ইসলামের উজ্জলতম নক্ষত্র: ইমাম সাজ্জাদ (আ.)
উমাইয়া খলিফা হিশাম বিন আবদুল মালিক হজ করতে এসেছেন। কাবা ঘরের হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরের কাছে হাজিদের প্রচন্ড ভীড়। খলিফা আবদুল মালিক কালো পাথরের কাছে যাবার জন্যে অনেক কষ্ট করেও ভীড় ঠেলে তেমন একটা এগুতে পারছিলেন না। এখানে যে একজন খলিফা আছেন ও তাকে পথ ছেড়ে দিতে হবে এমন মানসিকতাও কারো মধ্যেই দেখা গেল না। বরং দেখা গেল সৌম্য ও নূরাণী চেহারার এক ব্যক্তিকে মানুষ প্রাণঢালা সম্মান জানিয়ে পথ ছেড়ে দিচ্ছে ও ঐ ব্যক্তি সহজেই পৌঁছে গেলেন কালো পাথরের কাছে। হিশামের আত্মসম্মানে তীব্র ঘা লাগলো। তিনি ইমামকে চিনলেন না বা চিনেও না চেনার ভান করে মহাবিরক্ত ও বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন কে এই ব্যক্তি যাকে লোকেরা এতো সম্মান প্রদর্শন করলো!? সেযুগের কবি ফারাজদাক ছিলেন সেখানে উপস্থিত। তিনি খলিফার প্রশ্নের উত্তর দিলেন তাতক্ষণিকভাবে একটি অনুপম কবিতা রচনা করে। কবিতাটির কয়েকটি পংক্তি ছিল এ রকম:
মক্কার মাটি ও প্রতিটি ধুলি-কণা তাঁর পায়ের শব্দ চেনে
এবং পবিত্র কাবা ও আশপাশের ভূমিগুলোও তাঁর সঙ্গে পরিচিত।
(কিংবা) এতো তিনি যাঁর পদক্ষেপ চেনে প্রতিটি ধূলিকণা
যিনি অতি আপন এই সর্বজননন্দিত কাবা ঘরের কাছে
ইনি তো তাঁর সন্তান যিনি খোদার রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম
আর ইনি তো নিজেই শ্রেষ্ঠ এবাদতে ও তাসবীহ তাহলীলে,
নির্মল নিষ্কলুষ,পূতপবিত্র সততায় দীপ্ত নিশানবরদার ইসলামের
... ....
ইনি তো সন্তান ফাতেমা বিবির,
তার সম্পর্কে যদি না জেনে থাকো তুমি;
জেনে রাখো এঁর প্রপিতামহের মাঝেই সমাপ্তি নবুয়্যত ধারার
... ... খোদাকে যে চিনেছে সে-ই তো জানে ইনিই তো মর্যাদায় ও শ্রেষ্ঠত্বে আগে সবার
যেহেতু সারা বিশ্বে পৌঁছেছে ধর্মের বাণী এঁরই রক্তধারার উসিলাতে
হ্যাঁ,আজ আমরা এমন এক মহাপুরুষের কথা বলছি যাঁর রক্তধারা পৃথিবীর বুকে প্রকৃত ইসলামকে টিকিয়ে রেখেছে। ইসলামের বাহ্যিক লেবাস ঠিক রেখে ভেতর থেকে ধীরে ধীরে এ পবিত্র ধর্মকে নিষ্প্রাণ ও বিলীন করে দেয়ার উমাইয়া ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে শহীদগণের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালার যে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন সে বিপ্লবের বাণী ও কারবালার প্রকৃত ঘটনা যিনি পরবর্তী যুগের মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষিত করেছিলেন তিনিই হলেন আমাদের আজকের আলোচ্য মহাপুরুষ হযরত হুসাইন বিন আলী তথা জয়নুল আবেদীন (আ.)। তাঁর পবিত্র শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।
ইমাম হুসাইন (আ.)’র পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদীন ৩৮ হিজরীর শাবান মাসে তথা খৃষ্টীয় ৬৫৮ সালে মদীনায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আলী। আল্লাহর অত্যধিক এবাদত বন্দেগীর কারণে তিনি জয়নুল আবেদীন বা ইবাদতকারীদের অলংকার উপাধি পেয়েছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে নামাজ ও সিজাদায় রত থাকতেন বলে তিনি সাজ্জাদ নামেও পরিচিত ছিলেন। ইমাম সাজ্জাদ কারবালার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। দশই মহররমের সেই ভয়াবহ ঘটনার দিনে মারাত্মক অসুস্থ থাকায় তিন জিহাদে যোগ দিতে পারেন নি। ইয়াজিদের সেনারা তাকে হত্যা করতে গিয়েও তাঁর ফুফু জয়নাব (সা.)'র প্রতিরোধের মুখে এই মহান ইমামকে জীবিত রাখতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালেও আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান । আসলে মহান আল্লাহই এভাবে তাঁকে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দেয়াসহ কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের পরবর্তী অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করা ও এ বিপ্লবের প্রকৃত বাণী মুসলমানদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে জীবিত রেখেছিলেন।
কারবালার ঘটনার পর ইমাম জয়নুল আবেদীন ও তাঁর বোন হযরত জয়নাব (সা.) যদি জীবীত না থাকতেন তাহলে কারবালার শহীদদের আত্মত্যাগ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত ঐ বিপ্লবকে নিছক একটা দুর্ঘটনা বলে প্রচার করার ইয়াজিদী চক্রান্ত সফল হতো। উমাইয়া শাসকরা তখন এটাও প্রচার করতো যে ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াজিদের মতো তাগুতি শাসকের শাসন মেনে নিয়েছিলেন। আর এর ফলে পবিত্র ইসলাম ধর্মকে অবিচারের ব্যাপারে আপোসকামী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রও সফল হতো। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত ইমাম সাজ্জাদ ও জয়নাব (সা.) কারবালা থেকে বন্দী অবস্থায় কুফা ও দামেস্কে যাবার পথেই স্বল্প সময়ে জনগণকে জানিয়ে দেন যে কারবালায় প্রকৃত ঘটনা কি ঘটেছিল এবং কারা ছিল ইসলামের জন্যে নিবেদিত-প্রাণ ও কারা ছিল ইসলামের লেবাসধারী জালেম শাসক মাত্র।
কুফায় ইবনে জিয়াদের দরবারে এবং দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে জয়নুল আবেদীনের তেজোদৃপ্ত ও সাহসী ভাষণ জনগণের মধ্যে এমন জাগরণ সৃষ্টি করে যে পরবতীকালে সে জাগরণের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল তাগুতি উমাইয়া শাসকদের তাখতে তাউস।
ইবনে জিয়াদ ও ইয়াজিদের দরবারে তেজোদৃপ্ত বক্তব্য রেখেছিলেন হযরত জয়নাব (সা.)। একই ধরনের বক্তব্য রেখেছিলেন নতুন ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ)। কুফায় ফুফু জয়নাব (সা.) ও বোন ফাতিমার ভাষণ শুনে জনগণ যখন মর্মাহত হয় ও কাঁদতে থাকে তখন তাদের সমাবেশে নতুন এই ইমামও বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: হে মানুষেরা,আমি আলী,হুসাইন ইবনে আলী (আ.)’র সন্তান। আমি তাঁর সন্তান যার সব কিছু লুট করা হয়েছে,যার পরিবারের সবাইকে বন্দী করে এখানে আনা হয়েছে। আমি তাঁর সন্তান,যে ফোরাতের কিনারায় মর্মান্তিক ও নৃশংসভাবে নিহত হয়েছে। হে লোকেরা! তোমরা কিয়ামতের দিন কিভাবে নবী(সা.)’র সামনে দাঁড়াবে? রাসূল (সা.) যখন তোমাদের বলবেন,“ তোমারা আমার পরিবারবর্গকে এভাবে কতল করেছ আর আমার মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ রাখনি,তাই তোমরা আমার উম্মত নও।”
নতুন ইমামের এ বক্তব্য শুনে কুফাবাসী চিতকার ধ্বনি দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এবং একে-অপরকে তিরস্কার করে বলতে থাকে : আমরা এতই দুর্ভাগা যে নিজেরা যে ধ্বংস হয়ে গেছি তাও জানি না।
মৃত্যুর ভয়হীন যুবক ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)
ইবনে জিয়াদ নতুন ইমামকে হত্যার নির্দেশ দিলে ফুফু যেইনাব বলেন,তাহলে আমাকেও হত্যা কর্ তাঁর সঙ্গে!
নতুন ইমাম বললেন,আপনি ওর সঙ্গে কথা বলবেন না,আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি।
তিনি জিয়াদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন: “ ওহে জিয়াদের ছেলে! আমাকে হত্যার ভয় দেখাচ্ছ? তুমি কি জান না শহীদ হওয়া আমাদের প্রথা ও শাহাদত বরণ আমাদের মর্যাদা....।”
ইয়াজিদের দরবারে ও সিরিয়ার জামে মসজিদে নতুন ইমামের ভাষণ:
সিরিয়ায় শহরের অলি-গলি দিয়ে ইমাম ও তাঁর পরিবারের কয়েকজনকে একই দড়িতে বেঁধে ইয়াজিদের দরবারে আনা হয়। এ সময় ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) বীরত্বের সঙ্গে ইয়াজিদের দিকে তাকিয়ে বলেন: হে ইয়াজিদ! আল্লাহর রাসূলের (সা.) ব্যাপারে কি চিন্তা করেছ,যদি তিনি এভাবে আমাদেরকে দড়ি বাঁধা অবস্থায় দেখেন?
ইমামের এ কথা শুনে উপস্থিত সবার মধ্যে কান্নার রোল ওঠে।
সিরিয়ায় ইয়াজিদি প্রচারণায় বিভ্রান্ত এক বয়স্ক ব্যক্তি নবী পরিবারের বন্দীদের কাছে এসে বলল: আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ যে তিনি তোমাদেরকে ধ্বংস করে ফিতনা নিভিয়ে দিয়েছেন। সে আরো কিছু আজে-বাজে কথা বলে। নতুন ইমাম (যইনুল আবেদীন-আ.) তাকে বলেন:
তুমি কি কুরআন পড়েছ।
সে বলে: পড়েছি।
ইমাম: এ আয়াতটি পড়েছ কি যেখানে এসেছে- বল হে রাসূল,আমি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না (ইসলাম প্রচারের বিনিময়ে),শুধু এটা চাই যে তোমরা আমার পরিবারকে ভালবাসবে? (সূরা আশশুরা-২৩)
হ্যাঁ,পড়েছি।
রাসূলের আহলে বাইত (নবী-পরিবার) যে নিষ্পাপ তার প্রমাণ হিসেবে তিনি সুরা আহজাবের ৩৩ নম্বর আয়াতও তাকে শোনান।
এভাবে তিনি নবী পরিবারের সম্মান ও অধিকারের দলিল হিসেবে নাজেল হওয়া আরো কয়েকটি আয়াতের কথা তুলে ধরলে ওই বয়স্ক লোকটি আকাশের দিকে হাত উঁচু করে তিনবার বলেন: হে আল্লাহ,আমি তওবা করেছি। আর তাঁদের হত্যা করাতে আমি অসন্তুষ্ট। আমি এর আগেও কুরআন পড়েছিলাম,কিন্তু এইসব সত্য জানতাম না।
সিরিয়ার জামে মসজিদে নবী-বংশকে ও হযরত আলী (আ.)-কে গালি-গালাজ করা হত মুয়াবিয়ার আমল থেকেই। কারবালার ঘটনার পর একদিন এই মসজিদে হযরত আলী (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)-কে উদ্দেশ করে অপমানজনক কথা বলে বেতনভোগী খতিব। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)। তিনি খতিবকে বললেন: খতিব তুমি ইয়াজিদকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে দোযখে স্থান তৈরি করেছ নিজের জন্য। তিনি ইয়াজিদের দিকে ফিরে বললেন,আমাকেও মিম্বরে যেতে দাও,কিছু কথা বলব যাতে আল্লাহ খুশি হবেন ও উপস্থিত লোকদের সওয়াব হবে। উপস্থিত লোকদের চাপের মুখে ইয়াজিদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়। (ইয়াজিদ লোকদের প্রতি বলেছিল ইনি এমন এক বংশের লোক যারা ছোটবেলায় মায়ের দুধ পানের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানও অর্জন করতে থাকে)
নতুন ইমাম মহান আল্লাহর অশেষ প্রশংসাসূচক কিছু বাক্য বলার পর বলেছিলেন: হে জনতা! আল্লাহ আমাদের ছয়টি গুণ ও সাতটি মর্যাদা দিয়েছেন। জ্ঞান,সহনশীলতা,উদারতা,বাগ্মিতা,সাহস ও বিশ্বাসীদের অন্তরে আমাদের প্রতি ভালবাসা। আমাদের মর্যাদাগুলো হল রাসূল (সা.),আল্লাহর সিংহ ও সত্যবাদী আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.),বেহেশতে দুই পাখার অধিকারী হযরত জাফর আততাইয়ার (রা.),শহীদদের সর্দার হামজা (রা.),রাসূল (সা.)’র দুই নাতী হযরত হাসান ও হুসাইন (আ.) আমাদের থেকেই,আর আমরাও তাঁদের থেকেই। যারা আমাকে জানে তারা তো জানেই,যারা জানে না তাদেরকে জানাচ্ছি আমার বংশ-পরিচয়: হে জনতা! আমি মক্কা ও মিনার সন্তান,আমি যমযম ও সাফা’র সন্তান। আমি তাঁর সন্তান যিনি হজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) তুলেছিলেন তাঁর কম্বলের প্রান্ত ধরে,আমি ওই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান যিনি কাবা তাওয়াফ করেছেন ও সাই করেছেন (সাফা ও মারওয়ায়) তথা হজ করেছেন। আমি এমন এক ব্যক্তির সন্তান যাকে একরাতেই মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল (রাসূলের মেরাজের ইঙ্গিত)।... আমি হুসাইনের সন্তান যাকে কারবালায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে,আমি আলীর সন্তান যিনি মুর্তাজা (অনুমোদনপ্রাপ্ত),আমি মুহাম্মদের সন্তান যিনি বাছাইকৃত,আমি ফাতিমাতুজ জাহরার সন্তান,আমি সিদরাতুল মুনতাহার সন্তান,আমি শাজারাতুল মুবারাকাহ বা বরকতময় গাছের সন্তান,হযরত খাদিজা (সা.)’র সন্তান আমি,আমি এমন একজনের সন্তান যিনি তাঁর নিজের রক্তে ডুবে গেছেন,আমি এমন একজনের সন্তান যার শোকে রাতের আধারে জিনেরা বিলাপ করেছিল,আমি এমন একজনের সন্তান যার জন্য শোক প্রকাশ করেছিল পাখিরা।
ইমামের খোতবা এ পর্যন্ত পৌঁছলে উদ্বেলিত জনতা চিতকার করে কাঁদতে লাগল ও বিলাপ শুরু করল। ফলে ইয়াজিদ আশঙ্কা করল যে গণ-বিদ্রোহ শুরু হতে পারে। সে মুয়াজ্জিনকে আযান দেয়ার নির্দেশ দিল। ইমাম (আ.) আজানের প্রতিটি বাক্যের জবাবে আল্লাহর প্রশংসাসূচক বাক্য বলছিলেন। যখন মুয়াজ্জিন বলল,আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ-আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল- তখন ইমাম (আ.) মাথা থেকে পাগড়ী নামিয়ে মুয়াজ্জিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,আমি এই মুহাম্মাদের নামে অনুরোধ করছি,এক মুহূর্ত নীরব থাক। এরপর তিনি ইয়াজিদের দিকে তাকিয়ে বললেন: এই সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ রাসূল কি আমার প্রপিতামহ না তোমার? যদি বল তোমার তাহলে গোটা পৃথিবী জানে তুমি মিথ্যা বলছ,আর যদি বল আমার তাহলে কেন তুমি আমার বাবাকে জুলুমের মাধ্যমে হত্যা করেছ,তাঁর মালপত্র লুট করেছ ও তাঁর নারী-স্বজনদের বন্দী করেছ? একথা বলে ইমাম(আ.) নিজের জামার কলার ছিঁড়ে ফেললেন এবং কাঁদলেন। এরপর বললেন,আল্লাহর কসম এ পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই যার প্রপিতামহ হলেন রাসূলুল্লাহ (সা.),কেন এ লোকগুলো আমার পিতাকে জুলুমের মাধ্যমে হত্যা করেছে এবং আমাদেরকে রোমানদের মত বন্দী করেছে?...অভিশাপ তোমার ওপর যেদিন আমার প্রপিতামহ ও পিতা তোমার ওপর ক্রুদ্ধ হবেন।
গণ-বিদ্রোহের আশঙ্কায় দিশাহারা ও আতঙ্কিত ইয়াজিদ
অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াজিদ নামাজ শুরু করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ জনতার অনেকেই মসজিদ থেকে বেরিয়ে যান। পরিস্থিতির চাপে পড়ে ইয়াজিদ নিজেও ভোল পাল্টে ফেলে ইমাম হুসাইন (আ.) ও নবী পরিবারের সদস্যদের হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এবং এর দায় জিয়াদের ওপর চাপিয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে।
ইয়াজিদকে হত্যার পরিকল্পনা
ইয়াজিদ ইমাম হুসাইন (আ.)’র বোন হযরত জয়নাব (সা.)’র অনুরোধে কারবালার শহীদদের জন্য শোক অনুষ্ঠান পালনের অনুমতি দেয়। সাত দিন ধরে শোক সমাবেশ হয়। বিপুল সংখ্যক সিরিয় নারী শোক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। সিরিয় পুরুষদের অনেকেই সিদ্ধান্ত নেন যে তারা ঝড়ের গতিতে ইয়াজিদের প্রাসাদে ঢুকে তাকে হত্যা করবে। ইয়াজিদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি মারওয়ান এ পরিকল্পনার কথা জেনে ফেলে। সে ইয়াজিদকে পরামর্শ দেয় হুসাইনের পরিবারকে সিরিয়ায় বেশি দিন রাখা ঠিক হবে না। তাঁদেরকে মদীনায় ফেরত পাঠানো জরুরি। ইয়াজিদ নবী-পরিবারকে সফরের রসদপত্র দিয়ে তাঁদেরকে মদীনায় পাঠিয়ে দেয়।
আসলে কারবালা বিপ্লবের ব্যাপারে ইমাম হুসাইন (আ.)’র বোন হযরত জয়নাব (সালামুল্লাহি আলাইহা) ও অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া ইমামের পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদীনের (আ.) বলিষ্ঠ ভাষণ ও সত্য ঘটনা প্রচারের ফলেই জনগণ আসল ঘটনা বুঝতে পারে। ফলে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই উমাইয়াদের বিরুদ্ধে ইরাকে ও হিজাজে (বর্তমান যুগের সৌদি আরব অঞ্চল) বিদ্রোহ দেখা দেয়। কুফায় মুখতারের নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয় এবং এই সরকার ইমাম হুসাইন (আ.) হত্যাকারী ওমর সাদ ও শিমারসহ ইয়াজিদ বাহিনীর প্রায় সব ঘাতককে হত্যা করে। অনেক ঘাতক অলৌকিকভাবে কঠোর শাস্তি পেয়েছিল।
উল্লেখ্য,কারবালার মহাট্র্যাজেডির ৩৪ বছর পর ৯৫ হিজরির ১২ মহররম ৫৭ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেছিলেন হযরত ইমাম যইনুল আবেদীন (আ.)। ষষ্ঠ উমাইয়া শাসক ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক বিষ প্রয়োগ করে এই মহান ইমামকে শহীদ করে। ৩৮ হিজরিতে মদীনায় তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁর মা ছিলেন শেষ ইরানি রাজার কন্যা শাহরবানু।
কারবালার ঘটনার পর তিনি যখনই পানি দেখতেন বাবাসহ কারবালার শহীদদের চরম পিপাসার কথা ভেবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন। কোনো ভেড়া বা দুম্বা জবাই করার দৃশ্য দেখলেও কেঁদে আকুল হতেন। তিনি প্রশ্ন করতেন এই পশুকে জবাইর আগে পানি পান করানো হয়েছে কিনা। পানি দেয়া হয়েছে একথা শোনার পর তিনি বলতেন,কিন্তু আমার (তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত) বাবাকে পানি না দিয়েই জবাই করেছিল ইয়াজিদ-সেনারা। তিনি সব সময় রোজা রাখতেন। ইফতারির সময় তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলতেন: রাসূল (সা.)’র সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত অবস্থায়।
ইমাম জয়নুল আবেদীন তাঁর বাবার জন্য ৩৪ বছর ধরে কেঁদেছিলেন
তিনি সব সময় দিনে রোজা রাখতেন ও পুরো রাত জেগে ইবাদত করতেন। রোজা ভাঙ্গার সময় তিনি বাবার ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত অবস্থার কথা উল্লেখ করে এত বেশি কাঁদতেন যে অশ্রুতে খাবার ভিজে যেত এবং খাবার পানিতেও অশ্রু মিশে যেত। জীবনের শেষ পর্যন্ত এই অবস্থা ছিল তাঁর।
একদিন তাঁর খাদেম ইমামের কান্নারত অবস্থায় তাঁকে বলেন: আপনার দুঃখ ও আহাজারি শেষ হয়নি?
উত্তরে তিনি বলেন: তোমার জন্য আক্ষেপ! ইয়াকুব (আ.) আল্লাহর একজন নবী ছিলেন। তাঁর ১২ জন সন্তান ছিল। কিন্তু আল্লাহ তাঁর এক পুত্র ইউসুফকে চোখের আড়ালে রাখায় শোকে,দুঃখে ও অতিরিক্ত কান্নায় তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে পড়েন,চুল পেকে যায় ও পিঠ বাঁকা হয়ে যায়। সন্তান জীবিত থাকা সত্ত্বেও তাঁর এ অবস্থা হয়েছিল। আর আমি আমার পিতা,ভাই এবং পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে (জালিম শত্রুর অস্ত্রের ব্যাপক ও নির্বিচার আঘাতে) মাটিতে পড়ে যেতে ও শহীদ হতে দেখেছি; তাই কিভাবে আমার দুঃখ ও অশ্রু থামতে পারে?
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) কারবালায় নবীবংশের ওপর উমাইয়া শাসক ইয়াজিদের পাশবিক হত্যাযজ্ঞ এবং এক অসম লড়াইয়ে ইমাম হুসাইন (আ.)সহ ও তাঁর নিবেদিত-প্রাণ সঙ্গীদের বীরত্বব্যাঞ্জক শাহাদতসহ নবী-পরিবারের মহিলাদের সাথে অন্যায় আচরণের মতো ঘটনাগুলোর স্মৃতি মুসলিম মানসে চিরজাগরুক রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি এ লক্ষ্যে কারবালার ঘটনার স্মরণে আজাদারি,মাতম ও শোক অনুষ্ঠানের প্রচলন করেছিলেন। ফলে শোক পরিণত হয়েছিল ঈমানী শক্তিতে তথা অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি শক্তিশালী হাতিয়ারে এবং শহীদদের রক্ত বিজয়ী হয় জালিমের তরবারির ওপর।আর এরই ধারাবাহিকতায় আজো মুসলমানরা কারবালার বীর শহীদানদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে নিজ ঈমানকে সব ধরনের অশুভ শক্তির মোকাবেলায় শানিত ও প্রস্তুত করেন।
কারবালার বিপ্লবের ধারাবাহিকতা ও এর প্রভাব ছড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টার পাশাপাশি ইমাম সাজ্জাদ ইসলামের নামে বিকৃত চিন্তা ও কুসংস্কার মোকাবেলার জন্যে জনগণের মধ্যে পবিত্র কোরআন-হাদীসের প্রকৃত শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে থাকেন। ফলে তাঁর সুযোগ্য ছাত্ররা পরবর্তীকালে মুসলিম জাহানকে জ্ঞান ও সত্যের পথে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হন। আর এর ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে। ইমাম জয়নুল আবেদীন বা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) যোগ্যতা ও গুণাবলীতে ছিলেন এমন এক উচ্চতর স্থানে যার ওপরে রয়েছে শুধু নবী-রাসূল ও তাঁর পিতা ও পিতামহের স্থান।
তাঁর সুনাম শুধু রাসূল (সা.)’র প্রিয় দৌহিত্রের সুযোগ্য পুত্র বা আহলে বাইতের সদস্য হিসেবে নয়,তাঁর অকল্পনীয় মাত্রার ইবাদত,উদারতা,খোদাভীরুতা,খোদার ভয়ে ক্রন্দন,অতুল জ্ঞান,দানশীলতা ও বিনয়ের সুনামও ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র।
ইমাম জয়নুল আবেদীন(আ.) সফরে বের হলে অপরিচিত ব্যক্তির কাছে (আ.) কখনও রাসূলের বংশধর বলে পরিচয় দিতেন না যাতে লোকজন তাঁকে বিশেষ চোখে না দেখে। সত্য প্রচারে তাঁর সাহসিকতার প্রমাণ কুফা ও দামেস্কের দরবারেই সিমীত ছিল না। একবার খলিফা আবদুল মালিক ইমাম সাজ্জাদের (আ.) কাছে কিছু উপদেশ প্রার্থনা করলে তিনি বললেন,পবিত্র কোরআনের উপদেশের চেয়ে বড় উপদেশ কি হতে পারে? পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-যারা ওজনে কম দেয় তাদের জন্যে আক্ষেপ,যখন কম ওজনদাতার ব্যাপারে আল্লাহ এতো কঠোর কথা বলেছেন তখন তার ( বা,তোমার মতে ব্যক্তির ) অবস্থা কেমন হতে পারে যে জনগণের সমস্ত সম্পদ লুট করেছে?
সহিফায়ে সাজ্জাদিয়া ইমাম জয়নুল আবেদীনের (আ.) এক অনন্য সৃষ্টি। ইমাম সাজ্জাদের অধিকাংশ বিখ্যাত দোয়া স্থান পেয়েছে এ সংকলনে। মত প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি তাঁর বিভিন্ন প্রাণস্পর্শী দোয়া,আকুতি,মোনাজাত ও বাণীর মাধ্যমে মানুষকে বিভিন্ন দিকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এসব দোয়ায় আত্মিক পরিশুদ্ধির জ্ঞান ছাড়াও রয়েছে খোদা পরিচিতি,বিশ্বদৃষ্টি,মানুষের পরিচিতি,সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা। এভাবে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতা যখন সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে তখন তা উমাইয়া শাসকদের জন্যে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তাই তৎকালীন উমাইয়া শাসক ওলীদ বিন আবদুল মালিক ইমামকে শেষ পর্যন্ত বিষ প্রয়োগে শহীদ করে। আর এভাবেই ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র বরকতপূর্ণ ও বর্ণিল জীবনের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু ইমাম সাজ্জাদের পথ নির্দেশনা তাঁর সন্তান ও অনুসারীদের মাধ্যমে অমর হয়ে আজো আলো বিকিরণ করে চলেছে।
ইমাম সাজ্জাদ (আ.)'র কয়েকটি অমূল্য বাণী শুনিয়ে ও তাঁর শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আরো একবার গভীর শোক এবং সমবেদনা জানিয়ে শেষ করছি আজকের এই আলোচনা। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেছেন,
-আমি তাদের ব্যাপারে বিস্মিত যারা ক্ষতির কারণে বিভিন্ন ধরনের খাবার বর্জন করে অথচ তারা কদর্যতার কারণে পাপ বর্জন করে না।
-তোমরা বেহেশতে সর্বোচ্চ স্থান লাভের চেষ্টা করবে। তোমরা মনে রেখো যারা অপর ভাইয়ের প্রয়োজন মেটায় এবং দীন-দুঃখীদের সাহায্য করেন কেবল তাদেরকেই বেহেশতে সর্বোচ্চ স্থান দেয়া হয়ে থাকে। (রেডিও তেহরান)