আল হাসানাইন (আ.)

পিতামাতার অধিকার

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5
একটি পরিবারে সদস্যদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো পিতামাতা ও সন্তানাদির মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। অর্থাৎ সন্তানাদি ও পিতামাতা উভয়কেই তাদের অধিকারের ব্যাপারে পরস্পর সচেতন থাকতে হবে। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে সন্তানাদি ও সমাজের প্রতি একজন পিতার বহু কর্তব্য রয়েছে। নবী-রাসূলগণ, বিশেষ করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা পিতামাতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ এবং তাদের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। সত্যিকার অর্থে ছেলেমেয়েদেরকে সর্বদাই তাদের পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায়, মুসলমানদেরকে আল্লাহর ইবাদতের আহ্বান জানানোর পরপরই পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। যেখানেই অস্বীকার করা হয়েছে, সেখানেই কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলা হয়েছে এবং সাথে সাথে পিতামাতার প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা পোষণ করতে বলা হয়েছে : ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর শরীক করবে না; এবং অভাবগ্রস্ত , নিকট প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, পথচারী এবং অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, আত্মগর্বীকে।’ (সূরা নিসা : ৩৬)
কেউ বেহেশতে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে অবশ্যই তার পিতা ও মাতাকে সন্তুষ্ট করতে হবে। ইসলামী শিক্ষায় পারিবারিক বন্ধনকে জোরদার এবং পারিবারিক পরিবেশকে আন্তরিকতাপূর্ণ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তাঁর ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে এবং পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে; তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের প্রতি উফ্ (বিরক্তি, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, ক্রোধ ও ঘৃণাসূচক কোন কথা) বল না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সাথে সম্মানসূচক নম্র কথা বল। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল : ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩ ও ২৪)
ইবাদত-বন্দেগিতে ইখলাস বা নিষ্ঠা একটি বড় ধরনের ধর্মীয় বিধান এবং তা বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে কোন সমস্যা বা অভাব থাকলে তা আল্লাহর সাথে শরীক করার মতো পাপের সমতুল্য। সকল পাপেরই উৎস হচ্ছে র্শিক। যদি কোন ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে এবং অন্য কারো ইবাদত না করে, তাহলে সে নিজেকে শয়তানের কবল থেকে এবং নাফসের দাসত্ব থেকে রক্ষা করতে পারবে। সে কখনও পাপ করবে না এবং খোদার বিধান বা আদেশ লঙ্ঘন করবে না। সে কেবল তাই করবে যা করতে উপদেশ দেয়া হয়েছে এবং যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা থেকে বিরত থাকবে। খোদা ছাড়া অন্য কারো প্রতি আনুগত্যই সকল পাপের উৎস এবং অন্যের প্রতি আনুগত্যও এক ধরনের দাসত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘হে বনি আদম! আমি কি তোমাদের নির্দেশ দেইনি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব কর না, কারণ, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা ইয়াসীন : ৬০)
এমনকি এই পৃথিবীর স্রষ্টা ও প্রতিপালককে অস্বীকারকারী নাস্তিক কাফেরও বহুত্ববাদী। কেননা, তার আত্মা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করা সত্ত্বেও সে বিশ্বাস করে যে, প্রকৃতির ব্যবস্থাপনা প্রকৃতিই পরিচালনা করছে।
তাওহীদে বিশ্বাস এবং একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের পরেই পিতামাতার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার গুরুত্ব রয়েছে এবং মানব সমাজের বিকাশ ও সমৃদ্ধিই এর ওপর নির্ভরশীল। অতএব, মানবীয় ঐতিহ্য ও ফিতরাতের বিচারেই মানুষের উচিত তার পিতামাতাকে শ্রদ্ধা করা। এই বিধান যদি অনুসৃত না হয় এবং সন্তানরা তাদের পিতামাতাকে বহিরাগত বা আগন্তুকের মতো অনুভব করে তাহলে নিশ্চিতভাবেই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পারিবারিক জীবন থেকে মিলিয়ে যাবে এবং সামাজিক জীবনের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে, অবক্ষয় দেখা দেবে।
সূরা বনি ইসরাইলের ২৩ নম্বর আয়াতে ‘কিবারা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে অর্থাৎ ‘তাদের একজন অথবা উভয়েই বার্ধক্যে উপনীত হলে’- উক্ত ‘কিবারা’ শব্দ দ্বারা পিতামাতার বার্ধক্যের কথাই বুঝানো হয়েছে এবং ‘উফ্’ শব্দ দ্বারা তাদের প্রতি ভর্ৎসনা, তিরস্কার বা মনে আঘাত দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
‘তাদের প্রতি অবমাননাকর কোন শব্দ উচ্চারণ কর না।’ এই আদেশ দিয়ে বিশেষভাবে বার্ধক্য বয়সের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, এই বয়সে পিতামাতা তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম পর্যায়ে উপনীত হন এবং নিজেরা নিজেদের পরিচর্যা ও প্রয়োজন পূরণে অসমর্থ হয়ে পড়েন বিধায় সন্তানদের সাহায্য-সহযোগিতা তাদের জন্য খুবই জরুরি। অতএব, এখানে এ বক্তব্যটিই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, পিতামাতা যখন বৃদ্ধ ও অক্ষম হয়ে উঠবেন তখন সন্তানদের উচিত তাদের ভালোবাসা ও যত্ন নেয়া।
‘…তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল : ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৪)
‘পক্ষপুট অবনমিত করা’র  কথা বলে এখানে আক্ষরিক ও বাস্তব অর্থে অতিশয় বিনয় ও নম্র আচরণের কথা বলা হয়েছে। সন্তানদেরকে কথায় ও কাজে পিতামাতার প্রতি বিনয়ী ও অনুগত হতে হবে। উপরিউক্ত আয়াতে লোকদেরকে পিতামাতার সাথে এমনভাবে আচরণ করতে, সম্পর্ক-সাহচর্য বজায় রাখতে ও কথা বলতে বলা হয়েছে যে, তার মধ্যে যেন কোন রকম ঔদ্ধত্য প্রকাশ না পায় এবং পিতামাতা সন্তানদের কাছ থেকে বিনয়, ভদ্রতা ও ভালোবাসা লাভ করতে পারে। পিতামাতার জন্য সন্তানের দোয়া বা মোনাজাতে জীবিতকালে পিতামাতার অন্তর উৎফুল্ল হয় ও সান্ত্বনা লাভ করে এবং মৃত্যুর পর তাদের রুহ মাগফেরাত লাভ করে। প্রতিটি ব্যক্তি ও পরিবারের জন্যই ইসলাম এই উচ্চতর মূল্যবোধ লালন করার নির্দেশ দিয়েছে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)