কোরআনী সমাজে নারী (শেষ অংশ)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তিন : সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক নির্ভরতা
কোরআনী সমাজের তৃতীয় যে বৈশিষ্ট্যটি নারীর অবস্থান ও মর্যাদার ব্যাপারে খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে তা হচ্ছে সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক নির্ভরতার ওপর গুরুত্ব আরোপ। সমকালীন বিশ্বে সমাজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তির অধিকারের ওপর যেভাবে গুরুত্ব আরোপের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার বিপরীতে আমরা কোরআন মাজীদে দেখতে পাই,নারী-পুরুষের এবং সে সাথে সমাজের সদস্যদের পরস্পর নির্ভরতার ওপর বার বার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ,কোরআন মাজীদে স্বামী ও স্ত্রীকে পরস্পরের জন্যে পোশাকস্বরূপ (সূরা আল বাকারা : ১৮৭) এবং শান্তি ও স্বস্তিতে জীবন যাপন করার জন্য পরস্পরের জুটি বলে (সূরা আল আ’রাফ: ১৮৯) উল্লেখ করা হয়েছে। নারী ও পুরুষকে পরস্পরের অভাব পূরণ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে,পরস্পরের সাথে শত্রুতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলা হয়নি। তারা হবে পরস্পরের সংরক্ষক (সূরা আত তাওবা : ৭১)। উভয়ের এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর (সমাজের) কল্যাণের লক্ষ্যে প্রত্যেককেই তার জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে বলা হয়েছে।
নারী-পুরুষ উভয়ের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক কল্যাণের স্বার্থে এ পরস্পর নির্ভরতা অতীব জরুরী। তাই এ পরস্পর নির্ভরতার বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কোরআন মাজীদে নারী ও পুরুষ,পিতা ও মাতা,শিশু ও বৃদ্ধ তথা পরিবারের বিভিন্ন ধরনের সদস্যবর্গ এবং বিভিন্ন স্তরের আত্মীয়-স্বজনের জন্য পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে (সূরা বনি ইসরাঈল : ২৩-২৬;সূরা আন নিসা : ১,৭-১২;সূরা আল বাকারা : ১৭৭;সূরা আল আনফাল : ৪১;সূরা আন নাহল : ৯০...)।
সমাজের অন্যান্য সদস্যের খোঁজ-খবর ও যত্ন নেয়া এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্টতা সকল মুসলমানের জন্য সমভাবে দায়িত্ব-কর্তব্য।
আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেন :
لَّيْسَ الْبِرَّ أَن تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَـٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّـهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ
“তোমরা পূর্ব দিকে ও পশ্চিম দিকে মুখ ফিরালে তাতে কোন পুণ্য নিহিত নেই,বরং সে-ই পুণ্যবান ব্যক্তি যে আল্লাহ্,শেষ দিবস,ফেরেশতগণ,এই কিতাব ও নবিগণের ওপর ঈমান পোষণ করেছে এবং তাঁর (আল্লাহর) প্রতি ভালবাসার কারণে নিকটাত্মীয়বর্গকে,ইয়াতিমদেরকে,মিসকীন,৪২ পথিক,যাঞ্চাকারী ও বন্দিকে (মুক্ত করার জন্য) স্বীয় ধন-সম্পদ দান করেছে ...।” (সূরা আল বাকারা : ১৭৭)
অতএব,দেখা যাচ্ছে যে,কোরআন মাজীদ মুসলমানদের মধ্যে সমাজের প্রতি একটি আন্তরিক অনুভূতি ও দায়িত্ববোধ তৈরি করে দিচ্ছে। কিন্তু এ দায়িত্ববোধের সাথে ব্যক্তির প্রতি নিষ্পেষণের ভাবধারা জড়িত নেই। বরং এ ধরনের পরস্পর নির্ভরতা যে কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে তার ভিত্তিতে মুসলমানদেরকে অনবরত এ লক্ষ্যে উৎসাহিত করা হয়। একটি সামাজিক গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে এ ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা ব্যক্তির জন্য যে অর্থনৈতিক,সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে তা তার ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা উৎসর্গ করণের ক্ষতিপূরণের তুলনায়ও অনেক বেশি।
বর্তমানে পাশ্চাত্য সমাজে যে বিচ্ছিন্নতা এবং পরস্পর নির্ভরতাহীন অবস্থা বিরাজ করছে তা অনেক গুরুতর সমস্যার জন্ম দিয়েছে। একাকিত্ব,প্রবীণদের প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি না দেয়া,প্রজন্মব্যবধান,উচ্চ আত্মহত্যা হার এবং কিশোর অপরাধ হচ্ছে এ সব সমস্যার অন্যতম। এজন্য দায়ী সেখানের সামাজে পারস্পরিক নির্ভরতার ক্রম অবনতিশীল অবস্থা তথা ক্রম হ্রাসমানতা এবং পারস্পরিক যত্ন ও খোঁজ-খবরের মানবিক প্রয়োজনের অস্বীকৃতি।
চার : সম্প্রসারিত পরিবার১
নারী-পুরুষের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরস্পর নির্ভরতার সাথে আন্তঃবিজড়িত কোরআনী সমাজের চতুর্থ মৌলিক বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে সম্প্রসারিত পরিবাররূপ সামাজিক সংগঠন। সাধারণভাবে একটি পরিবারের ন্যূনতম কাঠামো গড়ে ওঠে মাতা,পিতা ও সন্তানদের নিয়ে। এতদসহ একটি ইসলামী পরিবারে (আয়েলাহ্) থাকেন দাদা-দাদী,চাচা-চাচী ও তাদের ছেলেমেয়েরা। মুসলিম পরিবার আবাসনগতভাবে সম্প্রসারিত পরিবার। অর্থাৎ এরূপ পরিবারে তিন বা ততোধিক প্রজন্মের সদস্য ঘনিষ্ঠজনেরা একটি ভবন বা একটি আবাসিক জায়গায়২ একত্রে বসবাস করে,এমনকি যেখানে এ ধরনের সম্প্রসারিত পরিবারের একটি আবাসিক ভবনে বা জায়গায় বসবাস করা সম্ভব হয় না বা পছন্দ করা হয় না,সেখানেও পারিবারিক সম্পর্ক ও বন্ধন ক্ষুদ্রতম পারিবারিক এককের সীমারেখা ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। শক্তিশালী মনস্তাত্ত্বিক,সামাজিক,অর্থনৈতিক,এমনকি রাজনৈতিক বন্ধনের মধ্য দিয়েও তা প্রকাশ পায়।
কোরআন মাজীদ সম্প্রসারিত পরিবার গঠনকে উৎসাহিত করেছে এবং স্বীয় বিধানের মাধ্যমে এ ধরনের পারিবারিক সংহতিকে শক্তিশালী করেছে। কোরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের অধিকারের কথা বার বার উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা বনি ইসরাঈল : ২৩-২৬,সূরা আন নিসা : ৭-৯,সূরা আল আনফাল : ৪১ এবং সূরা আন নূর : ২২) এবং তাদের সাথে আন্তরিকতা ও দয়ার্দ্রতার সাথে আচরণ করার জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছে (সূরা আল বাকারা : ৮৩,সূরা আন নাহল : ৯০,...)।
উত্তরাধিকারের অংশ শুধু একক পরিবারের সদস্যদের জন্য নয়,বরং সম্প্রসারিত পরিবারের সদস্যদের জন্যও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে (সূরা আল বাকারা : ১৮০-১৮২ এবং সূরা আন নিসা ৪৩ : ৩৩,১৭৬)। আর যারা আন্তঃপারিবারিক পৃষ্ঠপোষকতার এ মানদণ্ডকে উপেক্ষা করে তাদেরকে কঠোর শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে (সূরা আন নিসা : ৭-১২)। অতএব,সম্প্রসারিত বা যৌথ পরিবারের ইসলামী সংস্কৃতি কোন সামাজিক পরিবেশের ফসলমাত্র নয়,বরং এটি হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ্তায়ালার বাণীর ওপর ভিত্তিশীল একটি প্রতিষ্ঠান এবং কোরআন মাজীদের নির্দেশ ও বিধি-বিধানের ভিত্তিতেই তার কাঠামো গড়ে উঠেছে।
সম্প্রসারিত বা যৌথ পরিবার এমন একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান যা কোরআনী সমাজের অন্যান্য মৌলিক বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলিত হয়ে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই বিরাট কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। এখানে সম্প্রসারিত বা যৌথ পরিবারের কতিপয় কল্যাণের উল্লেখ করা হলো :
১. এ ধরনের পরিবার পরিবারের যে কোন সদস্যকেই স্বার্থপরতা বা পথচ্যুতি থেকে রক্ষা করে। কারণ এরূপ পরিবারে ব্যক্তি ভিন্ন পথ অবলম্বন করলে তাকে শুধু তার স্বামী বা স্ত্রীকেই মোকাবিলা করতে হয় না,বরং সমকক্ষ,বয়োজ্যেষ্ঠ ও শিশুদের নির্বিশেষে তথা গোটা পরিবারকে মোকাবিলা করতে হয়।
২. এ ধরনের পরিবার সব সময়ই নারীদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও ক্যারিয়ার গঠনে সহায়ক হয় এবং এ জন্য তাদের নিজেদের বা তাদের স্বামীদের,সন্তানদের বা বয়োজ্যেষ্ঠদের কোনরূপ ক্ষতি বা অসুবিধা হয় না। কারণ যে মহিলা বাইরে কোন কাজ করে,এ ক্ষেত্রে অন্য প্রাপ্তবয়স্করা ঘরে তাঁকে সাহায্য করে থাকেন। একটি ইসলামী যৌথ পরিবারের একজন পেশাজীবী মহিলাকে না শারীরিক বা মানসিকভাবে অতিরিক্ত কাজের বোঝা বহনের কষ্ট স্বীকার করতে হয়,না তাকে সন্তান,স্বামী ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে মানসিকভাবে অপরাধবোধে আক্রান্ত হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্য সমাজ বর্তমানে যে সব সমস্যার মোকাবিলা করছে এ ধরনের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ব্যতিরেকে তার কোন কার্যকর সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। বস্তুত একক পরিবারের নারীরা বাইরের কাজে অংশগ্রহণের কারণে পরিবার তার সদস্যদের প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। আর যে পরিবারে শুধু মাতা বা পিতা আছে তার অসুবিধার পরিমাণ তো এর চেয়েও একশ’গুণ বেশি। এ ধরনের (অর্থাৎ একক) পরিবার ব্যবস্থা কর্মে নিয়োজিত নারীর ওপর যে চাপের সৃষ্টি করে তা ব্যক্তির জন্য,তেমনি বৈবাহিক ও পারিবারিক সম্পর্কের জন্য বিপর্যয়কর হয়ে থাকে। আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোতে পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতা,বিক্ষিপ্ততা এবং উচ্চ তালাক হার জনিত মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক জটিলতা৩ সেখানকার চিকিৎসক,আইনজীবী,মনোসংশ্লেষণবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদগণের এবং তৎসহ এ অবস্থার ভাগ্যাহত ভুক্তভোগীদের জন্যও বেশ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. সম্প্রসারিত বা যৌথ পরিবার শিশুদের যথাযথ সামাজিকীকরণের নিশ্চয়তা বিধান করে। একটি একক ছোট পরিবারের পিতা বা মাতার পক্ষে স্বীয় একগুঁয়ে শিশুকে কথা শুনতে বাধ্য করা কঠিন হতে পারে,কিন্তু একটি শক্তিশালী সম্প্রসারিত পরিবারের সদস্যদের যৌথ চাপ খাপ না খাওয়ানো বা অমান্যতা মোকাবিলার ক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হবার সম্ভাবনা আছে।
৪. সম্প্রসারিত বা যৌথ পরিবার প্রাপ্তবয়স্কদের এবং সে সাথে শিশু-কিশোরদের জন্যও,সাহচর্যের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। যেহেতু এরূপ পরিবারে ‘এক ব্যক্তির সাথে এক ব্যক্তির সম্পর্ক’-এর ওপর নির্ভরতা কম থাকে সেহেতু পরিবারের একেকজন সদস্যের ওপর ভাবাবেগমূলক দাবি-দাওয়ার পরিমাণও কম থাকে। একটি একক পরিবারে প্রাপ্তবয়স্কদের,শিশু কিশোরদের বা যে কোন দু’ব্যক্তির মধ্যে মতানৈক্য ও সংঘাত যতখানি ক্ষতি বয়ে আনতে পারে,একটি সম্প্রসারিত যৌথ পরিবারে এরূপ ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রা সে তুলনায় খুবই কম হয়ে থাকে। কারণ এ ক্ষেত্রে সব সময়ই ব্যক্তির মনোবেদনা উপশমের জন্য অথবা ব্যক্তিকে পরামর্শ বা সাহচর্য দিয়ে তার মানসিক রোগের চিকিৎসা করার জন্য পরিবারে বিকল্প সদস্য থাকে। এমনকি একক পরিবারে বৈবাহিক সম্পর্কে যে ধরনের টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে দেখা যায় সম্প্রসারিত যৌথ পরিবারে সে ধরনের সমস্যা তেমন একটা ঘটতে দেখা যায় না।
৫. সম্প্রসারিত পরিবার (আয়েলাহ্) প্রজন্মব্যবধান সৃষ্টি প্রতিরোধ করে। কারণ প্রজন্মব্যবধানরূপ সামাজিক সমস্যা উদ্ভবের কারণ হচ্ছে প্রতিটি বয়ঃগোষ্ঠীর অপরাপর বয়ঃগোষ্ঠী থেকে বয়সের ব্যবধান বেশি হওয়া। এর ফলে বিভিন্ন বয়ঃগোষ্ঠীর লোকদের পক্ষে পরস্পরের সাথে সফল ও অর্থবহ আন্তঃক্রিয়া সম্পাদন কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু সম্প্রসারিত যৌথ পরিবারে অধিক সংখ্যক প্রজন্মের লোকেরা একত্রে বসবাস করে এবং অনবরত পরস্পরের সাথে আন্তঃক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতি শিশু-কিশোরদের জন্য উপকারী শিক্ষা ও সামাজিকীকরণের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে,অন্যদিকে প্রবীণদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অনুভূতি ও কল্যাণ নিয়ে আসে।
৬. সম্প্রসারিত যৌথ পরিবার একাকিত্ব সমস্যার মূলোৎপাটন করে। আমরা জানি যে,সমকালীন সমাজসমূহের মধ্যে অনেক সমাজেই,বিশেষত শহরসমূহে বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন একটি বড় ধরনের সমস্যায় পর্যবসিত হয়েছে। কিন্তু একটি কোরআনী সমাজে এ ধরনের পরিস্থিতির আশঙ্কা নেই। কারণ একটি সম্প্রসারিত পরিবারে একজন অবিবাহিতা বা একজন তালাকপ্রাপ্তা বা একজন বিধবা মহিলাকে কখনই সে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না যে সমস্যার সম্মুখীন,উদাহরণস্বরূপ,সমকালীন আমেরিকান সমাজকে হতে হচ্ছে। কোরআনী সমাজে বাণিজ্যিক কম্পিউটার-ডেটিং প্রতিষ্ঠান,একাকী জীবন যাপনকারীদের ক্লাব বা বার অথবা প্রবীণদের জন্য শেষ জীবনে বসবাসের পলীক্কবা বৃদ্ধ নিবাস প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয় না। কারণ একটি সম্প্রসারিত যৌথ পরিবারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তির সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন পূরণ করার ব্যবস্থা রয়েছে।
পাশ্চাত্য জগতে দিনের পর দিন ক্রমান্বয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক অধিকতর নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। আর এর বিষময় পরিণতির প্রধান শিকার হচ্ছে নারীরা। বৈবাহিক বা অন্যান্য সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম সক্ষম। ফলে এ অবস্থার দ্বারা তাদেরই বেশি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে।
৭. একটি যৌথ পরিবারে প্রবীণদের সেবা-যত্নের ব্যাপারে অধিকতর বাস্তবসম্মত ও মানবসুলভ ভূমিকা গ্রহণ করা সম্ভব হয়। একটি একক পরিবারে দাদা-দাদীর সেবা-যত্নের ভার পুরোপুরি এক দম্পতির অর্থাৎ পরিবারের পিতা-মাতার ওপর,বিশেষ করে মাতার ওপরে বর্তায়। তাকে শ্বশুর-শাশুড়ীর শারীরিক ও মানসিক খেদমতের জন্য অতিরিক্ত সময়ও শ্রম দিতে হয়। এটি একজন মহিলার জন্যে বেশ কঠিন বোঝা। কারণ স্বভাবতঃই তার ছেলে-মেয়ে থাকে এবং তাকে স্বামী ও ছেলেমেয়েদের সেবাও করতে হয়। আর সে যদি একজন কর্মজীবী বা পেশাজীবী নারী হয় তাহলে তার পক্ষে এতসব বোঝা বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বাধ্য হয়ে প্রবীণ ব্যক্তিদেরকে প্রবীণ আশ্রমে পাঠাতে হয় যেখানে তারা মৃত্যুর জন্য প্রহর গুণতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে সম্প্রসারিত যৌথ পরিবারে একাধিক ব্যক্তি ভাগাভাগি করে এ ধরনের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে বিধায় তাদের প্রত্যেকের বোঝাই উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পায় এবং তাদের পক্ষে দায়িত্ব পালন সহজ হয়।৪
পাঁচ : পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক সংগঠন
একটি কোরআনী সমাজের পঞ্চম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে,এ ধরনের সমাজ হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ৫। তথাকথিত নারী স্বাধীনতাকামী বা নারীবাদী আন্দোলনসমূহের লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিকভাবে,কোরআনী সমাজে নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পরিবারের প্রধান (উপার্জনশীল) পুরুষ ব্যক্তির ওপর অর্পিত হয়।
প্রতিটি সমাজেই কতগুলো মানবিক সংগঠন থাকে,যেমন সরকার,রাজনৈতিক দলসমূহ,ধর্মীয় সংগঠনসমূহ,বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান,সম্প্রসারিত পরিবার ইত্যাদি। এরূপ যে কোন সংগঠনকে তার অংশসমূহ বা সদস্যদের জন্য কল্যাণকর হতে হলে তাকে অবশ্যই স্থিতিশীল,সুসংবদ্ধ,সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিচালিত হতে হবে। আর সংগঠনটিতে এসব বৈশিষ্ট্য পেতে হলে অবশ্যই এর চূড়ান্ত দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বা পদাধিকারী গোষ্ঠীর ওপর অর্পণ করতে হবে।
অতএব,সমাজের নাগরিকগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে,সংসদ আইন পাশ করতে এবং পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধানই জাতীয় ক্রান্তিকালে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন;তেমনি অন্যদের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে থাকেন। অর্থাৎ সকল সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত দায়িত্ব একজনের কাঁধেই অর্পিত থাকে। একইভাবে একটি কারখানার কাজসমূহ অনেক লোক মিলে সম্পাদন করে থাকে। কিন্তু তাদের সকলেই কোম্পানীর পক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সমানভাবে সক্ষম নয়। তেমনি কোম্পানীর সাফল্য বা ব্যর্থতার জন্য তার প্রতিটি কর্মচারী সমভাবে দায়িত্বশীল নয়।
অনুরূপভাবে একটি পরিবারের জন্যও সামগ্রিকভাবে চূড়ান্ত দায়-দায়িত্বের বোঝা একজনের ওপর অর্পিত থাকা অপরিহার্য। কোরআন মাজীদ পরিবারের জ্যেষ্ঠতম পুরুষ সদস্যের ওপর এর দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এ হচ্ছে এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব। কোরআন মাজীদে এ ভাষায় এ দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে : ... وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ (সূরা আল বাকারা : ২২৮) এবংﹲ الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ (সূরা আন নিসা : ৩৪)।ﹶ
কোরআনের শত্রুরা এ আয়াতদ্বয়ের বিকৃত অর্থ করে দাবি করে যে,কোরআন নারীদের ওপর পুরুষদের লৈঙ্গিক ভিত্তিক একক ডিক্টেটরশীপ চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ আয়াতদ্বয়ের অর্থ তা নয়। কারণ কোরআন মাজীদ যে বার বার নারী-পুরুষের সমতার কথা বলেছে ও তা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে এবং নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও আন্তরিকতার সাথে আচরণের নির্দেশ দিয়েছে,সে প্রেক্ষিতে উক্ত আয়াতদ্বয়ের এরূপ ব্যাখ্যা করা অন্যান্য আয়াতের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন বৈ কিছু নয়। বরং আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে পরিবারের সকল সদস্যের কল্যাণের স্বার্থে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও সিদ্ধান্তহীনতা এড়াবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কারণেই একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া আলোচ্য আয়াতদ্বয়ের দ্বিতীয়টিতে ব্যবহৃত قَوَّامُونَ শব্দের তাৎপর্যের প্রতি আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ... الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ আয়াতে ব্যবহৃত ক্রিয়া বাচক বিশেষ্য (বহুবচনে)قَوَّامُونَ -এর মূল ক্রিয়াপদ হচ্ছে قوّم ৬ যা স্বৈরাচারী কর্তৃত্বের জন্য প্রযোজ্য নয়। বরং এ পরিভাষায় তাকেই বোঝানো হয়েছে যে অন্যের জন্য ‘দাঁড়িয়ে যায়’قام এবং তাকে রক্ষা করে বা তার প্রতি মহানুভবতা দেখায়। এখানে যদি সমাজে পুরুষ সদস্যদের স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী ভূমিকার কথা বলাই উদ্দেশ্য হতো তাহলে এজন্য অন্য কোন ক্রিয়াপদ থেকে নিষ্পন্ন শব্দ ব্যবহার করা হতো। উদাহরণস্বরূপ,مسیطرون বা مهیمنون বলা হতো। কোরআন মাজীদের অন্যান্য আয়াতে ব্যবহৃত قَوَّامُونَ শব্দের তাৎপর্য থেকে সুস্পষ্ট যে,আলোচ্য আয়াতে কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরতান্ত্রিক অর্থে নয়,বরং সহায়ক ও পৃষ্ঠপোষক অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে (সূরা আন নিসা : ১২৭-১৩৫ ও সূরা আল মায়েদা : ৯)। আলোচ্য আয়াতের এতদভিন্ন অন্য কোন অর্থ গ্রহণ আদর্শিক দিক থেকে ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যহীন এবং ভাষাগত দিক থেকেও অযথার্থ।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে,কোরআন মাজীদ কেন মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের কথা না বলে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার বা পুরুষের নেতৃত্বের কথা বলেছে? কোরআন মাজীদ স্বয়ং এভাবে প্রশ্নটির জবাব দিচ্ছে :
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّـهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ
“পুরুষরা নারীদের ওপর দায়িত্বশীল,কারণ আল্লাহ্ তাদের একজনের তুলনায় আরেকজনকে আধিক্য দিয়েছেন এবং এ কারণেও যে,তারা তাদের ধন সম্পদ থেকে (নারীদের প্রয়োজন পূরণের জন্য) ব্যয় করে...।” (সূরা আন নিসা : ৩৪)
অতএব,দেখা যাচ্ছে,কোরআন মাজীদ যে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের পরিবর্তে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রস্তাব করেছে তার পিছনে স্বয়ং কোরআন মাজীদ যে কারণ প্রদর্শন করছে তা হচ্ছে তাদের শারীরিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে অবদান এবং দায়িত্ব বহন।
সমকালীন পাশ্চাত্য সমাজের সমস্যাবলীর মুখোমুখী হয়ে পাশ্চাত্যের অনেক লোক এ ধরনের প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন : আমরা সাহায্যের জন্য কোথায় হাত বাড়াতে পারি? বর্তমান সামাজিক বিক্ষিপ্ততার মোকাবিলায় আমাদের করণীয় কি? বস্তুত পাশ্চাত্য সমাজ ক্রমবর্ধমান হারে ব্যক্তিগত উদভ্রান্ত অবস্থা ও সামাজিক বিক্ষিপ্ততার আঘাতের ফলে এখন চরম হতাশার মুখোমুখী এসে দাঁড়িয়েছে এবং মুক্তির সন্ধান করছে।
এমতাবস্থায় আমরা মুসলমান হিসেবে তাদের সাহায্যের জন্য কি করতে পারি? সব কিছুর আগে আমাদেরকে অবশ্যই সমগ্র মুসলিম বিশ্বে কোরআনী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ এরূপ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা ব্যতীত আমাদের পক্ষে সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে আন্তঃক্রিয়ার জন্য সমতাভিত্তিক ও টেকসই অবস্থান গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। অধিকন্তু আমরা যদি কেবল ইসলামী নামধারী সমাজ গঠন ও পরিচালনা ছাড়া আর কিছু করতে সক্ষম না হই তাহলে আমরা আশা করতে পারি না যে,আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের সমাজের প্রতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির প্রতি সম্মান ও আনুগত্য প্রদর্শন করবে। কারণ নামধারী ইসলামী মানদণ্ড বা প্রতিষ্ঠানাদি কার্যত ইসলাম বিরোধী বৈ অন্য কিছু নয়,কারণ তা এমন একটি দৃষ্টান্ত (মডেল) উপস্থাপন করে যার প্রতি সম্মান দেখানো এবং ‘ইসলামী’বিশেষণ লাগানো সম্ভব নয়। কারণ এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ সমাজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির কারণে অমুসলমানদের পাশাপাশি অনেক মুসলমানের মনেও স্বয়ং ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
আমাদের অবশ্যই মুসলিম ভাইবোনদেরকে বিশেষ করে মুসলিম জাতির ভবিষ্যৎ নেতা তরুণদেরকে নারী,পরিবার ও সমাজ প্রসঙ্গে কোরআনী ঐতিহ্যসমূহের গুরুত্ব ও যথার্থতা সম্বন্ধে শিক্ষা প্রদান করা অপরিহার্য। কিন্তু কোরআনী সমাজের বিপরীতে সমকালীন পাশ্চাত্যে যে সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান তার ব্যর্থতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের মধ্যে এমন অনেক লোক পাওয়া যায় যারা পশ্চিমা ধরনের লৈঙ্গিক সমতা,একলৈঙ্গিক ধ্যান-ধারণা,আচার-আচরণ,ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা দায়িত্বমুক্ত ব্যক্তি স্বাধীনতা ও একক পরিবার ব্যবস্থার অন্ধ সমর্থকে পরিণত হয়েছে এবং মুসলিম জাহানে তা প্রবর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ ধরনের সামাজিক ধ্যান-ধারণা ও তার চর্চার বিপজ্জনক পরিণতি সম্বন্ধে সকলকে সজাগ করা আমাদের জন্য অপরিহার্য। এসব ধ্যান-ধারণা ও তার চর্চার পরিণতি তুলে ধরতে হবে এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে অন্যথায় আমাদেরকে এক দুর্ভাগ্যজনক ভবিষ্যতকে স্বাগত জানাতে হবে। কারণ এ ধরনের সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যর্থ হতে বাধ্য।
কিন্তু আমাদের মুসলমানদের জন্য শুধু এতটুকুই যথেষ্ট নয়;বরং ধরণির বুকে আল্লাহ্তায়ার খলীফা হিসেবে (সূরা আল বাকারা : ৩০) আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব সম্বন্ধে এবং আল্লাহ্তায়ালার সৃষ্ট সকল প্রাণী সম্বন্ধেই উদ্বিগ্ন হওয়া। যেহেতু আল্লাহ্তায়ালা আমাদেরকে বিশ্বের প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাঁর ইচ্ছা ও পছন্দ-অপছন্দের কথা প্রচার করার জন্য আদেশ দিয়েছেন সেহেতু মানুষের কল্যাণের পথ সম্বন্ধে আমাদের যা জানা আছে তা অন্যদের নিকট পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বের প্রতি আমরা উপেক্ষা দেখাতে পারি না। বস্তুত শুধু মুসলমানদের সামনেই নয়,বরং অমুসলিমদের সামনেও ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষ থেকে সমকালীন সমাজের সমস্যাবলীর সমাধান উপস্থাপন করার জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। আর তা করা যেতে পারে ও করা উচিত কোরআনী সমাজের জীবন্ত দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে-যে সমাজে নারী-পুরুষের সমস্যাবলীর যথাযথ সমাধান হবে। তেমনি এ জন্য আমাদের চিন্তাবিদ ও মনীষিগণকে তথ্যবহুল লেখালেখি ও আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে এবং তা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট পৌঁছে দিতে হবে।
আল্লাহ্তায়ালার ইচ্ছার বাস্তব রূপায়ন ও সমগ্র মানব জাতির খেদমতের জন্য এর চেয়ে অধিকতর উত্তম কোন পথ নেই। বস্তুত একটি কোরআনী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমকালীন সমাজের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ছাড়া অধিকতর উত্তম ধর্মীয় প্রচার কার্যক্রম আর কিছু হতে পারে না। (সমাপ্ত)
পাদটীকা
১. Extended Family -মূলত বড় ধরনের যৌথ পরিবার বুঝানোই লেখিকার লক্ষ্য। বস্তুত যৌথ পরিবারের ন্যূনতম ধারণা হচ্ছে দু’ভাই ও তাদের পিতামাতা এবং প্রত্যেক ভাইয়ের স্ত্রী ও সন্তানগণ। কিন্তু চিন্তা করলে দেখা যাবে,দম্পতির সন্তান সংখ্যা গড়ে চার জনের কম হলে যৌথ পরিবারের ধারণার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ গড়ে চারটি সন্তান হলে গড়ে ছেলে ও মেয়ের সংখ্যা হবে দু’জন করে;মেয়েরা বিয়ে করে অন্য পরিবারে চলে গেলে ও ছেলেরা বিয়ে করলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা দাড়াবে ছয় জন। অতঃপর দু’ভাইয়ের প্রত্যেকের গড়ে চার জন করে সন্তান না হলে পরবর্তীতে যৌথ পরিবারের ধারণা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।-অনুবাদক
২. Compound -অভিন্ন মালিকানাধীন অভিন্ন সীমানা ঘেরা একাধিক (সাধারণত একতলা) ভবন বা গৃহসম্বলিত আবাসিক জায়গা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অনেক এলাকায় এ ধরনের বাড়ি আছে যেখানে একই পরিবারের সদস্যরা কয়েকটি স্বতন্ত্র ছোট ছোট ঘরে বসবাস করে।-অনুবাদক
৩. ১৯৭৯ সালে আমেরিকায় ২৩ লাখ ৩১ হাজার বিবাহ সংঘটিত হয় এবং তার বিপরীতে তালাকের ঘটনা ঘটে ১১ লাখ ৮১ হাজার। ১৯৮৩ সালের Almanac -এ এ তথ্য প্রদান করা হয়েছে। প্রতি বছরই তালাকের শতকরা হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।-(লেখিকা)
পরবর্তীকালে আমেরিকার সামাজিক অবক্ষয় আরো বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৫ সালে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আমেরিকায় প্রতি ১০০ বিবাহের মধ্যে ৫৫টি ভেঙ্গে যাচ্ছে (Newsweek -১২-০৬-৯৫)। এ ছাড়া পিতা- মাতার মধ্যকার বিবাহবিচ্ছেদ এবং পিতা কর্তৃক অবৈধ সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ না করা ও সন্তানের মাকে বিবাহ না করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ২৩ দশমিক ৯ ভাগ শিশু পিতা বা মাতার কাছে (প্রধানত মাতার কাছে) বড় হয় প্রাগুক্ত। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২২ হাজার শিশু জন্মের পর পিতা ও মাতা উভয় কর্তৃক হাসপাতালে পরিত্যক্ত হয় (এ. এফ. পি/ দৈনিক দিনকাল : ১১-১১-১৯৯৩)। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর যত শিশু জন্ম নেয় তার শতকরা ৩১ ভাগই অবৈধ News Week: ০৮-০১-১৯৯৬)। ১৯৯২ সালে আমেরিকায় ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়স্কা মেয়েরা ৩ লাখ ১১ হাজার শিশুর জন্ম দেয় যাদের মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগই ছিল অবিবাহিতা মায়েদের (AFP/ The Morning Sun, Dhaka: ০৯-০২-১৯৯৪)। সেখানে বছরে গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে ১৬ লাখ (The Telegraph, Dhaka: ২৭-১১-১৯৯২)। আমেরিকার সামাজিক অবক্ষয় সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার জন্য ‘মৎ’প্রণীত ‘পতনের দ্বারপ্রান্তে আমেরিকা’পুস্তকটি অধ্যয়ন করা যেতে পারে। -অনুবাদক
৪. সম্মানিত লেখিকা অত্র প্রবন্ধে সম্প্রসারিত বা যৌথ পরিবারের সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যেখানে দাদা-দাদী,চাচা-চাচী ও তাদের ছেলেমেয়েরা একই ভবনে বা একটি আবাসিক জায়গায় একত্রে বসবাস করবে। অবশ্য এটি সত্য যে,ইসলাম রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে (সূরা আল আহযাব : ৫০,সূরা আন নূর : ৬১) এবং ঈমানী সম্পর্কের অধিকারীদের মধ্যে (সূরা আল হুজুরাত : ১০;সূরা আল হাশর : ১০) ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক সম্পর্ক পছন্দ করে,তথাপি কোরআন মাজীদে ও হাদীসে সম্ভবত এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না যে,তাদের সকলের একটি ভবনে বা একটি আবাসিক জায়গায় একত্রে বসবাসকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। তেমনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগে প্রথম মুসলিম জনগোষ্ঠী এরূপ করেছেন বলেও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত নেই। অবশ্য লেখিকা যে সম্প্রসারিত যৌথ পরিবারের সপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন তা ইসলামী শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যহীন নয়। (Editor: Al-Tawhid)
৫. লেখিকার আলোচনা থেকেও সুস্পষ্ট যে,তিনি এখানে ‘পিতৃতান্ত্রিক’বলতে প্রচলিত ধারণার স্বৈরাচারী কর্তৃত্বকে বুঝাননি,বরং পরিবারের প্রতিটি সদস্যের শারয়ী ও আইনগত অধিকার সংরক্ষণসহ পরিবারের পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পরিবারের প্রধান পুরুষের হাতে থাকার কথা বুঝিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ,পিতৃতান্ত্রিক ইসলামী পরিবারে স্বামী জোর করে স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পদ ছিনিয়ে নিতে পারে না বা পিতা তার কন্যাকে কন্যার অসম্মতি সত্ত্বেও জোর করে বিবাহ দিতে পারে না। এখানে পিতৃতান্ত্রিকতার মানে এই যে,পরিবারের সামষ্টিক ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পরিবারের প্রধান পুরুষ ব্যক্তির।-অনুবাদক
৬. লেখিকার প্রতিপাদ্য বিষয় পুরোপুরি সঠিক,তবে ব্যাকরণগত বিশ্লেষণে সামান্য ভুল হয়েছে যদিও তাতে উপসংহারে কোন পরিবর্তন ঘটছে না। قوّامون শব্দটির একবচন قوّام এর অর্থ যে বেশি বেশি বা বার বার দাঁড়ায় এটি قام থেকে উদ্ভূত,قوّام থেকে নয়।–অনুবাদক
(জ্যোতি বর্ষ ২ সংখ্যা ৩)