আল হাসানাইন (আ.)

কারবালা ও ইমাম হোসাইন (আ.)-২য় পর্ব

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

১ম অংশের পর

মুআবিয়ার মৃত্যু ও ইয়াজিদের চিঠি

মুআবিয়া হিজরী ৬০ সালের রজব মাসে মারা যায় । ইয়াজিদ মদীনার তৎকালীন গভর্ণর ওলিদ ইবনে ওতবার কাছে এক পত্র লিখল । ঐ পত্রে নির্দেশ ছিল যে আমার  আনুগত্যের পক্ষে মদীনার সব লোক বিশেষ করে হোসাইনের কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ কর । হোসাইন যদি বাইআত করতে অস্বীকার করে তাহলে তার গর্দান উড়িয়ে দাও এবং আমার কাছে পাঠিয়ে দাও । ওলিদ মারওয়ানকে দরবারে ডেকে পাঠায় এবং এ ব্যাপারে তার পরামর্শ জানতে চায় । মারওয়ান বলল যে, হোসাইন (আ.) শির নত করবে না এবং কিছুতেই ইয়াজিদের হাতে বাইআত করবে না । তবে আমি যদি তোমার স্থানে থাকতাম এবং তোমার মত ক্ষমতার অধিকারী হতাম তাহলে কালবিলম্ব না করে হোসাইনকে হত্যা করতাম । যদি এমন হয় তাহলে আমার কামনা হল, এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার চাইতে দুনিয়াতে আমার না আসাই ভাল ছিল। কেননা, এত বড় বদনামীর  বোঝা মাথায় নেয়ার চাইতে সেটাই উত্তম হত ।

এরপর সরকারী দূতকে প্রেরণ করল এবং হযরত হোসাইনকে (আ.) নিজের ঘরে ডেকে পাঠাল । হোসাইন (আ.) তার পরিবার ও বন্ধুদের মধ্য থেকে ৩০ জন সঙ্গী সাথে নিয়ে ওয়ালিদের কাছে আসে । ওয়ালিদ মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর তাকে জানাল আর ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত করার অনুরোধ জানাল । হোসাইন (আ.) বলল আমার বাইয়াত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা গোপনে ও লোকচক্ষুর অন্তরালে সম্পন্ন হতে পারেনা । তবে কাল সকালে জনসাধারণকে যখন বাইয়াতের জন্য আহবান করবে তখন আমাকেও অবহিত করবে । মারওয়ান বলল –হোসাইনের কথায় কর্ণপাত করো না এবং তার অজুহাত গ্রহণ করতে যেওনা । যদি বাইয়াত করতে অস্বিকার করে তবে প্রাণে বাচিয়ে রেখো না । হোসাইন (আ.) অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন এবং বললেন – তুমি ধ্বংস হও । হে নষ্টা মেয়ের ছেলে । তুমি কি আমাকে হত্যার আদেশ দিচ্ছ ? আল্লাহর কসম, তুমি মিথ্যা বলেছ । এ কথা বলে তুমি নিজেকে হেয় ও অপমানিত করেছ । এরপর তিনি ওয়ালিদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন – হে আমির! আমরা নবুওতের ঘরের আহলে বাইত, আমরাই রেসালতের খনি । ফেরেশতারা আমাদের ঘরেই আনাগোনা করেন । আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্যই মানুষের দিকে তার রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন । এই রহমতের সমাপ্তি হবে আমাদের নামেই । আর ইয়াজিদ হল একটা মদখোর ফাসেক, খুনী এবং প্রকাশ্যে শরীয়ত লংঘনকারী লোক । আমার মত কোন লোক ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত করবে না । তবে কাল ভোর হোক । এ সময়ের মধ্যে আপনিও ভেবে চিন্তে দেখেন । আমিও চিন্তা ভাবনা করে দেখব যে, আমাদের মধ্যে কে খেলাফতের জন্য অধিকতর যোগ্য । এ কথা বলার সাথে সাথে তিনি ওয়ালিদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন । মারওয়ান ওয়ালিদকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি আমার উপদেশের প্রতি কর্ণপাত করনি । আমার অবাধ্যতা করেছ । ওয়ালিদ বললেন ধ্বংস তোমার জন্য । তুমি কি আমার দ্বীন ও দুনিয়া ধ্বংস করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছ । খোদার কসম আমি চাই না যে, দুনিয়ার রাজত্ব আমার হাতে থাকার জন্য আমি হোসাইনকে (আ.) হত্যা করব । আল্লাহর কসম, আমি বিশ্বাস করি না যে, কেউ হোসাইন (আ.) এর রক্তের বোঝা মাথায় নিয়ে কেউ আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে । এ ধরনের লোকের অবশ্যই নেক আমলের পাল্লা হালকা হবে এবং তার ক্ষমা পাওয়ার আশাও সুদূর পরাহত । মহান আল্লাহ তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না । গোনাহ থেকে তাকে পবিত্র করবেন না । তার জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে ।

 সে রাত কেটে গেল । খুব ভোরে হোসাইন (আ.) ঘর থেকে বেরিয়ে নতুন কোন খবরের অপেক্ষা করছিলেন । মারওয়ান তাকে দেখতে পেল এবং বলল – হে আবু  আব্দুল্লাহ, আমি তোমার হিতাকাংখী; তুমি আমার উপদেশ শ্রবণ কর, তাহলে কল্যাণ লাভ করতে পারবে। হোসাইন (আ.) জিজ্ঞেস করলেন তোমার উপদেশ কি ? সে বলল- আমি তোমাকে আদেশ করছি যে, তুমি অবশ্যই ইয়াজিদ ইবনে মুআবিয়ার হাতে বাইয়াত কর । কেননা তোমার দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য এ কাজ মঙ্গলজনক হবে । হোসাইন (আ.) বললেন-
 انّا لله و انّ الیه راجعون (ইন্নানিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন) যদি তাই হয় আমাকে দ্বীন ইসলাম থেকে বিদায় নিতে হবে । কেননা নবী (সা.) এর উম্মত ইয়াজিদের খেলাফত রাজত্বের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে । আমি আমার নানা আল্লাহর রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, আবু সুফিয়ানের বংশধরদের জন্য খেলাফত হারাম । ইত্যবসরে হোসাইন (আ.) ও মারওয়ানের মধ্যে এ মর্মে বহু কথা কাটাকাটি হয় । শেষ পর্যন্ত ক্রুদ্ধাবস্থায় মারওয়ান চলে গেল ।

মদীনা হতে ইমাম হোসাইনের (আ.) হিজরত


ওয়ালিদ ও মারওয়ানের সাথে  সাক্ষাতের পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ লিখেছেন- ঐদিন ভোরে অর্থাৎ ৬০ হিজরীর ৩রা শাবান ইমাম হোসাইন (আ.) মক্কার দিকে রওয়ানা হন । আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর তার খেদমতে উপস্থিত হন । তারা বলেন যে, আপনি মক্কাতেই অবস্থান করুন । তিনি বলেন – আমার প্রতি রাসূল (সা.) এর যে নির্দেশ আছে তা আমাকে পালন করতেই হবে । ইবনে আব্বাস ইমামের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন । পথে তিনি বলছিলেন- হায় হোসাইন ! এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আসেন এবং বললেন- এখানকার পথহারা লোকদের সংশোধন করাই উত্তম হবে । যুদ্ধের পদক্ষেপ নিবেন না । তিনি বললেন- “আপনি কি জানেন না, দুনিয়া এতখানি নিকৃষ্ট যে, ইয়হিয়া ইবনে যাকারিয়া (আ.) এর মাথা বানি ইসরাইলের এক অবাধ্যের কাছে হাদিয়া হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । আপনার কি জানা নেই যে বনি ইসরাইল সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত ৭০ জন নবীকে হত্যা করে । এরপর বাজারে এসে তারা কেনা কাটায় মশগুল হয় । অর্থাৎ যেন কোন ঘটনাই ঘটেনি । তবুও মহান আল্লাহ তাআলা তাদের আযাব ত্বরান্বিত করেননি । তাদেরকে অবকাশ দেন । আর অবকাশ দানের পরই চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করেন । হে আব্দুল্লাহ ! মহান আল্লাহর ক্রোধ ও আযাবকে ভয় করুন এবং আমার সাহায্য থেকে পিছপা হবেন না ।”

হোসাইন (আ.) এর প্রতি কুফাবাসীর দাওয়াত

কুফাবাসীরা হযরত হোসাইন (আ.) এর মক্কা আগমন এবং ইয়াজিদের হাতে বাইআত গ্রহণে তার অস্বীকৃতির খবর জানত । এ খবর পেয়েই তারা সুলাইমান ইবনে সা’দ খাজায়ীর ঘরে সমবেত হয় । সমাবেশে সুলাইমান ইবনে সা’দ দাড়িয়ে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন । বক্তব্য শেষে তিনি বলেন ওহে আলীর অনুসারীরা! তোমরা সবাই শুনেছ যে, মুআবিয়া মরে গেছে এবং নিজের হিসাব কিতাবের জন্য আল্লাহর দরবারে পৌছে গেছে । তার কৃতকর্মের ফল সে পাবে । তার ছেলে ইয়াজিদ ক্ষমতায় বসেছে । আপনারা আরো জানেন যে, হোসাইন ইবনে আলী (আ.) তার সাথে বিরোধিতা করেছেন এবং তিনি উমাইয়ার জালিম ও খোদাদ্রোহীদের দূরাচার থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন । তোমরা তার পিতার অনুসারী । হোসাইন (আ.) আজ তোমাদের সমর্থন ও সহযোগিতার মুখাপেক্ষী । যদি এ ব্যপারে নিশ্চিত হও যে, তাকে সাহায্য করবে এবং তার দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, তাহলে লিখিত আকারে নিজের প্রস্তুতির কথা তাকে জানিয়ে দাও । যদি ভয় পাও এবং আশংকা কর যে, তোমাদের মধ্যে গাফলতি ও দুর্বলতা প্রকাশ পাবে, তাহলেও তাকে জানিয়ে দাও, তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও । তাকে ধোকা দিও না । এরপর তিনি নিম্নোক্ত বিষয়বস্তুর উপর একটি পত্র লেখেন-
بسم الله الرحمن الرحیم
এ পত্র হোসাইন ইবনে আলী (আ.) সমীপে সুলাইমান ইবনে সা’দ খাজায়ী, মুসাইয়্যেব ইবনে নাজরা, রেফাআ ইবনে শাদ্দাদ, হাবিব ইবনে মাজাহের আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়ায়েলসহ একদল মুমিন ও অনুসারীর পক্ষ হতে প্রেরিত হল ।
সালামের পর আল্লাহর তা’রিফ ও প্রশংসা যে, তিনি আপনার ও আপনার পিতার দুশমনদের ধ্বংস করেছেন । সেই জালিম ও রক্তপিপাসু, যে উম্মতের শাসন ক্ষমতা তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে অন্যায়ভাবে চেপে বসেছে এবং মুসলমানদের বাইতুল মাল আত্মসাৎ করেছে, মন্দ লোকদের বাচিয়ে রেখেছে, আল্লাহর সম্পদকে অবাধ্য দুরাচারীদের হাতে তুলে দিয়েছে, সামুদ সম্প্রদায় যেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হয়েছে তারাও সেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হোক । আপনি ছাড়া আমাদের আজ কোন নেতা নেই । কজেই আপনি যদি আমাদের শহরে তাশরীফ আনেন তাহলে বড়ই অনুগ্রহ হবে । আশা করি আপনার মাধ্যমে আল্লাহ পাক আমাদেরকে সঠিক পথে হেদায়েত করবেন ।

কুফার গভর্ণর নোমান ইবনে বশির ‘দারুল এমারাত’ প্রাসাদে রয়েছে । কিন্তু আমরা তার পেছেনে জামাত ও জুমার নামাজে শরীক হইনি । ঈদের দিন তার সাথে ঈদগাহে যাইনি । যদি শুনতে পাই যে, আপনি কুফায় আসছেন তাহলে তাকে কুফা থেকে বিতাড়িত করে সিরিয়া পাঠিয়ে দেব । হে পয়গাম্বরের সন্তান আপনার প্রতি সালাম, আপনার পিতার পবিত্র রুহের প্রতি সালাম ।
و السلام علیک  و رحمة الله و برکته
و لا حول ولا قوة الا بالله العلی العظیم

চিঠিখানা লেখার পর পাঠিয়ে দিল । দুইদিন অপেক্ষার পর আর একদল লোককে প্রায় ১৫টি চিঠি নিয়ে হযরত  ইমাম হোসাইন (আ.) এর কাছে পাঠিয়ে দিল । ঐ সব চিঠির প্রত্যেকটিতে দুই কি তিন বা চার জনের স্বাক্ষর ছিল । কিন্তু হোসাইন (আ.) এত সব চিঠিপত্র পাওয়ার পরও নীরব রইলেন তাদের কোন পত্রের উত্তর দিলেন না । এমন কি মাত্র এক দিনেই ৩০০ টি চিঠি এসে তার হাতে পৌছে । এরপরও পর্যায়ক্রমে একের পর এক চিঠি আসছিল । তার চিঠি ১২হাজার ছাড়িয়ে যায় । সর্বশেষ যে চিঠিখানা তার হাতে এসে পৌছে তা ছিল হানি ইবনে হানি ছবিয়ী এবং সায়ীদ ইবনে আব্দুল্লাহ হানাফীর । তারা উভয়ে ছিল কুফার অধিবাসী ।  ঐ পত্রে তারা লিখেন-

بسم الله الرحمن الرحسم

  ইবনে  হোসাইন আলী (আ.) এর খেদমতে তার ও তার পিতার অনুসারীদের পক্ষ হতে প্রেরিত হলো । সালাম বাদ জনগন আপনার আগমনের অপেক্ষায়। আপনি ছাড়া কাউকে তারা চায় না । হে নবীর সন্তান ! অতি শীঘ্র আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন । কেননা, বাগ-বাগিচাগুলোতে সবুজের সমারোহ এসেছে, ফলগুলো পেকেছে, লতাগুল্ম জেগে উঠেছে এবং সবুজ পত্রে গাছের সৌন্দর্য  শোভায় মাতিয়ে তুলেছে । আসুন আপনি আমাদের মাঝে আসুন । কেননা আপনার সৈন্যদলের মাঝেই তো আপনি আসবেন ।
و السلام علیک  و رحمة الله وبرکته و علی ابیک من قبلک -

 চিঠি পাওয়ার পর পত্র বাহক দু’জনের কাছে হোসাইন ইবনে আলী (আ.) জিজ্ঞেস করেন – এ চিঠিগুলো কে কে লিখেছে । তারা বলল, হে আল্লাহর রাসুলের সন্তান! পত্রের লেখকরা হলেন-শাব্স ইবনে রাবায়ী, হাজার ইবনে আবজার, ইয়াজিদ ইবনে হারেছ, ইয়াজিদ ইবনে রোয়াম, উরওয়া ইবনে কাইছ, আমর ইবনে হাজ্জাজ এবং মুহাম্মদ ইবনে ওমর ইবনে আতারেদ ।

মুসলিম ইবনে আকিলের কুফা গমন

এরুপ পরিস্থিতিতে হোসাইন ইবনে আলী (আ.)একদিন কাবাঘরের পাশে গিয়ে রুকন ও মাকামে ইব্রাহীমের মাঝখানে দাড়িয়ে দু’রাকত নামায আদায় এবং মহান আল্লাহর দরবারে পরিস্থিতির কল্যাণকর পরিণতির জন্য দোয়া করেন । অতপর মুসলিম ইবনে আকিলকে ডেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন ।
এরপর ইমাম হোসাইন (আ.) কুফাবাসীর চিঠির জবাব লিখে মুসলিম ইবনে আকিলের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। জবাবী পত্রে তাদের আমন্ত্রণ কবুলের ওয়াদা দিয়ে লেখা ছিল- আমি আমার চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিলকে তোমাদের কাছে পাঠালাম যাতে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করে ।
মুসলিম ইমামের পত্র নিয়ে কুফায় আসেন । কুফাবাসী হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ও মুসলিম ইবনে আকিলকে পেয়ে আনন্দিত হল ।তাকে মুখতার ইবনে আবী ওবায়দা সাকাফীর বাড়িতে থাকতে দিলেন । অনুসারীরা দলে দলে মুসলিম ইবনে আকিলের সাথে সাক্ষাত করতে আসতে লাগল । প্রত্যেক দল আসার সাথে সাথে মুসলিম ইমামের পত্র পড়ে শুনাতে থাকেন । আনন্দে দর্শনার্থীদের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল এবং তার হাতে বাইআত গ্রহণ করছিল । দেখতে দেখতে আঠারশো লোক তার হাতে বাইআত গ্রহণ করে ।

ইবনে যিয়াদ কুফার গভর্ণর নিযুক্ত

 আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিম বাহেলী, এমারা ইবনে ওয়ালীদ এবং ওমর ইবনে সাআদ ইয়াজিদের কাছে এক পত্র পাঠিয়ে মুসলিম ইবনে আকিলের আগমন সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন । ঐ পত্রে নোমান ইবনে বশীরকে কুফার গভর্ণরের পদ থেকে সরিয়ে অপর কাউকে  কাউকে নিয়োগ দানের অনুরোধ জানায় । ইয়াজিদ বসরার গভর্ণর ওবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদের কাছে একটি পত্র লিখে  বসরার সাথে কুফার গভর্ণরের দাযিত্বও তাকে প্রদান করে । ঐ পত্রে মুসলিম ও হোসাইনের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিবরণ দেয় । পত্রে কড়া নির্দেশ প্রদান করে যে, মুসলিমকে গ্রেফতার ও হত্যা কর। ইবনে যিয়াদ চিঠি পাওয়ার পর কুফা গমনের উদ্দেশ্যে তৈরী হয়ে যায় ।

মুসলিমের আত্মগোপন

 মুসলিম ইবনে আকিল এ সংবাদ শুনে ভয় পেলেন । হয়তো ইবনে যিয়াদ তার কুফা অবস্থানের সংবাদ জেনে ফেলতে পারে । এমনকি তার অনিষ্ট সাধন করতে পারে এজন্যে তিনি মুখতারের ঘর থেকে এসে হানি ইবনে উরওয়ার ঘরে আশ্রয় নেন । হানি ইবনে উরওয়া তাকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিলেন । এর পর থেকে তার ঘরে অনুসারীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে । ইবনে যিয়াদ মুসলিম ইবনে আকিলের বাসস্থান খুজে বের করার জন্য কিছু গুপ্তচর নিযুক্ত করেছিল । হানি ইবনে উরওয়ার ঘরে আত্মগোপন করেছে বলে জানতে পারার পর মুহাম্মদ ইবনে আশআছ, আসমা ইবনে খারেজা ও আমর ইবনে হাজ্জাজকে তলব করে বলল- হানি কেন আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলনা । তারা বলল জানিনা। তবে হানি অসুস্থ বলেই শুনেছি । ইবনে যিয়াদ বলল যে, আমি শুনেছি যে, তার অসুস্থতা সেরে গেছে এবং সে তার ঘরের পেছন দরজায় বসে । যদি জানতে পারি যে, সে সত্যিই অসুস্থ তাহলে তাকে দেখতে যাব ।
তবে তুমি গিয়ে তাকে বল যে, আমাদের অধিকার যেন খর্ব না করে । আমার সাক্ষাতে যেন আসে । কেননা আমি চাই না যে, তার মত আরবের সম্মানিত ব্যক্তি আমার কাছ থেকে দূরে থাকুক । তার প্রতি অন্যায় হোক । এ তিন ব্যক্তি রাতের প্রথম ভাগে হানির ঘরে উপস্থিত হয়ে বললেন- আপনি কেন আমীরের সাথে সাক্ষাতে যাচ্ছেন না । অথচ তিনি আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। বলেছেন যে, অসুস্থ বলে জানতে পারলে আমি তার সাক্ষাতে যাব । হানি বললেন অসুস্থের কারণেই যেতে পারিনি । তারা বলল – ইবনে যিয়াদ জানতে পেরেছে যে, রাতের বেলা আপনি ঘরের দরজায় বসেন । কাজেই আপনার না যাওয়াতে তিনি অসন্তুষ্ট । আপনার মত গোত্রপতির পক্ষ থেকে অবহেলা ও অবজ্ঞা  তিনি বরদাশত করবেন না । দয়া করে আপনি আমাদের সাথে তার সাক্ষাতে চলুন । হানি তার পোশাক পরিধান করে দারুল ইমারার দিকে চললেন । দারুল ইমারার নিকট পৌছেই যেন তিনি অনুভব করলেন তার সামনে অনেক বিপদ । তিনি স্বীয় ভ্রাতৃস্পুত্র হিশাম ইবনে আসমা ইবনে খাজোকে সম্বোধন করে বললেন- খোদার কসম! আমি এই লোককে (ইবনে যিয়াদ) ভয় পাচ্ছি । তোমার কি মত ? বলল-চাচাজান কোন ভয় নেই । আপনি এসব দুশ্চিন্তা বাদ দিন । হানি তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে যিয়াদের কাছে উপস্থিত হন । ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ হানির দিকে দৃষ্টি দিতেই বলে উঠল : “যে ব্যক্তি তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার পাগুলো কি তাকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছে ? তার পর ইবনে যিয়াদ একটি কবিতা পাঠ করে যার অর্থ হল এই যে, আমি চাই হানি জীবিত থাকুক, কিন্তু সে তার  ঘরে আমার ক্ষতি করার চক্রান্ত করছে ।” হানি জিজ্ঞেস করলেন- হে আমীর আপনার এ কথার উদ্দেশ্য কি ? বলল চুপ কর হানি: তোমার ঘরে যে, আমীরুল মোমেনীন ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে তার কারণ কি ? মুসলিম ইবনে আকিলকে তোমার ঘরে এনেছ এবং তার জন্য লড়াকু সৈন্য যোগাড় করেছ । তোমার প্রতিবেশীদের ঘরে তাদের জমায়েত করেছ । তুমি কি মণে করেছ যে, আমার কাছে এসব গোপন রয়েছে ? হানি বলল আমি এমন কাজ করিনি । ইবনে যিয়াদ বলল তুমি করেছ । হানি আবারও অস্বীকার করলেন । ইবনে যিয়াদ বলল আমার গোলাম মাকালকে ডাক । মাকাল ছিল তার গুপ্তচর, সে মুসলিম এবং তার সহকর্মীদের তথ্য সংগ্রহে নিযুক্ত ছিল । মা’কাল ইবনে যিয়াদের পাশে দাড়াল । হানির দৃষ্টি যখন তার উপর পড়ল, তিনি বুঝতে পারলেন যে, সে গুপ্তচর ছিল । তিনি বললেন হে আমীর – আল্লাহর কসম আমি মুসলিমকে ঘরে ডেকে আনিনি । তিনিই আমার ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন । তাকে বের করে দিতে আমার লজ্জা হয়েছে। তাই আশ্রয় দিয়েছি । তাকে মেহমান হিসেবে আশ্রয় দিয়েছি । এখন যেহেতু আপনি জানতে পেরেছেন, আমাকে অনুমতি দিন আমি বাড়ী গিয়ে তাকে বলে দেই আমার ঘর ছেড়ে যেখানে ইচ্ছা চলে যান । যাতে আমার জিম্মা শেষ হয় এবং ঘরের মধ্যে আশ্রয় দেয়া থেকে রেহাই পাই । ইবনে যিয়াদ বলল- মুসলিমকে হাজির না করে আমার সামনে থেকে নড়তে পারবে না । তিনি বললেন- আল্লাহর কসম আমি কখোনই একাজ করব না । হত্যা করার জন্য আমি আমার মেহমান আপনার হাতে তুলে দিব ? খোদার কসম কেউ যদি আমাকে সাহায্য না করে এবং আমি একাকীও হই তবুও তার আগে মৃত্যূবরণ না করা পর্যন্ত তাকে তোমাদের হাতে তুলে দেব না । ইবনে যিয়াদ বলল মুসলিমকে আমার সামনে হাজির করতেই হবে না হলে তোমার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে । হানি বললেন- এমন কাজ করলে তোমার ঘরের চারপাশে অনেক নাঙ্গা তরবারী ছুঠে আসবে । ইবনে যিয়াদ বলল ওহে হতভাগা আমাকে তরবারীর ভয় দেখাও । হানি ভেবেছিল তার গোত্রের লোকেরা তার কথা শুনতে পাচ্ছিল । ইবনে যিয়াদ তাকে লাঠির সাহায্যে তার কপালে নাকে মুখে বেদম প্রহার করল । এতে তার নাক মুখ দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল । এর পর তাকে দারুল ইমারার একটি কক্ষে বন্দি করে রাখা হল ।
আমর ইবনে হাজ্জাজ যার মেয়ে ছিল ইবনে যিয়াদের স্ত্রী, যখন হানির মৃত্যূর সংবাদ পেল মাজহাজ গোত্রের লোকদের নিয়ে রওনা হল এবং দারুল ইমারাকে ঘেরাও করে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল- আমি আমর ইবনে হাজ্জাজ এবং এই জন সমষ্টি হল মাজহাজ গোত্রের সম্মানিত লোক ও অশ্বারোহী দল । আমরা বাদশাহর আনুগত্য ত্যাগ করিনি । মুসলমানদের দল পরিত্যাগ করিনি । কিন্তু শুনতে পেয়েছি যে, আমাদের নেতা হানিকে হত্যা করা হয়েছে । ইবনে যিয়াদ তাদের কথা শুনে শুরাইহ কাজীকে হুকুম দিল যে,  যাও হানিকে দেখে এসো এবং তার গোত্রকে সংবাদ দাও সে বেচে আছে, কাজী ইবনে যিয়াদের কথানুযায়ি কাজ করল এবং তাদের উদ্দেশ্যে বলল হানি নিহত হয়নি । মাজহাজ গোত্র একথা শুনেই রাজী হয়ে গেল এবং তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে চলে গেল ।

মুসলিম ইবনে আকিলের সংগ্রাম

হানির নিহত হওয়ার সংবাদ মুসলিম ইবনে আকিলের কাছে পৌছার পর যত লোক তার হাতে বাইআত করেছিল, তাদের সহ তিনি ইবনে যিয়াদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য বের হন । ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ এ সময় দারুল ইমারায় আশ্রয় নেয় এবং প্রাসাদের ভীতরে ঢোকার সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেয় । তার দলীয় লোকেরা মুসলিমের সঙ্গী সাথীদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় । আর যারা যিয়াদের সাথে দারুল ইমারার (প্রাসাদ) ভেতরে ছিল তারা মুসলিমের বাহিনীকে সিরিয়া থেকে সৈন্য বাহিনী আসার হুমকি দিচ্ছিল । ঐ দিন এভাবেই কেটে গেল এবং রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এল । এ সময় মুসলিমের সঙ্গী সাথীরা ধীরে ধীরে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল । পরস্পর বলাবলি করতে লাগল আমরা কেন গোলযোগ আর বিশৃংখলার আগুন জ্বালাচ্ছি । আমাদের তো উচিৎ ঘরে বসে থাকা আর মুসলিম ও ইবনে যিয়াদের ব্যাপারে নিজেকে না জড়ানো । আল্লাহই তাদের মধ্যে সমাধান করে দিবেন । এভাবে সবাই চলে গেল শেষ পর্যন্ত ১০ জন লোক ছাড়া আর কেউই মুসলিমের সাথে রইল না । এবার তিনি মসজিদে এসে মাগরিবের নামাজ পড়লেন, নামাজের পর দেখলেন ঐ দশ জনও সেখানে নেই । তিনি অত্যন্ত অসহায়ভাবে মসজিদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন । অলিগলির পথ চলতে চলতে তিনি ‘তাওয়া’ নাম্নী এক মহিলার ঘরে এসে পানি চাইলেন । মহিলা পানি দিলে তা তিনি পান করলেন এবং  মুসলিমকে আশ্রয় দিলেন । কিন্তু তার ছেলে গিয়ে ইবনে যিয়াদকে ব্যপারটা জানিয়ে দিল । ইবনে যিয়াদ মুহাম্মদ ইবনে আশআসকে একদল লোক সহ মুসলিমকে গ্রেফতারের জন্য পাঠাল । মুসলিম তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলেন এবং  তাদের সাথে একাই যুদ্ধে লিপ্ত হলেন ও তাদের বেশ কিছু লোককে হত্যা করলেন । আশআস চিৎকার দিয়ে বলল – হে মুসলিম আমরা তোমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছি । মুসলিম বললেন- ধোকাবাজ, ফাসেক লোকদের নিরাপত্তা দেয়ার কোন দাম নেই । যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে মুসলিমের ঢাল ও তরবারী ভেঙ্গে যাওয়ায় তার মনোবল কিছুটা দূর্বল হয়ে যায় (এত গুলো মানুষের সাথে একাই তাও আবার ভাঙ্গা ঢাল ও তরবারী নিয়ে ) ইতি মধ্যে এক ব্যক্তি পিছন থেকে তীরের সাহায্যে আঘাত করলে তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে যান । তখন তাকে বন্দী করে ইবনে যিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় ।

মুসলিম ও হানির শাহাদত

 ইবনে যিয়াদ বকর ইবনে হামারানকে দারুল ইমারার ছাদের উপর মুসলিমকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার নির্দেশ দিল । মুসলিম যাওয়ার সময় তাছবীহ পাঠ করছিলেন এবং আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্র্রার্থনা করছিলেন । ছাদের উপর পৌছা পর্যন্ত তিনি রাসূল (সা.) এর উপর দরুদ পাঠ করতে থাকলেন ।
তার মাথা দেহ থেকে আলাদ হয়ে গেল । তার হত্যাকারী অত্যন্ত ভীত বিহ্বলভাবে ছাদ থেকে নেমে আসল । ইবনে যিয়াদ জিজ্ঞেস করল তোমার কি হল । বলল হে আমীর যখন তাকে হত্যা করছিলাম তখন কুৎসিত কাল চেহারা এক লোক দেখলাম যে আমার মুখোমুখি দাড়িয়ে দাতে নিজের আঙ্গুল কামড়াচ্ছে । তাকে দেখে এত ভয় পেয়েছি যে জীবনে কোন কিছুতেই এত ভয় পাইনি । যিয়াদ বলল মণে হয় মুসলিমকে হত্যা করাতে তোমার মণে ভয় ধরে গেছে । এরপর হানিকে নিয়ে আসার হুকুম দিল । হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে যিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়া হল ।তখন হানি বারবার বলছিলেন- “কোথায় আমার গোত্রের লোকেরা ? কোথায় আমার আত্মীয় স্বজন?”
     জল্লাদ বলল মাথা নোয়াও । হানি বললেন খোদার কসম! আমার প্রাণ ও গর্দান দান করার জন্য আমি বদান্যতা দেখাব না । আমাকে হত্যা করার কাজে তোমাকে সহায়তা করব না । রশীদ নামক ইবনে যিয়াদের এক গোলাম তরবারীর আঘাত হেনে তাকে শহীদ করল ।
     ইবনে য়িয়াদ মুসলিম ইবনে আকিল ও হানির মৃত্যূর খবর জানিয়ে ইয়াজিদকে চিঠি লিখল । কয়েক দিন পর জবাব আসল । ইয়াজিদ তার কাজের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখল- শুনেছি যে, হোসাইন কুফার দিকে আসছে । এ সময় তাকে ধরপাকর করতে হবে । প্রতিশোধ নিতে হবে । কারো বিরোধিতার আশংকা ও আলামত দেখা দিলে সাথে সাথে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ কর ।

চলবে……………..

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)