হযরত আলী ও ইমামত

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়টি ছিল- খেলাফত তথা রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী নিয়ে৷ একটি দল কিছু বিশিষ্ট সাহাবাদের পরামর্শে আবু বকরের খেলাফতকে মেনে নিয়েছিল৷ অপর দলটির দৃঢ় বিশ্বাস রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী তাঁর মনোনয়নের মাধ্যমেই (অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশে) নির্ধারিত হবে আর তিনি হলেন হযরত আলী (আ.)৷ পরবর্তীতে প্রথম দলটি সাধারণ (আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত) এবং দ্বিতীয় দলটি বিশেষ (তাশাইয়্যো বা শিয়া ইছনা আ'শারী) নামে পরিচিতি লাভ করে৷

বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়টি হল এই যে, শিয়া সুন্নির পার্থক্যটা শুধুমাত্র ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারীকে নিয়ে নয় বরং প্রত্যেকের দৃষ্টিতে ইমামের অর্থ, বিষয়বস্তু এবং পদমর্যাদাও ভিন্ন৷ আর এ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিই দুই মাযহাবকে একে অপর থেকে পৃথক করেছে৷
বিষয়টির স্পষ্টতার জন্য ইমাম ও ইমামতের অর্থকে বিশ্লেষণ করব যার মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গিসমূহের ভিন্নতা সুস্পষ্ট হবে৷
"ইমামতের" আভিধানিক অর্থ হল পথপ্রদর্শন বা নেতৃত্ব এবং "ইমাম" তাঁকে বলা হয় যিনি কোন সম্প্রদায়কে একটি নির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন৷ তবে ইসলামী পরিভাষায় ইমামতকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷
আহলে সুন্নতের দৃষ্টিতে ইমামত হচেছ পার্থিব হুকুমত (ঐশী পদমর্যাদা নয়) যার মাধ্যমে ইসলামী সমাজ পরিচালিত হবে৷ যেহেতু প্রতিটি জাতিরই নেতার প্রয়োজন রয়েছে ইসলামী সমাজও রাসূল (সা.)-এর পর নিজেদের জন্য অবশ্যই একজন নেতা নির্বাচন করবে৷ তবে তাদের দৃষ্টিতে যেহেতু ইসলামে নেতা নির্বাচনের কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই কাজেই বিভিন্ন পন্থায় রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করা যেতে পারে৷ যেমন: অধিকাংশের ভোটের মাধ্যমে অথবা সমাজের বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের মতামতের ভিত্তিতে বা কখনো পূর্ববর্তী খলিফার ওসিয়তের মাধ্যমে এমনকি কখনো আবার সামরিক অদ্ভুত্থানের মাধ্যমে৷ কিন্তু শিয়া মাযহাব ইমামতকে নবুয়্যতের ধারার ধারাবাহিকতা এবং ইমামকে আল্লাহর হুজ্জাত ও মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম মনে করেন৷ তাদের বিশ্বাস হল এই যে, "ইমাম" শুধুমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত হবেন এবং ওহীর বার্তা বাহক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে পরিচয় লাভ করবেন৷ ইমামতের সুউচচ মর্যাদার কারণেই শিয়া মাযহাব ইমামকে মুসলমানদের পরিচালক এবং ঐশী হুকুম-আহকাম বর্ণনাকারী, কোরআনের বিশ্লেষণকারী এবং সৌভাগ্য অর্জিত পথের দিক নির্দেশক মনে করেন৷ অন্য কথায় শিয়া মাযহাবের সাংস্কৃতিতে ইমাম হলেন মানুষের দ্বীন ও দুনিয়া সংক্রান্ত সকল সমস্যার সমাধানকারী৷ অর্থাৎ সুন্নি মাযহাবের সম্পূর্ণ বিপরীত কেননা তারা বিশ্বাস করে যে, খলিফার দায়িত্ব হল সে শুধুমাত্র শাসন করবে এবং মানুষের পার্থিব সমস্যার সমাধান করবে৷
ইমামের প্রয়োজনীয়তা
দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ স্পষ্ট হওয়ার পর এই প্রশ্নটির জবাব দেওয়া সমিচীন মনে করছি যে কোরআন এবং রাসূল (সা.)-এর সুন্নত থাকা সত্ত্বেও (যেমনটি শিয়া মাযহাব বিশ্বাস করে) ইমাম বা নেতার কি প্রয়োজন?
ইমামের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার জন্য অসংখ্য দলিল প্রমাণ রয়েছে তবে আমরা এখানে একটি অতি সাধারণ দলিল বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হব৷ নবীর প্রয়োজনীয়তার জন্য যে সকল দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে তা ইমামের প্রয়োজনীয়তার দলিলও বটে৷ এক দিকে যেহেতু ইসলাম সর্ব শেষ দ্বীন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সর্ব শেষ নবী সেহেতু ইসলামকে অবশ্যই কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের সকল সমস্যার সমাধান দিতে হবে, অপর দিকে আল কোরআনে (ইসলামের) মৌলিক বিষয়, আহকাম সম্পর্কিত নির্দেশাবলী এবং ঐশী তথ্যাবলী বর্ণিত হয়েছে এবং তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের দায়িত্ব রাসূল (সা.)-এর উপর অর্পিত হয়েছে৷ এটা স্পষ্ট যে রাসূল (সা.) মুসলমানদের নেতা হিসাবে সমাজের প্রয়োজনীয়তা এবং ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী আল্লাহর আয়াতকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন৷ অতএব তাঁর এমন যোগ্য উত্তরাধিকরীর প্রয়োজন যিনি তাঁর মত আল্লাহর অসীম জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত থাকবেন, তাহলেই তিনি রাসূল (সা.) যে সকল বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে যান নি তার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন এবং ইসলামী সমাজের সকল যুগের সকল সমস্যার সমাধান করতে পারবেন৷ এমন ইমামই রাসূল (সা.)-এর রেখে যাওয়া দ্বীন ইসলামের রক্ষী এবং কোরআনের প্রকৃত মোফাস্সের৷ আর তাঁরাই পারেন ইসলামকে সকল প্রকার শত্রুর হাত থকে রক্ষা করে কিয়ামত পর্যন্ত পাক ও পবিত্র রাখতে৷
তাছাড়া ইমাম একজন পূর্ণমহামানব হিসাবে মানুষের জন্য একটি পরিপূর্ণ আদর্শ এবং মানুষ এমন একটি আদর্শের প্রতি বিশেষভাবে নির্ভরশীল৷ এভাবে তাঁর সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনায় উপযুক্ত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে৷ এই ঐশী পথপ্রদর্শকের ছত্র ছায়ায় থেকে চারিত্রিক অবক্ষয় এবং বাহ্যিক শয়তান থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে৷
উপরুক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মানুষের জন্য ইমামের প্রয়োজনীয়তা অতি জরুরী৷ তাই নিম্নে ইমামের কিছু বৈশিষ্ট বর্ণিত হল:
* নেতৃত্ব এবং সমাজ পরিচালনা (সরকার গঠন)৷
* রাসূল (সা.)-এর দ্বীন ও শরীয়তের রক্ষণাবেক্ষণ এবং কোরআনের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান৷
* মানুষের আত্মশুদ্ধি এবং হেদায়াত৷
ইমামের বৈশিষ্ট্যসমূহ
রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী যিনি দ্বীনের অব্যাহত ধারার কর্ণধর, মানুষের সমস্যার সমাধানকারী, এক ব্যাতিক্রমধর্মী ব্যাক্তিত্ব এবং মহান ইমাম ও নেতা হিসাবে নিঃসন্দেহে তিনি বহুমূখী গুণাবলীর অধিকারী৷ এখানে ইমামের উল্লেখযোগ্য কিছু গুণাবলী আপনাদের সামনে তুলে ধরা হল৷
তাকওয়া, পরহেজগারি এবং এমন নিঃস্কলুষ যে তাঁর দ্বারা সামান্যতম কোন গোনাহ সংঘটিত হয় নি৷
তাঁর জ্ঞানের উৎস হচেছ রাসূল (সা.) এবং তা ঐশী জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত৷
অতএব তিনি সকলের পার্থিব, আধ্যাত্মিক, দ্বীন এবং দুনিয়ার সকল ধরনের (প্রশ্নের) সমাধানকারী৷
তিনি ফযিলত এবং শ্রেষ্টতম চারিত্রিক গুনাবলিতে সু-সজ্জিত৷
তিনি মানবজাতিকে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম৷
উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এমন ধরনের ব্যক্তি নির্বাচন করা মানুষের জ্ঞান ও ক্ষমতার ঊর্ধে৷ একমাত্র আল্লাহ্ই তাঁর অসীম জ্ঞানের মাধ্যমে রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে থাকেন৷ সুতরাং ইমামের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত ও নির্ধারিত হবেন৷ যেহেতু উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ অধিক গুরুত্ববহ তাই প্রতিটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল:
১) - ইমামের জ্ঞান
ইমাম যেহেতু মানুষের নেতার আসনে সমাসীন সেহেতু অবশ্যই তাঁকে দ্বীন সম্পর্কে সার্বিকভাবে জানতে হবে, দ্বীনের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে৷ তাঁকে কোরআনের তফসীর এবং রাসূল (সা.)-এর সুন্নতের উপর পূর্ণ দখল থাকতে হবে৷ দ্বীনি শিক্ষার বর্ণনা ও জনগণের বিভিন্ন বিষয়ে সকল প্রকার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে এবং তাদেরকে উত্তমভাবে পথপ্রদর্শন করতে হবে৷ এটা স্পষ্ট যে কেবল মাত্র এধরনের ব্যক্তিই সর্বসাধারণের বিশ্বস্ত এবং আশ্রয় স্থান হতে পারেন আর এ ধরনের পাণ্ডিত্ব একমাত্র ঐশী জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত থাকার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে৷ ঠিক একারণেই শিয়া মাযহাবের অনুসারীগণ বিশ্বাস করেন যে, ইমাম (আ.) তথা রাসূল (সা.)-এর প্রকৃত প্রতিনিধিগণের জ্ঞান আল্লাহ প্রদত্ত৷
হযরত আলী (আ.) প্রকৃত ইমামের চি‎হ্ন সম্পর্কে বলেছেন:
ইমাম হালাল হারাম, বিভিন্ন ধরনের আহকাম, আদেশ, নিষেধ এবং জনগণের সকল প্রয়োজন সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী অবহিত (মিযানুল হিকমা খণ্ড-১, হাদীস-৮৬১)৷
২) - ইমামের ইসমাত (পবিত্রতা)
ইমামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং ইমামতের মৌলিক শর্ত হচেছ "পবিত্রতা" আর তা সত্যের জ্ঞান ও বলিষ্ঠ ইচছা (দৃঢ় মনবল) থেকে সৃষ্টি হয়৷ ইমাম এ দুই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার কারণে সকল প্রকার গোনাহ এবং ত্রুটি থেকে বিরত থাকেন৷ ইমাম ইসলামী শিক্ষার পরিচয় এবং বর্ণনা ও পালন করার ক্ষেত্রে, এবং ইসলামী সমাজের উন্নতি ও ক্ষতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ত্রুটি মুক্ত ও নিস্পাপ৷ ইমামের পবিত্রতার জন্য (কোরআন এবং হাদীসের আলোকে) বুদ্ধিবৃত্তিক এবং উদ্ধৃতিগত দলিল রয়েছে৷ উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলসমূহ নিম্নরূপ:
ক) দ্বীন এবং দ্বীনি কর্মকাণ্ড (ইসলামী সাংস্কৃতি) রক্ষার্থে ইমামের নিস্পাপ হওয়া একান্ত প্রয়োজন৷ কেননা দ্বীনকে বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করা এবং জনগণকে হেদায়াত করার দায়িত্বভার ইমামের উপর ন্যাস্ত৷ এমনকি ইমামের কথা, আচরণ এবং অন্যদের কার্যকলাপকে অনুমোদন করা বা না করাও সমাজে প্রভাব বিস্তার করে৷ সুতরাং ইমামকে দ্বীন সম্পর্কে জানতে হবে এবং আমলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ত্রুটি মুক্ত এবং নিস্পাপ হতে হবে আর তাহলেই তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে সঠিক পথে হেদায়াত করতে পারবেন৷
খ) সমাজে ইমামের প্রয়োজনীয়তার অপর একটি যুক্তি হল যে, জনগণ দ্বীন সম্পর্কে জানতে এবং তা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে ত্রুটি মুক্ত নয়৷ এখন যদি মানুষের নেতাও এমনটি হন তাহলে মানুষ কিভাবে তার প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করবে? অন্য কথায় ইমাম যদি মাসুম না হন তাহলে মানুষ তার অনুসরণ এবং নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে দ্বিধায় পড়বে (তাছাড়া ইমাম যদি মাসুম না হন তাহলে আর একজন ইমামের শরণাপন্ন হতে হবে যে মানুষের সমস্যার সমাধান করতে পারবে৷ যদি সেও মাসুম না হয় তাহলে আর একজন ইমামের প্রয়োজন দেখা দিবে এভাবে একর পর এক চলতে থকবে এবং দর্শনের দৃষ্টিতে তা বাতিল বলে গন্য হয়েছে)৷
কোরআনের আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয় যে, ইমামকে অবশ্যই মাসুম তথা নিস্পাপ হতে হবে৷ সূরা বাকারার ১২৪ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে নবুয়্যত দান করার পরও অনেক পরীক্ষা নিয়ে তবেই তাঁকে ইমামতের পদমর্যাদা দান করেন৷ তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করলেন যে, হে আল্লাহ এই মর্যাদাকে আমার বংশধরের জন্যেও নির্ধারণ করুন৷ আল্লাহতা'আলা বললেন: আমার এ প্রতিশ্রুতি (ইমামতের পদমর্যাদা) জালিমদের প্রতি প্রযোজ্য হবে না৷
পবিত্র কোরআনে র্শিককে সর্বাপেক্ষা বড় জুলুম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং আল্লাহর নির্দেশ লপঘন (গোনাহে লিপ্ত হওয়া) করাও নিজের প্রতি অত্যাচারের অন্তর্ভূক্ত৷ প্রতিটি মানুষই তাদের জীবনে কোন না কোন গোনাহে লিপ্ত হয়েছে, সুতরাং সেও জালিমদের অন্তর্ভূক্ত এবং কখনোই সে ইমামতের পদমর্যাদা লাভের উপযুক্ত নয়৷
অন্যকথায় নিঃসন্দেহে হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর ওই ধরনের বংশধরের জন্য দোয়া করেন নি যারা সারা জীবন গোনাহে লিপ্ত ছিল এবং যারা প্রথমে ঈমানদার ছিল পরে গোনাহগার হয়েছিল৷ সুতরাং দুই শ্রেণীর লোকরা অবশিষ্ট থাকে যথা:
১. যারা প্রথমে গোনাহগার ছিল কিন্তু পরবর্তীতে তওবা করে সৎকর্মশীল হয়েছে৷
২. যারা কখনোই গোনাহে লিপ্ত হয় নি৷
আল্লাহ রাববুল আ'লামিন কোরআনপাকে প্রথম শ্রেণীর লোকদেরকে বাদ দিয়েছেন এবং ইমামতের পদমর্যাদাকে শুধুমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর মহামানবদের জন্য নির্ধারণ করেছেন৷
গ) - ইমামের সামাজিক দ্বায়িত্ব ও কর্মতৎপরতা
মানুষ সামাজিক জীব৷ সমাজ মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং আচরণে বহুমুখী প্রভাব বিস্তার করে থাকে৷ তাই সঠিক প্রশিক্ষণ এবং সমাজকে আল্লাহর সান্ন্যিধ্যের পথে পরিচালনা করার জন্য উপযুক্ত সামাজিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করা একান্ত প্রয়োজন৷ আর তা কেবল ঐশী (ইসলামী) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব৷ সুতরাং ইমাম তথা জনগণের নেতাকে অবশ্যই সমাজ পরিচালনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে এবং কোরআনের শিক্ষা ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নতের আলোকে এবং উপযুক্ত ও কার্যকরি উপকরণের সাহায্যে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করতে হবে৷
ঘ) - মহান চারিত্রিক গুণাবলিতে গুনান্বিত হওয়া
ইমাম যেহেতু সমাজের নেতা সে জন্য তাঁকে অবশ্যই সকল প্রকার ত্রুটিমুক্ত এবং চারিত্রিক কলঙ্ক মুক্ত হতে হবে৷ পক্ষান্তরে তাঁকে সকল প্রকার চারিত্রিক গুণাবলীর সর্বোচচস্থানে অবস্থান করতে হবে৷ কেননা তিনি পরিপূর্ণ মানুষ (আদর্শ মহাপুরুষ) হিসাবে অনুসারীদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকেন৷
ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন, "ইমামের বৈশিষ্ট্য রয়েছে; তিনি সর্বাধীক জ্ঞানী, পরহেজগার, মহানুভব, সাহসী, দানশীল এবং ইবাদতকারী" (মায়ানী আল আখবার খণ্ড- ৪, পৃষ্টা ১০২৷)৷
তাছাড়া তিনি রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী এবং তার দায়িত্ব হল মানুষের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দান করা৷ সুতরাং তার নিজেকে অবশ্যই সবার আগে সু-চরিত্রের অধিকারী হতে হবে৷
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন:
যে (আল্লাহর নির্দেশে) মানুষের ইমাম হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছে তাঁর প্রথম দায়িত্ব হল সবার পূর্বে নিজেকে গঠন করা এবং অবশ্যই কথার পূর্বে কর্মের মাধ্যমে মানুষকে প্রশিক্ষণ দান করা (মিযানুল হিকমাহ বাব ১৪৭, হাদীস ৮৫০)৷
ঙ) - ইমাম আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত হন
শিয়া মাযহাবের দৃষ্টিতে ইমাম তথা রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী কেবলমাত্র আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর অনুমোদনেই নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং অতঃপর রাসূল (সা.) তাঁকে পরিচয় করান৷ সুতরাং এক্ষেত্রে (ইমাম নির্বাচনে) কোন দল বা গোত্রের বিন্দুমাত্র ভুমিকা নেই৷
ইমাম যে আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন তার অনেক যুক্তি রয়েছে যেমন:
১. কোরআনের ভাষায় একমাত্র আল্লাহই সকল কিছুর উপর ক্ষমতা রাখেন এবং সকলকে অবশ্যই তাঁর আনুগত্য করতে হবে৷ এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহ যাকে ইচছা এই ক্ষমতা (যোগ্যতা এবং প্রয়োজনানুসারে) দান করতে পারেন৷ সুতরাং যেমনভাবে রাসূলগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়ে থাকেন, ইমামও আল্লাহর নির্দেশে জনগণের উপর নেতৃত্ব পেয়ে থাকেন৷
২. ইতিপূর্বে আমরা ইমামের জন্য ইসমাত (পবিত্রতা) এবং ইলম (জ্ঞান) বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিয়েছি৷ এটা স্পষ্ট যে, এই সকল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিকে পাওয়া এবং চেনা একমাত্র আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব৷ কেননা তিনি সকল কিছুর উপর সম্যক জ্ঞাত৷ কোরআনপাকে আল্লাহ তা'আলা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে বলেন:
"আমি তোমাকে মানবজাতির জন্য ইমাম (নেতা) নির্বাচন করলাম" (সূরা বাকারা আয়াত নং ১২৪)৷
একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুন্দর বাণী
এ আলোচনার শেষে ইমামের মর্যাদা এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর বাণীর অংশ বিশেষ বর্ণনা করা উপযুক্ত মনে করছি যা নিম্নে তুলে ধরা হল :
"যারা ইমামত সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে এবং মনে করে যে ইমামত হচেছ নির্বাচনের বিষয়, তারা অজ্ঞ৷ জনগণের পক্ষে সম্ভবই নয় যে তারা ইমামের মর্যাদাকে উপলব্ধি করবে৷ অতএব কিরূপে সম্ভব যে তাদের ভোটে ইমাম নির্বাচিত হবেন?"
"নিঃসন্দেহে ইমামতের মর্যাদা, আসন এবং গভীরতা মানুষের বুদ্ধি ও নির্বাচন ক্ষমতার অনেক উর্দ্ধে৷"
নিঃসন্দেহে ইমামত, এমন একটি পদমর্যাদা যাকে আল্লাহ তা'আলা নবুয়্যাত ও খুল্লাত অর্থাৎ খলিলুল্লাহর পর তৃতীয় মর্যাদা হিসাবে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে দান করেছেন৷ ইমামত হচেছ আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর খলিফা এবং আলী (আ.)-এর পদমর্যাদা ও হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ৷ সত্যি বলতে ইমামত হচেছ দ্বীনের কাণ্ডারি, ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান, দুনিয়ার মঙ্গল এবং মু'মিনদের সম্মানের স্থান৷ অনুরূপভাবে ইমাম থাকার কারণেই ইসলামী রূপরেখা রক্ষিত এবং তাকে মেনে নেয়াতেই নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ কবুল হয়ে থাকে৷
ইমাম আল্লাহ বর্ণিত হারাম ও হালালকে ব্যাখ্যা করেন৷ আল্লাহর আদেশ নিষেধকে মেনে চলেন এবং আল্লাহর দ্বীনকে সমর্থন করেন৷ তিনি পরিপূর্ণ জ্ঞানের মাধ্যমে এবং সুন্দর যুক্তির মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত করেন৷
(সূত্র: রেডিও তেহরান)