসুস্থ স্বামীর প্রতি এটি আপনার দায়িত্ব। আপনি আপনার ভালবাসা দিয়ে সেবা-যত্ন দিয়ে স্বামীকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করুন।
এভাবে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালবাসার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার সমস্যাগুলো সমাধান করা চেষ্টা করুন। একটি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল পরিবার গঠনের স্বার্থে এ ধরণের আত্মত্যাগের কোন বিকল্প নেই। হযরত আলী (আঃ) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করবো। তিনি বলেছেন, যে অন্যের দুর্বলতার অনুসন্ধান করে, তাকে প্রথমে নিজের দিকে তাকাতে হবে।(রেডিও তেহরান)
আমি আমার স্বামী, শ্বাশুড়ী ও ননদসহ একত্রে থাকি। প্রথম প্রথম স্বামীর সাথে ভালোই কেটেছে আমার। একটা মধুর দাম্পত্য জীবন আমরা কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের এই সুখ কারো কারো অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যে আমার স্বামীর কাছে আমাকে অপ্রিয় করে তোলার জন্য আমার সম্পর্কে নানা রকম গুজব স্বামীর কানে দেয়া হয়। সেসব গুজব এমন লোকদের কাছ থেকে শোনানো হয় যে স্বামীর পক্ষে তা অবিশ্বাস করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্নকারী জানতে চাইলো-কী ধরণের গুজব একটু বলবেন ? ভদ্র মহিলা বললেন, আমার শ্বাশুড়ী চব্বিশটা ঘন্টাই আমার খুঁত ধরতে ওঁৎ পেতে থাকে। নানা ছলছুতায় আমার সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতে চায়। স্বভাবে এমনিতেই তিনি ভীষণ বদমেজাজী। আমার সাথে ঝগড়া করতে না পারলে আমার ব্যাপারে উল্টো-পাল্টা কথা বলে স্বামীর সাথে আমার ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতে চেষ্টা করে। সেদিন আমি কেনাকাটা করে বাসায় ফিরছিলাম। রাস্তায় ভীষণ জ্যাম ছিল। বাসায় ফেরার পর শ্বাশুড়ী আমাকে জেরা শুরু করে দিলেন। কেন দেরী হলো, কোথায় গেছো, কার সাথে পিরিতি করে বেড়াও? ইত্যাদি সব বাজে কথা।
আমাদের সমাজে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা মানবতাকে স্তব্ধ করে দেয়। ধরা যাক এরকম একটি চিত্র: দেখা গেল-একটা ঘরে হঠাৎ আগুন, সাথে চীৎকার চেঁচামেচি। পাড়া-প্রতিবেশীরা ঐ চীৎকার শুনে এগিয়ে এলো। যেই রুমের ভেতরে আগুন, সেরুমের দরজা খুলে ভেতরে দেখলো ঐ বাসার সুন্দরী বধূটির গায়ে আগুন জ্বলছে। তাড়াহুড়া করে আগুন নিভিয়ে বধূটিকে নিয়ে গেল মেডিকেলে। সৌভাগ্যবশত: বধূটি প্রাণে বেঁচে গেল। সুস্থ হবার পর গৃহবধূটিকে বাসায় যেতে বললে সে বললো, বাসায় যাবো না। প্রশ্ন করা হলো কেন যাবেন না? ভদ্র মহিলা বললো, ঐ বাসায় যাতে থাকতে না হয় সেজন্যেই তো মরতে চেয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করা হলো কেন থাকতে চান না ঐ বাসায়? জবাবে বধূটি বললো, সে অনেক কথা। প্রশ্নকারী আবার বললো, বলুন! আমরা শুনবো। তারপর ভদ্রমহিলা বলতে শুরু করলেন। অবশেষে আমার স্বামী যখন বাসায় ফিরলেন, শ্বাশুড়ী কান্নাকাটি করে তার ছেলেকে সব ঘটনা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলার পর বললো, কোন মাংস বিক্রেতার সাথে নাকি আমার বাজে সম্পর্ক আছে। একথা শুনে আমার স্বামী স্বাভাবিকভাবেই রেগে গেলেন। আমিও রাগে-দুঃখে ভেঙ্গে পড়লাম। আমি নিজেকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করলাম। এই বলে বধূটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
যে ঘটনাটি এতোক্ষণ আমরা শুনলাম, এধরনের ঘটনা কারোরই কাম্য নয়। এধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে পারিবারিক কাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বে। পরিবারের ভাঙ্গন রোধ করার জন্য তাই সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করতে হবে। এই ঘটনাটিতে একদিকে রয়েছে মা-বোন, অন্যদিকে স্ত্রী। উভয়ের প্রতিই স্বামী পুরুষটির দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বামী পুরুষটিকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে অগ্রসর হতে হবে। কোন রকম বোকামীর পরিচয় দিলেই সমূহ বিপদের আশঙ্কা দেখা দেবে। যে ঘটনাটি আমরা একটু আগে জানলাম, এধরনের ঘটনা অনেক পরিবারেই অহরহ ঘটছে। এর যে কী সমাধান তা অনেকেই ভেবে কুল পান না। অথচ ইসলাম এসব ব্যাপারে চমৎকার সমাধান দিয়েছে। এবারে সে সম্পর্কেই আলোচনা করা যাক।
প্রতিটি ছেলেই বিয়ের আগে বাবা মায়ের আশ্রয়ে বড় হয়ে ওঠে। ছোট বেলা থেকেই সন্তানেরা বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকে। বাবা-মা যেহেতু ছেলেকে লালন-পালন করে বড়ো করে তোলেন, সেহেতু তারা স্বাভাবিকভাবেই আশা করেন যে, বড়ো হয়ে ছেলে তাদের দেখাশোনা করবে। কিন্তু বিয়ে করার পর বাবা-মা যখন দেখেন যে, ছেলে তার নতুন সংসার তথা স্ত্রীর প্রতিই বেশী যত্নশীল হয়ে পড়ছে, তখন বাবা-মা কষ্ট পান। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে তারা আপাতত দৃষ্টিতে স্বাধীন করে দিলেও মনে মনে ঠিকই প্রত্যাশা করেন যে, ছেলে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাবে। কিন্তু বাস্তবে তা না দেখতে পেয়ে ভাবেন পুত্রবধূটিই এই পরিস্থিতির কারণ। সেজন্যেই তারা পুত্রবধূর ওপর থেকে ছেলের মনোযোগ কমাতে নববধূটির পেছনে লেগে পড়েন। আর বাবা-মায়ের এই দুঃখজনক আচরণ ছেলের নতুন জীবনের জন্যে মোটেই কল্যাণকর নয়। তাই ছেলেকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে যার যার অধিকার বুঝিয়ে দেয়াই হবে যুক্তিযুক্ত। বাবা-মা ছেলের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে যে, ছেলে উপার্জনক্ষম হলে তাদের প্রতি ছেলে লক্ষ্য রাখবে। বাবা-মায়ের এই প্রত্যাশা তাদের অনিবার্য অধিকার। এই অধিকার বিয়ের পরও যথাযথভাবেই অটুট থাকে। ফলে স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী হবার পাশাপাশি বাবা-মায়ের প্রতি আন্তরিক দায়িত্ব পালনেও সক্রিয় হতে হবে। বাবা-মায়ের আর্থিক সংকট মেটানো উপার্জনক্ষম সন্তানের অন্যতম কর্তব্য। তাই আগের মতোই বাবা-মায়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা ছেলের কর্তব্য। এই কর্তব্য যদি ছেলে পালন করে, তাহলে বাবা-মা ছেলের বৌ এবং সংসারের মঙ্গল কামনা করবে। সে ক্ষেত্রে ছেলের বৌ-এর পেছনে লাগার কোন কারণ আর ঘটবে না। কিন্তু তারপরও ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা ঘটে থাকে, সেসব ঘটনার ক্ষেত্রে ছেলেকে গভীরভাবে ভাবতে হবে-বাবা-মায়ের কথা কতোটা ন্যায্য। অন্যায় বা অধর্মীয় কোন আদেশ মানতে ছেলে বাধ্য নয়-একথা বাবা-মা এবং ছেলে সবারই জানা থাকা উচিত। বাবা-মায়ের প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের কারণেই যদি তারা বৌকে অন্তরায় ভেবে থাকেন, সেক্ষেত্রে, ছেলের উচিত হবে-বাবা-মায়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। বাবা-মাকে তার ঘরে ডেকে আনা, বাচ্চাদের বলা তারা যেন দাদা-দাদীকে সম্মান করে চলে। স্ত্রীকেও বলতে হবে সে যদি শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে সম্মান করে চলে, শ্বশুর-শ্বাশুড়ীও ছেলের বৌ-এর বিরুদ্ধে লেগে পড়ার পরিবর্তে বরং বৌকে নিয়ে গর্ববোধ করবে, পুত্র বধূকে তারা সকল ক্ষেত্রেই সহায়তা করবে।
এখানে যে কথাটি উল্লেখ করা দরকার তাহলো, বাবা-মাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে স্বামী স্ত্রীমুখী হয়ে পড়ুক-স্ত্রীদের এ ধরনের চিন্তা একেবারেই অন্যায্য। এ ধরনের দাবী না ন্যায়সঙ্গত না বাস্তবসম্মত। বরং স্ত্রীরা কৌশলে বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সাথে এমন আচরণ করতে পারে, যাতে তারা ভাবে যে বৌ তাদের সংসারের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য। তাতে উভয়কূল রক্ষা পাবে। মনে রাখতে হবে, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা যত্নের মধ্যে সন্তানের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। বাবা-মায়ের বাইরেও পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকে ঈর্ষুক থাকতে পারে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, তাহলো বাবা-মা সাধারণত ছেলের অমঙ্গল কামনা করে না। তারা যদি ছেলের সংসারে ঝামেলা ঘটানোর কোন কারণও হয়, তা কেবল তাদের নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য। ছেলে যদি তাদের অধিকার ঠিকমতো আদয় করে, তাহলে বাবা-মা ছেলের কল্যাণকামী হয়ে ওঠে। কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীরা হিংসা করে যদি কোন গীবত চর্চা করে, তাহলে তা খুবই ভয়ঙ্কর। তাদের কথায় হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই বোকামীপূর্ণ কাজ হবে। মনে রাখতে হবে বৌ আপনার জীবন সঙ্গী। সেও রক্ত-মাংশের মানুষ। পৃথিবীর কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। বৌ-এর ব্যাপারে কেউ যদি আপনার কানে কথা লাগায়, তাহলে ধীরে-সুস্থে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে ঠান্ডা মাথায় তা প্রতিহত করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কোনভাবেই বাইরের লোকের কুৎসা রটনাকে পাত্তা দেয়া যাবে না। বৌ-এর সাথে ভালোবাসাপূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে আলোচনা করার পর যদি মনে হয় যে, সত্যিই বৌ কোন অন্যায় করে ফেলেছে, তাহলে বৌ-এর ঐ অন্যায়কে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখাই হবে বড় মনের পরিচয়। যুক্তি দিয়ে বৌকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করুন-এর ফলে তাদের কী ক্ষতি হতে পারে, স্ত্রীকে হুট করেই কোন শাস্তি দেয়া একেবারেই ঠিক নয়। তাকে বুঝিয়ে বলার পর নিশ্চয় তার ভেতরে অনুশোচনাবোধ কাজ করবে। এর ফলে ভুলের পুনরাবৃত্তি আর নাও হতে পারে। অন্যদিকে আপনার স্ত্রী কৃতজ্ঞতায় আপনার প্রতি সব সময় সশ্রদ্ধ থাকবে। পরিণতিতে পারিবারিক শান্তি ও শৃঙ্খলা থাকবে অক্ষুন্ন। ক্রোধ খুবই মারাত্মক জিনিস। ক্রোধের আগুনে পুড়ে বহু সুন্দর সংসার ছারখার হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে যাবার পর ক্রুদ্ধরা কিন্তু অনুতপ্ত হয়। ফলে ক্রোধ নয়, ধৈর্য্যরে পরিচয় দিন। আল্লাহ ধৈর্য্য ধারনকারীদের সাথে রয়েছেন।
সোনালী নীড়ের গত পর্বে আমরা পুত্রবধূর ওপর ছেলের বাবা-মায়ের অসন্তোষজনিত জটিলতার ক্ষেত্রে স্বামীর কর্তব্য নিয়ে বথা বলেছি। এবারের পর্বে আমরা মেয়ের সংসারে ছেলের শ্বাশুড়ীর নাক গলানো সংক্রান্ত জটিলতায় স্বামীর করণীয় সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে To Err Is Human অর্থাৎ মানুষ মাত্রই ভুল আছে। সত্যিই তাই, আল্লাহ নিজেই যাদেরকে পাপ থেকে মুক্ত রাখবার ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা ব্যতীত অন্য কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। ফলে বাপের বাড়ীতে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা যে মেয়েটি হঠৎ বধূ হয়ে অচেনা একটা পরিবেশে এলো, সে যে ছোট-খাটো ভুল-ত্রুটি করে বসতেই পারে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। নববধূটি সাধারণত: যে ভুলগুলো করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-(১) স্বামীর সাথে রূঢ় আচরণ করা। (২) স্বামীর ইচ্ছার বিরূদ্ধে কিছু করে বসা এবং (৩) বেখেয়ালীপনাবশত স্বামীর আর্থিক ক্ষতি ঘটাবার মতো কোন আচরণ করা ইত্যাদি।
কোন স্ত্রীই সাধারণত প্রথম প্রথম স্বামীর সাথে রূঢ় আচরণ করে না। অবশ্য দু একটি ঘটনা ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। ধীরে ধীরে স্ত্রীদের অনেকেই রূঢ় আচরণ করতে প্রলুদ্ধ হয়। এর কারণ অনেক সময় স্ত্রীদের মা অর্থাৎ ছেলের শ্বাশুড়ী। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা না করলে ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে পারে। আমরা বলছি না যে, ছেলেদের শ্বাশুড়ীরা সবাই একইরকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তবে মেয়ের বিয়ে দেবার পরপর মেয়ের মা স্বাভাবিকভাবেই কামনা করে যে, তার জামাই হবে তারই মন মতো একটা আদর্শ ছেলে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিটি মানুষই মূলত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ফলে আপন-আপন স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই শ্রদ্ধা-সম্মানের ভিত্তিতে জামাই-শ্বাশুড়ী সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু শ্বাশুড়ী যখন দেখে যে জামাইর চালচলন একটু অন্য রকম, তখন শ্বাশুড়ী জামাইকে নিজের আদর্শে গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। এ ধরণের চেষ্টা প্রথম দিকে মেয়ের কল্যাণেই মূলত হয়ে থাকে। কিন্তু পরক্ষণে জামাই যখন তার ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যে অটল থাকে, তখন শ্বাশুড়ী মেয়েকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে জামাই সংশোধন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। এভাবে ছেলের শ্বাশুড়ী, মেয়ের সংসারে এবং জীবনে আস্তে আস্তে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। শ্বাশুড়ীর পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে জামাতার ওপর মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আর এই ক্ষিপ্ততার প্রয়োগ ঘটানো হয় মেয়েকে দিয়ে। মেয়ে তাই ধীরে ধীরে তার স্বামীর সাথে একটু অন্যরকম আচরণ শুরু করে দেয়। স্বামী যে ধরনের আচরণ তার স্ত্রীর কাছ থেকে প্রত্যাশা করে, স্ত্রী সেরকম আচরণ না করে কেমন যেন বিগড়ে যেতে থাকে। এমনকি স্বামীর কোন কোন কর্মকান্ডের সমালোচনায় মুখরও হয়ে ওঠে। মেয়েকে রীতিমতো শ্বাশুড়ী বিভিন্ন রকম নির্দেশ দিতে শুরু করে, আর মেয়েও আগ-পর চিন্তা না করে মায়ের আদেশ-নির্দেশকে অনুসরণ করতে শুরু করে। এমনকি স্বামীকে তার আচার-আচরণ পরিবর্তন করার জন্য বলতে শুরু করে। মা-মেয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। এই সম্পর্ক স্বভাবগত, প্রকৃতিগত । বছরের পর বছর ধরে যে মেয়ে তার মায়ের একান্ত আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বড়ো হয়েছে, স্বামীর তুলনায় মা-ই মেয়ের কাছে বেশী আপন বলে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। সেজন্যে মায়ের আদেশ শিরোধার্য করে মেয়ে তার স্বামীর সাথে দুর্ব্যবহার করতেও দ্বিধা করে না। অন্যদিকে জামাই যখন শ্বাশুড়ীর মনোপুত: হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, তখন শ্বাশুড়ী মেয়ের জামাতার ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে। ফলে দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে মহা-অসন্তোষ, দ্বন্দ্ব-কলহ। যার পরিণতি হয় বিবাহ বিচ্ছেদ, অথবা চির অশান্তি। স্বামীর সাথে এভাবেই স্ত্রী রূঢ় আচরণ করতে শুরু করে। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাহলো, শ্বাশুড়ীর সাথে জামাতার সম্পর্ক মানেই যে বৈরী সম্পর্ক এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বরং সম্পর্কটা সাধারণত এর বিপরীত অর্থাৎ শ্বাশুড়ীর সাথে জামাইর সম্পর্ক খুবই আন্তরিক ও শ্রদ্ধা-স্নেহের। মেয়ের মঙ্গল কামনা থেকেই মূলত: শ্বাশুড়ীরা মেয়ের সংসারে প্রভাব বা হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে। কিন্তু অজ্ঞতাবশত: অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যে শ্বাশুড়ীদের ব্যাপারে পুরুষদের অতিরিক্ত সমালোচনার মনোভাব পরিহার করে চলাই শ্রেয়। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে শ্বাশুড়ীরা খুবই ভালো প্রকৃতিরও হয়ে থাকেন। এক ভদ্রলোক বলেছেন, তাঁর ভাষায় “আমার শ্বাশুড়ী যেন সাক্ষাৎ দেবী। তিনি যেমন দয়াবতী, তেমনি সবকিছু ভালোমত বুঝতেও পারেন। তাই আমি তাকে মায়ের মতোই ভালোবাসি। আমাদের সমস্যায় তিনি সবসময় আমাদের পাশে থাকেন। তার অস্তিত্ব যেন আমার পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য এক নিশ্চয়তা স্বরূপ।”
তাই বলা যায়, শ্বাশুড়ী মাত্রই খারাপ নয় এবং শ্বাশুড়ীই মেয়ের সংসারে জটিলতা সৃষ্টির একমাত্র কারণ নয়। আরো অনেক কারণেও সংসারে সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেজন্যে শ্বাশুড়ীর সাথে বা শ্বশুর বাড়ীর সাথে সমস্যা এড়িয়ে চলার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হলো শ্বশুর পক্ষীয় আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। আসলে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই পরস্পরের বাবা-মা, ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। এতে উভয়েরই কল্যাণ নিহিত রয়েছে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সামনে কখনোই তাদের মেয়ের সমালোচনা করা উচিত নয়। বরং তাদের কন্যার প্রতি জামাতার ভীষণ ভালোবাসার দিকটিই ফুটিয়ে তোলা উচিত। মেয়ের বাবা-মাও কিন্তু অভিভাবক। ফলে নিজের বাবা-মায়ের মতো স্ত্রীর বাবা-মায়ের কাছেও অভিভাবকসুলভ পরামর্শ গ্রহণ করে সংসার জীবনে তা কাজে লাগানো যেতে পারে। স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই উচিত আপন-আপন শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সাথেই কেবল নয় বরং শ্বশুর বাড়ীর সবার সাথেই সহৃদয় আচরণ করা। এর ফলে দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি ও সাফল্য নেমে আসবে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যসমূহ যা আমার উম্মতকে বেহেশতে প্রবেশ করাবে তা হচ্ছে আল্লাহর ভয় ও উত্তম আচরণ।” ইমাম আলী (আঃ) বলেছেন, সদাচরণ প্রচুর পরিমাণে জীবনোপকরণ দান করে এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাকে বাড়িয়ে দেয়। তিনি আরো বলেছেন, বন্ধুত্ব গড়ে তোলা হলো জ্ঞানীর মতো কাজ। ফলে প্রতিটি মানুষের উচিত সর্বাবস্থায় উত্তম আচরণ করা।
সুখ-শান্তির মূল ভিত্তি হলো উত্তম আচরণ। তাই সদাচরণের অভ্যাস গড়ে তোলা শান্তিকামী প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সদাচরণের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রাসূল (সাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনি যদি কঠোর ও নির্মম হতেন তাহলে তারা নিশ্চিতরূপে আপনার চারপাশ থেকে সরে যেত। অন্যত্র বলেছেন, রাসূল (সাঃ)এর মধ্যেই রয়েছে, সর্বোত্তম চরিত্রের আদর্শ। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে রাসূলের আদর্শকে অনুসরণ করা । পারিবারিক সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও তার অনুসরণের কোন বিকল্প নেই।
আসলাম সাহেব বাসায় ফিরে দেখলেন তার স্ত্রী ঘরে নেই। ক্লান্তিকর কাজ শেষে ঘরে ফিরে স্ত্রীকে না দেখা আসলাম সাহেব কেন, সকল স্বামীর পক্ষেই কষ্টকর একটা ব্যাপার। কিন্তু তারচেয়েও কষ্টকর হলো স্ত্রী কোথায় গেল-এটা জানা না থাকা। আসলাম সাহেব সোফায় বসে ভাবছেন, এমন সময় একটা ফোন এলো- আসলাম সাহেব হ্যালো বলতেই ফোনটা কেটে গেল। স্বাভাবিকভাবেই মাথায় আরেকটা দুশ্চিন্তা ঢোকার কথা। আসলাম সাহেব পায়চারী করতে করতে স্ত্রীর ড্রেসিং টেবিলের ওপর চিঠির প্যাড খোলা দেখতে পেলেন। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা সন্দেহজনক বৈ কি। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে যদি তার স্ত্রী ঘরে এসেই পড়তো তাহলে আসলাম সাহেবের কী করণীয় ছিল? কোথায় গেছ? কেন গেছ? কেন আমাকে আগে জানাওনি? চিঠির প্যাড এখানে কেন? কার কাছে গোপনে গোপনে চিঠি লেখ ?-এসব করা কি সঙ্গত ? না, মোটেই না। কারণ এটা সন্দেহপ্রবণ মনের অভিব্যক্তি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রবিত্র কোরআনে বলেছেন, হে ঈমানদারগণ, অধিকাংশ অমূলক ধারণা করা পরিহার কর, কেন না আন্দাজ অনুমান কোন কোন ক্ষেত্রে নিশ্চিতরূপে গুনাহের কাজ হিসেবে পরিগণিত। তাছাড়া ইসলাম সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য না পাওয়া পর্যন্ত সন্দেহ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, সন্দেহ করার ব্যাপারে সতর্ক হও, কেননা সন্দেহ ইবাদত ধ্বংস করে এবং গুনাহ বৃদ্ধি করে।
ফলে সন্দেহ করা যাবে না। সন্দেহ পোষণ করলে স্ত্রীর বিশ্বস্ততাকে অবিশ্বাস করা হয়। এ ধরণের সন্দেহপরায়নতা পারিবারিক জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। এ রকম মানসিকতায় যারা ভোগেন তারা সারাক্ষণ স্ত্রীকে গোয়েন্দার মতো অনুসরণ করতে থাকেন। কিছু একটা হলেই সন্দেহের স্বপক্ষে প্রমাণ দেখতে পান। তার কাজই হয়ে পড়ে কেবল স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করা। অথচ ধৈর্যের সাথে সন্দেহ মুক্ত মন নিয়ে স্ত্রীকে দেখলে এক সময় স্ত্রী নিজেই হয়তো আপনাকে জানাবে কোথায় গেছে, কি করেছে, কার কাছে চিঠি লিখেছে। ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে স্বামী নিজেই এক সময় তার স্ত্রীকে বলেছিল-বাড়ীতে একটা চিঠি লিখতে। সেই চিঠিটাই লিখেছিল তার স্ত্রী। আর পোস্ট করার জন্যে গিয়েছিল পোস্ট অফিসে। কিন্তু পোস্ট অফিসে যথারীতি ভীড় থাকায় বাসায় ফিরতে তার দেরী হয়ে যাচ্ছিল। সেজন্যে টেলিফোন করে স্বামীকে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বাসার টেলিফোন সেটে সমস্যা থাকায় রিং হওয়ার পর কেটে যাচ্ছিল। যার ফলে আর কথা বলা সম্ভব হয়নি। এই সত্যটি যতোক্ষণ না অপনি জানছেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত আপনার মন থেকে সন্দেহের কালিমা দূর হচ্ছে না। কিন্তু কথা হলো স্ত্রীকে সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিলে স্ত্রী কি আপনাকে এই তথ্যটি মজা করে জানাতে যাবে ? অতএব সন্দেহ পরায়ন হওয়াটা মোটেই কল্যাণের নয় বরং হাসিখুশী থাকুন, স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত হন।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “যদি কেউ স্ত্রীর নামে দুঃশ্চরিত্রের মিথ্যা অপবাদ দেয়, তাহলে তার সমস্ত ভালকাজের সুফল বাতিল হয়ে যাবে। যেমন সাপের গা থেকে তার খোলস ঝড়ে পড়ে।” নবীজী আরো বলেছেন, যে কেউ ঈমানদার নারী বা পুরুষের নামে মিথ্যা অভিযোগ করে, শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ তাকে জ্বলন্ত অগ্নিকান্ডের ওপর বসিয়ে দেবেন, যেন সে এই অপরাধের যোগ্য শাস্তি পায়।”
ফলে অমূলক সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকুন। তারমানে এই নয় যে, আপনি স্ত্রীর আচরণের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসিন থাকবেন। বরং আপনার দেখা আলামতটাকে আপনি নিজেই যাচাই করুন-স্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্যে নয় বরং সত্যটাকে জানার জন্যে। সত্য না জেনেই কোন রকম সিদ্ধান্ত নেয়া, বাড়াবাড়ি করা মারাত্মক ভুল। যে ঘটনাটি আমরা আলোচনার শুরুতে জানলাম, সেখানে সন্দেহবশত স্ত্রীকে পরকীয়ার অভিযোগে যদি অভিযুক্ত করতেন, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হতো? না, সেটি মোটেই ভালো হতো না। স্ত্রী অপমানিত বোধ করতো। নিজস্ব সম্মান ও ব্যক্তিত্ব হারানোর যন্ত্রণায় স্ত্রী অবশ্যই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতেন। অথচ স্ত্রী মোটেই কোন অন্যায় করেননি। শুধুমাত্র ছোট্ট একটি অবিশ্বাস একটি সুন্দর সংসারকে ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দেয়ার আশঙ্কা থেকে যেত। স্বামীর অমূলক সন্দেহের ব্যাপারটা যদি বাইরে জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে আরো বড়ো বিপদ হতে পারে। মানুষ মাত্রই শত্রুমিত্র পরিবেষ্টিত থাকে। আপনার শত্রুরা এই সন্দেহের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আপনার সংসারের ব্যাপারে নাক গলাবার সুযোগ পাবে। তারা আপনার সন্দেহকে যথার্থ বলে প্রমাণ করার কুমতলবে বিভিন্ন গালগল্প ও বানোয়াট ঘটনার জন্ম দেবে। যা আপনার কাছে সত্য বলে মনে হবে। আপনি যখন সে সবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা মহা বিপদে পড়বেন-তখন তারা দেখে দেখে উপহাসের হাসি হাসবে।
মনে রাখবেন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালবাসার সম্পর্ক। এখানে তাই গভীর আবেগ ও আন্তরিকতা কাজ করে। কোন রকম সন্দেহ-অবিশ্বাস ভালবাসা বা আন্তরিকতাকে নষ্ট করে দেয়। সহজ-সরল পবিত্র মনে যদি একবার সন্দেহের কালো দাগ পড়ে, ঐ দাগ চিরজীবন থেকে যাবে। তাই যেকোন কাজ চিন্তা-ভাবনা করে করুন। হুট করে কোন কাজ করে বসা মারাত্মক ভুল, যেমনটি কবিও বলেছেন-
একটু খানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে
ভুল করেছে যারা সবাই ভুক্তভোগী বটে।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, তাহলো স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সন্দেহপরায়নতার যদি কোন কারণই না থাকে, অর্থাৎ স্ত্রী যদি সত্যিই সন্দেহজনক কোন কাজ না করে থাকে, তাহলে স্বামীর সন্দেহপ্রবণতা একটা মানসিক রোগ বৈ কি! এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর কিছু করণীয় থেকে যায়। প্রথমতঃ আপনাকে গভীর মনোযোগ ও আন্তরিকতা দিয়ে দেখতে হবে, আপনার স্বামী আপনার ঠিক কোন আচরণটিকে সন্দেহজনক ভাবছে। যদি আবিস্কার করছে সক্ষম হন, তাহলে ঐ ধরণের কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। আপনি এমনটি ভাববেন না যে আপনি আপনার স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাস হয়ে পড়েছেন। বরং একজন স্ত্রী হিসেবে আপনার মানসিকভাবে অসুস্থ স্বামীর প্রতি এটি আপনার দায়িত্ব। আপনি আপনার ভালবাসা দিয়ে সেবা-যত্ন দিয়ে স্বামীকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করুন।
এভাবে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালবাসার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার সমস্যাগুলো সমাধান করা চেষ্টা করুন। একটি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল পরিবার গঠনের স্বার্থে এ ধরণের আত্মত্যাগের কোন বিকল্প নেই। হযরত আলী (আঃ) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করবো। তিনি বলেছেন, যে অন্যের দুর্বলতার অনুসন্ধান করে, তাকে প্রথমে নিজের দিকে তাকাতে হবে।(রেডিও তেহরান)