আল হাসানাইন (আ.)

মদিনা সনদ পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান

1 বিভিন্ন মতামত 03.0 / 5

মহানবী (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে তদানীন্তন ইয়াসরিবে (মদিনা) হিজরত করেন। তাঁর হিজরতের মাধ্যমে ইসলাম আধ্যাত্মিকতার জগতের পাশাপাশি রাজনীতির জগতে প্রবেশ করে।  প্রিয় নবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর সমকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করে আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ নেন। এই চুক্তিটিতে তিনি ইহুদিদেরও অন্তর্ভুক্ত করেন। অর্থাৎ আনসার-মুহাজির-ইহুদিসহ গোটা ইয়াসরিবের জনগণের জন্য তিনি একটি সনদ প্রণয়ন করেন। মহানবী (সা.) কর্তৃক ইয়াসরিব উপত্যকার সব মানুষের জন্য লিখিত এই সনদই ইতিহাসে 'মদিনা সনদ' নামে পরিচিত। মদিনা সনদকে ঐতিহাসিকরা বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।

ইয়াসরিববাসীর সঙ্গে স্বাক্ষরিত এই সনদের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই সনদই ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নব প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রদান করে। এই সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইয়াসরিব উপত্যকার নাম পরিবর্তিত হয়ে মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর নাম ধারণ করে। পরবর্তী সময়ে এই শহর মদিনা নামেই জগৎময় পরিচিতি লাভ করে। ইবনে ইসহাক (রা.) বলেন, 'রাসুলুল্লাহ (সা.) মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র লিখে দেন এবং এতে ইহুদিদেরও এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ চুক্তিতে তাদের ধর্ম ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়, তাদের অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় এবং তাদের ওপর কিছু শর্ত শরায়েতও আরোপ করা হয়।'

এই সনদের মাধ্যমেই মহানবী (সা.) ধর্ম, বর্ণ, জাতি, উপজাতি- নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি যে রাষ্ট্রব্যবস্থার কাণ্ডারি ছিলেন, সেই রাষ্ট্রে সব মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক। তিনি সবার সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। এই সনদে মদিনাবাসী ইহুদি, খ্রিস্টান, মাজুসি, অগ্নি উপাসক অর্থাৎ সনদে স্বাক্ষরিত সব সম্প্রদায় উম্মাভুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়।

নিম্নে মদিনা সনদের উল্লেখযোগ্য কিছু ধারা তুলে ধরা হলো।

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম

এ চুক্তিনামা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশ ও মদীনার মুসলমানগণ এবং তাদের অনুসারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সম্পাদন করেন।

ধারা : ১

উপধারা ১ : এ চুক্তিনামায় স্বাক্ষরকারিগণ এক জাতি হিসাবে পরিগণিত হবে। কুরাইশ মুহাজিরগণ তাদের ইসলামপূর্ব নিয়মানুযায়ী রক্তপণ প্রদানে বাধ্য থাকবে। যদি তাদের কোন ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে অথবা তাদের কেউ বন্দী হয় তবে এ ক্ষেত্রে তাদের পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে। অর্থাৎ সমবেতভাবে ঐ রক্তপণ আদায় করবে ও বন্দীকে মুক্ত করতে হবে।

উপধারা ২ : বনি আওফ কুরাইশ মুহাজিরদের ন্যায় এ ক্ষেত্রে তাদের পূর্ববর্তী আইন অনুসরণ করবে এবং তাদের গোত্রের বন্দীদেরকে সমবেতভাবে মুক্তিপণ দানের মাধ্যমে মুক্ত করবে। তেমনিভাবে আনসারদের মধ্যে যে সব গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে,যেমন বনি সায়েদা,বনি হারিস,বনি জুশাম,বনি নাজ্জার,বনি আমর ইবনে আওফ,বনি নাবিত ও বনি আওস,তারাও প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের গোত্রের কোন ব্যক্তির রক্তপণ সমবেতভাবে প্রদান করবে এবং তাদের বন্দীদেরকে গোত্রের সকলে সমবেতভাবে মুক্তিপণ দানের মাধ্যমে মুক্ত করবে।

উপধারা ৩ : আর্থিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিকে মুসলমানগণ সমবেতভাবে সাহায্য করবে। কোন মুসলমান যদি রক্তপণ অথবা মুক্তিপণ প্রদানের কারণে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে তবে সকলে মিলে তাকে সাহায্য করতে হবে।

উপধারা ৪ : পরহেজগার মুমিনগণ তাদের কোন ব্যক্তি অবাধ্য হলে এবং অনাচার করলে তার বিরুদ্ধে সমবেতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে,যদিও সে ব্যক্তি তাদের কারো সন্তান হয়।

উপধারা ৫ : কোন ব্যক্তি কোন মুসলমানের সন্তান অথবা দাসের সঙ্গে তার পিতা ও মনিবের অনুমতি ব্যতিরেকে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না।

উপধারা ৬ : কোন কাফিরকে হত্যা করার দায়ে কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করার অধিকার কোন মুমিনের নেই। কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সহযোগিতা করা যাবে না।

উপধারা ৭ : চুক্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর দৃষ্টিতে সকল মুসলমান সমান। এ দৃষ্টিতে উচ্চ-নিচ সকল মুসলমানই সমানভাবে কাফেরদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার রাখে।

উপধারা ৮ : মুসলমানগণ একে অপরের বন্ধু ও সহযোগী।

উপধারা ৯ : ইয়াহুদীদের মধ্য হতে যে আমাদের অনুসরণে ইসলাম গ্রহণ করে সে আমাদের সহযোগিতা পাবে। সে ক্ষেত্রে তার সঙ্গে অন্য মুসলমানের কোনই পার্থক্য নেই এবং তার প্রতি অবিচার করার অধিকার করো নেই। তার বিরুদ্ধে কাউকে ক্ষেপিয়ে তোলা ও তার শত্রুকে সাহায্য করা যাবে না।

উপধারা ১০ : সন্ধি ও শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অপর মুসলমানের অনুমতি ব্যতিরেকে এবং সাম্য ও ন্যায়ের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিদান না করে সন্ধি চুক্তি করা যাবে না।

উপধারা ১১ : মুসলমানদের বিভিন্ন দল পালাক্রমে যুদ্ধে (জিহাদে) অংশগ্রহণ করবে যাতে আল্লাহর পথে তাদের রক্ত সমভাবে উৎসর্গীকৃত হয়।

উপধারা ১২ : মুসলমানদের অনুসৃত পথ সর্বোত্তম পথ।

উপধারা ১৩ : কুরাইশ মুশরিকদের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সহযোগিতা করার কোন অধিকার মদীনার মুশরিকদের নেই এবং তাদের সঙ্গে তারা কোনরূপ চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না। তাদেরকে মুসলমানদের হাতে বন্দী হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

উপধারা ১৪ : যদি কোন মুসলমান অন্য কোন মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং তার এ অপরাধ শরীয়তগতভাবে প্রমাণিত হয়,তাহলে হত্যাকারীকে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। তবে নিহত ব্যক্তির অভিভাবকরা যদি তাকে ক্ষমা করে দেয় তবে তাকে প্রাণদণ্ড থেকে মুক্তি দেয়া হবে। এ উভয় ক্ষেত্রে মুসলমানদের দায়িত্ব হলো হত্যাকারীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ।

উপধারা ১৫ : যে ব্যক্তিই এ চুক্তিনামার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করবে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনয়ন করবে তার এ চুক্তিনামা লঙ্ঘনের ও কোন অপরাধীকে সহযোগিতা ও আশ্রয় দানের কোন অধিকার নেই। যে কেউই অপরাধীকে সহযোগিতা করলে কিংবা আশ্রয় দিলে আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত হবে এবং এ ক্ষেত্রে সকল ক্ষতির দায়-দায়িত্ব তার।

উপধারা ১৬ : যে কোন বিভেদের ফায়সালার চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল।

ধারা : ২

উপধারা ১৭ : মদীনাকে রক্ষার জন্য মুসলমানরা যুদ্ধ করলে ইয়াহুদীদেরকে অবশ্যই যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে হবে।

উপধারা ১৮ : বনি আওফের ইয়াহুদীরা মুসলমানদের সঙ্গে এক জাতি হিসাবে পরিগণিত এবং মুসলমান ও ইয়াহুদীরা তাদের ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন। তাদের দাসরা এ বিধানের অন্তর্গত অর্থাৎ তারাও এ ক্ষেত্রে স্বাধীন। তবে যে সকল অন্যায়কারী তার নিজ ও পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় তারা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এ ব্যতিক্রমের ফলে ঐক্য কেবল শান্তিপ্রিয় মুসলমান ও ইয়াহুদীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়েছে।

উপধারা ১৯ : বনি নাজ্জার,বনি হারিস,বনি সায়েদা,বনি জুশাম,বনি আওস,বনি সায়ালাবা ও বনি শাতিবার ইয়াহুদীরাও বনি আওফ গোত্রের ইয়াহুদীদের ন্যায় উপরিউক্ত বিধানের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন অধিকারের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সায়ালাবা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত জাফনা গোত্র এবং বনি শাতিবার অন্তর্ভুক্ত সকল উপগোত্রও বনি আওফের ন্যায় অধিকার ভোগ করবে।

উপধারা ২০ : এ চুক্তির অধীন সকলকেই তাদের মন্দের ওপর ভালো বৈশিষ্ট্যসমূহকে বিজয়ী করতে হবে।

উপধারা ২১ : বনি সায়ালাবার অন্তর্ভুক্ত উপগোত্রসমূহ বনি সায়ালাবার জন্য প্রযোজ্য বিধানের অন্তর্ভুক্ত।

উপধারা ২২ : ইয়াহুদীদের উপরিউক্ত গোত্রসমূহের সাথে চুক্তিবদ্ধ গোত্র ও ব্যক্তিবর্গ এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত।

উপধারা ২৩ : হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুমতি ব্যতিরেকে কেউই এ চুক্তিবদ্ধ জোট থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না।

উপধারা ২৪ : এ চুক্তির অধীন প্রত্যেক ব্যক্তির রক্ত সম্মানিত (অর্থাৎ আহত ও নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির রক্তের মর্যাদার বিধান রয়েছে)। যদি কেউ কাউকে হত্যা করে তবে তার ওপর কিসাসের বিধান কার্যকরী হবে। এর (হত্যার) মাধ্যমে সে যেন নিজ ও স্বীয় পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করল। কিন্তু হত্যাকারী যদি অত্যাচারিত হয় তবে তার বিধান ভিন্ন।

উপধারা ২৫ : যদি মুসলমান ও ইয়াহুদীরা সমবেতভাবে যুদ্ধ করে তবে তারা ভিন্ন ভিন্নভাবে যুদ্ধের খরচ বহন করবে। যদি কেউ চুক্তিবদ্ধ জোটের কোন এক অংশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তবে জোটের অন্তর্ভুক্ত সকল পক্ষ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

উপধারা ২৬ : চুক্তিবদ্ধ পক্ষসমূহ কল্যাণের ভিত্তিতে পরস্পরের সহযোগী- অকল্যাণের ভিত্তিতে নয়।

উপধারা ২৭ : চুক্তিবদ্ধ কোন পক্ষই অন্য কোন পক্ষের ওপর অবিচার করার অধিকার রাখে না। কেউ এরূপ করলে সকলকে অবশ্যই অত্যাচারিত পক্ষকে সাহায্য করতে হবে।

উপধারা ২৮ : চুক্তিবদ্ধ সকল পক্ষের জন্য মদীনা নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষিত হলো।

উপধারা ২৯ : চুক্তিবদ্ধ পক্ষের কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রতিবেশীকে আশ্রয় দান করে তবে তার জীবন অন্য সকলের জীবনের ন্যায় সম্মানার্হ এবং কোনক্রমেই তার ক্ষতি করা যাবে না।

উপধারা ৩০ : কোন নারীকেই তার নিকটাত্মীয়ের অনুমতি ব্যতিরেকে আশ্রয় দেয়া যাবে না।

উপধারা ৩১ : চুক্তিবদ্ধ পক্ষসমূহের সকল ব্যক্তি ও গোত্র মুমিন হোক বা কাফের তাদের দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত মীমাংসাকারী স্বয়ং মুহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির সঙ্গে রয়েছেন যে ব্যক্তি এ চুক্তিনামার প্রতি সর্বাধিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

উপধারা ৩২ : কুরাইশ ও তাদের সঙ্গে  তবে মুসলমানগণ তা গ্রহণে বাধ্য। তবে যদি ঐ শত্রুপক্ষ ইসলামের শত্রু ও ইসলাম প্রচারের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে তবে তা গ্রহণীয় নয়।

উপধারা ৩৫ : আওস গোত্রের গোলাম-মনিব নির্বিশেষে সকল ইয়াহুদী এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত।

ধারা : ৪

উপধারা ৩৬ : এ চুক্তিনামা অত্যাচারী ও অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে না।

উপধারা ৩৭ : মদীনায় অবস্থানকারী যে কোন ব্যক্তি নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী এবং মদীনা থেকে যারা বাইরে যাবে তারাও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী,তবে এ বিধান অত্যাচারী ও অপরাধীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

প্রকৃতপক্ষে মদিনা সনদে আইনের ভাষায় সব নাগরিককে সমান অধিকার প্রদান করা হয়েছে। মহানবী (সা.) একজন ধর্ম প্রবর্তক হয়ে নিজের অনুসারীদের বিশেষ কোনো সুবিধা প্রদান না করে সব ধর্মাবলম্বী নাগরিকের ধর্ম পালন, সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনীতি, আইন, বিচার, অর্থনীতি তথা সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রদান করেন।

(আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী কর্তৃক রচিত এবং মো:মুনীর হোসাইন খান কৃর্তৃক অনূদিত ফুরুগে আবাদিয়্যাত গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

 

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)