ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর কিছু মূল্যবান বাণী
পবিত্র ইমামগণের বাণীসমূহ হলো তাঁদের জ্ঞান সূর্যেরই এক দীপ্তিময় শিখা। আল্লাহর বান্দাগণের জন্য তা উজ্জ্বল এবং নিশ্চিত পথনির্দেশনা স্বরূপ। কেননা এ মহামানবগণ সকল প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং ভ্রান্তি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। মানুষের সার্বিক দিক বিবেচনা করেই পবিত্র ইমামগণ পথ নির্দেশনা দিয়ে থাকেন,কোন এক বিশেষ দিক বিবেচনা করে নয়। তাঁরা এ পথ নির্দেশনা কোন বিশেষ গোষ্ঠীকে বিবেচনা করেও প্রদান করেন না,বরং সকল শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মানুষকে মানবিক উৎকর্ষের দিকে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যেই প্রদত্ত হয়ে থাকে,তাঁদের এ সার্বিক দিক নির্দেশনা। আর তা মানুষের সকল পর্যায়ের ফেতরাতসমূহকে জাগ্রত ও আন্দোলিত করতে সহায়তা করে থাকে।
এখন আহলে সুন্নাতের কিতাব থেকে নবম ইমাম হযরত আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী আল জাওয়াদ (আ.)-এর পবিত্র বাণীসমূহ থেকে কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরব। আশা করি,এ পথনির্দেশনা থেকে আমরাও উপকৃত হব।
১. مَنِ استَغنَى بِاللهِ اِفتقَرَالنّاسُ اِلَيهِ و مَن اِتَّقَى الله اَحَبَّهُ النّاسُ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং মানুষের মুখাপেক্ষী না হয়,মানুষ তার প্রতি নির্ভরশীল হয়। আর যে ব্যক্তি তাকওয়া (খোদাভীরুতা) অবলম্বন করে সে মানুষের নিকট প্রিয় ভাজন হয় (নুরুল আবসার,পৃ. ১৮০)।
২. الكمالُ فى العقلِ
অর্থাৎ কোন ব্যক্তির পূর্ণতা হলো তার বুদ্ধিমত্তায় বা বিচক্ষণতায়। (আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ,পৃ. ২৯০)।
৩. حسبُ المرء مِن كمالِ المرُوَّةِ اَن لايلقى اَحَداً بما يَكرهُ
অর্থাৎ যা সে নিজের জন্য অপছন্দ করে,কারো প্রতি ঐরূপ আচরণ না করাই হলো পরিপূর্ণ মহানুভবতা (নূরুল আবসার,পৃ. ১৮০)।
৪. لا تعالجوا الامرَ قبلَ بُلُوغِهِ فَتَندَمُوا ولا يَطُولَنَّ عليكم الامَلُ فتقسوا قلوبكم و ارحموا ضعفائكم و اطلبوا من الله الرحمة بالرحمة فيهم
অর্থাৎ যে কর্মের সময় এখনো আসেনি তার জন্য তাড়াহুড়া করো না,করলে অনুতপ্ত হবে। আকাশচুম্বি আশা-আকাঙ্ক্ষা করোনা,কেননা তার মাধ্যমে আত্মা পাষণ্ড ও কঠিন হয়। দুর্বল-অক্ষমদের প্রতি দয়া কর এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর (আল ফুসুলুল মোহেম্মাহ,পৃ. ২৯২) ।
৫. مَن اِستَحسَنَ قبيحاً شريكاً فيهِ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি অসৎকর্মের (কদর্যতার) প্রশংসা করে সে ঐ অসৎকর্মের অংশীদার (নূরুল আবসার,পৃ. ১৮০)।
৬. العامل باالظلم و المعين عليه والرّاضى شركاءُ
অর্থাৎ অত্যাচারী ও তার সাহায্যকারী এবং ঐ অত্যাচারের প্রতি তুষ্টি জ্ঞাপনকারীর প্রত্যেকেই অত্যাচারীর সমান (আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ,পৃ. ২৯১)।
৭. مَن وعظ اخاه سراً فقد زانه و مَن وعظهُ علانية فقد شانه
অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে গোপনে উপদেশ দিল সে তাকে অলংকৃত করল। আর যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে প্রকাশ্যে নসিহত করল সে তার সামাজিক ভাবমূর্তিকে ভুলুণ্ঠিত করল (নূরুল আবসার,পৃ. ১৮০)।
৮. القصد الي الله باالقلوب ابلغُ من اثباتِ الجوارح بالاعمال
অর্থাৎ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহকে স্মরণ করা,অমনোযোগের সাথে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কার্যে নিয়োজিত করার চেয়ে বেশি কার্যকরী (আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ,পৃ. ২৮৯)।
৯. يوم العدل علي الظالم اشدُّ من يوم الجور على المظلوم
অর্থাৎ অত্যাচারের দিন অত্যাচারিতের জন্য যতটা কষ্টদায়ক,ন্যায়বিচারের দিন অত্যাচারীর জন্য তার চেয়ে অধিক কষ্টদায়ক (আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ,পৃ. ২৯১)।
১০. عنوان صحيفة المسلم حسن خلقه
অর্থাৎ পুনরুত্থান দিবসে মুসলমানদের আমলনামা তাদের সুন্দর আচার-ব্যবহার দ্বারা শুরু করা হবে (নূরুল আবসার,পৃ. ১৮০)।
১১. ثلاثٌ يبلِّغنَ بالعبد رضوان الله تعالى كثرة الاستغفار و لين الجانب و كثرة الصدقة و ثلاث من كنَّ فيه لم يندم : ترك العجلة والمشورة والتوكّل على الله عند العزم
অর্থাৎ তিনটি জিনিসের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে : ১. আল্লাহর কাছে অধিক ক্ষমা প্রার্থনা করা ২. মানুষের সাথে নমনীয় আচরণ করা ৩. অধিক সদকা দেওয়া। তিনটি বৈশিষ্ট্য কারো মধ্যে থাকলে সে কখনোই অনুতপ্ত হবে না। ১. কোন কার্যে চঞ্চলতা প্রদর্শন না করা ২. পরামর্শ করে কাজ করা ৩. আল্লাহর উপর ভরসা রেখে কার্য শুরু করা (আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ,পৃ. ২৯১)।
১২. من امل فاجراً كانَ ادنى عقوبته الحرمان
অর্থাৎ যে ব্যক্তি চরিত্রহীন-পাপাচারীর প্রতি আশাবাদী হয় তার এ অপরাধের নূন্যতম শাস্তি হচ্ছে বঞ্চনা (নূরুল আবসার,পৃ. ১৮১)।
১৩. من انقطع الى غير الله وكله الله اليه و من عمل على غير علم افسد اكثر ممّا يصلح
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো প্রতি আশাবাদী হয়,আল্লাহ তায়ালা তাকে ঐ ব্যক্তির উপর ছেড়ে দেন। আর যে ব্যক্তি পর্যাপ্ত জ্ঞান ও তথ্য ছাড়াই কোন কার্য সম্পাদন করে তার সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি (আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ,পৃ. ২৮৯)।
১৪. اهل المعروف الى اصطناعه احوج من اهل الحاجة اليه لانّ لهم اجرهم و فخره و ذكره فمهما اصطنع الرجل من معروفٍ فانّما يبتدءُ فيه بنفسه
অর্থাৎ কল্যাণকারীদের কল্যাণ কর্ম সাধনের প্রয়োজনীয়তা অভাবগ্রস্তদের চেয়ে বেশি। কেননা পরোপকারিতা ও বদান্যতা তাদের জন্যে পুরস্কার,গৌরব এবং সুখ্যাতি বয়ে আনে। সুতরাং সৎকর্মপরায়ণগণ যখনই কোন জনকল্যাণমূলক কার্য সম্পাদন করেন মূলতঃ প্রথমে নিজের প্রতিই কল্যাণ করেন (নূরুল আবসার,পৃ. ১৮০)।
১৫. العفاف زينة الفقر، والشكر زينة الغنى، والصبر زينة البلاء، والتواضع زينة الحسب، و الفصاحة زينة الكلام، والحفظ زينة الرواية، و خفض الجناح زينة العلم، و حسن الادب زينة العقل، و بسط الوجه زينة الكرم، و ترك المن زينة المعروف، والخشوع زينة الصلواة، و ترك ما لا يعنى زينة الورع
অর্থাৎ সচ্চরিত্র দারিদ্রের অলঙ্কার। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ (আল্লাহর প্রতি শোকর) সম্পদশালীর অলঙ্কার। ধৈর্য-স্থৈর্য,বালা-মুসিবতের অলঙ্কার। নমনীয়তা মহত্ত্বের অলঙ্কার। ভাষার প্রাঞ্জলতা (দক্ষতা) বক্তব্যের অলঙ্কার। সংরক্ষণ এবং মুখস্থ করা বর্ণনার (হাদিসের) অলঙ্কার। সৌজন্যবোধ (বিনয়) জ্ঞানের অলঙ্কার। শিষ্টাচার বুদ্ধিমত্তার অলঙ্কার। সদাহাস্য বদন (আনন্দচিত্ত) দয়াশীলতা এবং মহানুভবতার অলঙ্কার। কল্যাণ কামিতা বদান্যতার অলঙ্কার। মনোযোগ এবং নিষ্ঠা নামাজের অলঙ্কার। অনর্থক কার্য পরিত্যাগ করা খোদাভীরুতা ও পরহেজগারীর অলঙ্কার (আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ,পৃ. ২৯১)।
১৬. من وثقَ باالله و توكل علي الله نجاه الله من كلَ سوءٍ و حرز من كل عدو
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখবে এবং তাঁর উপর নির্ভরশীল হবে,আল্লাহ্ তায়ালা তাকে সকল অনিষ্ট থেকে মুক্তি দিবেন এবং সকল প্রকার শত্রুতা থেকে সংরক্ষণ করবেন (নূরুল আবসার,পৃ. ১৮০)।
১৭. الدين عزٌّ، والعلم كنزٌ، والصمتُ نورٌ، ولا هدم للدين مثل البدع، ولا افسد للرجال من الطمع، و بالراعى تصلح الرعية، و بالدعاء تصرف البلية
অর্থাৎ দীন হচ্ছে মর্যাদার উৎস। জ্ঞান হলো ঐশ্বর্য (গুপ্তধন)। নীরবতা হলো নূর। কোন কিছুই বেদয়াতের ন্যায় দীনকে ধ্বংস করে না। কোন কিছুই লোভ-লালসার মত মানুষকে নষ্ট করে না। যোগ্য ও পূণ্যবান রাষ্ট্রনায়ক কর্তৃক মানুষ (জনগণ) সংশোধিত হয়। দোয়া এবং প্রার্থনার মাধ্যমে বিপদ-আপদ দূরীভুত হয় (আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ,পৃ. ২৯০)।
১৮. الصبر على المصيبة مصيبة للشامت
অর্থাৎ বিপর্যয় এবং মুছিবতে কারো ধৈর্যধারণ,তার শত্রুর জন্যে মুছিবত স্বরূপ। কেননা সে (দুশমন) অন্যের দুঃখে তিরস্কার এবং আনন্দ প্রকাশ করতে চায় (নুরুল আবসার,পৃ. ২৯০)।
১৯. كيف يضيع من الله كافله و كيف ينجو من الله طالبة
অর্থাৎ কিরূপে সম্ভব যে,আল্লাহ্ তায়ালা যার পৃষ্ঠপোষক সে ধ্বংস হয়ে যাবে! আর কিরূপে সম্ভব আল্লাহ্ যার অনিষ্ট চান সে নিস্কৃতি পাবে (আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ,পৃ. ২৮৯)।
২০. قال عليه السلام فى جواب رجل قال له اوصنى بوصية جامعة مختصرة قال صن نفسك عن عار العاجلة و نار الاجلة
অর্থাৎ এক ব্যক্তি ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর কাছে অনুরোধ করল,আমাকে সংক্ষেপে যথাযথ উপদেশ দান করুন। ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : “নিজেকে সেই সকল কর্ম থেকে বিরত রাখ,যা দুনিয়াতে অপমান ও আখেরাতে আযাবের (শাস্তির) কারণ (ইহকাকুল হাক,১২তম খণ্ড,পৃ. ৪৩৯)।”