আল হাসানাইন (আ.)

চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করণ বা শাক্কুল ক্বামার

2 বিভিন্ন মতামত 04.0 / 5

মানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র জীবন সেই শৈশব থেকে ওফাত পর্যন্ত মোজেজা বা মহাবিস্ময়কর অনেক ঘটনায় ভরপূর ছিল। আমরা জানি মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনা সাধারণ মানুষ বা সাধারণ কার্য-কারণ বা চালিকা শক্তির মাধ্যমে ঘটানো সম্ভব নয়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র জীবনের অলৌকিক অথচ সন্দেহাতীত ঘটনাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে তিনি মহান আল্লাহর পরম প্রিয়পাত্র এবং তাঁরই মনোনীত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ।
মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনা সব নবী-রাসূলের জীবনেই ঘটেছে। কারণ প্রত্যেক নবী ও রাসূলের সাথে আল্লাহর যোগাযোগ ছিল। অন্য কথায় নবী-রাসূলগণ আল্লাহর কাছ থেকে বাণী ও দিকনির্দেশনা লাভ করতেন। তাঁরা নবুওত বা রেসালাতের বিষয়টি প্রমাণের জন্যে প্রয়োজনে যুক্তির পাশাপাশি মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনাও ঘটাতেন। মোজেজা আল্লাহর নির্দেশেই ঘটতো এবং এ ধরনের ক্ষমতা আল্লাহ-প্রদত্ত ক্ষমতারই নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আ.)'র মো'জেজাসহ অতীতের অনেক নবীর মো'জেজার কথা বলা হয়েছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)ও তাঁর পূর্ববর্তী নবীগণের মো'জেজার বা অলৌকিক ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। 
বিশ্বমানবতার মুক্তির মহাকাণ্ডারী ও একত্ববাদের বিজয়-গাঁথার সর্বশ্রেষ্ঠ নিশানবরদার রাসূলে পাক (সা.) ও অনেক মো'জজা দেখিয়েছেন। পবিত্র কোরআন তাঁর সর্বত্তোম মো'জেজা এবং তাঁর রেসালাত ইসলাম ধর্মের সত্যতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
পবিত্র কোরআনে বিশ্বনবী (সা.)'র অন্য যেসব মো'জেজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেসবের মধ্যে চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করার ঘটনা অন্যতম।
আবুজেহেল ও ওয়ালিদ বিন মুগিরাহসহ মক্কার কোরাইশ ও মুশরিকদের একদল নেতা একবার বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র কাছে আসেন। সে সময় রাতের বেলায় পূর্ণ চাঁদ দেখা যাচিছল। ওরা রাসূলে পাক (সা.)কে বললো,তোমার নবুওতের দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে এই চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত হতে বল। রাসূলে খোদা (সা.) বললেন,এ কাজ করলে কি তোমরা ঈমান আনবে? তারা বললো হ্যা। রাসূল (সা.) আল্লাহর কাছে এ মো'জেজা ঘটানোর প্রার্থনা করেন। হঠাৎ সবাই দেখলো,চাঁদ এত স্পষ্টভাবে দুই খন্ড হয়ে গেছে যে দ্বিখণ্ডিত চাঁদের মাঝখানে হেরা পর্বত দেখা যাচেছ। এরপর দ্বিখণ্ডিত চাঁদ আবার জোড়া লেগে যায় এবং তা পূর্ণ চাঁদে পরিণত হয়। এ সময় রাসূলে পাক (সা.) বলছিলেন,সাক্ষী থাক ও দেখ। মুশরিকরা তো এই অসাধারণ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক! কিন্তু তাদের কেউ কেউ ঈমান না এনে বললো,মুহাম্মাদ আমাদেরকে যাদু করেছে। আবু জেহেল বলল,এটা জাদু হলে জাদুর প্রভাব কেবল তোমাদের উপরই পড়ার কথা,এটাতো হতে পারে না যে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের উপর পড়বে। আবু জেহেল আরো বলল,।অন্যান্য শহরের লোকেরা যারা তোমাদের নিকট আসবে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে । তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা সবাই বলল যে,আমরা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার দৃশ্য অবলোকন করেছি।

গ্রীক দার্শনিকদের একটি দল তারা কাফের-মুশরিকদেরও ছাড়িয়ে যায় এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার মোজেযাকে কেবল অস্বীকারই করে না,তারা তাদের ভ্রান্ত নীতি দর্শন অনুযায়ী বলতে থাকে,আকাশ ও গ্রহ-উপগ্রহের পক্ষে বিদীর্ণ হওয়াও সংযুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তারা আরও প্রশ্ন উত্থাপন করে যে,চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার মতো মোজেযা সংঘটিত হয়ে থাকলে তা বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পেত অথচ ইতিহাসে এই ঘটনার কথা উল্লেখ নেই। সুতরাং এই ঘটনার কোন বাস্তবতা নেই। তাছাড়া গণক,জ্যোতিষীরা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেনি,ভবিষ্যৎ বক্তারাও এ ব্যাপারে নীরব রয়েছে। এ ধরনের নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে দার্শনিক-বিজ্ঞানীরা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার সত্য ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা কম করেনি। এ ব্যাপারে তারা গোলক ধাঁধাঁর সৃষ্টি করে একশ্রেণীর মুসলিম সীরাত লেখককেও বিভ্রান্ত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যার জন্য আরেক সীরাত গ্রন্থে শক্কে কমরের মোজেযা সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পায়নি বলে দার্শনিক-বিজ্ঞানীদের অভিযোগ যে কত ভিত্তিহীন তা নিম্নের আলোচনা হতে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

১ ‘শক্কল কামারে’র মোজেযা মক্কার কাফেরদের একটি বিশেষ দাবির প্রেক্ষিতে সংঘটিত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) সেই দাবী পূরণ করার জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করেন এবং আল্লাহ তাঁর সেই দোয়া কবুল করেন।

২. মক্কাবাসীরা ছাড়াও আশপাশের এলাকা হতে আগত মোসাফিরগণও চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার সাক্ষ্য দান করে।

৩. যদি ধরেও নেয়া যায় যে,ঘটনাটি সকল স্থানে দেখা যায়নি এর কারণ কি? জবাবে বলা যায় চাঁদের উদয়স্থলের পার্থক্যের কারণে কোন কোন স্থানে চাঁদ উদিতই হয়নি। এ জন্য চন্দ্র গ্রহণ সব স্থানে পরিলক্ষিত হয় না এবং কোন কোন সময় অন্যান্য স্থানে মেঘাচ্ছন্ন বা পর্বত ইত্যাদি চাঁদের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে।

৪. ‘খিরকে ইলতিয়াম’- একটি বিশেষ পরিভাষা। খিরক অর্থ হচ্ছে ফেটে যাওয়া,চিরাচরিত নিয়মনীতি ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে কিছু ঘটে যাওয়া,ব্যতিক্রম,অভিনব,নবী-রাসূলগণের মোজেযা বা অলৌকিক ঘটনা। এর বহু বচন খাওয়ারেকা। আর ইলতিয়াম শব্দের অর্থ,পরস্পর দুই বস্তুর মিলিত হওয়া। সুতরাং ঘিরকে ইলতিয়াম বলা হয়,সৌরম-লে অর্থাৎ আকাশ,তারকারাজি তথা গ্রহ-উপগ্রহ ইত্যাদি ফাটল-মিলন বা ব্যতিক্রমী ঘটনাবলী। মুসলমানদের কাছে আকাশ নক্ষত্ররাজির মধ্যে এসব অবস্থার সৃষ্টি হওয়া খুবই সম্ভব। এর বহু দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে,কেয়ামতের সময় আসমান ও তারকারাজি ফেটে তুলাতুলা হয়ে যাবে যার বর্ণনা কোরআনের বহুস্থানে রয়েছে। এতদসংক্রান্ত বহু হাদীসেও এ বর্ণনা এসেছে। ‘হেকমত’বা যুক্তিশাস্ত্র অনুযায়ী ও দার্শনিকদের যুক্তি বাতিল-অচল এ সম্পর্কে গ্রীসের বিখ্যাত প্রাচীন দার্শনিক ফিসাব্যারাম ‘হাইয়াত’বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন যে,তারকারাজি মৃত্তিকার ন্যায় খুব ঘন,পুরু এবং সমস্তই লীন,ধ্বংসযোগ্য এবং তাদেও ফাটল-মিলন ঘটবে। অতএব বিনাদ্বিধায় প্রমাণিত যে,চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা একটি অকাট্য সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত,এতে সংশয়ের কোন অবকাশ নেই।

৫. প্রাচীন ঐশী গ্রন্থ ‘তওরাতে’বর্ণিত হয়েছে যে,হযরত ইউশা (আ.)-এর জন্য চলমান সূর্য থেমে গিয়েছিল,অথচ এ ঘটনা কোন ইতিহাস গ্রন্থে লিখিত হয়নি,যদিও এটি ছিল দিনের ঘটনা। সুতরাং ঘটনাটি ইতিহাসে লিপিবদ্ধ না থাকলে তার বাস্তবতা মিথ্যা হতে পারে না। কাজেই রাতের ঘটনা ‘শক্কে কমরকেও অস্বীকার করা যায় না। মুসলমান ঐতিহাসিকদের আরবী,ফার্সী,উর্দু,বাংলাসহ বিশ্বের নানা ভাষায় রচিত প্রাচীন ও আধুনিক বহু গ্রন্থে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মোজেযা সংক্রান্ত হাদীসও অন্যান্য অসংখ্য গ্রন্থে,পদ্যে-গদ্যে শক্কে কমরের ঘটনার বিবরণ,আভাস,ইঙ্গিত ছাড়াও কোরআনে সূরা ‘কামার’অপেক্ষা বড় দলিল আর কি হতে পারে!

৭. শক্কে কমরের মোজেযা অস্বীকারকারী আধুনিক শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সমাজের মধ্যে প্রত্যেকেই চাঁদে মানব অবতরণের বিস্ময়ক ঘটনা অবগত। বিশ্ব ইতিহাসের এই চমকপ্রদ ঘটনাটি সর্বপ্রথম ঘটেছিল ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই রাত ২টা ১৬ মিনিটে। চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানব চাঁদের তথাকথিত ‘কলঙ্ক’অর্থাৎ ক্ষত চিহ্নের যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তা কেউ এখনও ভুলে যায়নি। আমেরিকার চন্দ্র বিজয়ী নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে গিয়ে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রমাণ পেয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসে মুসলমান হয়ে গেছেন। এর পরেও কি অস্বীকারকারীদের বোধোদয় হবে না?

৮. ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত মালাবার রাজ্যের ততকালীন রাজা চক্রবর্তী ফারমাস (চেরামান পিরুমেল) আকাশে চাঁদ দুই টুকরো হয়ে যাওয়ার ওই অলৌকিক ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। যখন তিনি জানতে পারেন যে আরব দেশে শেষ নবী(সা.)’র আবির্ভাব ঘটেছে তখন তিনি মক্কায় আসেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ভারতের ইতিহাস গ্রন্থ ‘তারিখে ফেরেশতা’য় ওই ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে।
মার্কিন মহাশূন্য সংস্থা নাসার নভোচারীদের মাধ্যমে তোলা ছবিতেও চাঁদের মধ্যে গভীর ফাটলের চিহ্ন বা দাগ দেখা গেছে এবং এ থেকে স্পষ্ট হয় যে কোনো এক সময় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল।
ভারতীয় রাজা যে ওই  ঘটনা দেখেছিলেন তার লিখিত বিবরণের একটি প্রাচীন দলিল বর্তমানে লন্ডনে ভারতীয় দপ্তরের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে। ওই দলিলে ভারতীয় সেই রাজার ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ওই রাজা ভারতের দিকে ফেরার পথে ইয়েমেনে মারা যান।

পবিত্র কোরআনে এ ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়েছে,

اقْتَرَ‌بَتِ السَّاعَةُ وَانشَقَّ الْقَمَرُ‌  وَإِن يَرَ‌وْا آيَةً يُعْرِ‌ضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ‌ مُّسْتَمِرٌّ‌ وَكَذَّبُوا وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ

কিয়ামত আসন্ন এবং চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়েছে,তারা কোন নিদর্শন প্রত্যক্ষ করলেও বিমুখ হয়ে থাকে এবং বলে,‘এতো চিরাচরিত জাদু।’তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে।(সূরা আল ক্বামর-১-৩)

ফাখরে রাজী তাফসীরে মাফাতিহুল গাইবে সূরা ক্বামারের তাফসীরে লিখেছেন,সমস্ত তাফসীরকার এ ব্যাপারে একমত যে চাঁদে ফাটল বা ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল এবং গোটা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। এ ঘটনা সম্পর্কে হাদীসের প্রায় বিশটি বর্ণনা রয়েছে এবং এ ঘটনার সত্যতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)