আল হাসানাইন (আ.)

আল কুরআনের সামাজিক শিক্ষা

1 বিভিন্ন মতামত 05.0 / 5

(এক)

ইসলাম সমাজের জন্য কতগুলো মূলনীতি প্রণয়ন করেছে। এই মূলনীতিগুলো প্রশস্ত এবং ব্যাপক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণস্বরূপ :

১. সামাজিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের নিকট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাস এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে সমন্বয় সাধন। দু’টি ভিন্ন প্রকৃতির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও তা স্থায়ী হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাস, উদ্দেশ্য ও কর্মনীতির মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হওয়া। পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য আকীদা-বিশ্বাস তথা মতবাদগত ঐক্য ও সংহতি অপরিহার্য। এজন্যই দেখতে পাচ্ছি পবিত্র কুরআন মানব সমাজকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে- মুমিন এবং কাফের।

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنكُمْ كَافِرٌ‌ وَمِنكُم مُّؤْمِنٌ

 ‘তিনিই (আল্লাহ্) তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় কাফির এবং তোমাদের মধ্যে কেউ হয় মুমিন...।’(সূরা তাগাবুন : ২)

কুরআনে মুমিনদেরকে পরস্পর ভাই বলে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে :

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ

‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই...।’(সূরা হুজুরাত : ১০)

কুরআনে অন্যত্র মুমিনদের প্রতি এই মর্মে নির্দেশ জারি করা হয়েছে যে, তারা যেন মুমিনদের পরিত্যাগ করে কাফের তথা আল্লাহর অবাধ্যদের সাথে গাঢ় বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা না করে।

لَّا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِ‌ينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ

‘বিশ্বাসীরা যেন বিশ্বাসীদের ছেড়ে অবিশ্বাসীদের নিজেদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ না করে...’(সূরা আলে ইমরান : ২৮)

কেননা, আকীদা-বিশ্বাস, মতবাদ এবং জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে মুমিন ও কাফেরের মধ্যে কোনই সামঞ্জস্য নেই। এ অসামঞ্জস্যতার ফলে তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক পাতাতে গেলে তারা মুমিনদেরকে তাদের মূল জীবনাদর্শ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে। ফলে মুমিনের জন্য আসবে বৈষয়িক ও পরকালীন বিপর্যয়।

২. ইসলাম মানব জীবন তথা মানুষের সমাজকে একটি মূল লক্ষ্যের ভিত্তিতে সংগঠিত ও বিন্যস্ত করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার বা খানদানই হচ্ছে সমাজব্যবস্থার প্রাথমিক প্রয়োগক্ষেত্র। আর পরিবারের উৎপত্তি ও সৃষ্টি হচ্ছে নারী-পুরুষের ভারসাম্যপূর্ণ ও বৈধ সম্পর্কের ভিত্তিতে। নারী-পুরুষের এ সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি পরিবারের ভিত্তি রচিত হবার পর পবিত্র কুরআন উভয়ের শারীরিক ও মানসিক উপযোগিতার প্রেক্ষিতে তাদের নিজ নিজ কর্মসীমা ও কর্মক্ষেত্র পৃথক ও নির্দিষ্ট করে দেয়। অর্থাৎ পুরুষের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে পুরুষের উপযোগী কর্ম। আর নারীর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রকৃতিগতভাবে যা তার জন্য উপযোগী ও সহজ। কুরআনের এই কর্মবণ্টন নীতির প্রেক্ষিতে ঘরকন্না, শিশু পালন, পারিবারিক শিক্ষা এবং অন্যান্য সাংসারিক দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে নারী জাতির প্রধানতম কর্তব্য। আর এই সব দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে হলে গৃহ পরিমণ্ডলকেই (Circle) নারী জাতি তার প্রধানতম কর্মক্ষেত্র হিসেবে আঁকড়ে থাকবে। পরিমণ্ডলকে সংকীর্ণ ও অপ্রশস্ত ভেবে বাইরে পা বাড়াতে গেলেই অপরদের অর্থাৎ পুরুষদের সাথে তার সংঘর্ষ বাধতে বাধ্য। সে সংঘর্ষের কারণ হয়তো ভিন্নতর হয়ে থাকে, কিন্তু তাতে যে একদিকে নারী জাতির অমর্যাদা হয় এবং অপরদিকে মানব সভ্যতার প্রাথমিক স্তর পারিবারিক জীবনে বিপর্যয় দেখা দেয় সেটা কিছুতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। কুরআনে এজন্যই নারীদের বলা হয়েছে : ‘তোমরা নিজ নিজ গৃহ-পরিমণ্ডলে অবস্থান কর।’(সূরা আহযাব : ৩৩)

৩. কুরআনের উপস্থাপিত মূলনীতি অনুসারে সমস্ত মানুষই হযরত আদমের সন্তান বা বংশধর। মানুষ হিসাবে তাদের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই- সকলেই সমান। সুতরাং বর্ণ-গোত্র-অঞ্চল-ভাষা প্রভৃতির ভিত্তিতে তাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা অবৈধ ও অন্যায়। এ পার্থক্য শুধু যে পরিচয়ের জন্য- এটা পবিত্র কুরআনেই উল্লিখিত হয়েছে। কুরআনে বর্ণিত উপরিউক্ত মূলনীতি অনুসারে মানুষে মানুষে প্রভেদ ও পার্থক্যের মানদণ্ড হচ্ছে ঈমান ও প্রতিটি কাজে খোদাভীতিপূর্ণ সতর্কতা- যাকে কুরআন ‘তাকওয়া’ বলে উল্লেখ করেছে। তাকওয়া, সৎকর্ম ও স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রভৃতি গুণের ভিত্তিতেই এক মানুষ অন্য মানুষের ওপর মর্যাদার অধিকারী। মানবিক মর্যাদার মাপকাঠি পবিত্র কুরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে :

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ‌ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَ‌فُوا ۚ إِنَّ أَكْرَ‌مَكُمْ عِندَ اللَّـهِ أَتْقَاكُمْ ۚ إِنَّ اللَّـهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ‌

‘হে মানুষ! আমি তোমাদের একটি পুরুষ ও একটি নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি যেন তোমরা পরস্পর পরস্পরের পরিচয় জানতে পার। তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকী তথা আল্লাহর নির্দেশ পালনে সতর্ক ব্যক্তিই তাঁর নিকট সবচেয়ে বেশি সম্মানিত।’(সূরা হুজুরাত : ১৩)

নবী করীম (সা.) এভাবে এর ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন : অনারববাসীর ওপর কোন আরববাসীর বৈশিষ্ট্য নেই বরং আরববাসীর ওপরও অনারবদের কোন বৈশিষ্ট্য নেই। হ্যাঁ, একমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতেই তা হতে পারে। অর্থাৎ বর্ণ-গোত্র-ভাষা-অঞ্চল প্রভৃতির পার্থক্যের অজুহাতে মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য করা চলবে না। মহানবী এটাকে কুসংস্কার এবং বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন।

৪. কুরআনের সামাজিক শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বমানবতার মধ্যে সাম্যবিধান এবং মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। কুরআন মানুষকে সৃষ্টির সেরা তথা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বলে ঘোষণা করেছে।

وَلَقَدْ كَرَّ‌مْنَا بَنِي آدَمَ ..... وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ‌ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا

‘নিশ্চয়ই আমরা বনি আদমকে মর্যাদা দান করেছি... এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’(সূরা বনি ইসরাইল : ৭০)

কুরআনের দৃষ্টিতে এই ব্যাপারে নারী-পুরুষ উভয়ই সমান। অর্থাৎ সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে কোন ব্যবধান সৃষ্টি করা হয়নি। কোন কোন দার্শনিক নারীকে পাপের আকর, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষের তুলনায় হীন, অর্থাৎ নারী হয়ে জন্মানো অতীব দূষণীয় এবং অপরাধ প্রভৃতি বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু কুরআন সেখানে বলেছে : ‘তারা (নারীরা) তোমাদের ভূষণ।’(সূরা বাকারা : ১৮৭)

وَإِذَا بُشِّرَ‌ أَحَدُهُم بِالْأُنثَىٰ ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ ﴿٥٨﴾ يَتَوَارَ‌ىٰ مِنَ الْقَوْمِ مِن سُوءِ مَا بُشِّرَ‌ بِهِ ۚ أَيُمْسِكُهُ عَلَىٰ هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَ‌ابِ ۗ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ

‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখ কালো হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে, না তাকে মাটির নিজে পুঁতে ফেলবে। শুনে রাখ তাদের ফায়সালা খুবই নিকৃষ্ট।’(সূরা নাহল : ৫৮-৫৯)

ইসলাম এই বর্বর ও নিষ্ঠুর প্রথাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সমাজে নারীর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সমাজকে নারীর মূল্যায়ন করতে শিখিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সমগ্র সৃষ্টিই আল্লাহর। এতে কারও অংশীদারিত্ব কর্তৃত্ব নেই। সকলের প্রতিপালনের ভার তাঁরই ওপর ন্যস্ত এবং তিনি সকলকে সমভাবেই ভালবাসেন।

দুই

৫. নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে একটি পরিবার। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবার হচ্ছে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় একটি পূর্ণাঙ্গ ইউনিট বা শাখা। পরিবারের জন্ম তথা উৎপত্তি বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে সামাজিক জীবনের প্রাথমিক বুনিয়াদ বৈবাহিক সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই জন্য ইসলাম সমাজে বিবাহ প্রথাকে সহজতর করে দিয়েছে। কতিপয় নিকটাত্মীয় এবং পৌত্তলিক মহিলা ব্যতীত সকলের সাথে বিবাহ বন্ধনকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অতঃপর পারিবারিক জীবনে যদি কোন প্রকার বিঘ্নের সৃষ্টি হয়, যাতে কোন অবস্থাতে ঐক্যবিধান সম্ভব হয়ে না ওঠে, তাহলে পুরুষের জন্য তালাক এবং স্ত্রীর জন্য ‘খোলা’র অধিকার ইসলামে স্বীকৃত রয়েছে। এ ভাবেই ইসলাম নারী-পুরুষের অধিকারকে সংরক্ষণ করেছে। ইসলাম পবিত্র বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে সামাজিক পবিত্রতা রক্ষার যে সুন্দরতম বিধান দিয়েছে তার ব্যতিক্রমে সামাজিক পবিত্রতা ক্ষুন্ন হওয়া স্বাভাবিক। তাই সে এ পন্থায় নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে উদ্ভূত সমস্যা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছে এবং বিবাহ পদ্ধতিকেও সহজ করে দিয়েছে। এমনকি এক স্ত্রীতে যদি কারও বাস্তব অসুবিধা থাকে সেক্ষেত্রে তাকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণেরও অনুমতি দিয়েছে। তবুও যদি কেউ শরীয়তের নিয়ন্ত্রণসীমা অতিক্রম করে অবৈধ যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হয় তাহলে তার জন্য কঠিনতম শাস্তির ব্যবস্থা ইসলামে রয়েছে। ইসলামী শরীয়ত এরূপ অপরাধীর জন্য কশাঘাত এবং প্রস্তর আঘাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়েছে।

৬. পারিবারিক জীবন এবং নারী-পুরুষের কর্মসীমা ও দায়িত্ব সম্পর্কে ইসলাম বিশেষ কতগুলো পথনির্দেশ প্রদান করেছে। নিম্নে এর সংক্ষিপ্ত দিকগুলো আলোচনা করা হলো :

ক. আল্লাহ্ পুরুষকে পরিবার তথা সংসারের অভিভাবক করে সৃষ্টি করেছে। শুধু তা-ই নয়, অর্থোপার্জন এবং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের গুরুদায়িত্বও অর্পিত হয়েছে পুরুষের ওপর। অপর পক্ষে নারীর ওপর অর্পিত হয়েছে ঘরকন্না, শিশুপালন, শিশুর শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাংসারিক দায়িত্ব। ইসলাম নারীর ওপর পর্দার নির্দেশ জারি করেছে এবং তাকে সংসারের অভ্যন্তরীণ দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ ছাড়া ইসলাম স্বাভাবিক অবস্থায় নারীকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছে, নিষেধ করেছে তার অলংকার ও রূপ সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করতে। হ্যাঁ, বিশেষ প্রয়োজনবশত বাইরে যেতে হলেও পর্দা রক্ষা করে যেতে বলা হয়েছে :

وَقَرْ‌نَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّ‌جْنَ تَبَرُّ‌جَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ

‘নিজ নিজ ঘরে অবস্থান কর। অন্ধকার যুগের নারীরা যেভাবে সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বাইরে ঘোরাফেরা করত তদ্রূপ কর না।’(সূরা আহযাব : ৩৩)

খ. নারী-পুরুষ তথা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ককে অত্যন্ত পবিত্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর এই পারস্পরিক সম্পর্ককে উন্নত ও নিবিড় করার জন্য কুরআন মানব-মানবীকে উদ্বুদ্ধ করেছে। উভয়কে উভয়ের প্রতি আন্তরিকতা এবং সহানুভূতিশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কুরআনের ভাষায় :

هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ

‘...তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরাও তাদের পরিচ্ছদস্বরূপ...।’(সূরা বাকারা : ১৮৭)

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَ‌حْمَةً ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُ‌ونَ

‘আল্লাহর বহুবিধ নিদর্শনের মধ্যে এও একটি নিদর্শন যে, তিনি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য নারী (স্ত্রী) সৃষ্টি করেছেন। উদ্দেশ্য, তোমরা তাদের দ্বারা আনন্দ ও শান্তি লাভ করবে। বস্তুত আল্লাহ্ তোমাদের পরস্পরের মধ্যে প্রেম ও সহানুভূতির উদ্রেক করেছেন।’(সূরা রূম : ২১)

বলাবাহুল্য স্বামী-স্ত্রী উভয় উভয়ের জন্য শান্তির আধার।

গ. নারী-পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্কের উদ্দেশ্য শুধু আনন্দ উপভোগ, যৌন সম্ভোগ এবং আত্মতৃপ্তি লাভ করাই নয়, স্বয়ং একে ইসলামী শরীয়া একটি তামাদ্দুনিক/ সাংস্কৃতিক ও নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলেই গণ্য করেছে। এর মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের বংশধারা সংরক্ষণ। এই উদ্দেশ্য ঠিক তখনই ফলপ্রসূ হতে পারে, যখন নারীসমাজ একমাত্র সন্তান জন্ম দেওয়াকেই যথেষ্ট মনে না করে; বরং সন্তান জন্ম দেওয়ার সাথে সাথে তার শিক্ষা-দীক্ষা এবং প্রতিপালনের সুষ্ঠু দায়িত্বও নারীকে পালন করতে হবে। এ কারণেই কুরআনে নারীকে (মানব বংশ উৎপাদনের) ‘ক্ষেত্র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি বিশেষ প্রক্রিয়া ও কর্মপ্রণালীর মাধ্যমে ক্ষেত থেকে যেমন ফসল উৎপন্ন হয়, তেমনিভাবে নারী জাতির ক্রোড় থেকেও আদম সন্তানকে উপযুক্তভাবে তৈরি হয়ে সমাজে পদার্পণ করা উচিত।

ঘ. ইসলাম একাধিক বিয়ের অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের ওপর নির্ভরশীল। একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের মধ্যে যাবতীয় দিক দিয়ে সমভাবে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসলাম পুরুষদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে বিশেষ কারও প্রতি ঝুকে পড়তে নিষেধ করেছে। আদেশ করা হয়েছেঁ ভারসাম্য রক্ষার জন্য।

وَلَوْ حَرَ‌صْتُمْ فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ فَتَذَرُ‌وهَا كَالْمُعَلَّقَةِ

‘...তবে তোমরা কোন একজনের দিকে সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড় না এবং অপরকে ঝুলানো অবস্থায় রেখ না।...’(সূরা নিসা : ১২৯)

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনকি এটা এক পর্যায়ে বিবাহ-বিচ্ছেদেরও কারণ হয়ে যেতে পারে। যদি এই রূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তবে তা ভব্যজনোচিত এবং পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই হতে হবে। এমনকি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে যা ইতঃপূর্বে দেওয়া হয়েছিল তা ফিরিয়ে নিতে নিষেধ করা হয়েছে।

‘তোমরা স্ত্রীদের যা কিছু দান করেছ তা ফেরত নিও না।’ বরং আরও অতিরিক্ত দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে :

فَمَتِّعُوهُنَّ وَسَرِّ‌حُوهُنَّ سَرَ‌احًا جَمِيلًا

‘...তাদেরকে আরও কিছু মালসামগ্রী প্রদান করে সুন্দর তথা ভদ্রভাবে বিদায় দাও।’(সূরা আহযাব : ৪৯)

তিন

৭. স্বামী-স্ত্রীর কর্মক্ষেত্র ও কর্মসীমা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের সুষ্ঠু পদ্ধতিসমূহ বর্ণনা করার পর মাতা-পিতা ও ছেলে-মেয়েদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। পিতা-মাতার সাথে ছেলে-মেয়েদের কীরূপ সম্পর্ক এবং ব্যবহার হওয়া উচিত এ ব্যাপারে কুরআনের সুস্পষ্ট এবং ব্যাপক শিক্ষা রয়েছে। বলা হয়েছে যে, তাদের (মাতাপিতাকে) ‘উহ্’ করার মতো কষ্টদায়ক কথাও যেন বল না।(সূরা বনি ইসরাইল : ২৩) অর্থাৎ তোমাদের কথা এবং কাজে এমন কিছু কর না যা তাদের জন্য মনোকষ্টের কারণ হতে পারে। কুরআনের নির্দেশ হচ্ছে :

وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّ‌حْمَةِ وَقُل رَّ‌بِّ ارْ‌حَمْهُمَا كَمَا رَ‌بَّيَانِي صَغِيرً‌ا

‘তাদের সামনে ভালবাসার সাথে নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল : হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’(সূরা বনি ইসরাইল : ২৪)

এ ছাড়া পিতা-মাতা যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষা ও মূলনীতির স্পষ্ট বিরোধী কোন নির্দেশ না দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের আদেশ অমান্য করা যাবে না। অর্থাৎ ইসলামী শিক্ষা ও মূলনীতির স্পষ্ট পরিপন্থী কোন নির্দেশ পিতা-মাতা কর্তৃক ছেলে- মেয়েদের ওপর আরোপিত হলে তা পরিত্যাজ্য। অপর পক্ষে ছেলে-মেয়েদের সৎ ও উপযুক্ত নাগরিকরূপে গড়ে তোলার জন্য পিতা-মাতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইসলাম অন্ধকার যুগের অনুসরণে খাদ্যাভাব এবং দারিদ্র্যের ভয়ে শিশু তথা সন্তান-সন্ততিকে হত্যা করতে নিষেধ করেছে। এরূপ কর্মকে অমার্জনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পিতা-মাতার অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে তাদের ছেলেমেয়েদের ভাল কাজের নির্দেশ দেওয়া এবং অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বিরত রাখা।

হযরত ইসমাইল (আ.)-এর আলোচনা প্রসঙ্গে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি (ইসমাইল) তাঁর পরিবারবর্গকে নামায প্রতিষ্ঠা ও যাকাত প্রদান করার নির্দেশ দিতেন। এছাড়া কুরআন মুমিনদেরকে তাদের পরিবারের উদ্দেশ্যে একটি সুন্দরতম দো‘আ শিক্ষা দিয়েছে। দো‘আটি এই :

رَ‌بَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّ‌يَّاتِنَا قُرَّ‌ةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا

‘...হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের স্ত্রীবর্গ ও সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে আমাদের চক্ষুসমূহের উজ্জ্বলতা দান কর এবং আমাদের মুত্তাকী তথা খোদাপরায়ণ লোকদের ইমাম নিযুক্ত কর।’(সূরা ফুরকান : ৭৪)

আলোচ্য আয়াতে ‘মুত্তাকী’ অর্থে তাফসীরকারগণ পরিবারভুক্ত লোকদের বোঝাতে চেয়েছেন।

৮. পরিবার সংগঠনের পর ইসলাম আত্মীয়বর্গের সাথে সৌহার্দ্র্য প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে কোন তারতম্য করা হয়নি; বরং সকলই এর মধ্যে শামিল রয়েছে। ইসলামের উপস্থাপিত এই মূলনীতি ও নির্দেশ অনুযায়ী রক্ত অথবা আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে একটি দৃঢ়বন্ধন এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ে। একই পরিবারভুক্ত লোকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অগ্রগতির জন্য পরস্পরকে সহানুভূতিশীল এবং দয়াদ্রচিত্ত হওয়ার তাকিদ দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে নিকট আত্মীয়ের হক অধিক। তাই নিকটাত্মীয়ের সাথে সমধিক সৌহার্দ্র্য রক্ষা করার জন্য কুরআনে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْ‌بَىٰ

‘...পিতা-মাতা এবং নিকট আত্মীয়দের সাথে ইহসান কর...।’(সূরা নিসা : ৩৬)

৯. পরিবার এবং নিকটাত্মীয়দের পারস্পরিক সম্পর্কের পর আমাদের সামনে উপস্থিত হয় উপরিউক্ত পরিবারগুলোর সাথে নিকট প্রতিবেশী, দূরতম প্রতিবেশী এবং পরিচিত লোকদের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা। কুরআন নিকট প্রতিবেশীর এবং দূরতম প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহারের তাকিদ দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এমনকি পরিচিত এবং আগন্তুক তথা মুসাফিরদের সাথেও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ কুরআনে রয়েছে।

وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ‌ ذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْجَارِ‌ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ

 ‘এবং পিতামাতা,.ইয়াতিম, মিসকিন, নিকট প্রতিবেশী, দূরতম প্রতিবেশী, একত্রে বসবাসকারী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসদাসীদের প্রতি ইহসান তথা উত্তম ব্যবহার কর...।’(সূরা নিসা : ৩৬)

ইসলামী সমাজের প্রতি পাড়ায় পাড়ায় নির্মিত হয় মসজিদ। এই মসজিদই হচ্ছে একই পাড়াভুক্ত লোকদের পবিত্রতম মিলনকেন্দ্র। এখানে উপস্থিতির মাধ্যমেই একে অন্যকে জানবার সুযোগ পায়, পায় দুঃখে সুখে সমভাগী হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ।

১০. সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কী হবে এই সম্পর্কেও ইসলামে নির্দিষ্ট ভূমিকা ও বিধান রয়েছে। সমগ্র মুসলমান একে অন্যের ভাই। অতএব, একে অন্যের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং পারস্পরিক সাক্ষাতের সময় সালাম বিনিময়ের নির্দেশ রয়েছে। মানবীয় সমাজের কোন মানুষ যাতে দারিদ্র্যক্লিষ্ট হয়ে কষ্ট না পায় সে জন্য যাকাতের মতো উত্তম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :

إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَ‌اءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّ‌قَابِ وَالْغَارِ‌مِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّـهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِ‌يضَةً مِّنَ اللَّـهِ ۗ وَاللَّـهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

‘সাদাকাসমূহ (যাকাতসমূহ) কেবল অভাবগ্রস্ত (ফকির), মিসকিন (নিঃস্ব), এ সংক্রান্ত (যাকাত আদায়কারী) কর্মচারী এবং যাদের হৃদয়ে প্রীতি সঞ্চার করতে হয় এবং দাসদের মুক্তি ও ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধের জন্য, আল্লাহর পথে এবং অসহায় মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত ফরয এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’(সূরা তাওবা : ৬০)

যাকাতের এই আটটি খাতের যথাযথ বাস্তবায়ন হলে কোন সমাজই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হতে পারে না। এটা কুরআন পাকের একটি বিরাট সামাজিক শিক্ষা।

চার

১১. একটি জনকল্যাণকর সমাজ প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মৌল উদ্দেশ্য। সুতরাং ধনতন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী (সমাজতন্ত্রী) সমাজের মতো ইসলাম কখনও অচল, অক্ষম এবং দরিদ্র ও নিঃস্ব লোকদের উপেক্ষা করতে পারে না। এ সব লোকের জন্য ইসলাম বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।

فَذَٰلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ ﴿٢﴾ وَلَا يَحُضُّ عَلَىٰ طَعَامِ الْمِسْكِينِ

‘যে সব লোক ইয়াতিম-অনাথদের ভর্ৎসনা ও হুমকি প্রদান করে এবং অসহায় লোকদের প্রতি খাদ্য সরবরাহ করতে উৎসাহিত করে না।’(সূরা মাউন : ২-৩)

তারা মূলত পরকালকে ভয় করে না। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে :

وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُ‌ومِ

‘তাদের ধন-সম্পদে অভাবী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’(সূরা যারিয়াত : ১৯)

অভাবী ও অক্ষম লোকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করার উদ্দেশ্যেই ইসলাম যাকাত এবং সাদাকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে।

إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَ‌اءِ وَالْمَسَاكِينِ

‘সাদাকাসমূহ (যাকাতসমূহ) কেবল অভাবগ্রস্ত (ফকির), মিসকিনদের (নিঃস্ব) জন্য...’ (সূরা তাওবা : ৬০)

১২. মোটকথা, বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, বর্ণ গোত্র-ভাষা এবং আঞ্চলিক মনোবৃত্তি তথা সংকীর্ণতার পরিবর্তে ঈমানের দৃঢ়তা ও চারিত্রিক উৎকর্ষ, পারিবারিক সংবিধান তথা ঐক্য ও সংহতি, পারস্পরিক সম্পর্কের অগ্রগতি, নারী-পুরুষের স্বতন্ত্র কর্মক্ষেত্র এবং মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব প্রভৃতির ওপরই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মৌল ভিত্তিসমূহ প্রোথিত। একজন সত্যিকার মুসলিম যেমনি করে নিজের পরিবার এবং পাড়া- প্রতিবেশীর জন্য সহানুভূতিশীল হয়ে থাকে তেমনি সহানুভূতিশীল হয়ে থাকে সে বিশ্বমানবতার জন্য। সমাজ-সংহতির মৌল ভিত্তিই হচ্ছে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্র্য। যে সমাজের প্রতিবেশীরা পারস্পরিক শত্রুতায় লিপ্ত সে সমাজকে ইসলামী সমাজ বলে গণ্য করা যায় না।

১৩. এই হচ্ছে কুরআনে উপস্থাপিত সমাজ ব্যবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত কাঠামো। মুসলিম সমাজ জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে এর কিরণমালা আজও পরিদৃষ্ট হচ্ছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী গত হয়ে গেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে মুসলমানদের সামষ্টিক ও রাজনৈতিক প্রবাহ। এমনকি কতিপয় মুসলিম সমাজ তো শতাব্দীর পর শতাব্দী অমুসলিমদের অধীনে অতিবাহিত করেছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এর অস্তিত্ব বিলোপ করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ হচ্ছে এই যে, কুরআন ইসলামী সমাজের জন্য কতকগুলো মজবুত এবং দৃঢ় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে। এর বদৌলতেই অত্যন্ত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত ইসলামী সমাজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নিম্নে এর সংক্ষিপ্ত দিকগুলো আলোচনা করা হলো :

ক. ইসলাম কুরআন ও সুন্নাহর আকৃতিতে ইসলামী জীবনাদর্শের ধারণাকে সঞ্জীবিত রেখেছে। মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস জিইয়ে রাখা এবং তাদের সৎ ও যোগ্য নাগরিকরূপে গড়ে তোলার নিমিত্ত রাসূলের সুন্নাহ চিরদিন অনুপ্রেরণা যুগিয়ে আসছে। মোদ্দাকথা, রাসূলের সুন্নাহ চিরদিন মুসলমানদের জন্য সঞ্জীবনী শক্তি ও পাথেয় হিসাবে কাজ করে আসছে। এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আহ্বানে সাড়া দাও যখন সে (রাসূল) তোমাদের এমন বিষয়ের প্রতি আহ্বান করে যা তোমাদের জীবিত করে।’(সূরা আনফাল : ২৪)

সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই ইসলামী সমাজ জীবন লাভ করে থাকে। আর ইসলামের ইতিহাসে এর নজির দুর্লভ নয়। খাঁটি ও অকৃত্রিম মুসলমান স্মরণাতীতকাল থেকে এর পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে- সদাচার, মহানুভবতা, আতিথেয়তা, বড়কে সম্মান ও গুরুজনকে ভক্তি করা এবং ছোটদের স্নেহ করার মতো সদাচারগুলো মুসলমানরাই চিরদিন লালন করে এসেছে।

খ. ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের অন্যতম উপায় হচ্ছে শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-গবেষণার ব্যাপক প্রসার। কুরআনের প্রথম বাণীই হলো ‘পাঠ কর’(সূরা আলাক : ১), জ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে ইসলাম কী ভূমিকা পোষণ করে এ দ্বারাই তা প্রমাণিত হয়। মহানবী (সা.) জ্ঞান সাধনা ও শিক্ষা অর্জনকে অবশ্য কর্তব্য বলে উল্লেখ করেছেন। এই ব্যাপারে নারী-পুরুষের মধ্যে কোন তারতম্য করা হয়নি।

গ. মুসলমানদের একে অন্যকে সৎ কাজে উদ্বুদ্ধ এবং অন্যায় ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য কুরআন নির্দেশ দিয়েছে। সাধ্যানুসারে প্রতি মুসলমানের ওপরই এটা অবশ্য কর্তব্য। ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় খাঁটি ও অকৃত্রিম মুসলমানগণ চিরদিনই এ কাজ সম্পাদন করে আসছে। অন্যায় ও গর্হিত কর্মকে সমাজদেহ থেকে উচ্ছেদ ও নির্মূল করার জন্য তারা স্বীকার করেছে বহু ত্যাগ ও তিতীক্ষা, এর সাথে সাথে তারা সৎ কর্মের প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণে নিজেদেরকে বিলক্ষণ নিয়োজিত রেখেছে। এই প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম মুসলিম সমাজে আজও অব্যাহত রয়েছে।

ঘ. ইসলামী শরীয়া সমাজ জীবনের মৌল ভিত্তি হিসাবে পরিবারকে অত্যন্ত মজবুত সংগঠনরূপে গড়ে তোলার প্রত্যাশী। এর ফলেই সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম সমাজের পরিবার সংগঠনগুলো সমাজের শক্তিশালী ইউনিট হিসেবে টিকে রয়েছে। ইউরোপ বা অন্যান্য সমাজের মতো তা শিথিল ও বিচ্ছিন্ন-বিধ্বস্ত হয়ে যায়নি। আর এ কারণেই ইসলামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবন প্রবাহ অনেকাংশে শিথিল ও স্তব্ধ হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত মুসলিম সমাজের পরতে পরতে ইসলামের সামাজিক মূল্যবোধ ও প্রাণস্পদন মৃদু মৃদু হলেও তা স্পন্দিত হচ্ছে।

আল কুরআনের সামাজিক শিক্ষার মধ্যে ইয়াতিম, মিসকিন, অসহায়-দারিদ্র্যের বিষয়টি সমধিক গুরুত্ব বহন করে। আল্লাহ্পাক কুরআনের বিভিন্ন সূরায় এদের ব্যাপারে সমাজকে সতর্ক করে দিয়েছেন; শুধু তা-ই নয়, সমাজের কাছে তাদের অধিকার কী সেটা বিশ্লেষণ করেছেন; সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া- প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কেও তাকিদ রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে :

وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ‌ عَلَيْهِ رِ‌زْقَهُ فَيَقُولُ رَ‌بِّي أَهَانَنِ ﴿١٦﴾ كَلَّا ۖ بَل لَّا تُكْرِ‌مُونَ الْيَتِيمَ ﴿١٧﴾ وَلَا تَحَاضُّونَ عَلَىٰ طَعَامِ الْمِسْكِينِ ﴿١٨﴾ وَتَأْكُلُونَ التُّرَ‌اثَ أَكْلًا لَّمًّا ﴿١٩﴾ وَتُحِبُّونَ الْمَالَ حُبًّا جَمًّا  

‘এবং যখন তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর রিযিক সংকুচিত করে দেন, তখন বলে : আমার প্রভু আমাকে হেয় করেছেন, এটা অমূলক; বরং তোমরা ইয়াতিমকে সম্মান কর না এবং মিসকিনকে খাদ্য দানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না এবং তোমরা মৃতের ত্যাজ্য সম্পদ সম্পূর্ণরূপে ভক্ষণ কর তথা কুক্ষিগত করে ফেল এবং তোমরা ধন-সম্পদকে প্রাণভরে ভালবাস।’(সূরা ফাজর : ১৬-২০)

এ দ্বারা বোঝা গেল যে, ইয়াতিমের অধিকার আদায় করার সাথে সাথে তাকে সম্মানও করতে হবে। আমাদের সমাজে অনেকে ইয়াতিম মিসকিনকে তুচ্ছজ্ঞান করে, এটা অনুচিত। যেহেতু বিত্তশালীরা তাদের গার্ডিয়ানস্বরূপ, সুতরাং তারা বিবিধ উপায়ে অর্থাৎ দান-দক্ষিণার এবং তাদের যতেœর মাধ্যমে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে- এটাই কাম্য।

وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَ‌ائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّـهَ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ثُمَّ تَوَلَّيْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِّنكُمْ وَأَنتُم مُّعْرِ‌ضُونَ

‘যখন আমি বনি ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া কারও উপাসনা করবে না, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম ও দীন দরিদ্রের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, মানুষের সাথে সদ্ভাবে কথাবার্তা বলবে, নামায প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত প্রদান করবে, তখন সর্বমান্য ক’জন ছাড়া তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে, আর তোমরাই হলে অগ্রাহ্যকারী।’(সূরা বাকারা : ৮৩)

لَّيْسَ الْبِرَّ‌ أَن تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِ‌قِ وَالْمَغْرِ‌بِ وَلَـٰكِنَّ الْبِرَّ‌ مَنْ آمَنَ بِاللَّـهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ‌ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّ‌قَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا ۖ وَالصَّابِرِ‌ينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّ‌اءِ وَحِينَ الْبَأْسِ ۗ أُولَـٰئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا ۖ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ

 ‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিম্বা পশ্চিম দিকে মুখ করবে; বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর এবং সমস্ত নবী- রাসূলের ওপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই ভালবাসায় আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম- মিসকিন, মুসাফির, ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী, তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার।’(সূরা বাকারা : ১৭৭)

يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ ۖ قُلْ مَا أَنفَقْتُم مِّنْ خَيْرٍ‌ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَ‌بِينَ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۗ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ‌ فَإِنَّ اللَّـهَ بِهِ عَلِيمٌ

‘তোমার কাছে তারা জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? বলে দাও : যে বস্তুই তোমরা ব্যয় কর, তা হবে পিতা-মাতার জন্য, অসহায়দের জন্য এবং মুসাফিরের জন্য। আর তোমরা যে কোন সৎ কাজ করবে, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালভাবেই আল্লাহর জানা আছে।’(সূরা বাকারা : ২১৫)

وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُم مِّن شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّـهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّ‌سُولِ وَلِذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ إِن كُنتُمْ آمَنتُم بِاللَّـهِ وَمَا أَنزَلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْ‌قَانِ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ ۗ وَاللَّـهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

‘আর একথাও জেনে রাখ যে, কোন বস্তুসামগ্রীর মধ্য থেকে যা কিছু তোমরা গনিমত হিসাবে পাবে, তার এক-পঞ্চমাংশ হলো আল্লাহর জন্য, রাসূলের জন্য, তাঁর নিকট আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং ইয়াতিম, অসহায় ও মুসাফিরদের জন্য, যদি তোমাদের বিশ্বাস থাকে আল্লাহর ওপর এবং সে বিষয়ের ওপর যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি ফায়সালার দিনে, যে দিন সম্মুখীন হয়ে যাও উভয় সেনা দল। আর আল্লাহ্ সবকিছুর উপরই ক্ষমতাশীল।’(সূরা আনফাল : ৪১)

وَلَا تَقْرَ‌بُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّىٰ يَبْلُغَ أَشُدَّهُ

‘ইয়াতিমদের ধনসম্পদের কাছেও যেও না; কিন্তু উত্তম পন্থায় যে পর্যন্ত সে বয়ঃপ্রাপ্ত না হয়...।’(সূরা আনআম : ১৫২)

وَلَا تَقْرَ‌بُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّىٰ يَبْلُغَ أَشُدَّهُ ۚ وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ ۖ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا

‘আর ইয়াতিমের সম্পদের কাছেও যেও না, একমাত্র তার কল্যাণ আকাঙ্ক্ষা ছাড়া, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যৌবনে পদার্পণ করা পর্যন্ত এবং অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’(সূরা বনি ইসরাইল : ৩৪)

مَّا أَفَاءَ اللَّـهُ عَلَىٰ رَ‌سُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَ‌ىٰ فَلِلَّـهِ وَلِلرَّ‌سُولِ وَلِذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنكُمْ

‘আল্লাহ্ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রাসূলকে যা দিয়েছেন তা আল্লাহর রাসূলের, তাঁর আত্মীয়-স্বজনের, ইয়াতিমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্য, যাতে ধন-সম্পদ যেন তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।’(সূরা হাশর :৭)

وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّ‌قَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا ۖ وَالصَّابِرِ‌ينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّ‌اءِ وَحِينَ الْبَأْسِ ۗ أُولَـٰئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا ۖ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ

‘...সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই ভালবাসায় আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকিন, মুসাফির, ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণকারী, তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার।’(সূরা বাকারা : ১৭৭)

وَآتُوا الْيَتَامَىٰ أَمْوَالَهُمْ ۖ وَلَا تَتَبَدَّلُوا الْخَبِيثَ بِالطَّيِّبِ ۖ وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَهُمْ إِلَىٰ أَمْوَالِكُمْ ۚ إِنَّهُ كَانَ حُوبًا كَبِيرً‌ا

‘ইয়াতিমদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও। খারাপ মালের সাথে ভাল মাল অদল বদল কর না। আর তাদের ধন-সম্পদ নিজেদের ধন সম্পদের সাথে সংমিশ্রিত করে গ্রাস কর না। নিশ্চয়ই এটা বড়ই মন্দ কাজ।’(সূরা আন্ নিসা : ২)

রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘সাবধান! জুলুম কর না। মনে রেখ, কারও পক্ষে অন্যের সম্পদ তার আন্তরিক তুষ্টি ব্যতীত গ্রহণ করা বৈধ হবে না।’(মেশকাত : ২৫৫)

وَابْتَلُوا الْيَتَامَىٰ حَتَّىٰ إِذَا بَلَغُوا النِّكَاحَ فَإِنْ آنَسْتُم مِّنْهُمْ رُ‌شْدًا فَادْفَعُوا إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ ۖ وَلَا تَأْكُلُوهَا إِسْرَ‌افًا وَبِدَارً‌ا أَن يَكْبَرُ‌وا

‘আর ইয়াতিমদের প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখবে, যে পর্যন্ত না তারা বিয়ের বয়সে পৌঁছে। যদি তাদের মধ্যে বুদ্ধি-বিবেচনার উন্মেষ আঁচ করতে পার তবে তাদের সম্পদ তাদের হাতে অর্পণ করতে পার। ইয়াতিমের মাল প্রয়োজনাতিরিক্ত খরচ কর না বা তারা বড় হয়ে যাবে মনে করে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেল না।’(সূরা আন্ নিসা : ৬)

وَاعْبُدُوا اللَّـهَ وَلَا تُشْرِ‌كُوا بِهِ شَيْئًا ۖ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ‌ ذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْجَارِ‌ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۗ إِنَّ اللَّـهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالًا فَخُورً‌ا

‘আর উপাসনা কর আল্লাহর, শরীক কর না তাঁর সাথে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকট আত্মীয় ইয়াতিম-মিসকিন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পছন্দ করেন না দাম্ভিক ও গর্বিত লোককে।’(সূরা আন্ নিসা : ৩৬)

إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَىٰ ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارً‌ا ۖ وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرً‌ا

‘যারা ইয়াতিমদের অর্থসম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং সত্বরই তারা অগ্নিতে প্রবেশ করবে।’(সূরা আন্ নিসা : ১০)

فَلَا اقْتَحَمَ الْعَقَبَةَ ﴿١١﴾ وَمَا أَدْرَ‌اكَ مَا الْعَقَبَةُ ﴿١٢﴾ فَكُّ رَ‌قَبَةٍ ﴿١٣﴾ أَوْ إِطْعَامٌ فِي يَوْمٍ ذِي مَسْغَبَةٍ ﴿١٤﴾ يَتِيمًا ذَا مَقْرَ‌بَةٍ ﴿١٥﴾ أَوْ مِسْكِينًا ذَا مَتْرَ‌بَةٍ

‘অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। তুমি কি জান, সে ঘাঁটি কী? তা হচ্ছে দাসমুক্তি। অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান ইয়াতিম আত্মীয়কে অথবা ধূলি ধূসরিত মিসকিনকে।’(সূরা আল বালাদ : ১১-১৬)

فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ‌ ﴿٩﴾ وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ‌ ﴿١٠﴾ وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَ‌بِّكَ فَحَدِّثْ  

‘সুতরাং তুমি ইয়াতিমের প্রতি কঠোর হবে না। সওয়ালকারীকে ধমক দেবে না এবং তোমার পালনকর্তার নেয়ামতের কথা প্রকাশ কর।’(সূরা আদ দোহা: ৯-১১)

وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرً‌ا ﴿٨﴾ إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّـهِ لَا نُرِ‌يدُ مِنكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورً‌ا

‘তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে। তারা বলে : কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’(সূরা দাহর : ৮-৯)

وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا ۖ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْ‌هًا

‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্ট সহকারে গর্ভে ধারণ করেছে।’ (সূরা আহ্কাফ : ১৫)

أَرَ‌أَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ ﴿١﴾ فَذَٰلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ ﴿٢﴾ وَلَا يَحُضُّ عَلَىٰ طَعَامِ الْمِسْكِينِ

‘আপনি কি দেখেছেন তাকে যে বিচার দিবসকে মিথ্যা বলে? সে হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে ইয়াতিমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং মিসকিনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না।’(সূরা মাউন : ১-৩)

এ পর্যন্ত যে সব সূরা উল্লেখ করলাম, এর প্রত্যেকটি সূরার উদ্ধৃত অংশের শব্দমালার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, শুধু ইয়াতিম অনাথের কথাই নয়, অনেক প্রসঙ্গই আলোচিত হয়েছে। পিতা-মাতা, আত্মীয়-পরিজন, পথিক- মুসাফির, প্রতিবেশী, দাস-দাসী, আল্লাহর এবং মানবীয় অধিকার, মানুষের স্বভাব- চরিত্র, যাঞ্চাকারী ভিক্ষুক, অসহায় বন্দি প্রভৃতি বিষয়ে উল্লিখিত হয়েছে- যা আমাদের সমাজদেহের সাথে সংশ্লিষ্ট। একটি সুস্থ সমাজ ও এর দায়িত্বের জন্য এসব গুণা অপরিহার্য। তাই আল্লাহর সুন্দর সৃষ্টি মানব জাতির মধ্যে এ গুণাবলী প্রবিষ্ট না হলে সে কাঙ্ক্ষিত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না। কুরআনের এই সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার ওপর ভর করেই গঠিত হতে পারে সে সমাজ। এছাড়া কুরআনের সামাজিক শিক্ষার আওতা যে কত বিশাল বিস্তৃত তা এসব আয়াত থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়।

সামাজিকতা এবং সামাজিক শিষ্টাচারের ব্যাপারে আল কুরআন বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। সূরা হুজুরাত অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, একবার বনি তামীম গোত্রের কতিপয় লোক রাসূল (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে তাদের শাসক কে হবেন তা জানতে চেয়েছিল। তখন এ বিষয়ে আলোচনা চলছিল। হযরত আবু বকর কা’কা’ ইবনে হাকিমের নাম এবং হযরত ওমর আকরা’ ইবনে হাব্বাসের নাম প্রস্তাব করেন। এ নিয়ে কিছু কথা কাটাকাটি এবং উচ্চৈঃস্বরে তর্কবিতর্ক হচ্ছিল যা আল্লাহর দৃষ্টিতে পছন্দীয় ছিল না, তাই অবতীর্ণ হয়েছে :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْ‌فَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُ‌وا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ‌ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُ‌ونَ

‘মুমিনগণ। তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের ওপর তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু কর না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উচ্চৈঃস্বরে কথা বল, তার সাথে সেরূপ উচ্চৈঃস্বরে কথা বল না। এতে তোমাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না।’(সূরা হুজুরাত : ২)

এরপর বলা হয়েছে :

إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِن وَرَ‌اءِ الْحُجُرَ‌اتِ أَكْثَرُ‌هُمْ لَا يَعْقِلُونَ

‘যারা প্রাচীরের আড়াল থেকে তোমাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকে, তাদের অধিকাংশই অবুঝ।’(সূরা হুজুরাত : ৪)

আসলে মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ এসব আয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। পৃথিবীর সব মানুষ সমান নয়, আবার স্থান-কালের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের আচার-আচরণের মধ্যে তারতম্য ঘটে; তাই আল্লাহ্ নবীর মাধ্যমে তাঁর উম্মত তথা বিশ্বমানবকে সতর্ক করে দিয়েছেন, অবশ্য কুরতুবীর মতে আলোচ্য আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে ৬টি ঘটনা বর্ণিত আছে। কাজী আবু বকর ইবনে আরাবী বলেন : সব ঘটনাই নির্ভুল। (তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন)

আমাদের সমাজের দিকে তাকালে আমরা এর বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারব। আমরা প্রায়শ দেখি কোন কোন লোক অন্যকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে বেসামাল এবং শিষ্টাচারবর্জিত আচরণ করে থাকে, প্রয়োজন ছাড়াও চিৎকার করে হাঁক ডাক করে থাকে যা নিতান্তই অশোভন। এছাড়া অশোভন ও অশালীন ভাষায় তর্কবিতর্ক করে সামাজিক পরিবেশকে কলুষ করে। অনেক সময় দেখা যায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে- মেয়েদের সম্মুখে এমন সব বিশ্রী ভাষায় প্রতিপক্ষ গালি দেয় যা একান্তই শালীনতার পরিপন্থী।

ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ ۚ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُونَ ﴿٩٦﴾ وَقُل رَّ‌بِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ

‘মন্দের জবাবে তা-ই বল যা উত্তম। তারা যা বলে, আমি সে বিষয়ে সবিশেষে অবগত। বল, হে আমার পালনকর্তা! আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি।’(সূরা মুমিনুন : ৯৬-৯৭)

وَعِبَادُ الرَّ‌حْمَـٰنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْ‌ضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا

‘রাহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে তখন তারা বলে : সালাম।’(সূরা ফুরকান : ৬৩)

আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, কারও সাথে তাঁকে শরীক না করা, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার এবং দম্ভভরে পথ না চলা, আল্লাহর ইবাদাতে নিজেকে নিয়োজিত রাখা প্রভৃতি বিষয়ে হযরত লোকমান তাঁর ছেলেকে যে সব উপদেশ দিয়েছিলেন, পবিত্র কুরআন তা এইভাবে উল্লেখ করেছে। এসব আয়াতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক শিক্ষাও রয়েছে প্রচুর।

শিষ্টাচার শিক্ষা

وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِ‌كْ بِاللَّـهِ ۖ إِنَّ الشِّرْ‌كَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ﴿١٣﴾ وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَىٰ وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ‌ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ‌

‘যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল : হে বৎস! আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়। আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু’বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, অবশেষে আমারই দিকে ফিরে আসতে হবে। আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’(সূরা লোকমান : ১৩-১৪)

এরপর বলা হয়েছে :

يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ‌ بِالْمَعْرُ‌وفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ‌ وَاصْبِرْ‌ عَلَىٰ مَا أَصَابَكَ ۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ‌ ﴿١٧﴾ وَلَا تُصَعِّرْ‌ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْ‌ضِ مَرَ‌حًا ۖ إِنَّ اللَّـهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ‌

‘হে বৎস! নামায কায়েম কর, সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দ কাজে নিষেধ কর এবং বিপদ আপদে ধৈর্য ধর। নিশ্চয়ই এটা সাহসিতার কাজ। অহংকার ভরে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’(সূরা লোকমান : ১৭-১৮)

(প্রত্যাশা, ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা)

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)