মুয়াবিয়ার খেলাফত ও রাজতন্ত্রের উত্থান

আমিরুল মু’মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদতের পর তার ‘ওসিয়ত’ (উইল) এবং জনগণের ‘বাইয়াতের’ (আনুগত্য জ্ঞাপন) মাধ্যমে হযরত ইমাম হাসান (আ.) পরবর্তী খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন। বারজন ইমামের অনুসারী শীয়াদের মতে হযরত ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন দ্বিতীয় ইমাম।

ওদিকে মুয়াবিয়াও এ ব্যাপারে চুপ করে বসে থাকেননি। মুয়াবিয়া, হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর বিরুদ্ধে তদানিন্তন খেলাফতের রাজধানী ইরাকের দিকে সেনা অভিযান পরিচালনা করলেন। বিভিন্ন ধরণের ষড়যন্ত্র ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সমর্থকে ও সেনাপতিদের বিপুল পরিমাণ ঘষু প্রদানের মাধ্যমে মুয়াবিয়া তাদেরকে দূর্নীতির সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন। এর ফলে হযরত ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি চুক্তিতে বাধ্য হন। চুক্তি অনুসারে খেলাফতের ক্ষমতা মুয়াবিয়ার কাছে এই শর্তে হস্তান্তর করা হয় যে, মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর খেলাফত পুনরায় ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে হস্তান্তর করা হবে। আর তারা ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর অনুসারীদেরকে উৎপীড়ন করবেন না। এভাবেই খেলাফতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা মুয়াবিয়ার কাছে হস্তান্তরিত হয়।

হিজরী ৪০ সনে মুয়াবিয়া খেলাফতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা লাভ করার পর পরই ইরাকে এসে জনগণের উদ্দেশ্যেএকটি বক্তৃতা দেয়। ঐ বক্তৃতায় তিনি জনগণের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেনঃ আমি নামায রোযার জন্যে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি। বরং আমি তোমাদের শাসন ক্ষমতা দখল করার জন্যে যুদ্ধ করেছি এবং শেষপর্যন্ত আমি তা লাভও করেছি !!2 মুয়াবিয়া আরো ব্যক্ত করে : হাসানের সাথে যে মর্মে আমি চুক্তি সাক্ষর করেছিলাম, তা আমি বাতিল বলে ঘোষণা করছি এবং ঐ চুক্তি আমি পদদলিত করলাম!!3

মুয়াবিয়া তার সেই বক্তব্যের মাধ্যমে ধর্ম থেকে রাজনীত্রিক পৃথক করার আভাস দেয়। উক্ত বক্তব্যে আরো ইঙ্গিত দেয় যে, ধর্মীয় নীতিমালার ক্ষেত্রে কোন প্রকার প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে না এবং রাষ্টীয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন। আর এটা খুবই স্পষ্ট যে, এ জাতীয় রাজনৈতিক পদ্ধতি আদৌ কোন ইসলামী খেলাফত বা রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী প্রশাসন ছিল না। বরং ওটা (মুয়াবিয়া প্রশাসন) ছিল সম্পূর্ণ রাজতান্ত্রিক প্রশাসন। এ জন্যে যখন কেউ তার (মুয়াবিয়া) সাক্ষাতে আসতো তখন ঐ ব্যক্তিকে (মুয়াবিয়াকে) বাদশাহী পদ্ধতিতে সালাম দিতে হত। এমন কি স্বয়ং মুয়াবিয়াও বিশেষ বৈঠকগুলোতে নিজেকে রাজা বা বাদশাহ্ হিসেবে পরিচিত করতেন। অবশ্য জনসমক্ষে তিনি নিজেকে ইসলামী খলিফা উপাধিতে ভূষিত করতেন। অবশ্য যেসব প্রশাসন ব্যবস্থার ভিত্তি কেবল স্বেচ্ছাচারীতার উপর প্রতিষ্ঠিত সেসকল প্রশাসন ব্যবস্থা সাধারণত রাজতন্ত্রের জনক। আর শেষপর্যন্ত মুয়াবিয়াও তার হৃদয়ে লালিত আকাংখা বাস্তবায়িত করেন।

মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার যুবক পুত্র ইয়াযিদকে রাষ্টীয় ক্ষমতার উত্তরাধিকার অর্পণ করেন। চারিত্রিক দিক থেকে ইয়াযিদ ছিল লম্পট ও অনৈসলামী ব্যক্তিত্বের আধিকারী। এই ইয়াযিদই ইতিহাসে অনেক লজ্জাষ্কর ঘটনার সূত্রপাত করে। মুয়াবিয়া তার পূর্ববতী বক্তব্যে ইঙ্গিত করেন যে, কোনক্রমেই তিনি খেলাফতের ক্ষমতা ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে হস্তান্তরিত হতে দিবেন না। কারণ, তার পরবর্তী খেলাফতের ব্যাপারে ভিন্ন চিন্তা পোষণ করতেন। যে চিন্তার ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করেন। এভাবেই তিনি স্বীয় পুত্র ইয়াযিদের রাষ্টীয় ক্ষমতা লাভের পথকে কন্টকমুক্ত করেন। ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের ঘোষণার মাধ্যমে মুয়াবিয়া সবাইকে এটাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে পবিত্র আহলে বাইতের (নবীবংশ) অনুসারী শীয়াদেরকে তিনি কখনও শান্ত্রি ও নিরাপদে বাস করতে দেবেন না যে তারা (শীয়া) তাদের নিজস্ব ধর্মীয় কর্মকান্ড পূর্বের মতই চালিয়ে যাবে। আর এ বিষয়টি তিনি কঠোরভাবে বাস্তবায়িত করেন। তিনি প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা দেন : ‘যে ব্যক্তি পবিত্র আহলে বাইতের ফযিলত বা গুরুত্ব ও মহত্ত্ব সম্পর্কে কোন হাদীস বর্ণনা করবে, তার জান-মাল বা সম্মানের নিরাপত্তা বলতে কিছুই থাকবে না’। এর পাশাপাশি আরো ঘোষণা দেন, ‘যে ব্যক্তি কোন সাহাবী বা খলিফার মহত্ব ও পদ মর্যাদার ব্যাপারে কোন হাদীস বর্ণনা করবে, তাকে বিপলু ভাবে পুরস্কৃত করা হবে’। এ ঘোষণার পরিণতিতে উক্ত বিষয়ের উপর অসংখ্য বানোয়াট ও জাল হাদীস সৃষ্টি হয়।১০ মুয়াবিয়া আরো ঘোষণা দেয় যে, রাষ্ট্রের সকল মসজিদের মিম্বারগুলোতে বক্তারা যেন নিয়মিত ভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে গালি দেয় ও কুৎসা রটনা করে। (এই ঘোষণার বাস্তবায়ন খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের {হিঃ -৯৯-হিঃ-১০১} পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল)। মুয়াবিয়ার সহকারীদের মধ্যে রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সাহাবীও ছিলেন। মুয়াবিয়া তার ঐসব সাহাবী ও সহকারীদের সহযোগিতায় হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারী অসংখ্য শীয়াকে হত্যা করে। এমন কি এসব নিহতদের অনেকের কর্তিত মস্তক বিভিন্ন শহরে গণপ্রদর্শনের জন্যে প্রদক্ষিন করানো হত। সর্বত্র শীয়াদেরকে হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা বা অকথ্য ভাষা ব্যাবহার করতে বাধ্য করা হত। আর যে কেউ এ আদেশ লংঘন করত, তাকেই হত্যা করা হত।১১

শীয়াদের দূর্যোগপূর্ণ ও কঠিনতম দিনগুলো

মুয়াবিয়ার দীর্ঘ বিশ বছরের শাসনকালই শীয়াদের ইতিহাসের দূর্যোগপূর্ণ ও কঠিনতম দিন ছিল। ঐ সময় নিরাপত্তা বলতে শীয়াদের কিছুই ছিল না। শীয়াদের অধিকাংশই ছিল সর্বজন পরিচিত ও জনসমক্ষে চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব। শীয়াদের দু’জন ইমাম [ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)] স্বয়ং মুয়াবিয়ার শাসনামলে জীবন যাপন করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্রে এহেন অরাজক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সামান্যতম সুযোগও তাদের ছিল না। এমন কি তৃতীয় ইমাম [হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)], যিনি ইয়াযিদের শাসন আমলের প্রথম ৬ মাসের মধ্যে তার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন, যার পরিণতিতে তিনি স্বপরিবারে শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার শাসনের প্রথম দশ বছর জীবন- যাপনকালীন সময়ে এ (বিদ্রোহ) সুযোগটিও পাননি। রাসূল (সা.)-এর বিভিন্ন সাহাবী, বিশেষ করে মুয়াবিয়া ও তার সহকর্মীরা ইসলামী রাষ্ট্রে অন্যায়ভাবে হত্যা ও নির্যাতনসহ যে অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়ে ছিলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অধিকাংশই ঐসব অপকর্মের যুক্তিযুক্ত ব্যাখা দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। এ ব্যাপারে তাদের প্রধান যুক্তি হল, তারা ছিলেন রাসূল (সা.)-এর সাহাবী। আর সাহাবীদের সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর যেসব হাদীস আমাদের কাছে পৌছেছে, সে অনুযায়ী সাহাবীরা মুজতাহিদ (ইসলামী গবেষক) তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমার যোগ্য। মহান আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট তাই তারা যে কোন ধরণের অন্যায়-অপরাধই করুক না কেন, সে ব্যাপারে তারা ক্ষমা প্রাপ্ত! কিন্তু শীয়াদের দৃষ্টিতে এ যুক্তি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ :

প্রথমত : মহানবী (সা.) সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলন করেছেন। এক দল লোককে নিজ বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং নিজের সমগ্র অস্তিত্বকে ঐ পবিত্র লক্ষ্য বাস্তবায়নের স্বার্থে বিলীন করে দিয়েছেন। এ জাতীয় যুক্তি আদৌ বুদ্ধিমত্তা প্রসূত ব্যাপার নয় যে, এত কষ্টের বিনিময়ে স্বীয় পবিত্র লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার পর মহানবী (সা.) জনগণ ও ইসলামের পবিত্র নীতিমালার ব্যাপারে তার সঙ্গী বা সাহাবীদেরকে যা ইচ্ছে করার মত পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে যাবেন? স্বীয় সহকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত সত্যের অপলাপ, ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড ও অরাজতাকে তিনি ক্ষমা করবেন! এ জাতীয় কথার অর্থ হচ্ছে যাদের সহযোগীতায় তিনি সত্যের ভিত্তিরপস্তর স্থাপন করেছেন, তাদের দ্বারাই আবার তা ধ্বংস করবেন। এটা মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাপার নয়।

দ্বিতীয়ত : যেসব হাদীসে সাহাবীদের নিষ্কলুষতা ও অপরাধ মুলক শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপকে পরিশুদ্ধতার আবরণ দেওয়া হয়েছে এবং তাদের জন্যে অগ্রিমভাবে ক্ষমার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে পক্ষে ওগুলো সাহাবীদের দ্বারাই বর্ণিত হয়ে আমাদের কাছে পৌছেছে এবং রাসূল (সা.)-এর সাথে তা সম্পর্কিত করা হয়েছে। অথচ ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী স্বয়ং সাহাবীরাই একে অন্যের অন্যায়কে কখনও ক্ষমা করেননি। সাহাবীদের অনেকেই একে অন্যকে হত্যা করেছেন, পরস্পরকে গালিগালাজ ও অভিশাপ দিয়েছেন এবং একে অন্যকে অপদস্থ করতেও ছাড়েননি। প্রতিপক্ষের সামান্যতম ভুলকেও তারা এতটকু ক্ষমার চোখেও দেখেননি। সুতরাং সাহাবীদের কার্যকলাপের সাক্ষ্য অনুযায়ী-ও ঐসব হাদীসের অসত্যতা প্রমাণীত হয়। যদি ঐসব হাদীসকে সত্য বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে তার অর্থ অন্যকিছু হবে। আর তা অবশ্যই সাহাবীদের কলংকহীনতা বা আইনগত বৈধতা সংক্রান্ত নয়। যদি ধরে নেয়া যায় যে, মহান আল্লাহর পবিত্র কুরআনে সাহাবীদের কোন কাজের ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন,1২ তাহলে সেটা তাদের পূর্ববর্তী কার্যকলাপের প্রশংসারই প্রমাণ। এর অর্থ এই নয় যে, ভবিষ্যতে যা ইচ্ছে তাই করা বা আল্লাহর আদেশ বিরোধী কার্যকলাপও তারা করতে পারবেন।

উমাইয়া বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা

হিজরী ৬০ সনে মুয়াবিয়া মৃত্যু বরণ করে। মৃত্যুর পূর্বে সে জনগণের কাছ থেকে আপন পুত্র ইয়াযিদের খেলাফতের ব্যাপারে বাইয়াত গ্রহণ করিয়ে নেয়। সে অনুযায়ী পিতার মৃত্যুর পর ইয়াযিদ ইসলামী রাষ্ট্রের খেলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী ইয়াযিদ মোটেও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিল না। এমন কি পিতার জীবদ্দশাতেও এই যুবক ইসলামী নীতিমালার প্রতি এতটুকু তোয়াক্কাও করত না। বিলাসিতা, উচ্ছৃংখলতা ও লাম্পট্য চারিতার্থ করা ছাড়া আর কোন কাজ তার ছিল না। তার তিন বছরের শাসন আমলে এত অধিক পরিমাণে জঘণ্য অপরাধ সে ঘটিয়েছিল যা ইসলামের ইতিহাসে বিরল। প্রাথমিক যুগে ইসলামকে অসংখ্য জঘণ্য সামাজিক দুর্নীতিকে অতিক্রম করতে হয়েছিল। কিন্তু সেযুগে ইয়াযিদের দ্বারা সাধিত অপকর্মের কোন উদাহরণ ইতিহাসে খু্জে পাওয়া যায় না। ইয়াযিদ তার শাসন আমলের প্রথম বছরই রাসূল (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে সংগী-সাথী সহ স্বপরিবারে অত্যন্ত নৃশংস ভাবে হত্যা করে। অতঃপর ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের মহিলা, শিশু ও আহলে বাইতগণকে (নবীবংশ) শহীদদের কর্তিত মস্তক সহ গণ প্রদর্শনীর জন্যে বিভিন্ন শহরে প্রদক্ষিণ করানো হয়।1৩ ইয়াযিদ তার খেলাফতের দ্বিতীয় বছর পবিত্র মদীনা নগরীতে গণহত্যা চালায় এবং তিন দিন পর্যন্ত সে তার সেনাবাহিনীকে ব্যাপক লুটতরাজ ও গণধর্ষনের অনুমতি দিয়েছিল।1৪ খেলাফতের তৃতীয় বছর ইয়াযিদ পবিত্র কাবাঘর ধ্বংস করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়!1৫ ইয়াযিদের মৃত্যুর পর উমাইয়া বংশীয় মারওয়ান পরিবারের লোকেরা ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা অধিকার করে। ইতিহাস অনুযায়ী উমাইয়া বংশীয় এগারো জন ব্যক্তি প্রায় সত্তর বছর যাবৎ খেলাফতের শাসন কার্য পরিচালনা করে। ইতিহাসের এ অধ্যায়ই ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে সবচেয়ে দূর্যোগপূর্ণ ও তিক্ত। যেসময় ইসলামী সমাজের শাসন ক্ষমতায় একজন খলিফা নামধারী অত্যাচারী আরবীয় সম্রাট ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। অবস্থা এক সময় এমন পর্যায়ে গিয়ে দাড়ালো যে, রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী ও দ্বীনের ধারক-বাহক হিসেবে খ্যাত খলিফা ‘অলিদ বিন ইয়াযিদ’ নির্ভয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পবিত্র কাবা ঘরের ছাদে একটি ঘর তৈরী করবেন!! হজ্জের সময় তিনি সেখানে বিলাস যাপন করবেন!!1৬ খলিফা ‘অলিদ বিন ইয়াযিদ’ পবিত্র কুরআনকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে। তীর নিক্ষেপের সময় কুরআনকে লক্ষ্য করে কবিতার সুরে বিদ্রূপ করে বলে ‘কেয়ামতের দিন যখন তোর খোদার কাছে উপস্থিত হবি, বলিস খলিফা আমাকে ছিন্ন- ভিন্ন করেছে!!’’1৭ শীয়ারা খেলাফতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ধর্মীয় নেতৃত্ব এ দু’টো বিষয়ে অধিকাংশ আহলে-সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সাথে মৌলিকভাবে ভিন্ন মত পোষণ করত। তারা ইতিহাসের এ অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়ে চরম কষ্ট ও তিক্ততাপূর্ণ দিন যাপন করেছেন। খেলাফত প্রসাশনের অবিচার, অত্যাচার ও অরাজকতা এবং নির্যাতিত আহলে বাইতের ইমামগণের তাকওয়া ও পবিত্রতা দিনের পর দিন তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে অধিকতর সুদৃঢ় করে তোলে। বিশেষ করে তৃতীয় ইমাম হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের হৃদয় বিদারক ঘটনা রাজধানীর বাইরে বিশেষ করে ইরাক, ইয়ামান ও ইরানে শীয়া মতাদর্শের সম্প্রসারণে যথেষ্ট সহযোগিতা করে। উপরোক্ত বক্তব্যর প্রমাণ শীয়াদের পঞ্চম ইমামের (হযরত ইমাম বাকের (আ.) যুগের ঘটনায় দেখতে পাওয়া যায়। হিজরী বর্ষের এক শতাব্দী তখনও পূর্ণ হয়নি। তৃতীয় ইমাম হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের পর ৪০ বছরও তখন পূর্ণ হয়নি। ইতিমধ্যেই উমাইয়া খলিফার প্রশাসনে বিশৃংখলার সূত্রপাত ঘটে এবং এর ফলে প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে খেলাফত বা রাজ্যের চতুর্দিক থেকে শীয়ারা বন্যার বেগে পঞ্চম ইমাম হযরত ইমাম বাকের (আ.)-এর দিকে ধাবিত হয়। তার চর্তুপার্শ্বে ভক্তদের ভীড় জমতে থাকে। তারা ইমাম বাকের (আ.)-এর কাছে হাদীস ও ইসলামের জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করে।1৮ ইতিমধ্যে হিজরী প্রথম শতাব্দী শেষ হবার পূর্বেই প্রশাসনের ক’জন শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি ইরানের কোম শহরের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তাকে শীয়া প্রধান শহরে রূপান্তরিত করেন।1৯তথাপি শীয়াদেরকে সে যুগে তাদের ইমামগণের (আ.) নির্দেশে ‘তাকিয়া’ পালন করে অর্থাৎ নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস গোপন করে থাকতে হয়েছিল। এরপরও রাসূল (সা.)-এর বংশের সাইয়্যেদগণ ইতিহাসে বহু বার ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠির অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়ে ছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই তাদেরকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। অবশেষে নিজেদের প্রাণও তারা এ পথে উৎসর্গ করেছেন। তদানিন্তন স্পর্ধাপূর্ণ শাসকগোষ্ঠি তাদের পবিত্র দেহ পদদলিত করতেও কন্ঠা বোধ করেনি। যায়েদীপন্থী শীয়াদের নেতা জনাব যায়েদের মৃত্যু দেহকে কবর খুড়ে বের করে ফাসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। অতঃপর ঐ মৃত্যু দেহকে দীর্ঘ তিন বছর যাবৎ ঐ অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর ঐ মৃত্যু দেহ ফাসিঁ কাষ্ঠ থেকে নামিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং তার ভষ্মীভূত ছাই বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হয়!২০ শীয়াদের বিশ্বাস অনুসারে তাদের চতুর্থ (হযরত ইমাম জয়নলু আবেদীন (আ.) ও পঞ্চম (হযরত ইমাম বাকের (আ.) ইমামকেও উমাইয়া খলিফারা বিষ প্রয়োগে হত্যা করে।২১ দ্বিতীয় ইমাম হাসান (আ.) ও তৃতীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-ও তাদের হাতেই শাহাদত বরণ করে ছিলেন। উমাইয়া খলিফাদের প্রকাশ্যে নীতিহীন কার্যকলাপ এতই জঘণ্য পর্যায়ে গিয়ে পৌছে ছিল যে আহলে-সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীরা যারা সাধারণত খলিফাদের আনুগত্যকে ফরয বলে বিশ্বাস করে, তারাও খলিফাদেরকে দু’টো শ্রেণীতে ভাগ করতে বাধ্য হয়। ঐ দু’শ্রেণী হল ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’ এবং ‘খুলাফায়ে রাশেদীনদের পরবর্তী যুগ’। রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু পরবর্তী ইসলামের প্রথম চার খলিফা [আবু বকর, ওমর, ওসমান ও হযরত আলী (আ.) ] প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। আর মুয়াবিয়া থেকে শুরু করে বাকী সব খলিফাই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত । শাসন ক্ষমতায় থাকা কালীন উমাইয়া খলিফা তাদের নিপীড়ন মুলক নীতির কারণে জনগণের চরম ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন সর্বশেষ উমাইয়া খলিফা ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন। নিহত হবার পর তার দু’পুত্র সহ খলিফা পরিবারের বেশ কিছু সদস্য রাজ প্রাসাদ থেকে পলায়ন করে। কিন্তু পালানোর পর যেখানেই তারা আশ্রয় প্রার্থনা করেছে ব্যর্থ হয়েছে। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে নওবা, ইথিওপিয়া এবং বেজাওয়ার ও মরুভূমিতে লক্ষ্যহীনভাবে তাদের ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। এর ফলে তাদের অধিকাংশই ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় প্রাণ হারায়। অবশিষ্টরা ইয়ামানের দক্ষিণ অঞ্চলে এসে পৌছে। সেখানে ভিক্ষার মাধ্যমে পথ খরচ যোগাড় করে এবং কুলিদের ছদ্মবেশে মক্কার দিকে রওনা হয়। কিন্তু সেখানে মানুষের মাঝে তারা নিখোজ হয়ে যায়।2২

তথ্যসূত্র :

১. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৯১ নং পৃষ্ঠা। এবং অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।

২. শারহু ইবনে আবিল হাদীদ, ৪র্থ খণ্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠা। তারিখে তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, ১২৪ নং পৃষ্ঠা। তারিখে ইবনে আসির, ৩য় খণ্ড, ২০৩ নং পৃষ্ঠা।  

৩. পূ্র্বোক্ত সূত্র দ্রষ্টব্য।

৪. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৯৩ নং পৃষ্ঠা।

৫. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ২০২ নং পৃষ্ঠা।

৬. ইয়াযিদ ছিল এক অলস ও চরম বিলাসী ব্যক্তি। সে ছিল লম্পট ও মদ্যপ। রেশমী বস্তুই ছিল তার পোশাক। কুকুর ও বানর ছিল তার নিত্য সংগী ও খেলার সাথী। তার নিত্য আসরগুলো ছিল মদ ও নাচ-গানে আনন্দ মুখর। তার বানরের নাম ছিল আবু কায়েস। ঐ বানরটিকে ইয়াযিদ সবসময় অত্যন্ত সুন্দর মূল্যবান পোশাক পরিয়ে মদপানের আসরে নিয়ে আসত ! কখনো বা বানরটিকে নিজের ঘাড়ায় চড়িয়ে ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় পাঠাতো। (তারীখু ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৯৬ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড ৭৭ নং পৃষ্ঠা।)

৭. মরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, ৫ নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড ১৮৩ নং পৃষ্ঠা।

৮. আন নাসাঈহ আল কাফিয়াহ, ৭২ নং পৃষ্ঠা। আল ইহদাস নামক গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত।

৯. হাদীস জনাব আবুল হাসান আল-মাদায়েনী কিতাবুল ইহদাস গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, হাসান (আ.)-এর সাথে চুক্তির পরের বছর মুয়াবিয়া তার জনৈক কর্মচারীর কাছে লিখিত এক নির্দেশে জানায় : ‘‘যে ব্যক্তি ইমাম আলী (আ.) বা আহলে বাইতের মর্যাদা সম্পর্কে কোন হাদীস বর্ণনা করবে, তাকে হত্যা করার জন্যে আমি দায়ী নই।’’ {কিতাবুল নাসাঈহুল কাফিয়াহ (মুহাম্মদ বিন আকিল), (১৩৮৬ হিজরী সনে নাজাফে মুদ্রিত) ৮৭ ও ১৯৪ নং পৃষ্ঠা।}

১০. আন নাসাঈহুল কাফিয়াহ, ৭২ -৭৩ নং পৃষ্ঠা।

১১. আন নাসাঈহুল কাফিয়াহ, ৫৮, ৬৪, ৭৭ ও ৭৮ নং পৃষ্ঠা।

১২. আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনসারদের মাঝে পুরাতন এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। (-সূরা আত্ তওবা, ১০০ নং আয়াত দ্রষ্টব্য।) ১৩. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ২১৬ নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৯০ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, ৬৪ নং পৃষ্ঠা। আরও অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থ দ্রষ্টব্য ।

১৪. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ২৪৩ নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৯২ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, ৭৮ নং পৃষ্ঠা।

১৫. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ২২৪নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৯২ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, ৮১ নং পৃষ্ঠা।

১৬. তারিখে ইয়াকুবী, ৩য় খণ্ড, ৭৩ নং পৃষ্ঠা।

১৭. মরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, ২২৮ নং পৃষ্ঠা।

১৮. এ বইয়ের ইমাম পরিচিতি অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

১৯. ‘মু’জামুল বুলদান’ ‘কোম’ শব্দ দ্রষ্টব্য।

২০. ‘মরুযুয যাহাব’ ৩য় খণ্ড, ২১৭-২১৯ নং পৃষ্ঠা। ‘তারিখে ইয়াকুবী’ ৩য় খণ্ড, ৬৬ নং পৃষ্ঠা।

২১. ‘বিহারুল আনোয়ার’ ১২ নং খণ্ড।

২২. ‘তারিখে ইয়াকুবী’ ৩য় খণ্ড, ৮৪ নং পৃষ্ঠা।