আদাবুস সুলূক (আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমার নিয়মাবলী)-৩য় পর্ব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আধ্যাত্মিক পথের পথিকদের জন্য কতগুলো অভ্যন্তরীণ নিয়ম-নীতিও রয়েছে যা তাদের মেনে চলতে হয়। তা হচ্ছে এই :
এক
প্রথমত নাফস (স্বীয় ব্যক্তি সত্তা)-এর প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। অর্থাৎ সালেককে সদাসর্বদাই স্বীয় অন্তঃকরণের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে,এমনকি এক মুহূর্তের জন্যও তার এ ব্যাপারে উদাসীন হওয়া চলবে না। অন্যথায় সে তার ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনা ও শয়তানী কুমন্ত্রণার (ওয়াস্ওয়াসার) শিকার হবে। তাকে সব সময় স্মরণ রাখতে হবে,আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখছেন। কারণ আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
إنّ الله كان عليكم رقيباً
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তোমাদের ওপর দৃষ্টি রাখেন।’ (সূরা আন-নিসা : ১)
রাসূল (সা.) এরশাদ করেন,‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অন্তঃকরণ ও কাজকর্মের ওপর দৃষ্টি রাখেন;তোমাদের বাহ্যিক আচরণ ও পার্থিব ধনসম্পদের ওপর নয়।’
দুই
দ্বিতীয়ত রাব্বুল আলামীনের সমীপে স্বীয় বিনয়,দৈন্য ও তুচ্ছ অবস্থা প্রকাশ করতে হবে। হযরত বায়েজীদ (রহ.) বলেছেন,‘একটি কণ্ঠ আমার ভেতর হতে আমাকে ডেকে বলেন : হে বায়েজীদ! অনেক বান্দা আমার খেদমতে হাজির রয়েছে,অতএব,তুমি যদি আমার সন্ধানী হয়ে থাক তাহলে বিনয় ও মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ কর।’
হযরত বায়েজীদ (রহ.) আরো বলেছেন,‘তুমি নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ,তুমি প্রতি মুহূর্তে বিভিন্ন বিষয়ে তোমার রবের নিকট চরমভাবে মুখাপেক্ষী। অতএব,তুমি যেমন তাঁর হেদায়েতের আলোর মুখাপেক্ষী,তেমনি তাঁর দয়ার দৃষ্টি,পথ চলায় তাঁর সাহায্য এবং তোমার অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্যও প্রতি মুহূর্তে তাঁর মুখাপেক্ষী। তেমনি মৃত্যুর মুহূর্তেও তুমি তাঁর মুখাপেক্ষী যাতে ঐ সময় তোমার অন্তরে ইসলামের নূর ও তার জ্ঞান অবিকৃত থাকে। কবরেও তুমি তাঁর মুখাপেক্ষী যাতে তুমি মুনকার ও নাকিরের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পার। কবরের জীবনের ভয়াবহ অবস্থায় তিনিই হবেন তোমার বন্ধু। তোমার সবচেয়ে বড় মুখাপেক্ষিতা হচ্ছে শেষ বিচারের দিনে,চরম অনুতাপ ও অনুশোচনার দিনে-তাঁর ওপরে তোমার নির্ভরশীলতা যাতে মহান আল্লাহ তায়ালা তোমার চেহারাকে সমুজ্জ্বল করে দেন,অনুগ্রহ করে তোমার দোষ-ত্রুটি ও কলঙ্ক গোপন করে দেন,মীযানে তোমার নেক আমলসমূহের ওজন ও মূল্য বৃদ্ধি করে দেন,যাতে তিনি তোমার হিসাব-নিকাশকে পরিচ্ছন্ন ও নিঃঝঞ্ঝাট করে দেন ও তোমার আমলনামাকে তোমার ডান হাতে তুলে দেন,যাতে তিনি তোমাকে সীরাতের ওপর অটল রাখেন,দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করেন এবং বেহেশতে পৌঁছে দেন। আর তাঁর সবচেয়ে বড় মহানুভবতা ও সর্বোত্তম অনুগ্রহ হবে,তুমি তাঁর দীদার লাভে ধন্য হবে।’
এগুলো হচ্ছে আপনার রবের কাছে ইহকালে ও পরকালে আপনার অপরিহার্য প্রয়োজন। সুতরাং আপনাকে আল্লাহ তায়ালার সামনে এমনভাবে দৈন্য ও বিনয় প্রকাশ করতে হবে যেন তাতে আপনার প্রকৃত দৈন্য ও প্রয়োজনের প্রতিফলন ঘটে।
তিন
এ পর্যায়ের তৃতীয় বিষয় হচ্ছে সুখ-দুঃখ,স্বচ্ছলতা-দারিদ্র্য,আরাম-আয়েশ ও বিপদাপদ নির্বিশেষ সকল অবস্থায় আল্লাহ তায়ালার সামনে অনুতাপ করতে হবে ও তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে এবং ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা হযরত সুলাইমান (আ.)-এর কথা উল্লেখ করে এরশাদ করেন,‘কতই না ভাল বান্দা! সে ছিল (আল্লাহর দিকে) বারবার প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সূরা সোয়াদ : ৩০) আল্লাহ তায়ালা হযরত আইয়ুব (আ.) সম্বন্ধেও একই কথা বলেছেন। এ দু’ নবী সম্পর্কে এরূপ প্রশংসার কারণ হচ্ছে,হযরত সুলাইমান তাঁর ধন-সম্পদ ও প্রাচুর্যের মধ্যে স্বীয় রবের অনুগ্রহ দেখতে পান এবং হযরত আইয়ুব আল্লাহ তায়ালাকে বান্দাদের পরীক্ষাকারীরূপে দেখতে পান। তাই হযরত সুলাইমানকে প্রদত্ত ধনসম্পদ ও প্রাচুর্য এ সবের দাতা মহান আল্লাহ তায়ালা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে কালিমা লিপ্ত করতে পারে নি,তেমনি হযরত আইয়ুব যে মুসিবতের শিকার হন তা এর দ্বারা তাঁকে পরীক্ষাকারী ও তাঁর মাঝে পর্দা সৃষ্টি করতে পারে নি। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁরা নিজ নিজ অবস্থাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে উল্লেখ করেছেন।
চার
চতুর্থ মূলনীতি হচ্ছে,মহান আল্লাহ তায়ালার বরাবরে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ (তাসলীম) করা। ‘তাসলীম’ মানে হচ্ছে শরীর ও মন উভয় সহকারে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করতে হবে। কারণ এতদুভয়েরই মালিক আল্লাহ তায়ালা। কোন দাসের জন্য তার মালিকের প্রতি আনুগত্যের অপরিহার্য শর্ত হলো সে তার মালিকের সম্পদ মালিকের নিকট সমর্পণ করবে। ঐ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ এবং যেভাবে খুশী তা ব্যয়-ব্যবহারের অধিকার তার মালিকেরই। গোলামকে সম্মানিত করা বা অপমানিত করা তাঁর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তিনি তাকে বেঁচে থাকতে দেবেন,নাকি হত্যা করবেন;অসুস্থ করবেন,নাকি সুস্থতা দান করবেন;তাকে ধনী করবেন নাকি দরিদ্র বানাবেন -সবই তাঁর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তাই একজন সালেকের জন্য এটি অপরিহার্য যে,সে কখনোই আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনরূপ আপত্তি উত্থাপন করবে না। সে না তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোন অভিযোগ করবে,না গোপনে কোন অভিযোগ করবে। কারণ প্রকৃত মালিকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো একটি অযৌক্তিক ব্যাপার এবং নিয়মনীতির লঙ্ঘন। যে ব্যক্তি নিজেকে কারো দাস ও প্রেমিক বলে দাবি করে তার পক্ষ থেকে মালিক ও প্রেমাস্পদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে প্রেম,দাসত্ব ও ভক্তিতে ঘাটতির পরিচায়ক।
পাঁচ
পঞ্চম মূলনীতি হচ্ছে,‘রেযা’ বা সন্তুষ্টি অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু নির্ধারিত হয় তা যতই তিক্ত হোক না কেন,তাকে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয়া। সাধারণ মু’মিনগণ বিপদাপদ-বালা-মুসিবতের সময় ধৈর্যধারণ করে। অন্যদিকে একই অবস্থায় আল্লাহ তায়ালার নির্বাচিত বান্দাগণ যা করেন তা হচ্ছে রেযা। সবর ও রেযা-র মধ্যে পার্থক্য হলো ধৈর্যশীল ব্যক্তি তার ঈমানী শক্তির বদৌলতে ধৈর্যের সাথে বিপদাপদ মোকাবিলা করে,তার ঈমান এ অবস্থায়ও অটল থাকে এবং বিপদাপদের সময় সে বিচলিত হয়ে পড়ে না,সে তার মালিকের দাসত্বের পথ থেকে বিচ্যুত হয় না,বিপদাপদ ও বালা-মুসিবত যত মারাত্মক ও অসহনীয়ই হোক না কেন,তার অন্তর এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে। কিন্তু সন্তুষ্ট ব্যক্তি হচ্ছেন তিনি যাঁর অন্তঃকরণ সর্বাবস্থায়ই সন্তুষ্ট ও সুখী থাকে। বিপদাপদ তাঁর অন্তরে মোটেই দাগ কাটে না এবং তাঁকে বিচলিত করে না। কারণ তিনি জানেন,এ সবকিছুই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হচ্ছে।১ তাই এ সবকে তিনি বন্ধুর দেয়া উপহার বলে গণ্য করেন। অন্য লোকেরা আল্লাহর দেয়া নেয়ামতকে যেভাবে উপভোগ করে ঠিক সেভাবেই তিনি তাঁর প্রিয়তম ও বন্ধুর পক্ষ থেকে তাঁর ওপরে আপতিত দুঃখ-কষ্ট ও কঠোরতাকে উপভোগ করেন।২
ছয়
ষষ্ঠ মূলনীতি হচ্ছে,সার্বক্ষণিকভাবে দুঃখ অনুভব করা। রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন,‘আল্লাহ্ দুঃখিত অন্তরকে ভালবাসেন।’
মহানবীর গুণাবলী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে,তিনি সব সময় চিন্তামগ্ন ও দুঃখিত থাকতেন।
আরেফগণের মতে দুঃখশূন্য অন্তরসমূহ কর্দম ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন ঈমানদার যখন জানে না যে,সৃষ্টির শুরুতে তার ভাগ্যে কি লেখা হয়েছে-সে ভাগ্যবান হবে,নাকি হতভাগ্য হবে৩ তা যখন সে জানে না তখন কি করে তার পক্ষে আনন্দিত ও হাসিখুশী হওয়া সম্ভব? তা ছাড়া সে তো জানে না,সৎ পথে বা পাপের পথে আগামী দিনে সে কি অর্জন করবে। সে জানে না তার ইবাদাত ও আনুগত্য আল্লাহ তায়ালার নিকট কবুল হবে কিনা এবং তার পাপরাশি ক্ষমা করা হবে কিনা।
শেখ আবুল হাসান আল-খারকানী ছিলেন দুঃখভারাক্রান্ত লোকদের অন্যতম। একদিন তাঁর নিকট বড় বড় সূফিগণের দুঃখভারাক্রান্ত থাকার কারণ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়। তিনি জবাবে বলেন,এর কারণ হচ্ছে,তাঁরা আল্লাহ তায়ালাকে জানার মত জানতে চান,কিন্তু তা সম্ভব নয়। কারণ আল্লাহ তায়ালাকে পুরোপুরি জানা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
সাত
সপ্তম মূলনীতি হচ্ছে,মহান আল্লাহ তায়ালা সম্বন্ধে সুধারণা পোষণ করা। একটি হাদীসে কুদসী অনুযায়ী,আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
أنا عند ظنِّ عبدي فليظنّ بي ما شاء
‘আমি আমার বান্দার ধারণায় রয়েছি। অতএব,সে আমার সম্বন্ধে যেরূপ ইচ্ছা ধারণা করুক।’৪
সুতরাং আল্লাহর বান্দার জন্য তাঁর সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করা,তাঁর সম্পর্কে ইতিবাচক চিন্তা করা ও তাঁর ওপরে আস্থা রাখা অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্যবাচক গুণাবলী সম্পর্কে চিন্তা করা থেকে মানবমন এ অবস্থায় উপণীত হতে পারে। এ সব গুণের মধ্যে রয়েছে দয়া,মহানুভবতা,দানশীলতা,ঔদার্য এবং তাঁর ক্ষমার ব্যাপকতা। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ওপর অনাস্থা পোষণ করে বা স্বীয় রব সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা পোষণ করে এবং তাঁর দয়া-অনুগ্রহের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়ে,সে তার গুনাহ-খাতাকে আল্লাহ তায়ালার দয়া,মহানুভবতা ও ক্ষমার ক্ষমতার তুলনায় অনেক বড় মনে করে বলেই এরূপ ধারণা পোষণ করে। বস্তুত এরূপ ধারণা পোষণকারী কার্যত আল্লাহ তায়ালার ওপর ত্রুটি ও অক্ষমতা আরোপ করে যা একেবারেই ভিত্তিহীন।
আট
অষ্টম মূলনীতি হচ্ছে,ব্যক্তি নিজেকে যেন আল্লাহ তায়ালার পাকড়াও ক্ষমতার বাইরে মনে না করে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
أفأمنوا مكر الله فلا يأمن مكر الله إلّا القوم الخاسرون
‘তারা কি আল্লাহর কৌশল (পরিকল্পনা) সম্বন্ধে নিশ্চিত ও নিরাপদ হয়ে গেছে? বস্তুত ক্ষতিতে আত্মনিমগ্ন লোকেরা ছাড়া কেউ নিজেকে আল্লাহর কৌশল থেকে নিরাপদ গণ্য করে না।’ (সূরা আল আ’রাফ : ৯৯)
আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন,
إنّما يخشى اللهَ من عباده العلماء
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর বান্দাগণের মধ্য থেকে আলেমগণ তাঁকে ভয় করে।’ (সূরা আল ফাতির : ২৮)
যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার প্রতাপমূলক গুণাবলী এবং তাঁর ক্রোধ (অসন্তুষ্টি) সম্বন্ধে চিন্তা করে তার মধ্যে এই ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। কারণ আল্লাহ তায়ালা যেমন দয়া,মহানুভবতা ও ক্ষমাশীলতার গুণের অধিকারী,ঠিক সেভাবেই তিনি ক্রোধ ও শক্তিরূপ গুণাবলীরও অধিকারী। মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন,
لأملأنَّ جهنّم من الجنّةِ و النَّاس أجمعين
‘অবশ্যই আমি জ্বিন ও মানুষদের দ্বারা একত্রভাবে জাহান্নামকে পূর্ণ করব।’ (সূরা হুদ : ১১৯)
এক হাদীসে এরশাদ হয়েছে,মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.)-কে বলবেন,‘ওঠ এবং তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ কর।’ হযরত আদম জিজ্ঞেস করবেন,‘কতজনকে?’ জবাব দেয়া হবে,‘প্রতি হাজারে নয়শ’ নিরানব্বই জনকে।’
এ অবস্থা সম্পর্কে জানা থাকার পর একজন বান্দার পক্ষে স্বীয় পাপের বোঝাসহ কি করে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার ভয়ঙ্কর ক্রোধের শিকার হওয়া থেকে বেঁচে যাবে ভেবে নিঃশঙ্ক হওয়া সম্ভব হতে পারে?
নয়
নবম মূলনীতি হচ্ছে প্রেম (মুহব্বত)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
...يحبّهم و يحبّونه ...
‘তিনি (আল্লাহ্) তাদের ভালবাসেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসে।’ (সূরা আল মায়েদাহ্ : ৫৪)
বস্তুত আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমার সকল মনযিল ও সকল কারামতের মূল সুর হচ্ছে মুহব্বত। আল্লাহর বান্দা এই মুহব্বতের বদৌলতেই আসমান-যমীনের রবের পানে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এর বদৌলতেই সে এ পথ পরিক্রমার সর্বোচ্চ স্তরে উপণীত হবে। আর মুহব্বত হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্যবাচক নামসমূহ সম্পর্কিত জ্ঞানের ফসল।
একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া এ বিশ্বে কেউই নিজস্ব সৌন্দর্যের অধিকারী নয়। সৃষ্টিনিচয়ের মধ্য যা কিছু সৌন্দর্য ও পূর্ণতা দেখা যায় তা হচ্ছে তাঁরই সৌন্দর্যের ঝলকের একটি কণা এবং তাঁর পূর্ণতার মহাসমুদ্রসমূহের একটি বারিবিন্দু মাত্র। আপনি যদি সৌন্দর্য ও পূর্ণতাকে বস্তুগত ও পার্থিব জিনিসসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে করে থাকেন তাহলে জেনে রাখুন,আপনি আকার-আকৃতির জগতের মধ্যে বন্দী হয়ে আছেন এবং প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন। কারণ প্রকৃত সৌন্দর্য ও যৌক্তিক পূর্ণতা কেবল কোন সত্তার মূলের মধ্যেই দেখা যেতে পারে যা শক্তি ও জীবনের অধিকারী,যার রয়েছে মহানুভবতা,মহত্ত্ব ও ধৈর্য এবং যা পূর্ণতা ও ত্রুটি থেকে মুক্ত। এ কারণেই মহানুভব,মহত্ত্ব ও জ্ঞানী লোকেরা সকলের ভালবাসা পেয়ে থাকেন। অনুরূপভাবে যোদ্ধা,বীর ও সাহসী লোকেরা তাদের শক্তি ও সাহসের কারণে লোকদের কাছ থেকে ভালবাসা পেয়ে থাকেন এবং জ্ঞানী ও পুতচরিত্র ব্যক্তিগণ তাঁদের জ্ঞান ও পুতচরিত্রের কারণে লোকদের নিকট থেকে ভালবাসা লাভ করে থাকেন।
জেনে রাখুন,এ সব সৌন্দর্যবাচক ও শৌর্যবাচক গুণের প্রতিটিই ঐশী সত্তায় নিহিত রয়েছে যিনি চিরন্তনভাবে ও সীমাহীন মাত্রায় এ সব গুণের অধিকারী। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য সমস্ত সত্তা বা অস্তিত্ব যে সব শৌর্য ও সৌন্দর্যবাচক গুণের অধিকারী তা সীমিত,গণনাযোগ্য,ঘটনাক্রমেপ্রাপ্ত,এর শেষ আছে বা তা মরণশীল। শুধু তা-ই নয়,এ সব গুণ উদারতা,দানশীলতা ও মহানুভবতার ঐশী মহাসমুদ্র থেকে ধারকৃত। অতএব,প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউই বা কিছুই ভালবাসা পাবার উপযুক্ত নয় বা অধিকার রাখে না। কারণ যত ধরনের সৌন্দর্যের অস্তিত্ব রয়েছে তা তাঁর থেকেই উৎসারিত হয়েছে। অতএব,যে কেউই আল্লাহ্ ছাড়া কোন কিছুকে বা কাউকে ভালবাসে সে নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্যের ব্যাপারে অন্ধ।
দশ
দশম মূলনীতি হচ্ছে,স্বীয় ইচ্ছা ও স্বাধীনতার ওপর নির্ভরশীলতা পরিত্যাগ করা এবং বিশ্বজগতের চিরন্তন মহাপ্রভুর ওপর আস্থা স্থাপন করা। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
ضرب الله مثلاً عبداً مّملوكاً لا يقدر على شيءٍ و مَنْ رّزقناه منّا رزقاً حسناً فهو ينفق منه سرّاً و جهراً هل يستون
‘আল্লাহ্ উপমা দিয়েছেন,একজন হচ্ছে কৃতদাস যার কোন বিষয়েই কোন ক্ষমতা নেই এবং একজন হচ্ছে সেই ব্যক্তি যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে উত্তম রিযিক প্রদান করেছি,অতঃপর সে তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে;তারা কি পরস্পর সমান?’ (সূরা আন নাহল : ৭৫)
অতএব,একজন বান্দা বা দাসের জন্য স্বাধীনতার প্রশ্ন ওঠে না। কারণ স্বাধীনতা হচ্ছে তার ব্যাপার যে মুক্ত। আরেফগণ বলেছেন,একজন তালেবের যদি একটিমাত্রও কামনা-বাসনা থাকে তাহলে তার অর্থ হচ্ছে,তার দৃষ্টির সম্মুখে পর্দা অবস্থান করছে এবং তা তার দর্শন ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
তাঁরা আরো বলেছেন,কামনা-বাসনা হচ্ছে সবচেয়ে বড় পর্দা। সুতরাং আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে অন্ধকার পর্দা।
আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যের আকাঙ্ক্ষাকেই যখন সবচেয়ে বড় পর্দা বলে গণ্য করা হয়েছে সে ক্ষেত্রে জৈবিক ও ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনা এবং পার্থিব লোভ-লালসায় নিমজ্জিত ব্যক্তির অবস্থা সম্বন্ধে আর কি বলা যেতে পারে? অতএব,যে ব্যক্তি মুর্দাকে গোসল দেয় তার হাতে মুর্দার যে অবস্থা তালেবের অবস্থা তদ্রূপ হওয়া অপরিহার্য যাতে সে হকের সাথে মিলিত হতে পারে। বস্তুত প্রতিটি আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনাই ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা থেকে দূরে নিয়ে যায়।
আত্মিক পূর্ণতার জন্য উপরোক্ত মূলনীতিসমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিলের জন্য সালেকের উচিত এ সব মূলনীতির অনুসরণ করা ও সংশ্লিষ্ট গুণাবলীতে স্বীয় সত্তাকে ভূষিত করা। অন্যথায় তার ঐকান্তিকতা,নিষ্ঠা ও আকাঙ্ক্ষা মিথ্যা বলে পরিগণিত হবে। তার মুহব্বত হবে স্রেফ একটি মিথ্যা দাবি। যদিও সে নিজেকে আল্লাহর পানে পথ পরিক্রমরত বলে মনে করে,কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে ইন্দ্রিয় লালসার অন্ধকূপে নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে।
পাদটীকা
১. মানুষের ওপর যে সব বিপদাপদ আপতিত হয় তার পেছনে আমরা মোটামুটি দু’টি কারণ খুঁজে পাই : ব্যক্তির কর্মফল ও আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত। আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজীদে এরশাদ করেছেন,
مآ أصابك من حسنةٍ فمن الله ومآ أصابك من سيِّئَةٍ فمن نّفسك،
‘তোমার কাছে যে কল্যাণই আসে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তোমার ওপর যে মন্দ আপতিত হয় তা তোমার নিজের (কাজকর্মের) কারণে।’ (সূরা আন-নিসা : ৭৯)
এ ছাড়া আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যও বিপদাপদের সম্মুখীন করেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
و لنبلونّكم بشيءٍ مّن الخوف و الجوعِ و نقصٍ مِّن الأموال و الأنفس و الثّمرات و بشِّر الصّابرين،
‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের ভয়-ভীতি;ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব;আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সূরা আল-বাকারাহ্ : ১৫৫)
এ ছাড়া অনেক সময় আল্লাহ তায়ালা কোন কোন বালা-মুসিবতের দ্বারা তাঁর বান্দার জীবনের গতিধারাকে এমনভাবে বদলে দেন যার ফলে তার জন্য ইহকালীন বা পরকালীন বা উভয় জীবনের জন্য কল্যাণ বয়ে আসে।
অবশ্য ব্যক্তির ঐচ্ছিক ভালমন্দ কাজকর্মও আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট প্রাকৃতিক কার্যকারণ বিধানের অধীনে সংঘটিত হয়। তাই এক অর্থে ব্যাপকতর দৃষ্টিকোণ থেকে সকল কাজই আল্লাহর প্রতি আরোপিত হয়। এ অর্থে বান্দার সকল বিপদাপদই আল্লাহর পক্ষ থেকে।-অনুবাদক
২.ইমাম আলী (আ.) ‘খুতবায়ে হাম্মাম’ নামক তাঁর এক বিখ্যাত ভাষণে আল্লাহর ওয়ালিগণের গুণবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উল্লেখ করেন,
نزلت أنفسهم منهم في البلاء كالتي نزلت في الرجاء
‘আরাম-আয়েশের সময় যেভাবে উপভোগ করা হয় তাঁরা বিপদাপদের সময়ও ঠিক সেভাবেই নিজেদের উপভোগ করেন।’
৩. এ বক্তব্য থেকে মনে হয়,লেখক অদৃষ্টবাদী আকীদায় বিশ্বাসী। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে,নিরঙ্কুশ অদৃষ্টবাদ ও নিরঙ্কুশ কর্মবাদ উভয়ই প্রান্তিক ধারণা ও ভ্রান্ত। আসলে মানবিক জগতের কাজকর্ম ও মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত প্রাকৃতিক কার্যকারণ,আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মানুষকে দেয়া ইখতিয়ার ও ক্ষেত্রবিশেষে আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্তমূলক হস্তক্ষেপের সমন্বয়ের দ্বারা। আল্লাহ তায়ালা যদি সৃষ্টির শুরুতে মানুষের ভাগ্য পুরোপুরি নির্ধারণ করে দিতেন তাহলে মানুষের আমল বলতে কিছু থাকত না এবং মানুষ হতো জৈবিক যন্ত্র মাত্র। কিন্তু আমরা অনুভব করি,মানুষ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র নয়;তার স্বাধীনতা আছে। তা ছাড়া আল্লাহ্ তাঁর বান্দার ভাগ্যে তার জন্মের আগেই গুনাহ,পাপাচার ও গোমরাহী লিখে দেবেন এমন নীচতা থেকে এবং এ জন্য বান্দাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে তাকে শাস্তি দেবেন এমন অন্যায় থেকে তিনি মুক্ত। কোরআন মজীদে অবশ্য এ কথাও আছে,আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে গোমরাহ করেন,যেমন এরশাদ হয়েছে :
و من يضلل الله فلن تجد له سبيلا
‘আর আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ করেন তুমি কখনোই তার জন্য (হেদায়াতের) কোন পথ পাবে না।’ (সূরা আন-নিসা : ৮৮)
কিন্তু এ আয়াতেরই শুরুতে আল্লাহ তায়ালা তাদের গোমরাহ করার কারণ উল্লেখ করেছেন,এরশাদ করেছেন,
و الله أركسهم بما كسبوا
‘তারা যা অর্জন করেছে তার সাহায্যেই (সে কারণেই) আল্লাহ্ তাদের বিপরীতমুখী করে দিয়েছেন।’
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
وما يضلّ به إلّا الفاسقين
‘এ (উপমা) দ্বারা তিনি (আল্লাহ্) ফাসেকদের ছাড়া কাউকে গোমরাহ করেন না।’ (সূরা আল-বাকারাহ্ : ২৬)
অতএব এটি সন্দেহাতীত যে,আল্লাহ তায়ালা কারো ভাগ্যে গোমরাহী লিখে দেন নি বা কারো হতভাগ্য হওয়া পূর্ব থেকে নির্ধারণ করে দেন নি।-অনুবাদক
৪. এখানে আল্লাহ্ সম্বন্ধে ধারণা মানে তাঁকে দয়ালু ও ক্ষমাশীল বা কঠোর শাস্তিদাতা বলে ধারণা করা। নচেৎ মুশরিকরা আল্লাহ্ সম্বন্ধে যে সব কাল্পনিক ধারণা পোষণ করে এ হাদীসের উদ্দেশ্য তদ্রূপ ধারণা নয়।–অনুবাদক
(জ্যোতি, বর্ষ ২, সংখ্যা ১)